
কেদার
শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী
পর্ব-১১
“বর্হাপীড়ং নটবরপুঃ কর্ণয়োঃ কর্ণিকারং/বিভ্রদবাসঃ কনককপিশং বৈজয়ন্তীঞ্চ মালাম।রন্ধ্রান বেণোরধরসুধয়া পূরয়ন গোপবৃন্দৈঃ/বৃন্দারণ্যং স্বপদরমণং প্রাবিশদ গীতকীর্ত্তিঃ।।”(শ্রীমদ্ভাগতম,১০|২১|৫)(অপরূপ দেহ, মাথায় ময়ূরপুচ্ছ, কানে কর্ণিকা ফুল, সোনার বসনে, গলায় বৈজয়ন্তীমালা পরে শ্রীকৃষ্ণ বাঁশি হাতে নিজ লীলাভূমে প্রবেশ করলেন। গোপগণ তার সে লীলার কীর্তি গান করছিলেন।)
দিল্লী থেকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী সুরঙ্গমা চৌহান এসেছেন একাদেমিতে।ন্যুড স্টাডিতে তার সাহসী কাজ সারা পৃথিবীর বুকে আলোড়ন ফেলে দিয়েছে। সেই সুরঙ্গমা চৌহান অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন কৃষ্ণেন্দুর আঁকা ছবিটা। ভরতি শস্যক্ষেত্রের উপর একটি অপরূপা নগ্ন নারী উন্মত্ত পুরুষালী ঘোড়ার উপর বসে ছুটে যাচ্ছে। একটা আটচল্লিশ বাই ষাট ক্যানভাসে আঁকা। এটাই কৃষ্ণেন্দুদের প্রথম প্রদর্শনী। পাশেই কৃষ্ণেন্দু, সহেলী আর তাদের স্যার বসন্ত মাহাত দাঁড়িয়ে ছিল। বেশ খানিকক্ষণ ছবিটি দেখার পর সুরঙ্গমা বললেন,”ভেরি ইমপ্রেসিভ। বাট…”। সুরঙ্গমা শুধুই কৃষ্ণেন্দুদের প্রদর্শনী দেখতে আসেননি। তার আসার আরও একটা কারণ, এই সেমিস্টারে উনিই এক্সটারনাল একজামিনার। এর আগে সহেলীর ছবিতে আঁকা লাজুক পুরুষালী শরীর তার পছন্দ হয়েছে।সুরঙ্গমার অভিব্যক্তিতে বসন্ত স্যারকেও চিন্তিত লাগল।
-কোই প্রবলেম ম্যাডাম?
-অ্যাপারেন্টলি নো। বাট…
এই ‘বাট’ বা কিন্তুচিহ্নটাই কৃষ্ণেন্দুকে ভাবাচ্ছিল। শেষে কৃষ্ণেন্দুকে বললেন,”কাম অ্যাণ্ড মিট মি ইন মাই অফিস।”
সহেলীর দিকে তাকালো কৃষ্ণেন্দু। সেমে ফেল করে গেলে ছয় মাস পিছিয়ে যেতে হবে আবার। ছবিতে টোনাল ট্রিটমেন্ট বা ফিগারের প্রোপোরশান আগেই বসন্তস্যার দেখেছেন। কোনও খুঁত থাকলে তিনি বলতেন। তবে! বসন্তস্যারের দিকে তাকাতে তিনি ইশারা করলেন। ম্যাডামের ঘরে একবার যেতে হবে তাকে।অগত্যা ভয়ে ভয়ে কৃষ্ণেন্দু সুরঙ্গমা চৌহানের চেম্বারের দিকে এগিয়ে গেল।
দরজা নক করতেই ঘরে ঢুকে আসতে বললেন ম্যাডাম। সুরঙ্গমার বয়স সত্তর ছুঁইছুঁই। শোনা যায় তিনি অমৃতা শেরগিল ঘরানার ছাত্রী ছিলেন।তাঁর শিক্ষক শেরগিলের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। অদ্ভুত গম্ভীর অথচ আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব সুরঙ্গমা ম্যাডামের। সহজে কোনও কথা বলতে ভয় হয়। আবার উনি কোনও কথা বললে তার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসাটাও কঠিন হয়ে ওঠে। জড়োসড়ো হয়ে চেয়ারে বসতেই ম্যাডাম বললেন,”ডোন্ট ওয়ারি। ইউ পাসড। আই ট্রায়েড টু টেল, দি পিকচার কুড হ্যাভ বিন বেটার।বৈঠো।”
ঘরে বসিয়ে ম্যাডাম ওয়াশরুম ঘুরে এলেন। তারপর মুখোমুখি বসে বললেন,”কাভি নাঙ্গী ঔরত দেখে হো?”
এর প্রশ্নর কী উত্তর দেবে কৃষ্ণেন্দু! স্টাডিরুমে অতসীদিকে একাধিকবার দেখেছে সে। কিন্তু কখনও তাকে ‘নাঙ্গি ঔরত’ মনে হয়নি। কৃষ্ণেন্দুর সলজ্জ মুখের দিকে তাকিয়ে সুরঙ্গমা চৌহান সহজ হয়ে বললেন।
-আপকি গার্লফ্রেণ্ড হ্যায়?
কৃষ্ণেন্দু ইতস্ততভাবে মাথা নাড়ল।
-কাভি উসকি কারিব গয়ে হো?
কৃষ্ণেন্দু মাথা নীচু করে থাকে। সুরঙ্গমা চৌহান যেমন বিখ্যাত, তেমনই বিতর্কিতও কম নয়। বাঙ্গালোরে একবার নগ্ন রাধারাণী আঁকার জন্য কট্টরপন্থীদের কবলে পড়েছিলেন সুরঙ্গমা। এসবই কানাঘুষো শুনেছে সে। এমনকি ব্যক্তিজীবনেও তিন তিনটে বিয়ে। শেষ স্বামীর মৃত্যু বেশ রহস্যজনক। কেউ কেউ বলে মহিলা নিজেই নাকি শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলেছে বরকে। অবশ্য জ্বলজ্যান্ত শিল্পীর সামনে এসব কিছুই মনে হচ্ছিল না কৃষ্ণেন্দুর। বরং খানিকটা অনিশ্চয়তা ঘিরে ধরেছে তাকে। সেমিস্টারটা না পার হতে পারলে বিপদে পড়বে সে। এই কদিন বাড়ি যেতে পারেনি এতোটুকু। কেমন আছে মা কে জানে! ফোনে কথা হয় রাতে। যে দু একটা ছবি বিক্রি হয় জলের দরে, সে টাকায় বেনিয়াটোলায় একটা মেসবাড়ি পেয়েছে সে।কিন্তু সেই মেসবাড়ির ভাড়ার মেয়াদ বেশিদিন নেই। কৃষ্ণেন্দুর ভ্যবিষ্যত নির্ভর করছে এই মানুষটির উপর।
সুরঙ্গমা টেবিলে রাখি জলের গ্লাসে চূমোক দিয়ে বললেন,”ঘাবড়াও মাত। তুম পাশ হো যাওগে। উও বাত নেহি। লেকিন তুমহারি তুলিও মেইন যো আগ হ্যায়, উও বাহার কারোগে তো কাল তুমহারা পেইন্টিং আসমান ছুঁ লেগা।”
কৃষ্ণেন্দু মাথা নীচু করে শুনছিল। সুরঙ্গমা বলে চলে।”লুসে ইরিগারের নাম শুনেছো?বহুত বড়া ফিলোজফার হ্যায়। উও বোলতা হ্যায়, মর্দ কি শক্তি উসকি পেহনোয়ি মে রহতা হ্যায়। দ্য পাওয়ার অব মেন লাইজ হিডেন ইন হিজ ক্লোদিং। অউর অউরতকা উসকি না পহননে মে। দ্য পাওয়ার অব আ লেডি লাইজ ইন হার ন্যুডিটি। আগার তুমকো ক্যানভাসমে ন্যুড বনানা হ্যায়, তো তুমাকে ন্যুড ফিল কোরতে হোবে।”
কৃষ্ণেন্দু সহেলীর সামনে নগ্ন হলেও সহেলীকে সে কখনও নগ্ন হতে বলেনি তার সামনে। এমনকি ঘনিষ্ঠ মুহূর্তেও কোনও অজ্ঞাত কারণে সেই নগ্নতা ফুটে ওঠেনি। এটাই কি তবে কৃষ্ণেন্দুর আঁকার খামতি!
-কাম টু মাই হোটেল টুডে ইভিনিং। আই উইল টিচ ইউ।
সুরঙ্গমা ম্যাডাম তার হোটেলের নাম, ঠিকানা আর রুম নম্বর লিখে দিল কৃষ্ণেন্দুকে। ঘর থেকে বেরিয়েই যেন শ্বাস ফিরে ফেল কৃষ্ণেন্দু। ঘরের বাইরে সহেলী তখনও তার জন্যই অপেক্ষা করছিল।
-কী রে। কী বলল?
-বলল পাশ করে গেছি। কিন্তু আরও ভালো আঁকতে হবে।
সহেলীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুহূর্তের ভিতর।
-যাক। আমি তো যা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
কলেজ থেকে বেরিয়ে ফুটপাথ থেকে কটকটিভাজা কিনল দুইজনে। এখান থেকে মেট্রো ধরে মহাত্মা গান্ধী রোডে নেমে যাবে কৃষ্ণেন্দু। সহেলী দমদম থেকে ট্রেন ধরবে। ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সহেলীর কানের পাশে দোল খাওয়া চুলের ঢেউটা হঠাৎ স্পর্শ করল কৃষ্ণেন্দু। সহেলী মিষ্টি হেসে বলল।
-কী হলো তোর?
-কিছু না। সুরঙ্গমা ম্যাডাম বলছিল, টু ফিল দ্য ন্যুড।
-ও তাই বুঝি। শয়তান। তবে যাই বলিস। বসন্ত স্যার বলছিল। ছবির বাজারে ম্যাডামের অনেক জানাশোনা। উঁচু লেভেলে তাঁর হাত।
কৃষ্ণেন্দু কিছু বলল না। এসকালেটরে নামতে নামতে সহেলী বলল।
-আজ তো বাড়ি ফিরতে পারিস। পরীক্ষা তো শেষ। কাকিমা একা আছেন।মাকে মিস করছিস না।
সুরঙ্গমা ম্যাডামের হোটেলে যাবার কথা বলতে গিয়েও বলল না কৃষ্ণেন্দু। কেন বলল না! কে জানে! মনে হল, সহেলীকে বলা তার উচিত নয়।
-কাল যাব। আজ একটু রেস্ট নিই বুঝলি!
মহাত্মা গান্ধী রোডে নেমে হাঁটবে কৃষ্ণেন্দু। মেট্রোর কাঁচে সহেলী তাকে হাত নেড়ে টাটা করল। হাঁটতে হাঁটতে সুরঙ্গমা ম্যাডামের কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল তার মাথার ভিতর।’টু ফিল দ্য ন্যুড’।কীভাবে?রাস্তার ফুটপাতে গঙ্গার জলে সাবান মেখে চান করছে মানুষ। পরণে শুধুই সাবানের ফেনা। বিধানসরণীর মোড়ে প্রকাণ্ড সাইনবোর্ডে অর্ধনগ্ন নারীপুরুষ অন্তর্বাসের বিজ্ঞাপন দিয়েছে। রাস্তার উপর একটি টানা রিকশাচালককে প্রকাশ্যে থাপ্পড় মারল পাঞ্জাবি পাজামা পরা নিপাট এক ভদ্রলোক। কৃষ্ণেন্দুর মনে হল, এটাও তো একধরনের ন্যুডিটিই! নয় কী?
বেনিয়াটোলায় মেসে তার ঘরে শেয়ার করে থাকে প্রাঞ্জল।প্রাঞ্জলও তারই বয়সী। কী করে প্রাঞ্জল কৃষ্ণেন্দু স্পষ্ট জানে না। জানতে চায়নিও কখনও। প্রাঞ্জলও তেমন কথা বলে না। নিজের মতো আসে যায়। একবার দায়সারাভাবে নিজের ব্যাপারে বলেছিল। লেকটাউনের কাছে কোন একটা অ্যাপার্টমেন্টে সিকিউরিটির কাজ করে। নিজের ব্যাপারে কিছু না বললেও কৃষ্ণেন্দুর ছবির ব্যাপারে তার গভীর আগ্রহ।মাঝেমাঝেই আঁকার টেকনিকের ব্যাপারে কৃষ্ণেন্দুর কাছে খুঁটিনাটি জানতে চায়। কৃষ্ণেন্দুও সাধ্য মতো জবাব দেয় সেইসবের।আসলে প্রাঞ্জল নিজেও ভালো ছবি আঁকত একসময় । কিন্তু পরিস্থিতি তাকে শিল্পী হতে দেয়নি। বাবা পঙ্গু, মা নেই, তিন বোন অবিবাহিতা। পুরো সংসারটা প্রাঞ্জলের উপরেই নির্ভর করে আছে। ও বেরিয়ে যায় ভোর। কোনও রাতে ফেরে, কোনও রাতে ফেরে না। কৃষ্ণেন্দুর মেসের ঘরে দক্ষিণদিকে একটা গরাদ দেওয়া জানলা আছে। সেই জানলা দিয়ে দোতলার উপর থেকে ব্যস্ত কলকাতা শহর দেখা যায়। দেখা যায় তার উন্মুক্ত নগ্নতা। ফিল করা যায়। এই ঘরের কথা কৃষ্ণেন্দু তার মাকে বলেনি। মা জানলে থাকতে দিত না। বুকের ভিতর কুলকুলিয়ে ওঠে একটা অজানা যন্ত্রণা। মেসে ফিরে মুখে চোখে জল দিয়ে কৃষ্ণেন্দু মন শক্ত করে। কাল সে ঘরে যাবে। আজ একবার সন্ধ্যায় সুরঙ্গমা ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করা দরকার। ম্যাডামের হোটেলটা পার্কস্ট্রিটে ।কোনও মতে মেস ঘরে তৈরি হয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল কৃষ্ণেন্দু। কী মনে হল। ব্যাগে স্কেচপেনসিল, এক গোছা কাগজ আর পেপার কাটার পুরে নিল। বেরোবার সময় লক্ষ্য করল পাশের খাটে প্রাঞ্জলের পেস্ট, সাবান পড়ে আছে। আজ রাতে তার মানে ও ফিরবে না। মেট্রো করে পার্ক স্ট্রিট পৌছোতে পৌছোতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। ম্যাডামের হোটেলটা বড়লোকদের। এতো বড় হোটেলে এই প্রথম ঢুকল কৃষ্ণেন্দু। ঢোকার মুখেই সিকিউরিটি আটকে দিতে ম্যাডামের দেওয়া চিরকুট আর কার্ডটা দেখালো সে। কর্ডলেসে কথা বলে কৃষ্ণেন্দুকে সে ছেড়ে দিল অবশেষে। কাঁচের প্রকাণ্ড সদর দরজার মেটাল ডিটেকটর পার হতেই প্রকাণ্ড হলঘর। তার মধ্যিখানে একটি মার্বেলের নগ্ন নারীমূর্তি। তার অঙ্গ থেকে পরণের ভূষণ খসে পড়ছে। ডান স্তন অনাবৃত, যোনির অংশ মেয়েটি সলজ্জ ঢাকার চেষ্টা করছে বামহাত দিয়ে। য়োরোপীয় মাইকেলেঞ্জলীয় ঢঙে নির্মিত মূর্তিটি যেন জীবন্ত হয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তাঁর দ্বিধা, কুন্ঠা, ইতস্ততভাব, অসহায়তা, লাস্য, কোনও কিছুই যেন গোপন করছে না সে। ‘ফিল দ্য ন্যুড’।মার্বেলটা ছুঁতে গিয়েও হাত সরিয়ে নিল কৃষ্ণেন্দু। স্ট্যাচুর পাদদেশে লেখা আছে,’প্লিজ ডু নট টাচ’।
ম্যাডামের ঘরটা সাত নম্বর তলায়। স্বচ্ছ কাঁচের লিফ্ট দিয়ে উঠতে উঠতে কৃষ্ণেন্দুর মনে হল, এই শহরটাকে সে যেন নতুন করে চিনছে। চারপাশে ঝলমলে আলো। সেই আলোয় গঙ্গার ট্যাপকলে চান করতে থাকা শোভাবাজারের আলুথালু শরীরের চিহ্ন নেই। সব কেমন স্বপ্নর মতো। লিফট সাত নম্বর তলায় পৌছোতেই দরজা খুলে গেল। করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কৃষ্ণেন্দু ঘরের নম্বর মেলাচ্ছিল। সেভেন ওয়ান ওয়ান। দরজার সামনে এসে বেল দিল কৃষ্ণেন্দু। দরজা খুলে দিলেন সুরঙ্গমা চৌহান।
-আও।
বিলাসবহুল স্যুটে ঢুকে যেন হাতপা থরথর করে কাঁপছিল কৃষ্ণেন্দুর। সুরঙ্গমা ম্যাডাম একটা ফিনফিনে গোলাপী গাউন পরে রয়েছেন। গাউনের ভিতর থেকে তাঁর আটোসাঁটো বেঁধে রাখা শরীর বিভাজিকার মতো উঁকি দিচ্ছে। ম্যাডামের একহাতে কাঁচের গেলাসে রক্তিম লাল পানীয়।কৃষ্ণেন্দুকে বসতে বললেন বসার ঘরে। ঘরের এক কোণে ইজেল। কৃষ্ণেন্দু বুজল, ম্যাডাম ছবি আঁকছিলেন। এক নগ্ন পুরুষের শরীরের ছবি। চারকোল দিয়ে আঁকা। পুরুষটি সরাসরি দর্শকের দিকে না তাকিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।অপূর্ব চারকোলের আঁচড়! ছবিটি দেখতে দেখতে হঠাৎ নিজেরই অজান্তে চমকে উঠল কৃষ্ণেন্দু। এই পুরুষের মুখের আদল অবিকল প্রাঞ্জলের মতো! সুরঙ্গমা ম্যাডাম খানিক বাদে এসে কৃষ্ণেন্দুর মুখোমুখি বসল।
-হাম কাল লৌট যাচ্ছি।হাউ ডু ইউ লাইক দ্য পেইন্টিং?
-বিউটিফুল ম্যাডাম।
-টু পেইন্ট ন্যুড। ইউ হ্যাভ টু ফিল ন্যুড। ন্যুড অ্যাণ্ড নেকেড আর নট দ্য সেম। ন্যুড ইজ আর্ট। শিল্প। নেকেড ইজ কমপালশন। মজবুরি।
বলতে বলতে সুরঙ্গমা চৌহান কৃষ্ণেন্দুর সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
-আপকে ইঁয়াহা ন্যুড স্টাডি দূর সে কিয়া যাতা হ্যায়। ইয়ে সহি নেহি হ্যায়। অমৃতা শেরগিল জি কা ‘ন্যুড’ দেখো
১৯৩৩ ওয়ালে। মেরি গুরু অঙ্কিত অরোরাজি উনকা শিষ্য থা। উনোনে বলে থে, ন্যুড পেইন্ট করনে কেলিয়ে তুমকো আপনি সাবজেক্ট কো ফিল করনা হোগা।
কথা বলতে বলতে সুরঙ্গমা চৌহান তার পরণের গাউনের গিঁট খুলে দিলেন। কৃষ্ণেন্দু দেখল এক বিগতযৌবনা যেন তাঁর অসম্ভব প্রাণশক্তিতে তার শরীরের ভিতর জীবনী শক্তিকে ধরে রেখেছেন। বয়স স্তব্ধ হয়ে গেছে তার।
-আও। ফিল মি।
কৃষ্ণেন্দুকে সোফা থেকে তুলে তার দুটি হাত নিজের দুই স্তনের উপর রাখলেন সুরঙ্গমা। কৃষ্ণেন্দুর মনে হল তাঁর হাতের তালুর নিচে দুটি চঞ্চল বুলবুলপাখি তাদের লোম খাঁড়া করে তিরতির করে কাঁপছে।
-লেকিন ম্যাম…
-কুচ বাত মাত করনা। ফিল করো। আজ ম্যায় তুমহারা সাবজেক্ট হুঁ। ম্যাডাম নেহি। আপনি আঁখ বন্দ করকে ফিল করো।
সুরঙ্গমা তার উন্মুক্ত পিঠ পেতে দিলেন কৃষ্ণেন্দুর সামনে। কৃষ্ণেন্দু চোখ বন্ধ করে নেমে এল নিচে। বয়স্কতার জীর্ণতা সুরঙ্গমাকে স্পর্শ করেনি। দীঘল নিতম্ব বেয়ে জঘনের দিকে আসতে আসতে কৃষ্ণেন্দুর মনে হল, সে যেন কোনও ঝরনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
গাউন পরতে পরতে সুরঙ্গমা চৌহান বললেন,”আব ইয়ে ফিল তুমকো ক্যানভাসমে লানা স্যায়।তুমহারি আন্দার উয়ো শক্তি হ্যায়। তুম কর পাওগে। ”
মেসে ফিরতে ফিরতে কৃষ্ণেন্দুর যেন ঘোর লেগে গেল। ভিতর ভিতর অপরাধবোধ হচ্ছে তার। সুরঙ্গমা ম্যাডাম অবশ্য বলেছেন। প্রতিমাশিল্পী যখন মাতৃমূর্তির স্তনে তাঁর হাত রাখেন, তখন সে শিল্পী, পুরুষ নন। শিল্পী আর প্রেমিকের এই সূক্ষ্ণ সুতোর তফাত আয়ত্ত করতেই এই সাধনা। মেসে ফিরে কেন জানি হাত ধুতে পারল না কৃষ্ণেন্দু। তার হাতের যে অনুভূতি, সেখানে এক জ্বলজ্যান্ত নারী শরীর লেগে রয়েছে। সহেলী ফোন করেছিল। কৃষ্ণেন্দু ধরল না। মাকেও ফোন করল না রাতে। প্রাঞ্জল সত্যিই ফেরেনি রাতে। সুতরাং ঘরে সে আজ রাতে একা।কৃষ্ণেন্দু তার পরণের আভূষণ খুলে ফেলল। তারপর নগ্ন হয়ে আঁকতে লাগল।আঁকতে আঁকতে ঘুমিয়ে পড়ল এক সময়ে। ঘুমের ভিতর সে এক আশ্চর্য স্বপ্ন দেখল। এক নগ্ন নারীশরীর। তার শরীরের সমস্ত রোমকূপ থেকে এক অতিলৌকিক জ্যোতি বেরিয়ে আসছে। সেই জ্যোতির ঔজ্জল্যে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। কৃষ্ণেন্দু বারবার সেই আলোর সমুদ্রে ডুব দিয়ে উঠে আসছে। ফের ডুব দিচ্ছে। তার শরীরের ভিতর থেকে যেন শক্তির প্রবাহ মিশে যাচ্ছে ওই আলোর উৎসে।সে আলোর জ্যোতি কখনও দেবী ইউরোপার, কখনও বা জিনার, কখনও সে ইভ, আবার পরক্ষণেই ভেনাস। কৃষ্ণেন্দু দেখল তাকে জরিয়ে ধরছে সেই নগ্নিকা। এই মুহূর্তে সে লোভী কামুক পুরুষ, পরমুহূর্তে সে সর্বত্যাগী নিস্পূহ সন্ন্যাসী সাধক শিল্পী। ধীরে ধীরে আলো ফিকে হয়ে আসতে কৃষ্ণেন্দু শান্ত হয়ে এল। মুখের উপর সেই আলোকগোলক সরে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। ক্রমশ ফুটে উঠছে একটি চেনা মুখ। কৃষ্ণেন্দু বিস্ফোট চোখে আবিষ্কার করে। সে মুখ সহেলীর নয়। সে মুখ তার অননুমেয়।”এ কী অতসীদি। তুমি!” ভাবতে ভাবতে ঘুম ভেঙে গেল তার। নিঝুম রাত। তবু কৃষ্ণেন্দু স্নানঘরের দিকে ছুটল। এই পাপটুকু রাতের অন্ধকারেই ধুয়ে ফেলতে হবে। ফেলতেই হবে। এ কী স্বপ্ন দেখল কৃষ্ণেন্দু!ভাবতে ভাবতে সে স্নানঘরে মগ নিয়ে বালতি থেকে উন্মাদের মতো নিজের বিষধগ্ধ শরীরে জল ঢালতে শুরু করে দিল।