
ধারাবাহিক উপন্যাস
কেদার
নবম পর্ব
শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী
প্রথম থেকে সপ্তম পর্ব– কেদার (১-৭)
অষ্টম পর্ব– কেদার- অষ্টম পর্ব
“নয়ানের কাজর বয়ানে লেগেছে কালর উপরে কাল।প্রভাতে উঠিয়া ও মুখ দেখিনু দিন যাবে আজু ভাল ।।অধরের তাম্বুল বয়ানে লেগেছে ঘুমে ঢুলু ঢুলু আঁখি।আমা পানে চাও ফিরিয়া দাঁড়াও নয়ন ভরিয়া দেখি।।”
(শ্রীকৃষ্ণপদাবলীকীর্তন। রাগ রামকেলী।)
এক প্রান্তিক বিন্দুর কাছে দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণেন্দু আর সহেলী। এই প্রান্তিকতার কাছে পুরুষালি চোখ, মেয়েলি হাসি, সবকিছুই যেন অপ্রাসঙ্গিক। সেখানে শুধুই যেন গভীর দৃষ্টি। বিষণ্ণতায় অবগাহন। পরক্ষণেই তার থেকে উত্তরণ। আবার অবগাহন। ঘরের একদিকে উন্মুক্ত কাঁচ। সেখানে তাকালে ধূ ধূ করছে কাঁচ আর নির্মীয়মান প্রকাণ্ড সড়ক। সড়ক দিয়ে যানবাহন ছুটে চলেছে ব্যস্ত সময়ের মতো। অথচ ঘরের এই কোণে সময় যেন থেমে রয়েছে। মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে প্রহর গুনছে। ঘরের ভিতর ইজেল, ক্যানভাস আর রঙ তুলি বিছানো। এই হোটেলের মালিক সহেলীর পরিচিত। কীভাবে পরিচিত কৃষ্ণেন্দু জানে না। তবে এই দুদিনের জন্য ঘর অ্যারেঞ্জ করেছে সহেলীই। ছোট্ট টু বেডরুম ঘর। পাশেই কল্যাণী এক্সপ্রেস হাইওয়ের তৈরী হতে থাকা সিক্স লেন রাস্তা। সেই কাঁচের সামনে দাঁড়ালে কখনও কৃষ্ণেন্দুর গোকুলঘরিয়ার জন্য মন কেমন করে ওঠে। কী করছে মা এখন। কে জানে? ফোনও তো করে না তেমন। উদাসীনতার সেই মুহূর্তে শহরের এই প্রান্তিক বিন্দুকে কৃষ্ণেন্দুর ঝরা পাতা ভরা গন্ধেশ্বরীর বালুচর মনে হয়। সহেলী কবিতা পড়ে মাঝেমাঝে। সকালে কফি তৈরি করে সহেলী কৃষ্ণেন্দুকে আবার বাস্তবে ফিরিয়ে আনে।
-মন খারাপ কেন বল তো তোর? এতো চাপ নিচ্ছিস কেন?
-চাপ নয়। ওই রাস্তাটা দেখলে কেমন ভয় হচ্ছে জানিস!
-কেন? কীসের ভয়?
-মনে হচ্ছে আমার চারপাশের ঘরবাড়ি আমবাগান হরিসভা কুঁড়েবাড়ি, সব একদিন ওইরকম বিরাট চওড়া রাস্তা হয়ে যাবে। থামবার জায়গা থাকবে না। ছুটতে হবে শুধু। ছুটতেই হবে।
-বুঝলাম। ‘ও গাছ গাছের পাতা/আকাশে নিশ্চুপ তারা/ মহাকাশ মহাকাল/ প্রাণী যত/ ও জল নদীর জল তোমরা শোনো/ এখানে ছিলাম আমি/ আমার মাথাটা ছিল প্রজাপতি/ হাজার আলোকবর্ষ উড়ে এসে/ শহরের প্রেত আমি শহরে জন্মিয়ে-/ শহরেই পচে মরে গেছি।’
-বাহ। কী সুন্দর বললি।
-আমি নয়। কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা।
-কী সুন্দর।
সহেলীকে আরও কাছ থেকে দেখে কৃষ্ণেন্দু। ওর দুচোখে যেন গোকুলিয়ার সমস্ত আটকে পড়া জল পদ্মপাতার উপর জলকণার মতো আটকে রয়েছে। এতো কাছ থেকে কৃষ্ণেন্দু নগ্নিকা গডিভা আঁকবার সময় সহেলীকে দেখেনি। নগ্ন কে নয়। আকাশের নগ্ন দাবদাহ। নগ্ন গাছের পাতা, প্রকৃতির ভিতরেই তো মানুষ। নারী আর পুরুষ। তারা যখন নগ্ন হয়, শিল্প নড়ে ওঠে। নড়ে ওঠে বিপণন। বসন্ত স্যার কেনেথ ক্লার্কের কথা বলতেন ক্লাসে। নগ্ন প্রাকৃতিক হলে সে ‘নেকেড’। আর সে নগ্নতা শিল্পীর হলে তা ‘ন্যুড’। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিমান অস্ত্র ওই নগ্নতাই। সেই নগ্নতা আবরণহীনতা নয়। আবরণহীনতায় একধরণের অসহায়তা লুকিয়ে থাকে। এই নগ্নতা মুক্তির। শক্তির। যে শক্তিকে আধার করে লেডি গোডিভা নেমে আসেন মার্সিয়ার রাস্তায়। অথবা অতসীদি প্রতিবাদ করেন জনারণ্য রাজপথে তার অধিকারের জন্য।
প্রোজেক্ট জমা দেবার শেষ তারিখ আর মাত্র চার দিন পর। পেশিবহুল ঘোড়ার উপর উড্ডীন গোকুলঘরিয়ার রমণী লেডি গডিভাসম অবয়ব কৃষ্ণেন্দুর তুলিতে ধারণ করলেও সহেলী এখনও তার প্রোজেক্টে হাত দেয়নি। এই ঘর বুক করার সময় তারা দুজনে দুজনের কাছে শপথ করেছে। কেউ কারোকে ছোঁবে না। শুধুই নগ্নতা আর শিল্প। কোনও যৌনতা নয়। তাই দুজনের ভিতরেই যেন এক অদৃশ্য শিকল আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে ভিতর থেকে। সহেলী ক্যানভাস তৈরি করে দরজার বাইরে ‘ডু নট ডিস্টার্ব’ বোর্ড ঝুলিয়ে দিল।
-নে। চল শুরু করি।
কীভাবে শুরু করবে কৃষ্ণেন্দু। এতক্ষণ যে কাজ অত্যন্ত সহজ মনে হয়েছিল, সেই কাজই এখন কঠিনতম মনে হচ্ছে তার। শিল্পী এই দোলাচলকে কী বলতেন? হয়তো বলতেন সূর্যের মতো লাল হবার চেষ্টা করো। অথবা মা বৌদির কপিলের সিঁদুরের রঙের মতো লাল। কিন্তু তেমন লাল কীভাবে তৈরি করবে কৃষ্ণেন্দু। সিঁদুরে যে জল ধরে না। কৃষ্ণেন্দুর দোলাচল বুঝতে পারল সহেলী। তার ভিতরেও যেন কেমন দামামা বেজে চলেছে অবিরাম। বাবাকে না জানিয়ে এভাবে চলে এসেছে সে। কলেজের প্রোজেক্ট। কিন্তু বাবা যদি খোঁজ নেয়?এদিকে এই ক্যানভাস আর তার ভিতরের ক্ষরস্রোতা নদী! ওরা যে কৃষ্ণেন্দুকে চায়। কৃষ্ণেন্ধুর শরীর। তার ছোট্ট গোকুলঘেরিয়া গ্রাম। নগ্ন করেই পেতে চায়। এসব ভাবলেই তার মনের ভিতরটা উথালপাতাল করে ওঠে। তবু নিজেকে সংযত করে সে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে বলল।
-শোন। তুই আশপাশ ভুলে যা। নে। আমি পরদা টেনে দিলাম। মনে কর তুই গোকুলঘরিয়া গ্রামের বাড়িতে রয়েছিস। কল পাম্প করে জলে চান করছিস। মনে কর রামকিঙ্করের চোখে দেখা ওই গ্রাম্য রমণী তুই। অথব তৈলচিত্রে দেখা বীর পেট্রোক্লাস। ভুলে যা তুই সবকিছু কৃষ্ণেন্দু। এই ঘরে আমি নেই। ক্যানভাস নেই। এক্সপ্রেসওয়ে নেই। আছে শুধু তোর গোকুলঘরিয়া আর গোকুলিয়া নদী। কী?
কৃষ্ণেন্দু মাথা নাড়ে। সহেলী কবিতা পড়ে। তার কাছে তাই পৃথিবী কবিতার মতো। কিন্তু কৃষ্ণেন্দু? সে যে নুড়ি পাথরের গদ্যে তৈরি মানুষ! তবু সে বিচলিত হয় না। এক এক করে তার দেহ থেকে খুলে ফেলে আবরণ। চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে। পুকুরপারে দাঁড়িয়ে আছে সে। আধোআধো সেইসব ছবি। পিঠে হাতে মুখে মাথার চুলে ঘিষঘিষ করে সাবান মাখিয়ে দিচ্ছে মা। আশপাশের বৌগুলো জলে নামছে। কলসী ভরে উঠে আসছে পারে। কেউ যেন তাকাচ্ছে না তার দিকে। তার কোনও বাঁধন নেই যেন। মা জল ঢেলে দিচ্ছে। আর সে মুক্ত হচ্ছে ধীরে ধীরে।
ক্যানভাসে তুলির আঁচড় দিতে গিয়ে থমকে গেল সহেলী। কীভাবে আঁকবে সে কৃষ্ণেন্দুকে। টেক্সট বইতে পড়া আলব্রেখট ডিউরারের উডকাট ভেসে এল তার চোখের সামনে। খাটের ওপর শুয়ে থাকা আলুথুলু নগ্নিকাকে আঁকছেন এক পুরুষ। টেবিলের উপর তার কাঠচেরাইয়ের ছুড়ি উত্থিত শিশ্নের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু তেমন আঁচড় কীভাবে দেবে সহেলী। কৃষ্ণেন্দুর কাঁধের মাংসপেশি, দুই পায়ের মাংসপেশি, তার সলজ্জ মুখ ঢাকার ভঙ্গিমা। বসন্তস্যার বলেন, ক্যানভাস মানুষের শরীরের নগ্নতাকে পবিত্র করে দেয়।তুলির টানে যেন একধরনের পূর্ণতা লাভ করে নগ্নতা। তবে কি কৃষ্ণেন্দুর দেহের অসম্পূর্ণতাকে সম্পূর্ণ করে দেবে সহেলী? কিন্তু সেই কঠিন কঠোর পুরুষালি আঁচড় তার তুলিতে আসবে কীকরে। ডিউরারের মতো সে তো পুরুষ নয়। নারী। কোমনীয়তা তার ভিতরে অন্তঃসলীলা। রেনেসাঁর শিল্পীরা পুরুষ মডেল বসিয়ে তাদের বক্ষ পিনোদ্যত করে ও তলদেশে গভীর খাদ তৈরী করে নারীমূর্তি সৃষ্টি করতেন। এ যেন এক পূর্ণ পৌরুষ থেকে অপূর্ণ নারীত্ব নির্মাণ করা। কিন্তু সহেলী ঠিক করল, সে সেই বীতংসে ধরা দেবে না। সে কৃষ্ণেন্দুকে কোমনীয়তায় ভরিয়ে তুলল। তার পিঠ দিয়ে নিতম্ব দিয়ে গড়িয়ে পড়া ঘামের বিন্দুগুলো সহেলীর ক্যানভাসে এক একটি মুহূর্ত হয়ে গেল।
-আর একটু ঝুঁকবি প্লিজ?
কৃষ্ণেন্দু যতোটা সম্ভব তার মুখ ঢেকে ঝুঁকে আসে। তার এই ঝুঁকে যাওয়ায় উরুর উপর নতুন মাংসপেশি জেগে ওঠে। এভাবে কতক্ষণ কাটল কে জানে। যেন একটা পক্ষকাল অতিবাহিত হয়ে গেল ক্যানভাসে।
-দেখি কেমন হয়েছে?
চারকোল ব্যবহার করেনি সহেলী। কৃষ্ণেন্দু নিজের ভিতর আর সেই জরতা অনুভব করছে না এতোটুকু। সে ভুলে গেছে তার শরীরে একটুকরো সুতোও নেই। ঘরের ভিতর এক এবং একমাত্র নিরাভরণ সে। সহেলী তার সবুজ মেখলা সামলে ক্যানভাস মেলে ধরে বলল, ‘দ্যাখ’।
ক্যানভাসে কৃষ্ণেন্দু নেই। আছে এক অপূর্ব বিভা। সূর্যের আলোর মতো, গোকুলিয়া নদীর মতো। তার আশপাশে ঠিক সহেলীর পরণের মেখলার রঙ। যেন উন্মুক্ত ক্যানভাস। সরাসরি অয়েলের প্রথম কোটেই কৃষ্ণেন্দু আবিষ্কার করল, দক্ষতার সঙ্গে সহেলী তার শরীরের সমস্ত অপূর্ণতাকে পূর্ণ করে দিয়েছে। এই ‘ন্যুড’ কলেজে সাড়া ফেলে দেবে।
-অপূর্ব।
-সত্যিই বলছিস? এখনও কিন্তু কোট পড়া বাকি।
-সত্যিই বলছি।
-তাহলে?
-তাহলে কী?
-আমার পারিশ্রমিক?
-বল। কী চাই?
-শর্তভঙ্গ।
হঠাৎ দমকা হাওয়ার মতো তীব্র দাবদাহর ভিতরে হিমেল বাতাস ঘিরে ধরল কৃষ্ণেন্দুকে। সে দেখল তার সমস্ত শরীর যেন শিউরে ঠকঠক করে কাঁপছে। তার চারিদিকে সবুজ ঢেউখেলানো ধানক্ষেত। পুকুরের স্নানের জলের মতো তার নগ্ন শরীর বেয়ে যেন সহেলী গড়িয়ে পড়ছে।
তবু এই কাহিনীর অনুষঙ্গও ছিল। কেউ জানত না। কৃষ্ণেন্দু না। সহেলীও না। হোটেলের পাশের ঘরে এক একাকিনী দেওয়ালে কান পেতে শুনছিল। কথোপকথন কঠিনের ভিতর দিয়ে মুক্ত বাতাসের থেকে অধিক গতিতে চলাচল করে। কৃষ্ণেন্দু আর সহেলীর শ্বাসপ্রশ্বাসে তার মন চঞ্চল হয়ে উঠছিল। হোটেলে চেক-ইন করবার সময় ছেলেটিকে একঝলক দেখেছে সে। খুব যেন চেনা। ওই চোখ দুটো। মালায়শিয়া, থাইল্যাণ্ড, দুবাই, তাকে ছিবড়ে করে ফেলে দিয়েছে এই শহরে। এখন তার শরীরে শুধু অনুতাপ ছাড়া কিছু নেই। আর আছে ভয়ানক এক সংক্রমণ। সেই জীবাণু তার ক্লায়েন্টদের লোলুপ ক্ষিদের মতোই নাছোড়। জীবাণু ধীরে ধীরে যতো তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে, ততো তার মনে পড়ছে অলোকের কথা। মানুষটা ভালোবাসত তাকে। শুধু দোষের মধ্যে এই। মানুষটার কোনও স্বপ্ন ছিল না। স্বপ্ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। আর সেই স্বপ্নের জন্য দৌড় কাউকে কাউকে তার মতো ছিবড়ে করে দেয়। দেওয়ালে কান পেতে মোনালিসা ভাবছিল। কে এই ছেলেটি? ওর চোখে অলোকের গোকুলঘরিয়ার হাতছানি কেন? ছেলেটিকে সে চেনে? চিনত? ক্লায়েন্ট নয়। মোনালিসা নিশ্চিত। তার শরীরে নোঙর করা প্রতিটি ভেসেলকে সে মনে রেখে দিয়েছে। ও অন্য কেউ? কে? কীভাবে জিজ্ঞেস করবে? কাকে জিজ্ঞেস করবে! ভাবতে ভাবতে অনেকগুলো বছর পর মোনালিসার অলোকানন্দার কথা মনে পড়ে। গোকুলঘরিয়ার কথা মনে পড়ে। তাকে পুরোপুরি ছাই হবার আগে একবার অন্তত গোকুলঘরিয়া যেতেই হবে। যে করেই হোক।
ক্রমশ