
গেরিট এঙ্গেলকে-র কবিতা
অনুবাদ ও ভূমিকা- হিন্দোল ভট্টাচার্য
যখন ইউক্রেনে ভয়ংকর যুদ্ধ, সে সময় এই কবির কবিতা পড়া এক অন্যরকম অনুভূতির জন্ম দেয়। গেরিট এঙ্গেলকে (১৮৯০-১৯১৮)। যাঁকে বলা হয় জার্মান উইলফ্রেড আওয়েন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়েই এই কবিতাগুলি লেখা। কিন্তু তার পরের বিশ্বযুদ্ধ এবং তার পরের সমস্ত যুদ্ধের ক্ষেত্রেই এই কবিতাগুলি সত্য। আওয়েনের মতোই যুদ্ধের শেষ তিনিও দেখে যেতে পারেননি। The German Poets of the First World War (1985). বইটিতে তাঁর বেশ কিছু কবিতার ইংরেজি অনুবাদ পাওয়া যায়। এছাড়াও পাওয়া যায় মডার্ন জার্মান পোয়েট্রির জার্মান ভাষার সংকলনে। এখানে তাঁর বইটির দশটি কবিতার অনুবাদ রাখা হল। পরবর্তীকালে আরও কিছু কবিতার অনুবাদ করার ইচ্ছে রইল। - হিন্দোল ভট্টাচার্য
যুদ্ধ
শববাহকেরা, এগিয়ে এসো, আমাদের শৈশব এখানে কবর দেওয়া আছে
কাঁচা কবর, এখনও হাত ডুবিয়ে স্বপ্নের স্পন্দন টের পাবে
টের পাবে এককালে দেখা কুয়াশায় পরীদের গল্প, ইস্কুলপালানো মাঠেদের বুকে
এক আকাশ শুয়ে থাকার সেই সব মুহূর্তগুলোকে
শববাহকেরা, এগিয়ে এসো, তুলে নাও একখানি স্বপ্ন যা
আমাদের মায়েদের চোখে ধরা পড়েছিল
আমাদের সেই সব ছোটো ছোটো ঘরে যখন বরফ পড়ত
আমরা ভাবতাম এবার যুদ্ধ থেকে যাবে
শববাহকেরা, এগিয়ে এসো্, আমরাও একদিন এভাবেই
মাটি খুঁড়ে দেখে নিয়েছি
কতটা মাংসের পর স্বপ্নগুলি সুরক্ষিত থাকে
বডি
আমরা পাচার করছি বোমায় বিধ্বস্ত গাছ, হাড়, মাংস, সংসার
আমাদের কাইজার নেই
আমাদের জার্মানি নেই
একটা মৃত দেশের কাছে মুখ গুঁজে আছে আরও কয়েকটা মৃত দেশ
আমাদের কাঁটাতারও নেই
অথচ এককালে আমরা
একটি বুলেট নিয়ে ছুটে গেছি শত্রুদের শিবিরের দিকে
তাদের বন্দুকগুলো পড়েছিল মিয়োনো সভ্যতার মতো
আমাদের কারো কোনও দেশ নেই
আমরা পাচার করছি
আর কখন
তুমিও কবর থেকে উঠে পড়ে হো হো করে হেসে বলছ
শত্রু-মিত্র খেলা শেষ হয়ে গেলে পড়ে থাকে মৃতদেহ
বুলেট
সেই যে একটা বিন্দু ছুটে এলো অন্ধকার থেকে
সেই যে একটা বিন্দু ছুটে এলো আলো থেকে
সেই যে একটা বিন্দু ছুটে এলো ইতিহাস থেকে
সেই যে একটা বিন্দু ছুটে এলো শস্যক্ষেত থেকে
সেই যে একটা বিন্দু ছুটে এলো বাঙ্কার থেকে
সেই যে একটা বিন্দু ছুটে এলো বেশ্যালয় থেকে
সেই যে একটা বিন্দু ছুটে এলো সীমান্ত থেকে
সেই যে একটা বিন্দু ছুটে এলো দেশপ্রেম থেকে
আমি তার কিছুই বুঝতে পারলাম না
শুধু একটা চিনচিনে ব্যথা
আর তার পর মায়ের মুখ কিছুক্ষণের জন্য
পেটের তলপেটে ব্যথা
তার পর সাড়হীন
সেই যে একটা বিন্দু ছুটে এলো সভ্যতা থেকে…
ওয়াশিং মেশিন
আর কত পরিষ্কার করব, ও বন্ধু, আমাকে বোঝাও
আর কত পরিষ্কার করলে এই দাগ মুছে যাবে
তুমিও জানবে না আমি তোমাকেই হত্যা করেছি
আমিও জানব না তুমি আমাকেই হনন করেছ
আর কত পরিষ্কার করব, ও বন্ধু, আমাকে জানাও
আর কত আর কত আর কত ব্যথা পেলে ব্যথা মুছে যাবে
ফায়ার
যেই বললে, ‘ফায়ার’, আমি দেখলাম গর্জন করে উঠল আমার বন্দুক
কাঁধে সেই হত্যার ধাক্কা লাগল জোরে
আমি পিছিয়ে গেলাম
আমার সঙ্গে সঙ্গে পিছিয়ে গেল দু হাজার বছরের সভ্যতা
যেই বললে ‘ফায়ার’, আমি দেখলাম
এ আগুনে আলো নেই
শুধুই হিংসা পড়ে আছে।
দোস্তি
আমার দিকে চোখ টিপে সে বোঝাল, আমি তার কেউ।
আমিও চোখ টিপে বোঝালাম ইঙ্গিত আমিও বুঝি।
তার পর একটা কবর খুঁড়তে লাগলাম
সেও হয়তো।
আমাদের মাঝখানে অহঙ্কার করতে করতে এগিয়ে এলো
একটি মানবতাবাদী ট্যাঙ্ক।
ঢুকে পড়লাম কবরে।
সেও, কথামতোই, এখনো ঘুমোচ্ছে।
উইচ
তুমি বলবে, যুদ্ধ নেই। আমি বলব, দেশ নেই।
তুমি বলবে যুদ্ধ আছে। আমি বলব, উঠে পড়ো।
কবর ছাড়াও আরও যাওয়ার জায়গা আছে মানুষের।
এই ধরো গোধূলির আলোয় নদীর ধারে, কিংবা পানশালায়
অথবা যেখানে মেলা বসে, গান গাওয়া হয়
প্রথম ট্রেন ছাড়ে এমন কোনও স্টেশন।
তুমি বলবে এত শান্তি পৃথিবীতে ছিল না।
আমি বলব, এত শান্তি পৃথিবীতে আসবে না কখনও।
ধর্ম
আজও কোথা থেকে যেন চার্চসঙ্গীত ভেসে আসে এই অবেলায়
যখন মাথার উপর চক্কর কাটছে দেশপ্রেম
তোমাদের মৃত্যু নেই সৈন্যদল, তোমরা জম্বির মতো
উঠে পড়ে আবার যুদ্ধ করবে
ড্রাকুলার মতো শত্রুপক্ষের রক্তমাংস খেতেই জন্ম নিয়েছ’
তার পর রয়েছেই শান্তির কবর। তোমরা শুয়ে পড়বে ক্লান্ত হলে।
আমরা জল ছিটাবো। ফুল দেব। আর বলব, শহিদ।
সান্ত্বনা
যে সব দেশে যুদ্ধ হয়নি, সে সব দেশে সৈন্যদল
গাছ লাগাক।
ঘরে ঘরে পৌঁছে দিক সূর্যোদয়।
শহিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
মানুষ হলেই
এ পৃথিবী কৃতজ্ঞ থাকবে।
সাবধান
আমরা আর এক পাও এগোতে পারব না জেনারেল, এ সুযোগ ছাড়ব না আমরা
এইবার আমরা পালিয়ে যাব। যুদ্ধ থেকে মানবতাবাদের দিকে।
দেশ থেকে পালিয়ে যাব দেশের মানুষের কাছে।
আর একটাও বুলেট খরচ করব না হে নেতা
এইবার আমরা পালিয়ে যাব
হিংসা থেকে ভালোবাসার দিকে।
তোমার আপত্তি থাকলে
এ নিয়ে একটা মহাযুদ্ধ হতেই পারে।
আমরা প্রস্তুত।
মূল কবিতাগুলো পড়া নেই, তাই অনুবাদ নয় কবিতা হিসাবেই পড়লাম। আরও পড়তে চাই।