মাটির তলায় চাপা পড়া গ্রামগুলির কান্না
রণজিৎ অধিকারী

মানব চক্রবর্তীর সাম্প্রতিক উপন্যাস “ম্যাজিক ইনগট”-এর আলোচনা

সম্প্রতি মানব চক্রবর্তীর “ম্যাজিক ইনগট” উপন্যাসটি পড়তে বসে এক নতুন অভিজ্ঞতা হল। কত কত উপন্যাস পড়েছি কিন্তু কখনো এমন হয়নি। ২০১৯-এর জুলাই আগস্টের সেই বর্ষার দিনগুলিতে মানব দা প্রায়ই ফোন করতে লাগলেন —যে তাঁর প্রকাশিতব্য উপন্যাসের প্রচ্ছদ এঁকে দেওয়ার জন্য যেন হিরণ মিত্রকে বলি এবং তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করি।হিরণ দা রাজি হলেন কিন্তু কোনোমতেই ডেট মিলছিল না। সেপ্টেম্বরের কোনো একটা দিন ঠিক হল, ভেস্তে গেল, আবার অন্য দিন ঠিক হল। তো এক দারুণ অভিজ্ঞতা শিল্পীর বাড়িতে বসে… লেখক তাঁর উপন্যাসের কাহিনি বলে যাচ্ছেন, মাঝেমাঝে হিরণ দা-ও কথা বলছেন ইনগট বিষয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা… আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছি। তারপর তো প্রচ্ছদ আঁকা হল, অসাধারণ সে প্রচ্ছদ, বই বেরোল। নতুন করে উপন্যাসটি পড়তে পড়তে সেইসব কথা মনে পড়ল।
মানব চক্রবর্তী কতদিন ধরেই “পূর্ব”-এ লিখছেন ; নাজু পাউরিয়া-র মতো অসামান্য গল্প, হল্ট স্টেশন-এর মতো ভ্রমণ অভিজ্ঞতা অবলম্বনে লেখা ধারাবাহিক। বাংলা কথাসাহিত্যে তাঁর স্থান চিহ্নিত হয়ে গেছে আগেই। তবে তাঁর এই নতুন উপন্যাস ” ম্যাজিক ইনগট”-এর মূল্য ভিন্নভাবে বিচারের যোগ্য।
অভিজ্ঞতানির্ভর উপন্যাস রচনার যে ধারা তার সূত্রপাত তারাশঙ্করে। কোনো একটি বিশেষ অঞ্চলের মানুষজনের জীবন চর্যা, তাদের নানা বাস্তব সমস্যাকে অবলম্বন করে বাংলা ভাষায় কম উপন্যাস লেখা হয়নি। সেই ধারার উপন্যাস হয়েও “ম্যাজিক ইনগট” কোথায় স্বতন্ত্র! বিস্তারে বলা উচিত।
আধুনিক সভ্যতার ধারক যে শিল্প কারখানা ইন্ডাস্ট্রি —সেই ইন্ডাস্ট্রির প্রধানতম এক ব্যক্তি কর্ণপুর স্টিল প্ল্যান্টের জি.এম নীলকান্ত রথের ফর্মুলা হল, আগে ইন্ডাস্ট্রি, তারপর মানুষ, তারপর নেচার। ঠিক এই কথাটি এই উপন্যাসের বীজবাক্য যেন। এর উল্টোদিকের কথাটা হল —একটা পূর্ণাঙ্গ ইস্পাত শিল্প গড়ে তোলা ও সম্প্রসারণের জন্য কত কত গ্রাম অরণ্য ধ্বংস হয়ে গেছে। আর সেই মানুষগুলো ঠাঁইনাড়া হতে হতে ধুঁকছে, মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে নতুন আগ্রাসী সভ্যতার সঙ্গে। ভুলে যাচ্ছে তাদের স্বাভাবিক উদার মুক্তজীবন।
ইন্ডাস্ট্রির ঝলমলে জীবন, স্বাচ্ছন্দ্য, বিলাসবহুল জীবনের নিচে কত গ্রাম সাঁতলিডাঙ্গাল, বুড়াহাটি, নাদাশোল… মাটির তলায় চাপা পড়া গ্রামগুলোর কান্না। মাটির তলা থেকে মরা মানুষের দল উঠে আসতে চায়।
এই উপন্যাসের বেশ কয়েকটি স্তর আছে। দলিত আদিবাসী মানুষগুলো ছাড়া ইন্ডাস্ট্রি অচল অথচ তারাই গৃহছাড়া, তাদের বাসস্থান উধাও করেই গড়ে উঠেছে দৈত্যের মতো শিল্পাঞ্চল। জোসেফ লাকড়া ইন্ডাস্ট্রির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হয়েও সে যেন মনে মনে দলিত সমাজের প্রতিনিধি আর তার স্ত্রী গোয়ানিজ লোরা আধুনিক বিলাসী সভ্যতার প্রতিনিধি। উপন্যাসের গঠনকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে যখন লৌহ ইনগটগুলো পরস্পর কথা বলে ওঠে, প্রতিবাদ করতে চায়, তারাও যেন বঞ্চিত দলিতদের মুখপাত্র হয়ে ওঠে। সেইসঙ্গে উপন্যাসে এসেছে ইন্ডাস্ট্রির কর্মকর্তা কর্মচারীদের মধ্যে পারস্পরিক ঈর্ষা হিংসা, এ ওকে ঠেলে ওপরে ওঠার চেষ্টা …।
কর্ণপুর স্টিল প্ল্যান্টের বাতিল হয়ে যাওয়া ইনগট বা লৌহপিণ্ডের জঙ্গল ; সাপ নানারকম বিষাক্ত পোকামাকড় বুনো বেড়াল ইঁদুর শেয়াল ইত্যাদি প্রাণীর নিশ্চিন্ত আশ্রয়স্থল ঐ স্টক ইয়ার্ড। ব্লাস্ট-ফার্নেসের ইনচার্জ জোসেফ লাকড়া একে বলে ইনগট কমিউনিটি। লাকড়া রিপোর্ট তৈরি করতে গিয়ে টের পেয়েছিল যে ওই নিষ্প্রাণ লৌহপিণ্ডরা কথা বলে, অভিযোগ জানায়, ক্ষোভে ফেটে পড়তে চায়। জি.এম নীলকান্ত রথের নির্দেশে লাকড়া এই ইনগটের একটা সার্ভে রিপোর্ট করতে গিয়ে জানতে পারে —বড়ো বড়ো রাঘব বোয়ালের গোপন ষড়যন্ত্রে ইনগট পাচার হয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেক ইনগটের গায়ে নাম্বার দেওয়া ; এমনই এক ইনগট যার নাম্বার এন ৩১, তার বয়ান —”আমি এন থার্টিওয়ান, ডেট অফ বার্থ ২০০১, ১৭ই জুন দুপুর দেড়টায়। প্লেস অফ বার্থ, তিন নম্বর ফার্নেস। জন্ম হয়েছিল আয়রন মেকার রামালু রেড্ডির হাতে।… ”
এই ইনগটের কাছেই লাকড়া জানতে পারে রথের লকারেই আছে ইনগট বিক্রির টাকা। এবং এই এন থার্টিওয়ান লাকড়ার ওপর পড়লে তার ভয়ংকর চাপে পিষ্ট হয়ে তার শরীর মাটির গভীরে ঢুকে যায়। লাকড়ার মৃত্যুর এমন মর্মান্তিক ঘটনায় উপন্যাস শেষ হয়। ইনগটদের সমবেত ক্রোধ যেন আছড়ে পড়ল সবুজ ধ্বংসকারী ইন্ডাস্ট্রির এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ওপর।
উপন্যাস শেষ হয় এক অন্য ইঙ্গিত রেখে। পাঁচফুট গভীরে ঢুকে যাওয়া লাকড়ার দেহ তোলার সময় সেখান থেকে বেরোয় —”উঠে এল কয়েকদশক আগের রূপোর মল, তোবড়ানো ধাতব ডেকচি ও কড়াই, থালাবাটির সঙ্গে কোন সুদূর অতীতে উৎখাত হওয়া এক গ্রামের প্রায় ধ্বংস সংস্কৃতি সভ্যতার ক্ষীয়মান আলোর মতো একটা পিতলের প্রদীপদানি।”
অর্থাৎ আধুনিক যন্ত্র সভ্যতার নিচে চাপা পড়ে যাওয়া মৃত পুরনো সভ্যতা —যা ভারতবর্ষের প্রকৃত সভ্যতা… যেন একটা সংঘাত —প্রাচীন আর নবীন, অরণ্যবাসী ও বিলাসী আধুনিক সভ্যতার চিরকালীন দ্বন্দ্ব। ইনগটগুলো যেন প্রতীকী —তারা এই অপরাধকে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি আর লোভকে উন্মুক্ত করতে সাহায্য করেছে। তাদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বেচারা লাকড়ার জীবন কেড়ে নিল।সেও তো হেরে যাওয়া সভ্যতারই প্রতিনিধি ছিল। তার মানে কি জিতে গেল আলোময় কৃত্রিম সভ্যতা?
তার ইঙ্গিতও দিয়েছেন লেখক ভিন্ন এক স্তরে।
স্টিল প্ল্যান্টের স্ল্যাগ জমে পাহাড় হয়, স্ল্যাগের পাহাড় এগোতে এগোতে গ্রাম গ্রাস করতে থাকে। এগিয়ে যায় দামোদর পর্যন্ত। তাহলে বাকি গ্রামগুলোও ধীরে ধীরে উঠে যাবে! অবশ্য বুলডোজারের নিচে চাপা পড়ে মৃত চরণ বাস্কে স্বপ্নে এসে ধনু বাস্কে-কে বলে, গ্রাম মরে না।
একজন মানুষ বেঁচে থাকলেও গ্রাম বেঁচে থাকে। “গাঁয়ের বিত্তান্ত তুমি বুঝ না ধনু। মানুষ হল গা বীজ… একটা থিকেই শয়ে… শয়ে… ”
তবে কি লোরাই জিতে গেল? সে লাকড়ার মধ্যে দেখতে পেত এক বুনো ট্রাইবাল মোষকে। সে চায় না তার গর্ভে আসা সন্তান লাকড়ার মতো হোক।
এইসব নানা জটিল স্তর উপন্যাসটিকে উঁচুমানের করেছে যেমন, তেমনই বাংলা উপন্যাসের সীমানাকে বিস্তৃত করে দিয়েছে। লেখক উপন্যাসটি শেষ করেছেন দারুণ এক জায়গায়।
“দিনকয় পরেই সব স্বাভাবিক। সেই ঢালাই সেই ল্যাডেল সেই কোলাহল। কালি কয়লা ধোঁয়া আর লোকোর চলমান শব্দ। লাইনে মাঝরাতে লোকো নিয়ে স্ল্যাগ-ব্যাঙ্ক যাওয়ার পথে একদিন এক ড্রাইভার নাকি জোসেফের ভূত দেখেছে। রেললাইনের মাঝে দু’হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে।… আগেও দেখত। কখনো সাঁতলিডাঙ্গালের ভুজঙ্গ তাঁতি, পঞ্চম তাঁতি, কখনো নাদাশোলের চরণ। কখনো বা বুড়াহাটির কোন প্রান্তজ ভিটেখোয়ানো প্রতিবাদী।” আসলে ইনগটের কথা বলতে বলতে লেখক কখন যেন এক সভ্যতার ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড় করিয়ে দেন পাঠককে। এখানেই লেখক মানব চক্রবর্তীর মুন্সিয়ানা।
এই উপন্যাস শুধু বাংলা নয় আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে রচিত এক সৃষ্টি। লেখকের ম্যাজিক কলম বহুদিন ধরেই আদিবাসী সাঁওতাল দলিতদের নিয়ে লিখে চলেছে একের পর এক উপন্যাস। একদিন কলকাতার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মানব দা বললেন, রণজিৎ জানো? সাঁওতালদের মধ্যেও কত শ্রেণি আছে? ক’জন জানে? ঐ যে পাউরিয়া… ওরা তো সাঁওতাল সমাজ থেকে বিচ্যুত, ওদের নিয়েই পরের উপন্যাসটা লিখব।
আমরা মানব দা-র সেই নতুন উপন্যাসের অপেক্ষায় থাকলাম।

★”ম্যাজিক ইনগট” / মানব চক্রবর্তী / প্রচ্ছদ —হিরণ মিত্র / প্রকাশক —এবং মুশায়েরা / মূল্য —৩৫০ টাকা

CATEGORIES
TAGS
Share This
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes