
সীতাহরণ – একটি মন: সমীক্ষণ
অর্ঘ্য বক্সী
বস্তুত লক্ষণরেখার কোন উল্লেখ মূল বাল্মীকি রামায়ণে নেই। এটাই সবথেকে বড় একটি তথ্য হতে পারে, লেখাটি ও তার উদ্দেশ্য এই দু লাইনেই শেষ হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু আমরা এক্ষেত্রে প্রচলিত লোকগল্পকেই অনুসরণ করব।
যে কোন রেখা অতিক্রম করাই একটি মানসিক শ্রমের ব্যাপার। একটি রেখা বা সীমা অতিক্রম করার অর্থ হল থ্রেশহোল্ড ক্রস করে এক নিম্নতর মানসিক স্টেট থেকে উচ্চতর মানসিক স্টেটে যাওয়া। নিজেকেই নিজে ছাপিয়ে যাওয়া। তাই আদিম উপজাতিগুলিতে পুরুষদের বয়ঃসন্ধি থেকে অ্যাডাল্ট হওয়ার উৎসব ও রিচুয়াল্স পালন করা হত। যেমন সেই প্রথা উন্নত বাঙালিদের মধ্যে পৈতে দেওয়ার মাধ্যমে এখনও প্রবহমান ও সকলেই জানেন যে তাকে দ্বিতীয় জন্ম হিসাবে ধরা হয়। অযোনিজ জন্ম, আধ্যাত্মিক ইন্টেলেকচুয়াল রিবর্ন, transcendent। Not born out of flesh, but from spirit. ঠিক যেভাবে জন্মেছিলেন যিশু তার ভার্জিন মেরী মায়ের থেকে। সন্ন্যাসীদের এইভাবে একের পর এক ধাপ এগিয়ে যেতে হয় কুলকুণ্ডলিনী সাধনার চক্র থেকে চক্রে। আর উদ্বাস্তুদের করতে হয় এক এনভায়রনমেন্ট ও তার কমফোর্ট জোন ছাড়িয়ে অন্য দেশের অন্য পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার সংগ্রাম। অথবা যে কোন মানুষ… তার নিশ্চিন্তি, দৈনন্দিনতা ও অভ্যাস ভেঙে বেরিয়ে এসে বিপদের সম্মুখীন হয়ে তাকে শলভ করে উচ্চতর ম্যাচিওরিটি ও wisdom পৌছোনো … এই হল রেখা অতিক্রম করা, সীমা ভাঙ্গা। আর রূপকথায় আমরা এর রূপক পাই চাষার ছেলের ড্রাগন বা ডাইনি মেরে অভিশপ্ত রাজকুমারী ও অর্ধেক রাজত্ব পাওয়ার মধ্যে আর রামায়নেই পাই হনুমানের আত্মজ্ঞানের পর সাগর অতিক্রম করার মধ্যে। এতে যেহেতু লাগে অসীম সাহস, প্রভূত কমন সেন্স আর শুভ বুদ্ধি তাই খুব কম লোকই জীবনে প্রকৃত transcend করতে পেরেছে। বেশিরভাগ মানুষই চিরন্তন ভয় আলস্য ও এস্কেপিজমের মধ্যে থেকে গিয়ে শুধুই রিগ্রেস( পশ্চাতাপসরণ) করে গেছে, অ্যাডাল্ট তারা কোনদিনই হতে পারেনি… এমনকি রাস্তায় বেড়াল রেখা টেনে গেলে অলীক অশুভের ভয়ে তাকেও অতিক্রম করে ওঠা হয়নি তাদের।
সীতাহরণ ও লক্ষণরেখার গল্পে বরাবর আমি কিছু মনস্তাত্বিক সত্য দেখে এসেছি। হয়তো বিবিধ সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার, তার উপসর্গ লক্ষণ ধরে ধরে একে ব্যাখ্যা করতে পারতাম কিন্তু নির্দিষ্ট করে একে ডিসঅর্ডারে বললে পাঠকের আপত্তি থাকতে পারে এবং যেহেতু সাইকোসিসের বিবিধ রোগলক্ষণ পরস্পর মিশে থাকে তাই আপাতভাবে এক সাধারণ স্তর থেকে আমরা এর অ্যানালিসিস করব।
প্রথমেই যে জিনিষটি লক্ষণীয় তা হল ভিজ্যুয়াল ডিলিউশান যদি তাকে হ্যালুসিনেশন নাও বলা হয়। একটি সোনার হরিণ দেখা। বস্তুত মারীচ কথাটির অর্থই হল মরীচিকা। সীতার লজিক সিস্টেমে ও বাস্তবসংলগ্নতায় বড়সড় গণ্ডগোল দেখা যাচ্ছে। লক্ষণ মায়ামৃগ দেখেই মারীচ হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলা সত্বেও সীতার মতো এহেন বিদগ্ধা নারী হঠাৎ যেন ছেলেমানুষ হয়ে গেলেন! তার হঠাত এতো আনন্দ হল যেন তিনি কিছু সময়ের জন্য একটি ইউফোরিক স্টেজে চলে গেলেন যাকে বলতে হবে ম্যানিক অবস্থা। হরিণ তিনি আগে শহুরেদের মতো দেখেননি এমন তো নয়। বাস্তববিচ্ছিন্ন অলীক সোনার হরিণের বায়না তবে তিনি এভাবে করলেন কেন? এর উত্তর যদি কোথাও থাকে তবে তা সীতার অতৃপ্ত কাম ও অপত্যস্নেহতেই খুঁজতে হবে। দেখুন বিবাহের প্রায় ২০ বছর পরও সীতার কোলে সন্তান নেই। রাম রাক্ষসনিধনমন্ত্রে দীক্ষিত ও প্রায় সন্ন্যাসব্রতচারী। সীতার মাতৃত্ব অতৃপ্ত আর তাই সোনার হরিণ তাকে এক সুন্দর স্বপ্নের মতো সন্তানতুল্য পোষ্যের প্রলোভন দেখায়। সীতা বলছেন যখন তারা অযোধ্যায় ফিরে যাবেন তখনো রাজবৈভবেও এই সোনার হরিণ শোপিস হয়ে থাকবে এবং তিনি একে সযত্নে পালন করবেন। সীতার এই উদগ্র বাসনা তাই দীর্ঘকালীন অবদমিত কাম ও আবেগ , একাকীত্ব ও বনবাসের ক্লেশ, অসহায়তা ও অ্যাঙ্গজাইটির ফল।
দ্বিতীয় পর্যায়ে সীতার একপ্রকার অবসেসিভ কম্পালশন দেখতে পাচ্ছি অর্থাৎ যা চাই তা কোন বাস্তব পরিস্থিতি বিচার না করেই এক্ষুনি চাই এবং তার জন্য অবশ হয়ে যথার্থ হচ্ছে না জেনেও বাধ্যতামূলক কিছু অস্বাভাবিক আচরণ প্রদর্শন করা। বিপদ বুঝেও ও সীতা মরীচিকা দেখছেন বুঝেও যা রামকে বাধ্য করে সেই চাহিদার কাছে নতিস্বীকার করে হরিণের পিছু ধাওয়া করতে, শুধুমাত্র সীতার কমপালশানকে চরিতার্থ করতে। অথবা রামও কক্ষনও মুখ ফুটে কিছু না চাওয়া সীতার এই আবদার ফেলতে পারেননি, তিনিও সীতার অপত্য অতৃপ্তি ভালই জানতেন। একটা খেলনা তাই এনে দিতে তাকেও তাই বাধ্য হতে হল সেই ফাঁদে পা দিতে।
তারপর এক অডিটরি হ্যালুসিনেশনের পর্ব। সীতার অন্য এক পুরুষের গলার স্বরকে রামের ভয়েস হিসাবে ভাবা। স্পষ্টতই সীতা দুটি গলার স্বরের মধ্যে প্রভেদ ( স্টিমুলাস ডিস্ক্রিমিনেসন) করতে পারছেন না। তার কগনিটিভ ডিসফাংশান হচ্ছে, মেমোরি ডিসফাংশান হচ্ছে, অর্থাৎ যে মেমোরি পরিচিতের গলার স্বর বা মুখ মনে রাখার কগনিটিভ কাজ করে তার মধ্যে বড় রকমের ওলটপালট হয়ে গেছে। সীতা একটি স্বর শুনছেন এবং যতই তা মিমিক্রি হোক না কেন তাকে সর্বাপেক্ষা পরিচিতের গলার স্বরের সঙ্গে তিনি আলাদা করতে পারছেন না এবং ভেবে বসছেন যে রাম বিপদগ্রস্ত ও তিনি লক্ষণের সহায়তা চাইছেন। কেন তিনি কি জানতেন না রামের বলবীর্য বা লক্ষণও কি তাকে সে কথা স্মরণ করিয়ে দেন নি? সীতার থট কন্টেন্ট আর থট প্রসেস দুটোতেই এখন অসংলগ্নতা এবং তার যুক্তি ও বাস্তবতা আর সাধারণ মানুষের মত স্বাভাবিক কাজ করছে না… কেন? সীতা যে আগেই সোনার হরিণের হ্যালুসিনেশন দেখেছেন তা তার অবচেতন আগেই ঠিক চিহ্নিত ( রেজিস্টার) করেছে, তিনি মনে মনে জানেন তিনি ভুল করেছেন এবং সেই অ্যাঙ্গজাইটি ও বিবেকদংশন তাকে আত্মপ্রতিরক্ষাব্যবস্থা হিসাবে আরো হ্যালুসিনেশনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
তারপর এক প্যানিক পর্যায়। সীতা খুব বেশি মাত্রায় প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন সেই আর্ত রামনাদের। সীতা তার যাবতীয় ইম্পাল্সের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন। তার ব্যবহার বিজার। তৎক্ষনাত তিনি লক্ষণকে রামের সাহায্যে যেতে ইন্ডাল্জ করছেন
ও বাস্তবসংযুক্ত লক্ষণের নির্বিকারত্ব তার কাছে ষড়যন্ত্র বা কুমতলব বলে প্রতিভাত হচ্ছে। অর্থাৎ অধিকাংশ মানসিক রোগের সাধারণ উপসর্গ “ অতিরিক্ত সন্দেহবাতিকগ্রস্ততা“য় ভরে গেছে সীতার মন। লক্ষণের শান্ততার এক মারাত্মক ওভার রিঅ্যাকশান বা সামান্য স্টিমুলাসে অস্বাভাবিকভাবে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন আমরা ভালোরকম লক্ষ্য করছি সীতা ব্যবহারে ( observed overt behaviour যা ব্যবহারবাদীদের প্রধান observation এর জায়গা )। এতই অবাস্তব এই সন্দেহবাতিকগ্রস্ততা যে লক্ষণের মতো ব্রহ্মচর্যব্রতচারী ও আদর্শ দেবর পরাকাষ্ঠাকেও তার মনে হচ্ছে বউদিসম্ভোগলালায়িত হয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে রাম সাহায্যে যেতে না চাওয়া এক লম্পট! যে চায় রাম মরুক আর সে তৎকালীন যুগে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী বউদির উপর স্ত্রীর অধিকার প্রয়োগ করবে! যে সীতা না হলেও ২০ বছরের অধিক তার এই সৎ সরল দেবরটিকে দেখছে এবং তার সঙ্গে নিজেও যে সে তৎকালীন যুগের অন্যতম বিদগ্ধা রমণী তার এই কষ্টকল্পিত সন্দেহবাতিকগ্রস্ততা ও মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াপ্রাবল্যে হতবাক হয়ে যেতে হয়! বস্তুত মনোরোগীরা এমনকি বিখ্যাত সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়কেও তার বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো হিসাবে ভাবে এবং যে কোন… বাস্তবিকই যে কোন ঘটনাকে বা কথাকেই তারা তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসাবে সন্দেহ করে। যাচাই করে বিশ্বাস স্বাভাবিক, এক্ষেত্রে একদিকে যেমন মাত্রাতিরিক্ত অবিশ্বাস অন্য দিকে কিছু ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত সরলতা যেমন বিশ্বাস করে নেওয়া সোনার হরিণ!!! সাইকোঅ্যানালিটিক তত্ত্বে এজাতীয় গুলিবলনেস একমাত্র ওরাল ফিক্সেসনজাতীয়দেরই থাকে। এর সঙ্গে লক্ষ্য করতে হবে যে ভাষায় সীতা লক্ষণকে তিরস্কার করছেন সে দিকে। সীতা লক্ষণকে তুই তোকারি করছেন!! এবং যেন তিনি ধরেই নিয়েছেন যে রাম মৃত ও লক্ষণই তার জন্য দায়ী। তিনি অন্তত যে ভাষায় এখন তার নিষ্ঠাবান দেবরটির সঙ্গে কথা বলছেন তাতে এটা অন্তত স্পষ্ট হয়ে যায় যে সীতা সুলভ তা নয়। হঠাত সীতার কগনিটিভ লেভেলে স্পিচ ডিসফাংশান ও ডিজেনারেশন হচ্ছে। সীতা নিজেই জানেন না তিনি কি বলছেন অথবা তিনি যা বলছেন তাই কি তিনি বোঝাতে চাইছেন? সীতার এই ভাষা শুনে পণ্ডিতেরা কেউ কেউ তো তিনি সীতাই নন, বরং শবরী বলে ভেবে বসছেন!!! ( এই থিয়োরি হল সীতাকে সরিয়ে রাম সীতা look alike শবরীকে কুটীরে এনে রাখেন যাতে রাবণ সীতা বোধে শবরীকে হরণ করেন)।
এর পরবর্তী পর্যায় লক্ষণরেখা টানা ও সীতাকে এই প্রথম একাকী ও অরক্ষিত রেখে রাম ও লক্ষণ উভয়েরই প্রস্থান। বেশিরভাগ মানসিক রোগের যে কারণ ও ফলাফল সেই একাকীত্ব – সোশ্যাল ইমোশনাল অ্যালুফনেস ও ভালবাসা সহানুভূতি আশা-আস্থাহীনতার বোধ যাই কিনা আসল বেসিক ইভ্ল সেই loneliness এ ভোগার পালা এবার সীতার। একা থাকা, বিশেষত প্রকৃতির মধ্যে যথোপযুক্ত শেল্টারের বিনা একা থাকার ভয়ঙ্কর মানসিক বিপদের কথা পৃথিবীব্যাপী পুরাকথা ও লোকগল্পে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। মানুষের self identity/ image নিজের কাছেই নিজে confused হিসাবে দেখা দেয়। মানুষ নিজের সঙ্গেই নিজের সংযোগ হারায়। নিজেই সে আর নিজেকে চিনতে পারে না। হারিয়ে ফেলে। নিজের কাছেই নিজের হরণ হয়ে যায় তার। মানুষের চেতন তার সত্ত্বা যেন গলে গলে মিশে যেতে থাকে প্রকৃতির মধ্যে। তার জন্য তখন শুধু অপেক্ষা করে থাকে প্রকৃতির মধ্যে মিশে গিয়ে নিজের সেলফকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার বিপদ। বস্তুত একমাত্র প্রাজ্ঞ ঋষিরা বা shamanরা যারা জানে কিভাবে নিজের অবচেতনকে নিয়ন্ত্রনে রেখে এভাবে একলা প্রকৃতির মধ্যে exist করা যায় তারা ছাড়া এই ঝুঁকি যে অজ্ঞ মানুষই নিয়েছে তারই আত্মা খোয়া গেছে। তাই মহাকাব্যিক সীতা হরণ হয়ে প্রতীকায়িত হয়েছে। এ বিষয়ে একটি fact উল্লেখ না করলেই নয়। সেটি হল সীতা কিন্তু আগেও পরিত্যক্তা হওয়ার দুঃসহ স্মৃতি বহন করছেন। তা তিনি নারী বলে অনাকাঙ্ক্ষিতই হোন বা প্রচলিত গাথা অনুযায়ী রাবণেরই সন্তান তিনি পরিত্যক্তা। আবার শেষ জীবনে আবার তিনি পরিত্যক্তা স্বামী দ্বারা। মধ্যবর্তী পর্যায়ে তিনি রাবণ কর্তৃক দীর্ঘ এক বছর সম্পূর্ণ অন্য এক সংস্কৃতি জাতিতে বন্দিনী। সুতরাং সীতা তো প্রায় সারা জীবনই immigrant. empty, aloof. এ সকলই ভীষণভাবে নিউরোসিসের উপসর্গ।
প্রকৃতপক্ষে লক্ষণরেখা হল একটি স্যুইচের মতো। এক পোটেনশিয়াল ভোল্টেজ ডিফারেন্সের মতো। ছোট্ট কুটীর যেখানে রাম সীতার বাস, তার চারপাশের ছোট্ট বৃত্তটি হল চৈতন্যের, কনশাসের, মানুষের শুভ সত্ত্বার ও ego এর যার উপর আলো পড়েছে আর চারপাশের সেই বিরাট পঞ্চবটীর অরণ্য হল অবচেতন ও id এর অন্ধকার অজানা রহস্যাবৃত মুক্তাঞ্চল যা পশুত্বের ও পাশবিকতার , যাকে self চেনে না। একটি আইস বার্গের প্রতীক এটি, যার ১০% জলের উপর দৃশ্যমান বা self এর চেনা কনশাস ও ৯০% ভাগ জলের নীচে ও self এর অজ্ঞাত আনকনশাস। যেখানে আগুন জ্বালানো হয় সেই স্থানটি মানুষের জন্য উষ্ণতার ও প্রকৃতির বিরুদ্ধে নিরাপদ আশ্রয়। সেখানে সিংহরা ঘেঁষে না। অদূরে ওত পেতে থাকে প্রকৃতি আশ্রয়হীন মানুষকে গিলে নেবার জন্য। তার উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। সেই পশুত্ব অপেক্ষা করতে থাকে মানুষী চৈতন্যের আলো কখন নিভবে আর সে সেই সুযোগে সত্ত্বা ও সুস্থতাকে আক্রমণ করে নিশিহ্ন করে দেবে! গণ্ডির মধ্যে এই সাদা আলোর রাজা হল রামের, আর বাইরের সেই কালো অন্ধকার এলাকার একনায়ক হল রাবণ। বস্তুত এ এক borderline! তাতে দাঁড়িয়ে সীতা বা মানব মন। সীতার কাছে সবই হয় all white or all black। All good or all bad। কিন্তু রাম হোন বা রাবণ, রিয়ালিটিতে এই বাইনারী নেই। রাবণ তো বটেই এমনকি রামও যে ১০০% একজন গ্রে শেডের মানুষ তা বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। বস্তুত রাম ও রাবণ এমনভাবে পরস্পরের মধ্যে ভালোমন্দে মিশে গেছেন যে তাদের আলাদা করাই মুশকিল হয়ে যায় কখনো কখনো। মনে হয় এক dissociative persona বা multiple personality এর দুই স্তর, তার এক সত্ত্বা রাম, আর এক সত্ত্বা রাবণ। এক ও একই মানুষ সে, একই self। শুধু তার দুটো ভাগ। একজন রাম, অন্যজন রাবণ। যব তক রাম হ্যায় রাবণ রহেগা। এক জন যদি রাবণের মতো super power ধারণ করে তবে অন্য অংশও সম পরিমাণ শক্তি ধারণ করে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে। তাই যে কোন Hollywood হোক বা পুরাকথা বা fairytales… এক জন অশুভ সুপ্রিম পাওয়ারের বিরুদ্ধে সবসময় গজিয়ে ওঠে এক super positive power।
ধরা যাক, ০=০ এটি স্বতঃসিদ্ধ। এবার আমরা লিখতে পারি, ২ – ২=০; আবার ধরা যাক, 2.5x + (– 2.5x) = 0 ; অর্থাৎ রাবণ যদি equilibrium ভেঙ্গে 2.5x পরিমাণ ঋণাত্মক শক্তি নিয়ে মানসে আবির্ভূত হন তবে রামও 2.5x পরিমাণ ধ্বন্যাত্মক শক্তি নিয়ে প্রকাশিত হবেনই। এবার যেহেতু দুজনেই গ্রে শেডেড তাই এই সমীকরণ কে লেখা যেতে পারে, (4x – 1.5x) + ( x – 3.5x ) =0 ; বোঝাতে চাইছি যে রামের যদি বেশির ভাগ শুভ সত্ত্বা থাকে ( 4x পরিমাণ) তবে তার মধ্যেও কিছু নঞার্থক দিকও আছে ( – 1.5x ) . আবার রাবণের মধ্যে বেশিরভাগ নেগেটিভ বৈশিষ্ট ( -3.5x ) থাকলেও কিছু অন্তত পজিটিভ দিকও আছে ( x পরিমাণ) ।
একজন যদি তুমি আনো তবে অন্য জন সবতঃসিদ্ধভাবেই আসবে। এবং লক্ষ লক্ষবার এই প্রবণতা পুনরাবৃত্ত হয়ে চলে। এটাই হল law of duality। এই হল বাস্তব। সেই বাস্তব এই বলতে চায় যে স্বাভাবিক অবস্থায় তাই এই চরম যুদ্ধংদেহি বৈপরীত্য নেই। যা আছে তা হল অমোঘ মানবধর্ম “গ্রেনেস”। সেই বাস্তব থেকে সীতা তার যোগাযোগ হারিয়েছেন। আর তাই তিনি বেসিক ইভ্লের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন না। এখানেও রাবণের জন্য লক্ষণরেখা অতিক্রম করে বেরিয়ে আসা এক ব্যাখ্যার বিষয়। রাবণ যতই ঋষির বেশ ধারণ করুন তার দৈহিক লক্ষণাদি ও রং দেখে তাকে অনার্য রাক্ষস হিসাবে বুঝতে না পারার মতো অনভিজ্ঞা সীতা নন। এখনে এক তো সীতার অতিসারল্য বা গুলিব্লনেস, নিজেকে নিজের কাছে সৎ প্রমাণ করার অদম্য বাসনা নিয়ে অতিথি সৎকারের প্রবল নিউরোটিক চাহিদা (towards good) ও অতিরিক্ত কম ভেবে কাজ করার রোগলক্ষণ আমরা বুঝতে পারছি। এভাবেই ডিফেন্স মেকানিজ্ম যখন ভেঙ্গে পড়ে তখন মানব মন নিজেকে অবচেতনের পশুত্বের কাছে হারিয়ে ফেলে। তার আত্মা খোয়া যায়।
আবার সীতার যে নিউরোটিক লক্ষণ তাতে তার পক্ষে দীর্ঘ সময় একা থাকা প্রায় অসম্ভব। তাই এক অতিথি এসেছেন তার সঙ্গেই সময় কাটাতে চেয়েই হয়তো সীতার রাবণকে এন্টারটেইন করা। এই জাতীয় মানসিকদের committed relationship নিয়ে প্রবল অনিশ্চয়তাবোধ থাকে। রাম ও সীতার জবানীতে অন্তত বাল্মীকি তার অসংখ্য clue দিতে কোন কার্পণ্য করেননি।
এবং আমরা জানি যেমন বহু সাইকোসিস কোন দিনও কিওর হয় না, তেমন রাম থেক রাবণ পর্যায়ে একবার চলে যাওয়া সীতামন কোনদিনও সেই trace বা trauma মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি। যাই আসলে নিজের কাছেই সীতার নিজের কলঙ্ক। সীতার মানসিক আত্মসুরক্ষা ব্যবস্থা চিরতরে ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেছে। ম্যানিয়া ও ডিপ্রেশন পর্যায় অল্টারনেটিভভাবে চলতে থাকছে vicious circle এ পড়ে যাওয়া borderline এর সীতার… লক্ষণরেখা একবার পেরিয়ে চিরতরে সে মানসিক রোগের কবলে চলে গেছে। এবং লঙ্কায় অশোকবনে হনুমানের কাছে যতবার আত্মহত্যার কথা বলছেন উন্মাদিনী সীতা, যেভাবে তার কথায় কোন সংলগ্নতার লেশমাত্র নেই, সেই চরম আতঙ্কের দিনগুলির স্মৃতি সাধারণ মানুষের স্কিতসোফ্রেনিয়া বা ওই জাতীয় অ্যাকিউট সাইকোসিস ফেস শেষ হয়ে গেলেও অমলিন থেকে যায়। তা কোনদিনও রোগীকে স্বাভাবিক হতে দেয় না। আর তাই ইতিহাসের প্রথম বর্ণিত single mother হওয়া সত্বেও রামের সঙ্গে শেষ সাক্ষাতে সেই পুরোনো ঘায়ে আঘাত লাগাকে মেনে নিতে পারেননি সীতা, এমনকি তার সন্তানদের মুখ চেয়েও পারেন নি আমাদের জাতির জননী !!! আর সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে গেছেন, suicide করেছেন, সন্তানদের তাদের right প্রতিষ্ঠা করিয়ে দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে যেতে পারেননি। পারেননি আজন্ম বাবাকে না পাওয়া দারিদ্রে মানুষ হওয়া রাজপুত্রদের স্বমহিমায় বিরাজিত হয়ে সুখী হয়ে দেখে যেতে। শেষে এসে কি সীতাকে সন্তানদের ভবিষ্যতের চেয়েও নিজেকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলা স্বার্থপর মনে হয়নি? কারণ আছে। কারণ সেই সীতার চরম নরম জায়গাতে আবার আঘাত যা অনেক আগেই সে বিষয়ে যাবতীয় প্রতিরোধ হারিয়ে ফেলা সীতার সকল আত্মসংযমকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। সীতা নিজের উপর যাবতীয় control আবার হারিয়ে ফেলছেন। তার regression শুরু হচ্ছে। আর তা এতই ব্যাপক ভাবে হচ্ছে যে তাকে জন্ম মুহূর্তে নিয়ে চলে যাচ্ছে। সীতা আবার যেখান থেকে জন্মেছিলেন অর্থাৎ ধরণী মাতৃগর্ভের নিশ্চিন্ত সংশয়হীন দ্বিধাহীন আশ্রয়ে নিজেকে নিমগ্ন করেছেন। তারপর সীতা শূন্য অবস্থা প্রাপ্ত হচ্ছেন।
শেষে আমাদের বলতেই হবে রাবণ কর্তৃক হরণের পর সীতাকে লঙ্কায় নিয়ে যাওয়ার মাধ্যম পুস্পকরথ বা মনোরথ বা ওড়ার ফ্যান্টাসি নিয়ে। ওড়া মূলত যৌন অতৃপ্তদের স্বপ্নে আসে। ওড়ার মাধ্যমে তাদের অতৃপ্ত যৌন ক্রিয়ার wish fulfilment হয়। পুস্পকরথ সুতরাং যৌনমনোরথ। তা হল এক ধর্ষকামীর অবচেতনে নিজেকে ম্যানিক বা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী বিরাট ভাবার ডিলিউশান। বিশেষত মনোরোগে, তার ক্রমশ বাড়তে থাকা পর্যায়ে অতিরিক্ত uncontrollable যৌন উত্তেজনা এক স্বাভাবিক ঘটনা। ওড়া এবং তাও সেই ঘন ক্রান্তীয় অরণ্যের উপর দিয়ে যা আসলে নারী রহস্য যৌনতারই প্রতীক, এক অলভ্য অবদমিত যৌনতার পুরুষের কাছে, … আসলে রাবণ বা রোগ সীতাকে / মানব চৈতন্যকে অবদমিত বিকৃত সর্বগ্রাসী মনুষ্যত্ব হারানো পাশবিক যৌনতার প্লাবনে ঢেকে দেয়। অনিচ্ছা বা প্রতিরোধ কোন কাজে আসে না । সীতার স্থান হয় অবচেতন জলরাজি বেষ্টিত ফ্যান্টাসির বাস্তববিচ্ছিন্ন নন্দন কানন বা wonderland বা Eden garden এ। রাম উদ্ধার করে নিয়ে এলেও সেই অসুখস্মৃতি কোনদিনও মানবমন ভুলতে পারেনা। কোনদিনও সে আর বাস্তবে ফিরতে পারেনি। স্বাভাবিক হতে পারেনি। কিছুদিনের জন্য অযোধ্যার অশোকবনে রামের সঙ্গে মৈরেয় মদ্য খেয়ে ম্যানিক ফেস কাটিয়ে আবার অ্যাকিউট ডিপ্রেসনের নির্বাসন হয়েছে তার। মোদ্দা কথা হল সীতা রাম রাবণ ও রামায়ণ বাদ দিয়েই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ মনস্তাত্বিক case study এর বিষয়।
লেখাটি যদি ভালো লাগে, আবহমানে নিজের ইচ্ছেমতো ফোন পের মাধ্যমে
অবদান রাখতে পারেন, এই কিউ আর কোড স্ক্যান করে। ফোন পে করুন 9051781537
অথবা স্ক্যান করুন পেমেন্টের লিংক