ছোটবেলা, কৈশোর – এই শব্দ দুটোর মধ্যে এমন এক ইতিহাস লুকিয়ে আছে যেখানে শুধুই রহস্য। বাস্তবতার আলপনা তো বর্তমান আঁকে আমাদের জীবনে উপর। আমিও ছোটবেলার দিকে আবার ফিরে তাকালাম একটা বই হাতে নিয়ে। একান্ত আমার তারুণ্য কৈশোর যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে বইটা প্রতিটি অক্ষর থেকে। সেই সুরম্য অতীত যেন বলছে,”কতদিন আমার কথা ভাবিস না তুই! একদম ভুলেই কি গেলি সেই সব সময়?” আশ্চর্য – আমার দিনগুলো কেন ফিরে আসছে এই বইটার থেকে! কেন আমার চোখে জল এসে যাচ্ছে বরবিলের এক কিশোরের কথা পড়তে পড়তে – সেই কিশোর কেন আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমার পুরোনো ভাড়া বাড়ি পেয়ারাবাগানের কাছে। বিবেকানন্দ সংসদ মাঠের গোলপোস্টের মাঝে আবার আমি দেখতে পাচ্ছি তীরবেগে ফুটবল এগিয়ে আসছে – হঠাৎ আকাশ কালো করে বৃষ্টি। এএএএবাবা আমার কথা শুনিয়ে যাচ্ছি, বরং শুনুন বইটার নাম – ‘মরা আলোর সিম্ফনি’, লিখেছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য।
‘চিন্তা’ বেশ চিন্তা করেই এমন এক বিরল গদ্য সিরিজের বই করেছেন। বিরল বললাম কেন জানেন? আসলে বইটা না একজন অনির্বাণ লেখেননি, লিখেছেন – কিশোর, তরুণ, যৌবনদীপ্ত, আবেগঘন পিতা, খেলা পাগল, একাকি, দগ্ধ অনির্বাণ। একে কি আমরা বলতে পারি গদ্যের বিল্ডাংরোমান?
মোট উনত্রিশ টি গদ্য এই বইতে আছে। এই সবকটি গদ্যের মধ্যে এমন একটা সময়যান তৈরি করা আছে যা অনায়াসে পাড়ি দিতে পারে আমাদের সাম্প্রতিক সময় থেকে ফেলে আসা সময়ের সবুজ মাঠে। কোনও গভীর কথা খুব ভারি জটিল ভাবে বলতে হয় না, সে কথা নদীর মতো, প্রশ্বাস বাযুর মতো তার যাতায়াত।
জীবনের কথাগুলো এই জটিল পৃথিবীতে যখন কেউ এত আবেগে ভর করে বলে তখন খুব আদর করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয়।
‘মরা আলোর’ রঙ মাখতে মাখতে গতকাল রাতে হঠাৎ দেখি স্বপ্নের পথে হাঁটছি এক নতুন দেশে। যে দেশ আমার চেনা। দেখলাম, বারবিল থেকে এক বিস্ময় বালক অনেকটা পথ ছুটে আসছে। তার হাতে কলম, কলমের শিরায় শিরায় ছিটকে আসছে বিশ্বাসের আলো।
“মায়ের থেকে সব শুনে, অদ্ভুত একটা স্মিত হাসি হেসে, বললেন মা’কে বাইরে বসতে, করিডরের কাঠের বেঞ্চে ।” (পৃ ১৯-২০)
মৃত্যুর সঙ্গে লড়ই করা বাবার জন্য সেই কিশোরের চোখে ভয়, আবার দেখতে পাচ্ছি মায়ের সঙ্গে লেপ্টে থেকে কিভাবে খুঁজে নিচ্ছে দৃপ্ততার হৃৎস্পন্দন। এই বিশ্বাসে ভর করেই কোথাও যেন সে জীবন আর রাহুল দ্রাবিডের একটা হেরে যাওয়া ইনিংসকে একক বিন্দুতে দাঁড় করিয়ে দিতে প্রস্তুত হচ্ছে। লীলা মজুমদার তাই হয়তো সেই বালককে বলে – “সারা জীবনের জন্য কেউই তো মুছে যায় না গো, কখনওই অজস্র ফাঁকা, শূন্য নির্মিত হয় না সেখানে। সব্বাই থেকে যায় ‘নেই’ হয়ে।”( পৃ-২৫) পৃথিবীতে এই বিশ্বাস, এই প্যন্ডোরার বাক্সটা আজও আছে ওই বালকের কাছে যে হয়তো এখন বাবা হয়ে মেয়েকে এই সমস্ত কথন উচ্চারণ করে। স্পষ্ট। প্রফেসর শঙ্কু হয়ে এলভিস প্রেসলির গল্প আর গানের সুরে, সমস্ত অন্ধকার পৃথিবীর বিরুদ্ধে সেই কিশোরের বিশ্বাসের প্রতি ভালোবাসায় কিভাবে যেন হেঁটে চলেছি আমিও …………………….একি সকাল হয়ে গেছে
বইয়ের পাতা উড়ছে ………….. চাযে চুমুক দিলাম ..আহহ
আহহা কি আরামে এই বই পড়ছি, আসুন একটু আপনাদেরও শোনাই, যেন শব্দ খোদাই করেছে স্নায়ুর রঙ দিয়ে –
“অপুকে যেন দুর্গা ওই কদিনই বড়ো হওয়ার পথ দেখাচ্ছিল। ওই যে পেছন পেছন আয়…বাঁশবন , ঝোপঝাড, আম-কাঁঠাল বাগান মুহূর্তে অতিক্রমিযে দুর্গা,অপুকে উৎসস্থলের সমস্ত জিযোগ্রাফি ধরাচ্ছিল যেন।”( পৃ ৪৭)
“ওই বসুশ্রীতে যাঁরা উত্তমের ছুঁয়ে যাওয়া সিটে হাজার সুযোগ ও প্রাণপণ ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বসেননি, ক্ষান্ত থেকেছেন জাস্ট মায়া-ঘ্রাণ নিয়েই, ইচ্ছে যখন হয়েছে প্রবল, সামলানো যায়নি আর কিছুতেই, সেই মুহুর্তে জিভ কেটে সংবরণ করছেন হয়তো নিজেকে, ছিঃ কী পাপ হত আর এট্টু হলেই মনে মনে বলে, তাঁরাই তো উত্তমদর্শনশাস্ত্রের সেরা বিজ্ঞাপন।”( পৃ ৮৯)
পাঠক, আমি কিন্তু ইচ্ছে করে গদ্যের নামগুলো দিচ্ছি না, আপনাকে বইটা হাতে নিয়ে আরামে সেগুলো পড়তে হবে। রহস্যটুকু থাক।
“পৃথিবীর সমস্ত বলের আসল কর্তব্য বা লক্ষ্য কী, যে-একের পর এক গোল হয়ে জালে ঢুকে যাবে, তাই তো? ফুরা-রেডিস বা নেট-পাঞ্চারের অকল্পনীয় প্রতিভা ছিল এ ক্ষেত্রে।” (পৃ ১১৯)
এই ফুরা-রেডিস কি জানেন? একটা ফুটবল। ফুরা-রেডিস আর গোলকিপার বিলো-বিলো- প্রেমের গল্পটা পড়তে হবে তো? বইয়ের পাতার উপর একটা বিকেলবেলার রোদ খেলে যাচ্ছে। যে বিকেলে আমি নিজে গোল বক্সে দাঁড়াতাম , প্যাড দেওয়া জার্সি প্যান্ট, হাতে গ্লভস। উফফফফ….কি সব দিন ছিল….এইরে আবার আমার জীবনে ঢুকে পড়ছি।
বরবিলের ওই কিশোর আবার কলকাতার কাঁকুড়গাছিতে মিশে যাচ্ছে, ওই তো ও বলছে , “কাঁকুড়গাছি ছেড়েছে সে ছেলে বহুকাল হল, ওই মাঠেও এখন বহু আগাছা, তবু মেঘ হয়ে কখনও ওখান দিয়ে ভেসে গেলে নিচে তাকিও, …।সে ছেলের মা-ও গেছে মিশে হাওয়ায়, শাঁখ বাজা-ও এখন বন্ধ। শুধু ছেলেটি আবার বল কুড়িয়ে বোলিং মার্কে ফিরে যায়।” আবার তার স্মৃতির ফ্রেম সোনা দিয়ে বাঁধানো থাকে সেই দিনটার কথা ভেবে যেদিন স্বয়ং পি কে গাড়ির মধ্যে বসে অনর্গল আড্ডা মেরে যেতে থাকে এম এ পার্ট ২ দেওয়া এক খেলা পাগল তরুণের সঙ্গে।
এইভাবেই বই যত এগোতে থাকে সেই কথক আরও বড় হতে থাকে। আকাশের রঙ মজে যাওয়া কমলালেবুর মতো হতে থাকে। জীবনের লং পাস তোলা কিংবা ইয়র্কার ট্যকেল করতে করতে কখনও কালবৈশাখী পার হয়ে, কখন উম্ফুন ঝড়ে ভেঙে যেতে যেতেও না যাওয়ার আনন্দকে শত সম্ফনির ঝর্ণার জলে ভাসিয়ে দিয়েছে আমাদের জন্য। দগ্ধ হলাম বইয়ের শেষে এসে, কাঁদলাম, যখন কথকের চোখে চোখ রাখলাম, ” আমাদেরই যে খামতি, পাখিদের মতো হওয়া হল না, চোখে লেগে রইল, দপ করে যেভাবে অফ-হোয়াইট শাড়িটাকে গ্রাস করে নিল প্রথম পর্যায়ের আগুনটা।”( পৃ ১৫৫)
অনেকগুলো ফোঁটা চোখের জল শেষ পাতায়….বাকিটা ঝাপসা……
জড়িয়ে ধরলাম লেখককে – “ভালোবাসি”
অসাধরন