
বাংলায় বোর্হেসের বিপুল ভাণ্ডার
সন্দীপন চক্রবর্তী
নির্বাচিত বোর্হেস। ভূমিকা, সংকলন ও সম্পাদনা – রাজু আলাউদ্দিন। কাগজ প্রকাশন।
প্রত্যেক ভাষাতেই এমন কিছু লেখক থাকেন, যাকে আপনি পছন্দ করতে পারেন, অপছন্দও করতে পারেন, কিন্তু কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারবেন না। স্প্যানিশ ভাষার তেমনই এক লেখক হোর্হে লুই বোর্হেস। আদর্শগতভাবে আপনি তাঁর বিরোধী হতেই পারেন, কিন্তু তাঁর লেখা ও কল্পনাশক্তির মৌলিকত্ব কিছুতেই অস্বীকার করতে পারবেন না। অথচ লাতিন আমেরিকার অন্যান্য অনেক লেখকের লেখাই বাংলায় অনুবাদ এবং তাঁদের নিয়ে বাংলায় চর্চা হলেও, বোর্হেস যেন খানিক উপেক্ষিতই থেকে যান বাংলায়। অথচ মার্কেসের মতো লেখক স্বীকার করেন যে ‘বোর্হেসের প্রতি আমার প্রবল অনুরাগ, প্রতি রাতে তাঁর লেখা পড়ি।… তিনি এমন একজন লেখক যাকে অপছন্দ করি… কিন্তু পাশাপাশি, তাঁর গল্পগুলি ফাঁদতে গিয়ে তিনি যে সুর ও স্বর বাঁধেন সেটা আমার ভীষণ পছন্দ।’ অথবা মারিও বার্গাস য়োসার মতো লেখক জানান, ‘আমাকে যদি একজনের নাম বেছে নিতে বলা হয় তাহলে আমি বোর্হেসের কথাই বলব। কারণ তিনি যে-জগৎ তৈরি করেছেন তা আমার কাছে একেবারে মৌলিক মনে হয়।’
এহেন বোর্হেসের অনুবাদের কাজ বাংলায় হয়েছে খুব কম। সম্প্রতি সেই ঘাটতি অনেকটাই পূরণ করেছে এ বছরই কাগজ প্রকাশন থেকে রাজু আলাউদ্দিনের সংকলন ও সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘নির্বাচিত বোর্হেস’ বইটি। কে এই রাজু আলাউদ্দিন? মূলত কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। ইস্পানো-আমেরিকায় রবীন্দ্রচর্চার ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন অসাধারণ এক তথ্যবহুল গবেষণাগ্রন্থ ‘দক্ষিণে সূর্যোদয়’। প্রায় মাতৃভাষা বাংলার মতোই জানেন স্প্যানিশ ভাষা। দুই বাংলা মিলিয়ে আমার জানা সেরা বোর্হেস-বিশেষজ্ঞ। ফলে এই বিষয়ে বাংলায় তাঁর মতো যোগ্য সম্পাদক আর পাওয়া যেত না।
এই সংকলনটিতে রয়েছে বাংলা অনুবাদে হোর্হে লুই বোর্হেসের গল্প কবিতা প্রবন্ধ অভিভাষণ ও সাক্ষাৎকারের এক বিপুল সংগ্রহ। ঠিক কতটা বিপুল, সেটা বোঝানোর জন্য একটা ছোট্ট হিসেব দিই— রয়েছে ৭টি বই থেকে নির্বাচিত ৩৭টি গল্প ও প্যারাবল, ১৪টি বই থেকে নির্বাচিত ৪৯টি কবিতা, ১৮টি নির্বাচিত প্রবন্ধ ও অভিভাষণ এবং ১০টি নির্বাচিত সাক্ষাৎকারের অনুবাদ। মূলত ইংরেজি, কখনো বা সরাসরি স্প্যানিশ থেকেও অনুবাদ করেছেন ৪৩জন লেখক, যার মধ্যে অনুবাদক হিসেবে আছেন বেলাল চৌধুরী, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আনিসুজ্জামান, নির্মলেন্দু গুণ, আল মাহমুদ, রফিক আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, শামসুর রাহমান বা কবীর চৌধুরীর মতো লেখক। আর রাজুর নিজের করা অজস্র অনুবাদ তো আছেই। এখানে মূল বইয়ের ভূমিকা ছাড়াও, প্রতিটি অংশের ক্ষেত্রেই যথার্থ পরিচয়বাহী চমৎকার এক-একটি বিশ্লেষণী ভূমিকা লিখেছেন রাজু। বিশেষভাবে বলতে হয়, ‘নির্বাচিত গল্প ও প্যারাবল’ অংশের শুরুতে লেখা এক অসাধারণ দীর্ঘ ভূমিকা ‘ফুকোর হাসি, একটি গ্রন্থের জন্ম এবং বোর্হেস’ লেখাটির মাধ্যমে বোর্হেসের মূল্যায়নের কথা। তাছাড়া এই সংকলনের শেষে রয়েছে আরেকটি অসাধারণ প্রাপ্তি— একেবারে সাল ধরে ধরে বোর্হেসের এক বিস্তারিত জীবনপঞ্জী। এবং সবশেষে অনুবাদক পরিচিতি।
গত শতাব্দীর আটের দশক থেকেই বোর্হেস-চর্চায় নিবেদিতপ্রাণ রাজু। এই শতাব্দীর গোড়াতেই তিনি তৈরি করে ফেলেন এই বিপুল অনুবাদ-সংকলনের পাণ্ডুলিপি। তারপর প্রথমে ২০১০-এ ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে পাঁচ খণ্ডে বেরোয় বোর্হেসের নির্বাচিত রচনার এই অনুবাদ-সংকলন। তবে ওই পাঁচ খণ্ডের মধ্যে একটি ছিল বোর্হেস-বিষয়ক। সেটি বর্জন করে, এবং ‘প্রতিটি লেখা আবার নতুন করে মূলের সঙ্গে মিলিয়ে পরিমার্জন / সংশোধন’ করে, বাকি চার খণ্ডকে একত্র করেই তৈরি হয়েছে এই অখণ্ড সংগ্রহ। ভূমিকায় রাজু জানিয়েছেন যে, এখানে ‘বাদ পড়েছে দু-একটি গৌণ লেখা, অন্যদিকে যুক্ত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এমন কিছু লেখা যা অনবধানতাবশত বাদ পড়ে গিয়েছিল।’ বোর্হেস সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাই ‘পরমাশ্চর্য এই লেখককে বাংলা ভাষায় ব্যাপকভাবে উপস্থিত’ করার জন্য সমস্ত বাঙালির তরফ থেকে রাজুকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন আবদুল মান্নান সৈয়দ।
আরেকটা কারণেও এই সংকলনের মধ্যে দিয়ে বোর্হেসকে যেন খানিক আপন করে পাওয়া যায়, কারণ তাঁর কবিতার বিষয় হয়ে উঠতে পারে ‘বেনারস’, বা প্রবন্ধের বিষয় হয়ে উঠতে পারে ‘জাতীয়তাবাদ এবং রবীন্দ্রনাথ’, বা অভিভাষণের বিষয় হতে পারে ‘বৌদ্ধধর্ম’। রবীন্দ্রসূত্রে বাঙালির কাছে পরিচিত নাম ভিক্তোরিয়া ওকাম্পো ছিলেন বোর্হেসেরও নিকটজন। তাঁদের দুজনের মধ্যে এক দীর্ঘ সংলাপও রয়েছে এখানে সাক্ষাৎকার অংশে। সব মিলিয়ে শুধু এটুকুই বলা যায় যে, বাংলায় বোর্হেসের লেখা পড়তে গেলে বা বোর্হেস সম্পর্কে চর্চা করতে গেলে এ বই অপরিহার্য। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হলেও ভারতে এর পরিবেশক অভিযান পাবলিশার্স।