পৃথা কখন আসবে (দ্বিতীয় পর্ব) <br /> অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়

পৃথা কখন আসবে (দ্বিতীয় পর্ব)
অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়

লেখকের নোট এই উপন্যাসের প্রায় পুরোটাই লেখা এমজেএন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পুরুষ শল্য বিভাগের বিছানায় বসে বা বালিশে হেলান দিয়ে আধ শোওয়া হয়ে। ট্রামাডল ইনজেকশন নেওয়ার পর ব্যথা একটু কমলে এবং ফের যন্ত্রণা শুরু হওয়ার মাঝখানের সময়গুলোতে এই উপন্যাসের বাক্য এবং যতিচিহ্নগুলো লেখা। কখনও মাঝরাতে উঠেও নিশ্চুপ হাসপাতালে বসে ভোর অবধি টানা লিখে গেছি। যখনই যন্ত্রণা শুরু হত ওঁরা ইনজেকশন দিয়ে কমানোর চেষ্টা করতেন, যাতে নিশ্চিন্তে লিখতে পারি। হাসপাতালে শুয়েই ডায়রি এবং নোট রাখার শাদা কাগজগুলোতে উপন্যাসটা গুছিয়ে আনার পর ‘অন রিকোয়েস্ট’-এ ডিসচার্জ নিয়ে ঘরে এসে এতে সংযোজন, পরিমার্জন ও ঘষামাজা সেরে ফেলি। কোনও অসুখ নয়, কোনও যন্ত্রণা নয়, আর কিচ্ছু নয়, মাথা থেকে গোড়ালি পর্যন্ত এ উপন্যাস শুধু প্রেমের উপন্যাস।

প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন– উপন্যাসের প্রথম পর্ব

এমপ্যাথি জিনিসটা শুধু মুখের কথায় প্রকাশ করার জিনিস নয়। বরং মুখের কথায় এটা প্রকাশ পায়ই না বলতে গেলে। পায় মুখের কথা বলার ভঙ্গিতে। আর প্রকাশ পায় শরীরের ভাষায়। কোনও সিস্টার হাঁটছে তীক্ষ্ণ, তীব্র, চোখা এবং কাটাকাটা হয়ে। কেউ হাঁটেন কাঠকাঠ। কেউ গার্লস স্কুলের রাগি দিদিমনি। কেউ হাঁটছে, দেখে মনে হয় ম্যাদামারা। কেউ হাঁটে গুটিগুটি। কারও হাঁটায় খুব ক্লান্তি। কেউ হাঁটেন ল্যাতরপ্যাতর করে। কেউ হাঁটে হনহন, যাতে কেউ ডাকার সুযোগই না পায়। কেউ হাঁটে যেন গৃহবধূ। কেউ যেন জমিদার গিন্নি। কেউ হাঁটে কলেজের অধ্যাপিকার মতো উন্নত ও অহংকারী গ্রীবা তুলে। কেউ হাঁটে মাথা নীচু করে। চোখ তুলে তাকায় না। আড়চোখে দেখে। কেউ কথায়-বার্তায় খুব বিরক্ত। সবসময়েই খুব বিরক্ত। কেউ ঘ্যানঘ্যানে। কেউ খিটখিটে। এমপ্যাথি যার আছে, তা তার কথায়, তাকানোয়, হাঁটায়, হাতের ছোঁয়ায়, দাঁড়ানোয়, সাড়া দেওয়ায়, স্পর্শে, ডাকায়— সব কিছুতে প্রকাশ পায়। আলাদা করে কোনও একটা পথ দিয়ে তা ফুটে বেরোয় না। সর্বত্র প্রকাশিত হয়।
আমার সেই সুন্দরী নার্স যখন স্যালাইনের ড্রপ চেক করেন তখন আরেক হাতে আলতো করে ধরে থাকেন রুগির চ্যানেল লাগানো হাতটি। সেই স্পর্শের ভাষা একমাত্র সেই রুগি টের পায়। চ্যানেলের জন্য ভেইন না পেয়ে ডাক্তার যখন দু’ হাতে একের পর এক জেলকো নিডল ঢুকিয়ে ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছেন— তখন আমার অন্য হাতে, আঙুলে লেগে থাকা রক্তের দাগ তুলো দিয়ে মুখ নীচু করে যত্নে মুছছেন সুন্দরী নার্স। কিংবা চ্যানেলের জন্য ভেইন খুঁজে পেতে হাতে ইলাস্টিকের গার্ডার বা রাবার ব্যান্ড লাগানো হয়েছিল। শক্ত করে বাঁধা সেই ব্যান্ড খুলে নেওয়ার পর তিনি দু’ হাতে হাতের ওই জায়গাটা একটু মুচড়ে দেন হালকা করে— যাতে ওখানকার রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয় এবং শক্ত হয়ে থাকা মাংসপেশি আবার ঢিলে হয়। আপাত দৃষ্টিতে এগুলো কিছুই নয়। কিন্তু বেশিরভাগ জনই এটা করেন না। কিংবা ধরা যাক, রাতের ডিউটি শেষে বাড়ি ফেরার পথে রুগির পাশে দাঁড়িয়ে ছোট্ট একটা জিজ্ঞাসা রাখছেন তিনি— ব্যথা কমল একটু? আমি তখন আধো তন্দ্রায়। ডিউটি শেষ। তিনি বাড়ি ফিরছেন। ফিরে গেলেই হয়। যেমন সবাই যায়। কিন্তু ফিরতে ফিরতে ফেরার পথেও তিনি খোঁজ নিতে নিতে যাচ্ছেন। পিসিএম নেওয়ার পর ঘুম ঘুম ঘোরের মধ্যে শুনতে পাচ্ছি তাঁর আন্তরিক গলার সেই খোঁজ। অল্প চোখ মেলে দেখতে পাচ্ছি, তুঁত রঙের সালোয়ার কামিজ পরে তিনি সার্জিক্যাল ওয়ার্ডের বারান্দা ধরে হেঁটে যাচ্ছেন বাইরে যাওয়ার রাস্তায়। বাইরে তখন ঝুম বৃষ্টি। সারাদিন পরে ঘরে ফিরছে আমার ক্লান্ত সিস্টার। যেতে যেতেও তার এমপ্যাথি স্যালাইনের ফোঁটা ফোঁটা জীবনবিন্দুর মতো ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে বিছানায় শুয়ে থাকা রুগিদের মন। এসব টের পাওয়া যায়। টের পাওয়ার মতো মন থাকলে টের পাওয়া যায়।

যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা ঠিকঠাকই হল। আসলে অসুস্থ অবস্থায় একজন মানুষের সঙ্গে এতগুলো যদি, সুতরাং, কিন্তু চলে যে, কোনও একটা কাজ, আপাতচোখে তা যত সামান্যই হোক, শেষ অবধি ঠিকঠাকভাবে করে ওঠাটাই দুরূহ হয়ে ওঠে। ষষ্ঠ দিন ভোরে যখন হাসপাতালের বিছানায় আমার ঘুম ভাঙল তখন কটা বাজে জানি না। সঙ্গে ঘড়ি কিংবা মোবাইল নেই। আশপাশের বিছানায় সবাই ঘুমিয়ে। গ্রিল দিয়ে বাইরে আকাশ দেখে মনে হল ভোর। এই সময়টায় ভোরের আলো ফুটে যায় অনেক আগেই। ভোর চারটে কিংবা পাঁচটা হবে মনে হল। ঘুম ভাঙতেই আমি বুঝলাম, আজ পায়খানা হবে। আমার প্রস্তুত হওয়া উচিত। প্যাংক্রিয়াসের সমস্যায় নিয়মিত পায়খানা হয় না। এবারেই প্রায় ছ’-সাতদিন হয়নি। বাথরুমে পাশাপাশি চারটে পায়খানার দরজাই ভাঙা। ভাঙা দরজা ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে আড়াল করতে হয়। ইন্ডিয়ান টয়লেট এখানে সবগুলোই। এটা সার্জিক্যাল ওয়ার্ডের বাথরুম। অথচ এখানে একটাও কমোড নেই। হাত-পা ভাঙা পঙ্গু-আধপঙ্গু মানুষগুলো পায়খানায় বসতে পারে না। আমার মতো অনেককেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাগতে হয়। আর এসবের মধ্যে হাসপাতালের স্পিকারে রবীন্দ্রনাথের গান বাজতে থাকে— বড় আশা করে এসেছি গো। বাথরুমে একটা ছোট বালতিও পেয়ে গেলাম। এক সপ্তাহ পর অবশেষে পায়খানা হল। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসার সময় দু’বার পড়ে যাওয়ার উপক্রম হল। প্রথমবার বাঁচাল একটা দেওয়াল। ডান হাতে দেওয়ালটাকে ধরে বেঁচে গেলাম। দ্বিতীয়বার পড়ে যাচ্ছিলাম বারান্দায়। আমার ডান কাঁধটা শক্ত করে ধরে বাঁচালেন এক বয়স্ক মহিলা। বললেন, ‘হুইল চেয়ার নেওয়া লাগে। হাঁটেন ক্যান?’ বললাম, ‘কে টানবে হুইল চেয়ার?’ তিনি বললেন, ‘ক্যান? বউ।’ আমি অল্প হাসলাম তাঁর কথায়। জীবন বড় আশ্চর্যের। নদীর ওপার থেকে রামপ্রসাদ চেঁচিয়ে বলছেন, ডুব দে রে মন কালী বলে। এপার থেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে হাত নেড়ে বলছেন, আমি ডুবতে রাজি আছি। কে যে ডুববে কে জানে।

পাশের আই রুমে চারটে পাখা কাল সারাদিন মিছিমিছি ঘুরে গেছে। একটাও লোক নেই। আর এখানে বারান্দায় এক্সট্রা বেডে আমরা কতগুলো লোক ভ্যাপসা গরমে সেদ্ধ হচ্ছি। নার্সরমের পাশে বেড নম্বর এক্সট্রা ওয়ান, ওখানে একটা পাখা আছে। তারপর এদিকে আর একটাও পাখা নেই। এরপরে পাখা রয়েছে পুলিশ সেলের সামনে। বারান্দায় এই এক্সট্রা চারটে বিছানা আগে ছিল না। বোঝাই যাচ্ছে পরে এই চারটে বেড বসানো হয়েছে। সেজন্যেই এগুলোর নামের আগে ‘এক্সট্রা’। এর মধ্যে এক্সট্রা ওয়ান বাদে বাকিগুলোর মাথার ওপরে পাখা নেই। দিনে-রাতে গরম। রাতে প্রচণ্ড মশা। উলটো দিকে ট্রলি বে-তে রাখা নোংরা ফেলার বাক্স এবং তার পাশে চোখ অপারেশনের রুগিদের ঘর ও তাঁদের বাথরুম— এই দুয়ের ঝাঁঝালো গন্ধ; এসবের সঙ্গে বারান্দা দিয়ে দিন-রাত আসা-যাওয়া করা লোকজনের কথাবার্তা এবং পদশব্দ। রাতবিরেতে আসা গুরুতর রুগির আর্তনাদ, মেঝের ওপর দিয়ে ট্রলির চাকা ঘষে যাওয়ার ঘরঘর শব্দ, দূরের বারান্দা দিয়ে সেই শব্দ গুরুগুরু স্বরে ধীরে ধীরে কাছে এগুতে এগুতে একেবারে সামনে এসে বিরাট চেহারা নেয় এবং এরই সঙ্গে রুগির পরিজনদের চিন্তাগ্রস্ত ও উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বরের সমবেত ধ্বনি ও বিবিধ মোবাইল ফোনের বিচিত্র রিংটোন। সামনে পুলিশ সেলের উলটো দিকে পুলিশের থাকার ঘর। সেই ঘরের দরজার সামনে চেয়ার নিয়ে পাখার নীচে প্রায় সারারাত বসে থাকেন কর্তব্যরত পুলিশ। সেই পাখার হাওয়া আমাদের এদিক পর্যন্ত আসে না। শব্দ আসে। শব্দটা শুনে মনে হয় বুঝি বৃষ্টি নামল। গ্রিল দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি সত্যিই বৃষ্টি এল কিনা। আকাশের রঙে বোঝা যায় না পতনশীল বৃষ্টির জলরেখা। তখন বাইরে হাসপাতালের ছাদের ওপর থেকে ঝুলতে থাকা আলোটার দিকে চোখ ফেলি। আলোর সামনে দিয়ে জলের ধারাপাত দেখলে বুঝতে পারব বৃষ্টি নেমেছে কিনা। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বুঝি বৃষ্টি নেই। শুধু বৃষ্টির শব্দ তৈরি করেছে পুলিশ সেলের চলন্ত পাখা। পুলিশ সেলের দরজার সামনে চেয়ার নিয়ে রাতভর বসে থাকা কর্তব্যরত পুলিশের হাতের মোবাইল ফোনে ফুল ভলিউমে সারারাত চলতে থাকে হিন্দি সিনেমা— রাতের হাসপাতালের নৈঃশব্দ্য চিরে যে আওয়াজকে অডিটোরিয়ামের শব্দ বলে মনে হয়। আর এর সঙ্গে চলে ভুল বাংলায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নাগাড়ে ঘোষণা। ঘন ঘন ঘোষণা হয়, ‘হাসপাতালের সামনে অবৈধ গাড়ি পার্কিং করবেন না’। কথাটা ভুল। গাড়ি অবৈধ নয়। গাড়িগুলোর হয়ত বৈধ কাগজপত্র রয়েছে। পার্কিং অবৈধ। বলা উচিত— গাড়ির অবৈধ পার্কিং করবেন না। ‘হাসপাতালের সকল প্রকার কর্মচারীদের সাথে—’ ইত্যাদি ইত্যাদি। রাত দেড়টায় এই ঘোষণা কে শোনে কে জানে। একই বাক্যে একই বস্তু বা বিষয়ের জন্য দুবার বহুবচন বাংলা ভাষায় হয় না। কথাটা হবে— ‘সকল প্রকার কর্মচারীর সঙ্গে’। এবারেই একটা মজা আছে। ‘সকল প্রকার কর্মচারীদের সাথে’ সামথিং ‘ব্যবহার করুন’। নারীকণ্ঠে ওই সামথিংয়ের জায়গাটায় কী যে বলে—একবার মনে হয় বলছে ‘চন্দন ব্যবহার করুন’। একবার মনে হয়, ‘চনমনে ব্যবহার করুন’। আবার মনে হয় বলছে, ‘কন্ডোম ব্যবহার করুন’। ‘হাসপাতালের সকল প্রকার কর্মচারীদের সাথে কন্ডোম ব্যবহার করুন’— কী সাংঘাতিক। যদিও অবশ্যই এ কথা বলছে না যন্ত্রস্থ ওই নারীকণ্ঠ।
আগের দিন সন্ধেয় আমার ব্লাড রিপোর্টগুলো এসেছে শুনলাম। এদিন তাহলে সিটি স্ক্যান হওয়ার কথা। পুরনো লুঙ্গিটা ছেড়ে নতুন একটা লুঙ্গি পরলাম। শাদার ওপরে সরু নীল চেক। আগের লুঙ্গিটা ছোটমাসি দিয়েছিল। নতুন লুঙ্গিটা কাচা হয়নি বলে মাড় দেওয়া কাপড়ের মতো শক্ত হয়ে থাকল। আগের রাতে স্বপ্ন দেখলাম আমার বন্ধু স্বাগতা আর বেবিকে। স্বাগতার বাড়িতে ছাদের ঘরে (এটা কার বাড়ির ছাদ সেটা বুঝলাম না যদিও) ওর তিনটে বইয়ের পাণ্ডুলিপি পড়লাম। তিনটেই কম্পিউটারে কম্পোজ করে এ-ফোর মাপের কাগজে প্রিন্ট করে স্পাইরাল বাইন্ডিং করা। পাণ্ডুলিপি না বলে এগুলোকে প্রুফ কপিও বলা যায়। এর মধ্যে প্রথম দুটোতে স্বাগতা নিজের বাংলা কবিতার সঙ্গে সেগুলোর ইংরেজি অনুবাদও করেছে। লেখাগুলো টানা গদ্যের মতো রান অ্যান্ড কম্পোজে টাইপ করা, যেভাবে স্বাগতার বেশিরভাগ কবিতাগুলো লেখা। কয়েকটা লেখা দেখলাম তিন কলামে লেখা হয়েছে। তৃতীয় পাণ্ডুলিপিটা ফিল্মের চিত্রনাট্যের ভঙ্গিতে। একটা পাণ্ডুলিপিতে দেখলাম প্রিন্টার্স লাইনে কৃতজ্ঞতায় শ্রীজাতর নাম লেখা। স্বপ্নে লেখাগুলো, লেখার শিরোনামগুলো একদম স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। এতই স্পষ্ট যে ইংরেজি অনুবাদগুলো আমি কণ্ঠস্বর ব্যবহার করে জোরে জোরে উচ্চারণ করে পড়ছিলাম। তৃতীয় পাণ্ডুলিপিটার নাম, তার লেখাগুলো, বইটার ডিজাইন এত স্পষ্ট দেখছিলাম যে মনে হচ্ছিল এটা আমি কখনওই ভুলব না। এত স্পষ্ট জিনিস কখনও ভোলা যায় না। বুঝতে পারছিলাম আমি স্বপ্ন দেখছি— এবং স্বপ্নের ভেতরে ভাবছিলাম সকালে উঠে পাণ্ডুলিপির এই লেখাগুলো, বইয়ের নাম, লেখার শিরোনামগুলো— সব মনে থাকবে। সকালে উঠে আমি এসব লিখে রাখব। কিন্তু সকালে উঠে দেখলাম কিছুই মনে নেই। এত পরিষ্কার আর স্পষ্ট জিনিস কী করে ভুললাম কে জানে। স্বপ্নে যে দিনগুলোর ছবি দেখছিলাম, সেগুলো সেই সতেজ দিনের ছবি যখন দিনগুলো ছিল রোদ ঝলমলে, লাল মেঝের ঘর আর সতেজ বন্ধুত্বে ভরপুর।
‘এটা তুমি কী করলা বলো তো? কেন করলা এরকম আমার সঙ্গে?—’ জীবনে প্রথমবার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে বারান্দায় শুয়ে চ্যানেলের জন্য জেলকো নিডলের ভেইনে ঢোকার যন্ত্রণার দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে সিস্টারকে এই প্রশ্ন করল জহিরুল মিঞা ওরফে কানু মিঞা। কানু মিঞা আমার পরের বিছানা এক্সট্রা থ্রিয়ের নতুন রুগি। জহিরুল ওরফের কানুর বয়স ৪০। পরিশ্রমী চেহারা। কাঁধ, বাহু, ছাতি, পেট, কোমর ও পিঠের মাংসপেশিগুলো সুগঠিত। কানু সিমেন্টের দোকানে ভ্যানচালক। চুল ছোট করে ছাঁটা, গোঁফ সরু। বাড়ি দিনহাটা রোডে চার নম্বর অঞ্চলে। রোজ সকালে সাইকেল নিয়ে নৌকো করে ঘাট পেরিয়ে কালীঘাটের ঘাটে নেমে শক্তি সংঘের সামনে সিমেন্টের দোকানে চলে আসে কানু। বাড়িতে দুই ছেলে, বড় ছেলের বউ আর কানুর মা আছে। এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। হাসপাতালে কানুর সঙ্গে রয়েছে তার মা। মায়ের বয়স দেখে মনে হয় ৬০-৬৫। আগের রাতে কানুর মায়ের থেকে চেয়ে ডিমের ঝোল, ভাত, আলুভাজা খেলাম। অপূর্ব রান্না। কানুর মা বললেন, ছেলের ঘরের নাতির বউ রান্না করেছে। কানুর পাড়ায় এক বাড়িতে প্রতি রবিবার সকাল থেকে গরু কাটা হয়। আমি ঠিকানা জেনে নিলাম। মালদায় মীরচক, কলকাতায় পার্ক সার্কাস আর মীর্জা গালিব স্ট্রিট ছিল আমার গরুর মাংসের ঠিকানা। এখানে গরু পেতে হলে যেতে হবে শুটকাবাড়ি। বহুদূর। কানুর বাড়ি চার নম্বরে। স্টেশন মোড় থেকে দিনহাটার বাস ধরে অল্প সময়েই নিয়ে আসা যাবে।
বিকেল চারটে নাগাদ উলটো দিকের বারান্দা দিয়ে সুন্দরী নার্স আরও কয়েকজন নার্সের সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন দেখলাম। কতগুলো মেয়ের কলকল শব্দ শুনে আমি ঘাড় ঘোরালাম। উলটো দিকের বারান্দা ধরে চলে যাওয়া মেয়েগুলোর মধ্যে একজনের খোঁপা দেখে বুঝলাম ওদের মধ্যে ইনিই তিনি। চলে গেলেন, কিন্তু দেখা করে গেলেন না।
রাত ৮টায় তিনি এলেন। নিঃসঙ্গ অন্ধকার সুড়ঙ্গের কাছে যেভাবে মানুষ টর্চের আলো নিয়ে আসে— সেইভাবে তাঁর এই আসা। কলাপাতা রঙের সালোয়ার পরে সামনের টানা বারান্দা দিয়ে আমার সামনে যখন তিনি এলেন, জিজ্ঞেস করলাম— ‘অসময়ে?’
‘ঘুরতে,’ তিনি বললেন, ‘এটা তো সেকেন্ড হোম।’ বলে অদৃশ্য হয়ে গেলেন নার্সরুমের ভেতরে। এক ঘণ্টা পর, রাত ৯টায় ফিরে যাওয়ার সময়, এবারে আর বিকেলের মতো উলটো দিকের বারান্দা দিয়ে নয়— যেতে যেতে বললেন, ‘চলি।’
‘আপনি যাচ্ছেন কবে?’ অসমাপ্ত এক কথোপকথনের অবশিষ্ট অংশের মতো আমি বললাম। যেন শেষ না হওয়া একটি কথা বাকি ছিল, সেটাই আমি বলছি তাঁকে।
যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে অল্প ঘুরে তিনি বললেন, ‘রিলিজ দিক আগে। ১৫-এর মধ্যে আশা করি।’
‘এই ১৫?’ অন্য কিছু একটা চিন্তা করতে করতে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম। তখন আমি চিন্তা করছিলাম, ওঁর নাম জিজ্ঞেস করব কিনা। ওঁকে চোখের ইশারায় একটু আমার কাছে এগিয়ে আসতে বলব কিনা। পরের বার আমি এই হাসপাতালে এলে ওঁর দেখা পাব না— এই কথা মনে করিয়ে দেব কিনা। ’১৫-এর মধ্যে’ চলে যাওয়ার আগে একদিন আমার আপ্যায়নে ফেয়ারওয়েল পার্টিতে আসবেন কিনা শুধুই আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করার জন্যে। কিন্তু এসব কিছুই জিজ্ঞেস না করে আমি বললাম, ‘এই ১৫?’
‘এই ১৫।’ তিনি বললেন। তারপর বললেন, ‘চলি।’ আমি ওভাবেই ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে একটু উদ্বেগে মাথা নাড়লাম— যেভাবে কেউ যেতে চাইলে আমরা অল্প মাথা নেড়ে প্রত্যাশাহীনভাবে অস্ফুটে তাকে বলি, ‘আচ্ছা।’ এখন কেমন আছি, এ কথা তিনি আমায় সচরাচর জিজ্ঞেস করেন না। এদিনও করলেন না। অনেকে হয়ত ভাববে, এ তার নিষ্ঠুরতা। এ তার উদাসীনতা। কিন্তু তা নয়। উনকো দেখে সে যো আ যাতি হ্যায় মুহ্পর রওনক, ওহ্ সমঝতে হ্যায় কি বিমার কা হাল অচ্ছা হ্যায়। গালিব বলেছিলেন। তাকে দেখে আমার মুখে যে আলো ফুটে ওঠে, তাই দেখে সে মনে করে রুগির অবস্থা এখন বেশ ভালোই।
পরের দিনটা আমি শুরু করলাম জনৈকা সিস্টারের প্রশ্নের উত্তরে। অল্প বয়েসি সেই সিস্টার, যার মধ্যে একটু শিশুভাব এখনও রয়েছে, আমার ব্লাড প্রেশার মাপতে মাপতে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার প্রিয় উপন্যাসিক কে?’ এক মুহূর্তও দেরি না করে আমি বললাম, ‘আমি নিজে।’
সন্ধের পর থেকে প্যাংক্রিয়াসে যন্ত্রণা শুরু হল। আলট্রাসেট খেলাম। কাজ হল না। নার্সরুমে গেলাম। দুজন নেপালি সিস্টার ছিলেন। ‘সিস্টার’, আমি বললাম, ‘পেইন হচ্ছে খুব। ইনজেকশন দিলে ভালো হয়।’ রোগা চেহারার নেপালি নার্স বললেন, ‘আপনি বেডে যান। যাচ্ছি।’ আমি যখন ‘সিস্টার’ বলে ডাকলাম তখন আরেক নেপালি সিস্টার, যিনি স্থূলকায়া, তিনি বিরক্তিভরা মুখে নাক-ঠোঁট কুঁচকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। ফিরে এসে আমি আমার বিছানায় শুয়েই আছি। গরমে ঘামে চুপসে গেছি। তার মধ্যে চরচর করে যন্ত্রণা বাড়ছে। একটু পরে সেই দুই নেপালি নার্স নার্সের পোশাক ছেড়ে সাধারণ পোশাকে আমার বেডের সামনে দিয়ে বারান্দা ধরে বাড়ি চলে গেলেন। যেতে যেতে রোগা চেহারার সেই নেপালি নার্স বললেন, ‘দাদা, আসতেছে, হ্যাঁ?’ আমি উঠে নার্সরুমে গিয়ে দেখলাম সেখানে কেউ নেই। মেল সার্জিক্যাল ওয়ার্ড সেই মুহূর্তে নার্স শূন্য।
ইউএসজি গাইডেড এন্ডোস্কপির জন্য এরা আমাকে সেদিন রাতে ওটি-তে নিল। এন্ডোস্কপি হয়ে যাওয়ার পর প্রায় ঘণ্টা দেড়েক জ্ঞান নেই আমার। ট্রলিতে শুইয়ে ওটি থেকে বের করে বেডে দিয়ে গেছে আমাকে। ঘুম যখন অল্প অল্প করে ভাঙছে, সেই আধোচেতনের টলমল জায়গায় আমি আমার এক্স, শাহানাকে ফোন করে বসলাম। এ অনেকগুলো বছরের পর করা একটা ফোন। আমাদের চেতন, অবচেতনের আরও অনেক গভীরে কোন নির্জ্ঞানে কী সংকেত যে চুপ করে মাথা নীচু করে দীর্ঘকাল বসে থাকে। সেখানে আমাদের মধ্যে কারুর কারুর ছেলেবেলা আর ফুরোতেই চায় না। বেলা যায়, বেলা যায়। তবু সে খেলে বেড়ায় মাঠে, বনে, ঝোপে। সন্ধ্যার শাঁখ বাজে। মাগরেবের আজান হয়। তবু সে ঘরে ফেরে না। ঘটাং ঘট ঘটাং ঘট করে টিউকল পাম্প করে হড়হড় করে নেমে আসা জলে হাত-পা ধুয়ে পড়তে বসে না। বেলা যায়, বেলা যায়। কারুর কারুর ছেলেবেলা তবু ফুরোতেই চায় না। বেলা যায়। কেউ কেউ ফিরেও আসে না। কী করে যে মাথার ভেতর একেকটা স্মৃতি বহুকাল ঘুমিয়ে থাকার পর হঠাৎ নড়েচড়ে উঠে আড়মোড়া ভাঙে, আঙুল ফোটায় মটমট করে। অ্যানাস্থেশিয়ার রেশ তখনও পুরো কাটেনি, আমি তন্দ্রা অঞ্চল থেকে ডায়াল করলাম শাহানার নম্বর। যে নম্বর আমি বহুদিন বহুবার মনে করার চেষ্টা করেও মনে করতে পারিনি, সেই নম্বর আমার মনে পড়ল অ্যানাস্থেশিয়ার এক অন্য জগতের ঘুমে-জাগরণে— মনে পড়ল এমনভাবে যেভাবে জাতিস্মরের মনে হঠাৎ আসে বিগত জন্মের স্মৃতি।

(ক্রমশ)

লেখাটি যদি ভালো লাগে, আবহমানে নিজের ইচ্ছেমতো ফোন পের মাধ্যমে
অবদান রাখতে পারেন, এই কিউ আর কোড স্ক্যান করে
পেমেন্টের লিংক

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes