
অমিতাভ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা
বাতিঘর
ভিতরে এক নির্জন প্রেক্ষাগৃহ
নামমাত্র এই আমি দর্শক, একই ভাবে স্থির
হলের ধ্বনি ও চিত্রের মধ্যে লগ্ন, বাইরে দিকে
প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলে ঘুরেফিরে যে ত্রিভুজ
তৈরি হচ্ছে বারবার, তা আমারই মধ্যে
জড়োসড়ো, ঘুমিয়ে পড়তে চাইছে
বহুবর্ণ আলোর বিচ্ছুরণ ভীষণ গুটিয়ে রাখা
কৌটোর মধ্যে ভরে রেখে, প্রকৃত প্রাণভ্রমর
কোনখানে ভুলে খুঁজে ফিরি — এই বাতিঘর
তার শ্রম ও ব্যথাতুর আত্মা পেটের ভিতর নিয়ে
আজীবন দাঁড়িয়ে রয়েছে, নাকের কয়েক হাত
দূরে পেন্ডুলাম, নড়ে নড়ে উঠে রচনা করছে
এই অন্দরমহল, তার ভূমিকার প্রথম অস্ফুট…
সন্ধান
তোমাকে আঘাত না করলে জেগে ওঠো না
না জাগলে কী ভাবে আমার স্পর্শের ইচ্ছেগুলো
দানা বাঁধবে ? কী ভাবে তোমার মধ্যে নিজেকে
জব্দ করবো ! গেঁথে নেব শিকের অন্দরে !
কোথায় তোমাকে পাবো ? দোকান বাজার সব
বন্ধ হয়ে গেছে, এই রাত সাড়ে আটটায়
গেরস্তের দরজায় দরজায় চুঁইয়ে পড়ছে হিম…
কোথায় নিজেকে পাথরের মতো খাড়া করে
উচ্চতার ধারণা নেবো ? কোথায় গলিতে গলিতে
বয়ে চলবো ? আমি কি ফের প্রচলিত হয়ে
আলো ছড়াবো ভোরে ? আগুন ছড়াবো সাবেক
উনুনে, অস্থিতে ?
আমি কে ? তুমিই বা কোথা থেকে এমন রাতের সব
পোশাক আর ছায়াছবি নিয়ে এলে !
তাহলে, তুমি কোথা থেকে আসো ? ছোটদির মৃত চাহিদার
পথ ধরে এমন সুচারু ! তুমি পদশব্দহীন
জোড়াবাগানের সিঁড়ি নও ! এই রাত সাড়ে আটটায়
বন্ধ হতে চলা চাউমিন স্টলের তাওয়ার নীচে
বিড়ালের ভাষা শিখি…কেউ নও, তুমি কেউ নও…
ফেরি
১.
তারিখ চমকাচ্ছে, শীত ভেঙে যাচ্ছে
মাদুর ও দালান খুব ক্ষতিকর না, জেনেই
তোমার চাদরে শুইয়ে দিচ্ছি রোদ, গড়ে নিচ্ছি
মন্ত্রময় দুপুর, এলানো বিকেল, ঝাঁ চকচকে রাত্তির
তবে, কোন প্রশ্ন থেকে তুমি শুরু হয়েছিলে ?
কোনখানে শেষ হবে এইসব আপাত সংগীত !
কোনখানে পাঠোদ্ধার করা হবে মুকেশের গানের খাদ !
কোথায় আকস্মিক ভাবে নেশা বেয়ে উঠে যাবো
তোমার বেরং পতাকাতলে ! সুর খুব আপদকালীন,
আর শব্দহীন সিঁধেল অক্ষর, কেউ ভাবতেও পারে না
এই সীমারেখা, এই টান টান ইজেল
ঠাসা বারুদের গন্ধ, থ্রি নট থ্রি, অস্ত্র নাকি যৌন ঘনক !
খুব দূরে নয় মোগলাই পরোটার স্টল, যেখানে প্রশ্নে বিঁধেছে
সহজ পাতায় লেখা দূরতর ছেলেবেলা !
কোথায়, কোথায় আজ বালি ভেঙে আরো মিহি
আরো পর্যাপ্ত ধুলো আর সেই মিঠে কড়কড় !
২.
কোনখান থেকে ডুকরে ওঠা যাবে !
নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে উঠে আসবে ক্রোধ
যেহেতু পুরুষের বেদম কান্না নাকি সমীচীন নয়
বাষ্পের ভিতর তার দীর্ঘ বসবাস, বল্কলের
পরিধানযোগ্যতার মধ্যে তার লিঙ্গের উত্থান
— সেভাবে পড়িনি কোনো প্রবন্ধ পুস্তক
তার ফলে আমিও কি পাঠোদ্ধারহীন হয়ে থেকে যাবো
কামারশালায় ! বট ধাতু চূর্ণ হবার শব্দে হামানদিস্তার সুর
কথা বলবে যে ভাষায়, সে যেন মাতৃভাষা, আরোপ ছাড়াই
বেড়ে উঠবে লাথখোর, পাঁচিল দেখলেই যেটুকু টপকাবে
তা’ মূলত আবেগ, তবু আমি তার স্মৃতি নিয়ে যাবো
কতকটা পূর্বে আর পশ্চিমা বায়ুর আগমনে…
মনোলগ
……………
সকাল
খুব নিশ্চুপ হয়ে যে সব দুঃখের কথা বলতে চেয়েছি তার প্রতিচ্ছবি অলস কুকুরগুলির ছায়ায় লেগে আছে। আজ, হেমন্তের এক অতি সাধারণ চিমসে রোদের সকালে ইলেকট্রিক পাখা বন্ধ করলাম শীতের কথা ভাবতে, মহাজীবনের মধ্যে নিজেদের ছোট ছোট শীলমোহর ছেপে দিতে, ওক কাঠের টেবিলের অন্তর্গত বিষণ্ণতা চেপে রাখতে… ঢের দূরে এখন বরফপাত হচ্ছে, ঢের জীবনে এখন রেতঃপাত হচ্ছে, ঢের স্বপ্নে এখন প্রবল নীলাকার ঢেউ উঠছে, ঢের মানুষ এখন ছোট ছোট ফোলিও ব্যাগ হাতে নিজের অফিসের কিউবিকলের দিকে দ্রুত চলেছে, ঢের মানুষ এখন সবজিবাজারের প্রত্যন্ত ভিতরে সংসারের ঘ্রাণ খুঁজছে, একটু পরেই দুপুর নামবে…একটু পরেই পৃথিবীর কাজের সমুদ্রে আমি বাতিল নাবিক হয়ে যাবো, একটু পরেই শুকিয়ে যাবে আমার ঘেমো বিছানার সোঁদা ভাব…
দুপুর
এমন একটা পথের কথা বলতে চাইছি, যেখানে শতাব্দীর শ্যাওলামাখা ইঁটঘেরা পাঁচিলের ওপর থেকে পাইন আর ফার ঝুঁকে এসে পূর্বজন্মের মতো পড়েছে একটানা লম্বা জীবনে… কয়েকটা রোমশ কুকুর শুঁকে শুঁকে তাদের গতায়াত ঠিক করে নিচ্ছে আর মেঘ পোহাচ্ছে এই ভীতু দুপুরের অসহায় নগ্নতায়… কোথায় জানি ঝিঁঝিঁ আর ধর্মসংগীত বেজে চলেছে অবান্তর, পাহাড়ের ঢালে গড়িয়ে গড়িয়ে নামছে বর্ণনাবিহীন বিকেল, মুখের চামড়া থেকে আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে হালকা হলুদ তাপ, চড়চড় করছে মনস্তত্ত্ব… ঠোঁট শুকিয়ে আসছে তোমাকে চুম্বন করব ভেবে, বুক শুকিয়ে আসছে তোমাকে কখনো চুম্বন করেছিলাম ভেবে…
সন্ধে
ঘন সন্ধে, তুমি কি আমাকেও গিলে নেবে! তোমার নরম নালি বেয়ে ঠেলে নিয়ে যাবে এক প্রকান্ড রাত্রির পেটে ! খুব ভয়ের ভিতর দ্রিম দ্রিম করে বাজনা বাজছে, প্রেমের মতো গন্ধ চারদিকে ! দুপুরের এঁটো বাসনের উপর কোন বাড়িতে লেবুগন্ধ ডিশওয়াশ চেপে ধরলে, সন্ধে! আমাকেও বয়ে বয়ে নিয়ে চললে… ইশারাদের কাঁধে কাঁধে আমি পেরিয়ে যেতে লাগলাম একটার পর একটা জনপদ, একটার পর একটা ধারণা ও প্রমাণ ! খুব ক্লান্ত লাগলে খেয়ে ফেললাম মদ ও মোহ ! ডুকরে কেঁদে উঠলাম মানুষের ছোট ছোট দুঃখের কথা শুনে। তাদের ভার বইতে পারলাম না। মানুষের ছোট ছোট কষ্টের কাঁধে চেপে আমি পেরিয়ে যেতে লাগলাম এইসব অবাস্তব সন্ধে…
লেখাটি যদি ভালো লাগে, আবহমানে নিজের ইচ্ছেমতো ফোন পের মাধ্যমে
অবদান রাখতে পারেন, এই কিউ আর কোড স্ক্যান করে। ফোন পে করুন 9051781537
অথবা স্ক্যান করুন পেমেন্টের লিংক



পড়ে খুব আনন্দ পেলাম অমিতাভদা। কবিতার যে গতি ও ভাষার কাছে যেতে চাই, এই কবিতা তার কাছাকাছি পৌঁছে দেয়। বিশেষত তাতে করে কবিতার বোধ নষ্ট হয় না। আমার ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা নেবেন।
ধন্যবাদ, দীপশেখর।
অমিতাভর এইসব কবিতার গভীর, চিত্ররূপময় ভাবপ্রতিমায় মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই।
ধন্যবাদ। সাহস পেলাম।
অমিতাভদার কবিতা মানে নিজের অন্দরমহলের সন্ধান। অসাধারণ প্রাপ্তি।
ধন্যবাদ।