
স্বরূপ সুপান্থ -র কবিতা
মাতৃডাঙাডোরে
তোমার দিকে তাকিয়ে লিখেছি বৃষ্টির গান,
আত্মবিস্মৃতি ঠেকাবে? এখানে আরব নাই
শাদা পাতা, কী করে আটকাবে ঐ মরুমন
অবিন্যস্ত পাতায় ডুবে গেছে গাছগাছালি
চোখের শিয়রে ঢেলে দিয়ে দোয়ার দরুদ
যত দূর দেখা যায় ঠিক তত দূর ঘোর
পানিপূর্ণ এ-দেশে চোখ কি ময়লা পড়েছে
হে উটব্যাপারি, রঙে কাচ লাগিয়ে দেখছ কি!
ক্যারাভান নয়, নৌকায় পাড়ি দিয়াছি পথ
ধানের উজ্জ্বল হাসি নিবিড় করেছে কাম
মাতৃডাঙাডোরে অদ্ভূত সুন্দর এ-সুন্দর
যত ভালোবাসি তত কাছে আসি, তৃপ্ত প্রাণ
সজল বর্ষায় ভেসে যাবে উষর দর্শন
ইস্রাফিল শিঙা ফুঁকে জানান দেবে এখানে
চির অনঙ্গের দেশে আরব অনেক দূরে
লড়াই
চলো লড়াই করি
পুঁজি কিছুই নেই
বাদাম গাছের তলে একা
পৃথিবীর বোকা পাখিটার সাথে
আমার হইচই প্রেম হয়ে যায়।
আমাদের দুই ঠোঁটের পার্থক্য
কত কিছুই আলাদা করে দেয়,
ব্যক্ত আর অব্যক্তের
কী দারুণ পরিণতি
বাদাম গাছের তলে আমার তারুণ্য
বোকা পাখিটার সাথে বুড়া হয়ে যায়।
আমাদের লড়াইয়ের সাধ
অনন্য নজির হতে পারত,
যদি ভিন্নরকমের ঠোঁটে
অসমাপ্ত চুম্বনের মতো
কিছু কথা ও বাক্য লেখা হতো।
শকুন্তলা
সুখ তার শকুন্তলা,
বিভূঁই ঘুরে এসে না পাওয়ার নাম।
কালিদাসও জানতেন, শুকিয়ে যাওয়া
গাছটির মত—জীবন উষর,
তবু কী দূর্দান্ত নাকানিচুবানি
কী হরেক কামকর্ষণ।
অজাতশ্মশ্রুর শরীরে জন্মেছে পরগাছা,
আমার চোখে ভূগোল নেই ভ্রমণ আছে
কামনিরীক্ষণ নেই শব্দদন্ডায়মান আছে
এর অর্থ তুমি বোঝো বা না-বোঝো
হারমোনিয়াম ভেঙ্গে কি গান
বন্ধ করা যায়, পাগলা!
আমার গোপন
মাছের গন্ধের মত চোখ নিয়ে তাকিয়েছি
আমার গোপন, যত আছে তত লেখা যায়
নজর কেড়েছে, শিশুর হাসির মত মুখ
ঘুমহীন রাত আকাশ যেভাবে ঢেকে ফেলে
আমি জানি, তুমি ছায়ার মত নকলবাজ
রকমফেরে বীজ বপন করে দেখেছি
চিটা ধানের কসম, রক্তাক্ত মাঠে কেঁদেছি
খই বিন্নি মোটা চালে তোমারে ভালোবেসেছি
আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে রোদের গরমে হেঁটে
আসমুদ্রহিমাচল মাতাল নৃত্য দেখেছি
প্রাকৃত
আকাশ দখলের সাধ্য কি আছে
প্রিয়, পরমাত্মিক বিকার
ধ্বজা তুলে ধরো, কিন্তু
কব্জা কি হবে গাছের বাতাস!
থাকোই না হয় হাঁসের খোঁয়াড়ে
মিলনে মিলনে পাতার কী হয়
সম্পদ অসম—এ ভাবনা যে
কী পরিমাণ জ্বালা ধরায় মনে
ভাগ তবুও কখনো সমান হবে না।
আমার প্রকৃতিচারিতা তোমার থেকে
আলাদাই বটে গ্রহণ-বর্জন অনুপাতে
আমরা আলাদা হতে থাকি
মানুষের চিহ্নের আরোহ অবরোহে,
সৃষ্টির শুরু থেকে এ-যুগ বড়ই বিশীর্ণ
আমি কৌম সমাজের লোক
মানতে পারি না—উত্তরাধিকার
কী ভাবে হাঁটু গেড়ে মাথা নিচু
প্রস্তাবনা পেশ করে—দখল, কব্জা
অতঃপর সম্পদশালী হওয়া!
সরকারী চামচ
বোঝাও আমাকে, কান্না কী ভাবে কথা শোনে
বিগত দৃষ্টি ক্ষয়ে যেভাবে জন্ম নেয় নতুন চোখ
অত্যন্ত রাত ডুবে গেছে এখন কালের গহ্বরে
ডিকশন ভুলে যে পাখি ছেড়ে গেছে গাছের কান্ড
সম্পন্ন চাউলের খামারি কিন্তু সে ভুল করে না
এ-কারণে মশাল সৃষ্টির পর যত হাত ঘুরেছে মিছিল
মানুষের মিলনের অপূর্ব সে দ্যোতনা আজ এত
অনুপস্থিত!
নিজের মুখের দিকে তাকিয়েও মানুষ আজ
বিশ্বাস করতে পারে না—তার নিজমুখ আছে,
কেননা সরকারী চামচে তেলের বদলে এত ঘি ঝরছে
হিসাবের বাকির খাতায় পড়ে রইলো কিছু
শুকনা পাতা
গায়েবি বাতাস
আমার চুপচাপ আকাশ থেকে ঝরে পড়ে
বিপ্রতীপ ভাবনা, কিচ্ছু বলি না, হাসি।
এ-হাসির ভেতর ডুবে আছে হাজার বছর
দেখি পর্দা তুলে—পায়ের নিচে হেঁটে গেছে
কত পা
গায়েবি বাতাস নিয়া বেশ ভাবে আছো,
তা অন্ধ ক্রমাবনতির দিকে এত দূর
ঠেলে দিয়াছে যে ফেরত আসা সহজ নয়।
আত্মা মোচনের দিগন্তের উন্মোচন হলে শুধু
পৃথিবীর ষড়যন্ত্রীরা তোমার পেছনে হুদাই
লেগে থাকবে না
কালিদাস
কুমারসম্ভবে কালিদাসের সাথে দেখা হলে
জেনে নেয়া যেত— বৃষ্টির ভাষ্য কী ভাবে বদলে
দিয়েছিল মেঘদূত!
নকল-জীবনে রঘুবংশের কাউকে খুঁজে পাই নাই
ওরকম সুস্পষ্ট আত্মার খোঁজ হয়ত পাওয়াই ভার—
যেখানে মানুষ মানুষের মত মানুষ হয়েই বেঁচে থাকে।
ওদিকে মেঘেরও কৃতিত্ব বটে—ধরে রাখে জল
আর উপুড় হয়ে করে বর্ষণ
জল হলেই যে যাপনের জিদ জেগে ওঠে
নিম্নাঞ্চলে, আমাদের ইতিহাসে!
কুমারসম্ভবে রঘুবংশের কারো সাথে দেখা হলে
জেনে নিতে পারতাম— মেঘদূতের বর্ণনায়
কালিদাসের মনে কত কত বৃষ্টি ঝরে পড়েছিল