মেঘে  মেঘে  তড়িৎ শিখার  ভুজঙ্গপ্রয়াতে <br />  প্রথম পর্ব <br />  গৌতম চৌধুরী

মেঘে মেঘে তড়িৎ শিখার ভুজঙ্গপ্রয়াতে
প্রথম পর্ব
গৌতম চৌধুরী

১.
বাংলা ১৩৪৪ সাল। বৈশাখের শুরুতেই শান্তিনিকেতনে গরমের ছুটি পড়িয়া গিয়াছে। বিগত ৪বছর রবীন্দ্রনাথ কখনও বিশ্রামের জন্য ছুটি লন নাই। ৭৭তম জন্মদিনের প্রাক্কালে এইবার ঠিক হইল শৈলশহর আলমোড়া যাত্রার। সেই উদ্দেশে ২৯ এপ্রিল ১৯৩৭ ঘনিষ্ঠজনের ছোট একটি দল লইয়া বাহির হইয়া পড়িলেন। এইযাত্রা প্রায় ২মাস হিমালয়ের কোলে কাটাইবেন – ‘কাজ ক’রে মন অসাড় যখন মাথা যাচ্ছে ঘুরে/ হিমালয়ের খেলা দেখতে এলেম অনেক দূরে’। আপাতত গান আসিতেছে না। শেষ গানটি রচনা করিয়া আসিয়াছেন শান্তিনিকেতনে বসিয়া, নববর্ষের দিনে। সেদিন আবার ছিল চিনাভবনের উদ্বোধন অনুষ্ঠান। নেহরুর আসিবার কথা ছিল। আসিতে পারেন নাই। ভাষণ পাঠাইয়া দিয়াছেন কন্যা ইন্দিরার হাতে। সেদিনের সেই গানটি ছিল – ‘ওরে, নূতন যুগের ভোরে/ দিস নে সময় কাটিয়ে বৃথা সময় বিচার ক’রে’, যাহা স্বদেশ পর্যায়ে সংকলিত। সময় অবশ্য এইখানে বৃথা কাটিতেছে না। একদিকে লিখিয়া চলিয়াছেন বিশ্বপরিচয়-এর বিজ্ঞাননির্ভর নিবন্ধ, অন্যদিকে ছড়ার ছবি-র লঘুচালের রচনাগুলি। ছবি আঁকিতেছেন প্রচুর। মাঝে মাঝে ১টি/২টি করিয়া সেঁজুতি, নবজাতক, সানাই-এর কবিতা।
বহুযুগ আগে এই আলমোড়াতেই রচিত হইয়াছিল শিশু কাব্যগ্রন্থের একগুচ্ছ শিশুপাঠ্য কবিতা। ছড়ার ছবি-তেও ঠাকুরের অবলম্বন হইল তেমন এক ছন্দ, যাহা ‘প্রাকৃত ভাষার ঘরাও ছন্দ। এ ছন্দ মেয়েদের মেয়েলি আলাপ, ছেলেদের ছেলেমি প্রলাপের বাহনগিরি করে এসেছে।’ তবু মাঝে মাঝেই সেই সকল ‘ছড়া’ তাহাদের লঘুভার কথকতা পরিহার করিয়া যেন কিছু গভীর অনুভবের কবিতা হইয়া উঠিতেছে। ঘটিতেছে স্বগতের বিনির্মাণ। কখনও দেখা যায়, বিজন প্রান্তরের বালুরাশির ভিতর দিয়া বহিয়া চলা শীর্ণ নদীর নিঃসঙ্গতার ছবির ভিতর দিয়া ঝরিয়া পড়িতেছে কবির নিজেরই অন্তর্বেদনা – ‘সমস্ত নিঃঝুম/ জাগাও নেই কোনোখানে, কোত্থাও নেই ঘুম’ (রিক্ত)। সেই আত্মজৈবনিক হাহাকার আরও অবিমূর্ত হইয়া উঠে, যখন সাগরতীরের পাথরপিণ্ডটির কথা উঠে – ‘আগুন ছিল পাখায় যাহার আজ মাটি-পিঞ্জরে/ কান পেতে সে আছে ঢেউএর তরল কলস্বরে।/ শোনার লাগি ব্যগ্র তাহার ব্যর্থ বধিরতা/ হেরে-যাওয়া সে যৌবনের ভুলে-যাওয়া কথা’(পাথরপিণ্ড )। দিনান্তবেলায় এলাইয়া পড়িয়াছে অস্তসূর্যের বিষণ্ণ পট, তবু আজও ‘মর্ত্যধরার পিছু-ডাকা দোলা লাগায় বুকে’।
কিন্তু মর্মলোকে এই বেদনাবোধ জাগিয়া উঠে কিসের জন্য? সে কি সভ্যতার সেইসব কীর্তির জন্য, যাহারা দিকে দিকে শক্তিমত্তার নিশান উড়াইয়া, কালক্রমে বিলীন হইয়া যায়? না, এ-বেদনার উৎস তো তাহারা নয় – ‘অনেক কীর্তি, অনেক মূর্তি, অনেক দেবালয়, / শক্তিমানের অনেক পরিচয়।/ তাদের হারিয়ে যাওয়ার ব্যথায় টান লাগে না মনে’ (পিছু-ডাকা)। দেবালয়ও তাহা হইলে শক্তিমানের কীর্তিমাত্র, যাহা নিশ্চিহ্ন হইয়া গেলে আজ আর হৃদয়ে কোনও টান অনুভূত হয় না? নতুন কথা বটে! বদলে, বেদনা জাগে, যখন চোখে পড়ে সামনের সবুজ বনের ছায়ায় গরু চরিতেছে, শুকনো বাঁশের পাতায় আচ্ছন্ন সরু পথটি দিয়া একটি মেয়ে ঘাসের আঁটি মাথায় হাটে চলিতেছে – ‘তখন মনে হঠাৎ এসে এই বেদনাই জাগে/ ঠাঁই রবে না কোনোকালেই ওই যা-কিছুর মাঝে’(ঐ)। শক্তিমানের পরিচায়ক কীর্তি-মূর্তি-দেবালয় আকীর্ণ বিশ্বব্যবস্থার প্রতি এই নির্বেদ এবং বিপরীতে প্রতিদিনকার না-অসাধারণ জীবনপ্রবাহের প্রতি এই আকুতি প্রকাশের ভিতর অবশ্য কোনও তিক্ততা নাই। আছে এই নির্মল স্বীকারোক্তি যে, ক্ষমতাতন্ত্রের অন্যান্য প্রতীকের মতো, দেবালয়ের অস্তিত্বে-অনস্তিত্বেও তাঁহার আজ আর কিছু যায় আসে না।
ছড়ার ছবি-র পাতা উলটাইতে উলটাইতে চোখ চলিয়া যায় পিস্‌নি বুড়ির মর্মস্পর্শী বৃত্তান্তে। দিনের আলো না ফুটিতেই আজ সংসার-পরিত্যক্ত তাহাকে সঙ্গোপনে গ্রাম ছাড়িয়া যাইতে হইতেছে – ‘দূরে গিয়ে, বাঁশবাগানের বিজন গলি বেয়ে/ পথের ধারে বসে পড়ে, শূন্যে থাকে চেয়ে’(পিস্‌নি)। ৩ জুন ১৯৩৭-এ লেখা এই কবিতার আখ্যান অংশটি কবিকে নিশ্চয় তাড়িত করিয়াছিল। দেখা যাইতেছে, কয়দিন পূর্বেই (২২ মে ১৯৩৭) তীর্থযাত্রিণী নামে এ-কাহিনির অপর একটি কাব্যরূপ ঘটিয়া গিয়াছে। সেঁজুতি-র সেই কবিতার তীর্থযাত্রিণীও পিস্‌নি বুড়ির মতোই – ‘প্রত্যাখ্যাত জীবনের প্রতিহত আশা/ অজানার নিরুদ্দেশে প্রদোষে খুঁজিতে চলে বাসা’। অন্তিমে, পিস্‌নির মতো সেও পথের ধারে পড়িয়া থাকে নিঃসঙ্গ। তবে পিস্‌নি শুধুই শূন্যের পানে তাকাইয়া রয়, আর এই প্রত্যাহত মানুষটি হয়তো শূন্যের কাছে এখনও কিছু প্রত্যাশা বহন করে – ‘পরিত্যক্ত একা বসি ভাবিতেছে, পাবে বুঝি দূরে/ সংসারের গ্লানি ফেলে স্বর্গ-ঘেঁষা দুর্মূল্য কিছুরে’। কিন্তু এহেন প্রত্যাশার প্রতি ঠাকুরের তির্যক মন্তব্যটি লক্ষ করার। তাহা বেদনাবিদ্ধ, তবু স্বর্গীয় সান্ত্বনার ভণিতা সেখানে নাই –
হায় সেই কিছু
যাবে ওর আগে আগে প্রেতসম, ও চলিবে পিছু
ক্ষীণালোকে, প্রতিদিন ধরি-ধরি করি তারে
অবশেষে মিলাবে আঁধারে। (তীর্থযাত্রিণী /সেঁজুতি)

স্বর্গীয় শান্তির স্বপ্নকল্পনা তাহা হইলে মিথ্যা সান্ত্বনা মাত্র! তাহা শুধুই পার্থিব জীবনের সকল অপ্রাপ্তিকে ভুলাইয়া রাখিবার এক ছলনাময় আয়োজন, যাহা মানুষকে ভূতগ্রস্তের মতো ছুটাইয়া লইয়া চলিয়া শেষ পর্যন্ত বিলুপ্তির অন্ধকারে নিক্ষেপ করে? নতুন কথা বটে! তাহা হইতেও নতুন হইল অভিব্যক্তির এই অভাবিত তিক্ততা। একেবারেই অঠাকুরোচিত!
অথচ মন যে তাঁহার খুব তিক্ত হইয়া উঠিয়াছে এমন নহে। ‘হংকঙেতে সারা বছর আপিস করেন মামা’(ভজহরি / ছড়ার ছবি, জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৪) বা ‘যোগীনদাদার জন্ম ছিল ডেরাস্মাইলখাঁয়ে’ (যোগীনদা / ছড়ার ছবি, জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৪) ইত্যাদির মতো অনর্থলোভী ছড়া জন্ম নিতেছে। সিংহলে দেখা ক্যান্ডিদলের ‘আগুন হয়ে জ্বলে ওঠা’ নাচের কথা মনে পড়িয়া যাইতেছে। সেইসূত্রে, নটরাজের ভিতর দিয়া ব্যক্ত হইতেছে পুরুষশক্তির অদম্যতা – ‘নটরাজ যে পুরুষ তিনি, তাণ্ডবে তাঁর সাধন,/ আপন শক্তি মুক্ত করে ছেঁড়েন আপন বাঁধন’ (ক্যান্ডীয় নাচ /নবজাতক , জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৪)। সেই পুরুষসত্তার কথাই অপর একটি কবিতায় আসিতেছে এইভাবে – ‘পুরুষের অনন্ত বেদন / মর্ত্যের মদিরা-মাঝে স্বর্গের সুধারে অন্বেষণ’ (নারী /সানাই, ১৮ মে ১৯৩৭)। কোন স্বর্গীয় সুধার জন্য পুরুষের এই অনন্ত হাহাকার? মর্ত্যের সেই শ্রেষ্ঠ মদিরাটি কী? সে-মদিরা হইল, রমণীর ভিতর মূর্ত হইয়া থাকা আনন্দরস, ‘স্বাতন্ত্র্যস্পর্ধায় মত্ত পুরুষেরে করিবারে বশ/ যে আনন্দরস/ রূপ ধরেছিল রমণীতে’। এই উপলব্ধিতে আর যাহাই হৌক, তিক্ততা আছে বলা যায় না।

দেহমনে ভাঙনের পদশব্দ, তথাপি আলমোড়া হইতে শান্তিনিকেতন ফিরিবার পর নানান কর্মকাণ্ডে জড়াইয়া পড়িতেই হয়। সহসা মন উতলা হইল, দিনকয়েকের জন্য একবার পতিসর মহাল ঘুরিয়া আসিবার জন্য। শান্তিনিকেতনের রাঢ়ভূমি হইতে বরেন্দ্রির খাল-বিল-নদী-নালা ঘেরা সেই শ্যামল জনপদে। সেই গহন জলযাত্রার স্মৃতি তো তাঁহাকে ছাড়ে নাই – ‘আমারও পথ হাঁসের যে-পথ, জলের পথে যাত্রী, / ভাসতে যাব ঘাটে ঘাটে ফুরোবে যেই রাত্রি।/ সাঁতার কাটব জোয়ার-জলে পৌঁছে উজিরপুরে,/ শুকিয়ে নেব ভিজে ধুতি বালিতে রোদ্‌দুরে…’ (জলযাত্রা / ছড়ার ছবি, জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৪)। নাগর নদের তীরে এই পতিসরে ইতিপূর্বে জমিদারির কাজে কতবার কত না দিনরাত্রি কাটাইয়াছেন। সেখানকার কাছারিবাড়িতে বা নদীতে বোটের বুকে বসিয়া লিখিয়াছেন কত না অবিস্মরণীয় রচনা। কিন্তু এখন তো জমিদারির কাজ কিছুই নাই। শুধু সেখানকার পরিচিত মানুষজনের সাথে, প্রকৃতির সাথে, একবার দেখা করিয়া আসা। কেহ কি জানিত, ইহাই তাঁর এতদঞ্চলে শেষ সাক্ষাৎকার। তাঁহার প্রজাবৃন্দ কি কিছু টের পাইয়াছিলেন? নহিলে, ফিরিবার পথে সাশ্রুনয়নে তাঁহারা ঠাকুরের বোটের পাশাপাশি নদীতট ধরিয়া পতিসর হইতে আত্রাইঘাট পর্যন্ত হাঁটিতে হাঁটিতে আসিবেন কেন! সে কি শুধু এই কৃতজ্ঞতাবশে যে, স্থানীয় কৃষকদের জন্য তিনি সেই দুর্গম পল্লীঅঞ্চলে কৃষিব্যাংক স্থাপন (১৯০৫) করিয়াছিলেন। আর, নোবেল পুরস্কারে প্রাপ্ত অর্থ হইতে এক বিপুল অংক এই কৃষিব্যাংকে জমা করিয়াছিলেন (১৯১৩)। মনে হয়, না। রাজশাহী জেলার তৎকালীন জেলাশাসক অন্নদাশংকর আসিয়া আত্রাইঘাটে কবির সহিত মিলিত হন। তাঁহাকে অভিভূত ঠাকুর বলেন, ‘ওরা কী বলে জানো? বলে, পয়গম্বরকে তো আমরা চোখে দেখিনি। আপনাকেই দেখেছি’।
কিন্তু সেই ‘পয়গম্বর’এর দেশকালও তো বজ্রগর্ভ। স্মৃতি বা স্বপ্ন ব্যতীত শান্তির অবকাশ কোথায়। পতিসরের নাগর নদীর মতোই একদা পদ্মার বুকে কাটানো দিনগুলির স্মৃতিও আজতক চিরঅম্লান। আলমোড়াতে বসিয়া তাই লিখিয়াছিলেন–
আমার নৌকা বাঁধা ছিল পদ্মানদীর পারে,
হাঁসের পাতি উড়ে যেত মেঘের ধারে ধারে –
জানি নে মন-কেমন-করা লাগত কী সুর হাওয়ার
আকাশ বেয়ে দূর দেশেতে উদাস হয়ে যাওয়ার।
কী জানি সেই দিনগুলি সব কোন্‌ আঁকিয়ের লেখা,
ঝিকিমিকি সোনার রঙে হাল্‌কা তুলির রেখা। পদ্মায় /ছড়ার ছবি, ৬।৬।১৯৩৭ (২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৪)

কিন্তু বাংলাদেশের গ্রামের সেই সোনার রঙে আঁকা দিনগুলি আজ কই? আসিয়া পড়িয়াছে যে ‘নতুন কাল’! একদিকে দরিয়ার অপর প্রান্ত হইতে ভাসিয়া আসিতেছে সেই নতুন কালের ভয়াবহ গর্জন – ‘যুদ্ধ লাগল স্পেনে;/ চলছে দারুণ ভ্রাতৃহত্যা শতঘ্নীবাণ হেনে’(চলতি ছবি / সেঁজুতি, জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় ১৩৪৪)। অন্যদিকে আপন ঘরের আঙিনায় আকালের কালো ছায়া আসিয়া ঢাকিয়া দিতেছে বাংলার সকরুণ মুখ। সামান্য রুজি-রুটির খোঁজে মানুষ চলিতেছে শহরের অভিমুখে, দিশাহীন – ‘প্রাণ-ধারণের বোঝাখানা বাঁধা পিঠের ’পরে,/ আকাল পড়ল, দিন চলে না, চলল দেশান্তরে।/ দূর শহরে একটা কিছু যাবেই যাবে জুটে,/ এই আশাতেই লগ্ন দেখে ভোরবেলাতে উঠে/ দুর্গা ব’লে বুক বেঁধে সে চলল ভাগ্যজয়ে…’ (দেশান্তরী / ছড়ার ছবি, আষাঢ় ১৩৪৪)। কিন্তু শহর-গঞ্জের হালই বা কী? নতুন কাল কি সেইখানেও নিজেকে জানান দিতে ছাড়িতেছে – ‘এমন সময় নরম যখন হল পাটের বাজার/ মাইনে ওদের কমিয়ে দিতেই, মজুর হাজার হাজার/ ধর্মঘটে বাঁধল কোমর; সাহেব দিল ডাক, / বললে, মাধো, ভয় নেই তোর, আলগোছে তুই থাক্।/ দলের সঙ্গে যোগ দিলে শেষ মরবি-যে মার খেয়ে।/ মাধো বললে, মরাই ভালো এ বেইমানির চেয়ে’ (মাধো / ছড়ার ছবি, শ্রাবণ ১৩৪৪) ।
এই ‘আলগোছে’ না-থাকিতে পারার সংকট তো আসলে চটকলের মজুর মাধোর নহে, তাহা ঠাকুরেরই নিজের। তাই দেশের নানান সামাজিক-রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে এই বুড়া বয়সেও কেবলই জড়াইয়া পড়িতে হয়। মাধো হয়তো একটি মনগড়া নাম, কিন্তু চটকলের যে-ধর্মঘটের কথা ওই ছড়ায় আমরা পড়ি, তাহা আদৌ কবিকল্পনা নহে। আসলেই সেই বছর (১৯৩৭) ফেব্রুয়ারি মাস হইতে হাওড়ার ফোর্ট উইলিয়াম, হাওড়া মিলস, গ্যাঞ্জেস জুট মিলস-এর মতো কয়েকটি চটকলের কয়েক সহস্র শ্রমিক ন্যায্য মজুরি, প্রভিডেন্ট ফান্ড, পেনসন, স্বাস্থ্যবীমা ইত্যাদির দাবিতে ধর্মঘটে সামিল হইয়াছিলেন। এক পর্যায় যখন মিল-মালিকদের স্বার্থে, সাম্প্রদায়িকতার বিষধোঁয়া ছড়াইয়া সেই ধর্মঘট বাঞ্চাল করিবার প্রয়াস দেখা গেল, তখন মর্মাহত ঠাকুর আর চুপ করিয়া থাকিতে পারিলেন না। দেশবাসীকে ধর্মঘটী শ্রমিকদের পাশে আসিয়া দাঁড়াইবার আহ্বান জানাইয়া বলিলেন –
…Humanity demands that those who bear the burden of the society should be protected and looked after by the society itself. To give this strike a communal turn by stirring up ugly communal poisons should be condemned by every right-thinking man.
I appeal to my countrymen to help the jute-workers and their helpless women and children in this period of their suffering and distress. In Defence on the Workers on Strike, 29 April 1937

প্রিয় পাঠিকা, প্রিয় পাঠক, ধর্মঘটী শ্রমিকদের সমর্থনে দেওয়া এই বিবৃতির তারিখটি আমরা একটু খেয়াল করিতে পারি। হ্যাঁ, ২৯ এপ্রিল ১৯৩৭, গরমের ছুটিতে ‘বিশ্রাম’ লইবার উদ্দেশ্যে যেদিন তিনি আলমোড়া যাত্রা করিতেছেন। ফিরিয়া, কিছুদিন শান্তিনিকেতন থাকিয়া আবার পতিসর। পতিসর হইতে কলিকাতায় ফিরিতে না ফিরিতেই খবর পাইলেন, সুদূর আন্দামানের কারাগারে বাংলাদেশের ১৮৭জন বিপ্লবী বন্দি তাঁহাদের মুক্তি এবং দেশের মূল ভূখণ্ডে ফিরিবার দাবিতে অনশন শুরু করিয়াছেন। ‘আলগোছে’ থাকা হইল না তাঁহার। অনশনরত বন্দিদের মুক্তির দাবিতে ডাকা টাউন হলের জনসভার (২ অগস্ট ১৯৩৭) সভাপতির আসনে গিয়া বসিতে হইল তাঁহাকে। তাঁহার বক্তৃতায় সরকারের মনোভাবকে ‘ফাসিস্ট’ বলিয়া নিন্দা করিলেন তিনি। আর, বন্দিদের তারবার্তা পাঠাইয়া, তাঁহাদের প্রতি সারা বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা, সমর্থনের কথা, জানাইয়া দিলেন।

২.
ওইদিকে বর্ষামঙ্গল উৎসব আসন্ন। শান্তিনিকেতনে এই উৎসবের সাফল্যে কলকাতার শিল্পীদেরও আগ্রহ জাগিয়াছে। এই বছর তাই দুই জায়গাতেই অনুষ্ঠান হইবে। প্রিয় ছাত্র শান্তিদেবকে শান্তিনিকতনের উৎসবের দায়িত্ব দিয়া ঠাকুর নিজে কলকাতার শিল্পীদের তালিম দিতেছেন। আর রচিত হইতেছে একের পর এক নতুন গান। ১৫-৩০ শ্রাবণ ১৩৪৪-এর ভিতর বর্ষা-প্রকৃতি ও প্রেম-বৈচিত্র্যের যে ১৫টি গান রচিত হইল তাহার অধিকাংশই ভাবসম্পদে ও সুরবিন্যাসে সম্প্রতিও আমাদের মুগ্ধ করে।

এসো শ্যামল সুন্দর প্রকৃতি বর্ষা
আমি শ্রাবণ আকাশে ওই দিয়েছি পাতি প্রকৃতি বর্ষা
চিনিলে না আমারে কি প্রেম প্রেম-বৈচিত্র্য
মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে সে দিন ভরা সাঁঝে প্রেম প্রেম-বৈচিত্র্য
আজি গোধূলিলগনে এই বাদলগগনে প্রেম প্রেম-বৈচিত্র্য
থামাও রিমিকি ঝিমিকি বরিষন প্রকৃতি বর্ষা
বর্ষণমন্দ্রিত অন্ধকারে এসেছি তোমারি এ দ্বারে প্রেম প্রেম-বৈচিত্র্য
আমি তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে প্রকৃতি বর্ষা
ওগো আমার চির-অচেনা পরদেশী প্রেম প্রেম-বৈচিত্র্য
মেঘছায়ে সজল বায়ে মন আমার প্রেম প্রেম-বৈচিত্র্য
মধুগন্ধে ভরা মৃদুস্নিগ্ধছায়া নীপকুঞ্জতলে প্রকৃতি বর্ষা
আমার প্রাণের মাঝে সুধা আছে, চাও কি – প্রেম প্রেম-বৈচিত্র্য
আজি পল্লীবালিকা অলকগুচ্ছ সাজালো বকুলফুলের দুলে প্রকৃতি বর্ষা
শ্রাবণের পবনে আকুল বিষণ্ণ সন্ধ্যায় প্রেম প্রেম-বৈচিত্র্য
আমার যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে প্রকৃতি বর্ষা

প্রায় ৬০বছর ধরিয়া সংগীত সৃজন করিয়া মানুষটি যে আজ কথা ও সুর সংস্থাপনায় অনায়াস সাবলীলতার অধিকারী, তাহা বলিবার অপেক্ষা রাখে না। কোনও একটি বিশেষ অনুষ্ঠানকে সামনে রাখিয়া খানিকটা ফরমায়েশি ধরনের কিছু গান নামাইয়া দেওয়া আজ তাঁহার পক্ষে কিছুই কঠিন নহে। পূর্বেও এইভাবে তাঁহার বহু গান সৃষ্টি হইয়াছে। তবু, উপরের গানগুলি আমরা যদি নিছক কবিতা হিসাবে পড়িয়া যাই, সেই সুরহীন পাঠ হইতেও এক মর্মান্তিক সজীবতার বিচ্ছুরণ অনুভূত হয়। সেই সপ্রাণতা যে, কিছু সযত্ন নির্মাণমাত্র, উহার পিছনে যে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের বিন্দুবিসর্গ হাজির নাই, একথা কোন্‌ অবিশ্বাসী বলিবে! বিশেষত যখন দেখিতে পাই, ‘এসো শ্যামল সুন্দর’-র নিটোল বর্ষাবন্দনার আবহ হইতে কত সহজেই তিনি পৌঁছাইয়া গিয়াছেন এক অনন্ত বিরহবোধের পরিসরে – ‘আমি শ্রাবণ-আকাশে ওই দিয়েছি পাতি/ মম জল-ছল-ছল আঁখি মেঘে মেঘে।/ বিরহদিগন্ত পারায়ে সারা রাতি অনিমেষে আছে জেগে’। ‘ঝড়ের রথে অগম পথে’র আবাহন হইতে পৌঁছাইয়া গিয়াছেন ঝড়ের রাতের প্রহর গণনায়।
ঝড়ের রাত্রির এই অনুষঙ্গে আমাদের মনে পড়িতে পারে, একদা মাননীয় শঙ্খ ঘোষ মহাশয় ঠাকুরের গীতাখ্য পর্বের কাব্য হইতে ৩রকম ঝড়ের উল্লেখ করিয়াছিলেন – ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’ (গীতাঞ্জলি), ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে’ (গীতিমাল্য) এবং ‘যেতে যেতে একলা পথে নিবেছে মোর বাতি/ ঝড় এসেছে, ওরে এবার ঝড়কে পেলেম সাথি’ (গীতালি)। তিনি বলিতে চাহিয়াছিলেন, ১ম ঝড়ের অনেক পথ পার হইয়া ‘তুমি’ আসিতেছে ‘আমি’র কাছে, ২য় ঝড়ে ‘আমি’র আগল ভাঙা ঘরে আসিয়া হাজির সেই ‘তুমি’ আর ৩য় ঝড়ের সর্বনাশের ভিতর ‘আমি’ই পথে বাহির হইয়া পড়িয়াছে ‘তুমি’র অভিমুখে।এইভাবে সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব অতিক্রম করিয়া ক্ষুদ্র ‘আমি’-র নাকি মুক্তি ঘটিল বৃহৎ ‘তুমি’র দিগন্তে।
শাঙ্খ্য তত্ত্বটিকে মানিয়া লইয়াই আমরা এইবার ঠাকুরের ৭৬বছর বয়সের এই ঝড়ের রাতটির দিকে তাকাই – ‘ঝড়ের রাতে ছিনু প্রহর গণি।/ হায়, শুনি নাই তব রথের ধ্বনি’। দরোজায় ‘তুমি’ আসিয়াছিল, ‘আমি’ তাহার প্রতীক্ষাতেও ছিল, কিন্তু তবু আকাঙ্ক্ষিতের রথের ধ্বনি শুনিতে ভুল হইয়া গেল। মিলনের পথে এই যে অন্তরায়, ইহার জন্য কি ‘আমি’-র অন্তর্গত বাধাই দায়ী? ইহা কি সেই ‘আমার আমি’র বাধা, শঙ্খের বিবেচনায় যাহা ছিল গীতাঞ্জলি-র লক্ষণ? তাহা হইলে বুঝিতে হয়, গীতালি-তে আসিয়া যে-ক্ষুদ্র ‘আমি’-র মুক্তি সম্পূর্ণ হইয়াছিল বৃহৎ ‘তুমি’র ভিতর, তাহা জীবনের প্রান্তে আসিয়া পুনর্মুষিকতা পাইয়াছে। এখন পরিস্থিতি যেন সেই পূর্বজীবনের মতোই, মিলনের জন্য যখন আকাঙ্ক্ষা আছে কিন্তু যথাযথ আয়োজন নাই। তাহা হইলে কি আবার এক উন্নততর অঞ্জলি পর্বের সূচনা হইতে চলিল ঠাকুরের জীবনে! এবংবিধ জল্পনার আগে, বর্তমান গানটির শুরুটি একবার মনে করা যাক –
চিনিলে না আমারে কি।
দীপহারা কোণে ছিনু অন্যমনে, ফিরে গেলে কারেও না দেখি।
দ্বারে এসে গেলে ভুলে পরশনে দ্বার যেত খুলে –
মোর ভাগ্যতরী এটুকু বাধায় গেল ঠেকি।

উরিব্বাস, এইখানে তো দেখা যাইতেছে কাহিনি সম্পূর্ণ উলটা! ঘরের এক ‘দীপহারা কোণে’ প্রতীক্ষায় আনমনা হইয়া সময় কাটিতেছিল ‘আমি’র। অর্থাৎ ঘরটি একেবারে নিষ্প্রদীপ ছিল না। কাহাকেও না দেখিতে পাইয়া ফিরিয়া যাইবার মতো পরিস্থিতি তাহাকে বলা যায় না। ভালো করিয়া লক্ষ করিলে, অন্তত একটি ছায়ামূর্তিও নজরে পড়িতে পারিত। তথাপি ‘তুমি’ ফিরিয়া গেল। এই ব্যর্থতা কাহার? তদুপরি, ‘আমি’র দ্বারে আসিয়া ‘তুমি’ এই তথ্য বেমালুম ভুলিয়া গেল যে, সামান্য স্পর্শেই দ্বার খুলিয়া যাইবার কথা। এই ব্যর্থতা কাহার? ইহা হইতে একটিই মর্মান্তিক প্রশ্ন উঠিয়া আসে, ‘তুমি’ কি আদৌ ‘আমি’-কে চিনিতেই পারিল না। আশ্চর্যের বিষয়, ‘আমি’ যেন এক নিভৃত স্বগতোক্তির মতো ব্যথাহত কণ্ঠে প্রশ্নটি তুলিতেছে কেবল, বিচ্ছেদের শত বেদনা সত্ত্বেও ‘তুমি’কে কোনওভাবে অভিযুক্ত করিতেছে না। বরং নিজের ভাগ্যকে দোষী করিতেছে মাত্র।
এমতাবস্থায়, এই গানের এই ঝড়ের রাতটিতে, ‘আমি’-র কোনও অন্তর্গত বাধাই যে ‘তুমি’র সহিত মিলনের পথে অন্তরায় হইয়া উঠিয়াছে, একথা কি আর আমরা আদৌ বলিতে পারি? পারি যে না, তাহা আরও স্পষ্ট হয় গানটির অন্তম দুইটি চরণে পৌঁছিয়া –
গুরুগুরু গরজনে কাঁপি বক্ষ ধরিয়াছিনু চাপি,
আকাশে বিদ্যুৎবহ্নি অভিশাপ গেল লেখি।

ঝলসিয়া উঠিতেছে বিজরি, গুরুগুরু শব্দে ধ্বনিয়া উঠিতেছে আকাশ। কিন্তু এই বজ্রে ‘তুমি’-র কোনও বাঁশি তো বাজিতেছে না। বরং সেই অশনিরবে ‘তুমি’র আগমনবার্তাটিই চাপা পড়িয়া গেল। বিপুল সেই গর্জনের আকস্মিকতাই ‘আমি’কে আকাঙ্ক্ষিত রথের ধ্বনি শুনিতে দিল না। তাহা হইলে, প্রস্তুতির কোনও অভাব নহে, একটি অভাবিত পরিস্থিতিই এই বিচ্ছেদগাথার নির্মমতা রচনা করিল। আর ‘তুমি’ও বুঝি সেই পরিস্থিতিরই শিকার। আকাশ বিদীর্ণ করা এক শম্পাতরঙ্গ আসিয়া মুহূর্তের জন্য চোখ ধাঁধাইয়া দিল, ‘দীপহারা কোণে’ প্রতীক্ষারত ‘আমি’কে তাই নজরে পড়িল না। যে-দরোজা ঈষৎ ঠেলিলেই খুলিয়া যাইবে বলিয়া জানা, ভুলাইয়া দিল সেই সহজ কথা।
তাহা হইলে দেখা যাইতেছে, এই চিরবিরহের জন্য ‘আমি’ বা ‘তুমি’, কেহই দায়ী নহে। দায়ী এই অভিশপ্ত লগ্ন, গগনপটে লিখিয়া দেওয়া বিদ্যুৎবহ্নির প্রজ্বলন্ত লিখন। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, এই অভিশাপের দংশন ‘আমি’কে স্পর্শ করিলেও, তাহা কি কোনওভাবে ‘তুমি’র উপরেও বর্তাইতে পারে, অন্তত যে-‘তুমি’ ‘আমি’রই এক স্বপ্নলালিত বিস্তার, ধমনীপ্রবাহে রূপকল্পিত এক ‘পরম সত্তা’? মাত্র ৫বছর পূর্বে রচিত পরিশেষ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতার অংশ এই প্রসঙ্গে পড়িয়া লইতে পারি –
তোমারে দিব না দোষ।
জানি মোর ভাগ্যের ভ্রূকুটি,
ক্ষুদ্র এই সংসারের যত ক্ষত, যত তার ত্রুটি,
যত ব্যথা
আঘাত করিছে তব পরম সত্তারে;
জানি যে তুমি তো নাই কোনোদিন ছাড়ায়ে আমারে
নির্লিপ্ত সুদূর স্বর্গে।
আমি মোর তোমাতে বিরাজে;
দেওয়া-নেওয়া নিরন্তর প্রবাহিত তুমি-আমি-মাঝে
দুর্গম বাধারে অতিক্রমি। মিলন /পরিশেষ, ১৯ আষাঢ় ১৩৩৯

‘ভাগ্যের ভ্রূকুটি’ সেদিনও মিলনের অন্তরায়। তথাপি, সকল দুর্গম বাধা অতিক্রম করিয়া ‘আমি’-‘তুমি’র ভিতর একটি ন্যূনতম লেনদেন রহিয়া গিয়াছে। মিলনের সুস্পষ্ট প্রত্যাশা লইয়াও শেষতক তাই কোনও দ্বিধা নাই – ‘তোমাতে আমাতে মিলি ধ্বনিয়া উঠিবে এক সুর।’ আজ এই প্রত্যয় সম্পূর্ণ অবলুপ্ত। কোনও এক কালে শ্রাবণরাতের বুকের ভিতরের আগুনের যে-কালোরূপ চোখের পর্দায় নাচিয়া উঠিয়াছিল, আজ সেই আগুনের হরফে লিখা অভিশাপে পুড়িয়া ছাই হইয়া গিয়াছে ‘আমি’-‘তুমি’র পুরানো রসায়ন। আজ তাই দিগন্তে কোথাও কোনও সান্ত্বনা নাই, কোনও শুশ্রূষা নাই। আছে শুধু এক ‘তীর্থহারা যাত্রী’র হাহাকার – ‘হায়, জানি সে নাই জীর্ণ নীড়ে, জানি সে নাই নাই। তীর্থহারা যাত্রী ফিরে ব্যর্থ বেদনায় – ’। ব্যর্থতার এই বোধ এমনই সুতীব্র যে, ৭৬বছর বয়সী স্থিতধী পুরুষটিকে আর্তনাদ করিয়া উঠিতে হয় – ‘হায় হায় হায় রে’! গভীর এক কান্নায় ভাঙিয়া পড়িয়া বলিতে হয় –
দুই তারে জীবনের বাঁধা ছিল বীন।
তার ছিঁড়ে গেছে কবে একদিন কোন্‌ হাহারবে
সুর হারায়ে গেল পলে পলে।

আসুন প্রিয় পাঠিকা, প্রিয় পাঠক, আমরাও সেই হৃতসর্বস্ব লগ্নভ্রষ্ট মানুষটির দিকে তাকাইয়া তিলেক অধোবদন হই। আর, নিভৃত নীরবতা উদ্‌যাপনের এই অবকাশেই আমাদের মনের ভিতর কি আরও একটি অস্ফুট প্রশ্ন জাগিয়া উঠে না? একদিকে যেমন এক সুর হারাইয়া গেছে, ছিঁড়িয়া গিয়াছে জীবনবীণার বাঁধা তার, কালের কৃষ্ণ বিদ্যুতের উদ্ভাসে চিরবিরহের অন্ধকারে হারাইয়া গিয়াছে এক ‘তুমি’র মুখ, পাশাপাশি অন্য কোনও এক গান কি ফিরিয়াও পাওয়া গিয়াছে সেই বিরহের আড়াল হইতে – ‘পারিলে না তবু পারিলে না চিরশূন্য করিতে ভুবন মম – / তুমি নিয়ে গেছ মোর বাঁশিখানি, দিয়ে গেছ তোমার গান’।
তবে কি বিরহবোধের উত্তাল তরঙ্গবিক্ষোভের উত্থানপতনগুলি আত্মসাৎ করিয়া ‘আমি’র স্বপ্নস্বরূপের ভিতর জাগিয়া উঠিল কোনও নতুন আশ্বাস? পড়িয়া লইতে ইচ্ছা করিতেছে এই বর্ষামঙ্গলের জন্য রচিত আর একটি বহুশ্রুত গানের কিছু অংশ –
আমি তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে
যখন বৃষ্টি নামল তিমিরনিবিড় রাতে।

আমার স্বপ্নস্বরূপ বাহির হয়ে এল, সেথায় বুঝি সঙ্গ পেল
আমার সুদূর পারের স্বপ্নদোসর-সাথে

সেই স্বপ্নস্বরূপের ভিতর তাই বুঝি কখনও হানা দিতেছে দেখি এক ‘চির অচেনা পরদেশী’র স্মৃতি, যাহা হারাইয়াও হারায় না –‘আমি বসে ভাবি নিয়ে কম্পিত হৃদয়খানি,/ তুমি আছ দূর ভুবনে’। কখনও সেই ক্ষীণ প্রত্যাশার বুকে জাগিয়া উঠে এমন এক দুর্মর প্রত্যয় – ‘… সে আসিবে – আমার মন বলে সারাবেলা,/ অকারণ পুলকে আঁখি ভাসে জলে’। কখনও আবার ব্যক্ত হয় আপন হৃদয়সম্পদের উপর এমনই এক গভীর আস্থা – ‘আমার প্রাণের মাঝে সুধা আছে, চাও কি / হায় বুঝি তার খবর পেলে না’।
এ কোন ‘সুদূর পারের স্বপ্নদোসর’এর উদ্দেশে উচ্চারিত প্রলাপ? সে কি ‘বিদ্যুৎবহ্নির অভিশাপে’ চিরবিচ্ছিন্ন হইয়া যাওয়া সেই পারম্পরিক ‘তুমি’? না কি এই জটাজটিল সময়প্রবাহের ‘মেঘে মেঘে তড়িৎশিখার ভুজঙ্গপ্রয়াতে’ বিনির্মিত হইয়া উঠিল অন্য কোনও এক শিল্পীত ‘তুমি’?
প্রিয় পাঠিকা, প্রিয় পাঠক, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজিয়া পাইবার জন্য আপাতত আমাদের কিছু প্রতীক্ষা রহিয়া গেল।

অঘ্রান ১৪১৯

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes