
অজিত সিং বনাম অজিত সিং
পর্ব ৫২
তৃষ্ণা বসাক
৫২
-কোথায় চলে যেতে পারে আপনার স্ত্রী কোন ধারণা
আছে?
ইনভেস্টিগেটিং অফিসার এই প্রশ্ন তো করবেই জানা ছিল
প্রদীপ্তর। সে নিজেই নিজেকে এই প্রশ্ন করে চলেছে খবরটা
পাওয়ার পর থেকে। ভুবনেশ্বর থেকে যত দ্রুত সম্ভব সে
কলকাতায় রওনা দিয়েছে। ফ্লাইটের টিকিটের ব্যবস্থা
করে দিয়েছে কাননবালা জেনা। এত কাজের মেয়ে জীবনে
সে দুটি দেখেনি। সে বুঝতে পারছিল, এই যে তাকে
হঠাৎ করে ফিরে আসতে হচ্ছে, কাননবালার কাছ থেকেও
চলে আসা, আবার ফেরাটা অত সহজ হবে না।হয়তো সে
আর কোনদিন ফিরতেই পারবে না। এইরকমই হয়।
জীবন মাঝে মাঝেই একেকটা বাঁকের মুখে এসে দাঁড়ায়,
শুরু হয়ে যায় আকণ্ঠ নতুন জীবন, যার সঙ্গে আগের
জীবনের বিন্দুমাত্র মিল নেই। কলকাতায় ফিরতে ফিরতে
প্রদীপ্তর কেন জানি মনে হচ্ছিল আর সে ফিরতে পারবে
না। যে কাজ সে শুরু করেছিল সেই কাজের কাছে,
কাননবালার কাছে। দোলন যদি হারিয়েও যায়, তবে
তাকে খোজাটাই তার জীবন হয়ে দাঁড়াবে। আর সবচেয়ে
অদ্ভুত যা, তা হল কানবালার কাছে ফিরতে পারবে না
এই ভাবনাটা তাকে একটুও দুঃখ দিচ্ছিল না, বরং
দোলনের কাছে, বলা ভাল দোলনকে খঁজার কাছে ফিরতে
পারছে ভেবে তার নিজেকে হালকা লাগছিল। সে বুঝতেও
পারেনি এতটা অপরাধবোধ তার মধ্যে জমা ছিল। তার
মনে পড়ছিল, কতদিন সে দোলনকে চেক আপে নিয়ে
যায়নি, কতদিন তাকে নতুন পোশাক কিনে দেয়নি,
ইদানীং বারবার স্মার্ট ফোনের কথা বলত দোলন, সেটাও
সে কিনে দেয়নি। একটা মেয়ে হারিয়ে গেছে, তার কাছে
কোন ফোন নেই। থাকলে তাকে ট্র্যাক করা কত সহজ
হত!
পুলিশ তদন্তে নেমে তো এগুলো খুঁড়ে বার করবে, দোলন
যে সম্পূর্ণ সুস্থ নয়, এখনও মেডিকেশনে আছে, সেগুলো
জেনে যাবে কয়েক মুহূর্তেই। আর তখন আঙুল তার
দিকেই উঠবে। এইরকম অসুস্থ স্ত্রীকে একলা ফেলে সে চলে
গেছে, একটা ফোনও কিনে দেয়নি। যদি কিছু হয়ে যায়
দোলনের, ভাবতেই ওর হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে গেল, মনে হল
দোলন বেঁচে আছে তো? পরশু রাতে পাশের কোয়ার্টার
থেকে তাকে ফোন করে বলা হয় ওদের কাজের মেয়ে
এসে দরজা খোলা পাচ্ছে না, ক্যাম্পাসে আরও কয়েক
বাড়ি কাজ করে সে, ঘণ্টা দুয়েক পরে এসেও সে দেখে
দরজা বন্ধ। ইদানীং দোলন প্রায়ই বেরোত, তবে কাজের
লোক আসার সময়টাতে নয়।
প্রদীপ্ত অবাক হয়ে বলেছিল ‘কেন, দিনরাতের একজন
যে থাকার কথা?’ কাজের লোক তাকে জানাল সে
ভুবনেশ্বর চলে যাওয়ার পরেই দোলন সব ছাড়িয়ে
দিয়েছিল। বউদি ইদানীং ভালো হয়ে উঠছিল। ঘরের
টুকটাক কাজও করতে পারত। আগের থেকে হাসিখুশি
থাকত।
অফিসার তাকে আবার বললেন ‘ এমন কেউ আছেন যার
কাছে যেতে পারেন? কোন রিলেটিভ?’
-ওর বাবা মা মারা গেছেন অনেক বছর। রিলেটিভ তো
কেউ নেই।
-বন্ধু কেউ?
দোলন তো অনেক বছর সব রকম সম্পর্ক থেকে
বিচ্ছিন্ন। ওর ওষুধ চলে। এখন একটু কমলেও বন্ধ হয়নি
ওষুধ।
-কারো সঙ্গে ফোনে কথা হত? স্মার্ট ফোন না থাকলেও
ল্যান্ডফোনে?
প্রদীপ্তর মনে পড়ল না কিছু।
-চিঠি আসত কারো? উনি লিখতেন কাউকে?
চিঠি! হঠাৎ বিদ্যুত চমকের মতো মনে পড়ে যায় কিছু।
কী যেন মেলের কথা বলেছিল একবার দোলন? কারো
একটা মেল এসেছিল। খুব উত্তেজিত ভাবে সেটা পড়াতে
চেয়েছিল প্রদীপ্তকে। প্রদীপ্ত শোনেনি আদৌ। ভেবেছিল
দোলনের অসুখটা আবার বেড়েছে।
-দেখুন কারো সঙ্গে ওর ই-মেল চলাচালি হত মনে পড়ছে
যতদূর। সেটার ডিটেলস জানি না। আমি এত ব্যস্ত
থাকি।
-ইমেল অ্যাকাউন্ট ছিল নাকি ওঁর? বাহ। তাহলে তো
কিছু সূত্র পাওয়া যেতে পারে। কবে খুলেছিলেন? উনি
নিজেই খুলেছিলেন নাকি আপনি খুলে দিয়েছিলেন?
মাথাটা পুরো ব্ল্যাংক হয়ে যায় প্রদীপ্তর। না, সে তো খুলে
দেয়নি কিছু। নিজেই খুলেছিল নাকি? পুরনো ল্যাপটপটা
নাড়াচাড়া করত। শিখে গিয়েছিল নিজে নিজেই?
সে আমতা আমতা করে বলে ‘আমি তো খুলে দিইনি
কিছু, নিজেই খুলেছিল নিশ্চয়, হাতিঘোড়া ব্যাপার তো
কিছু নয়।’
‘হাতিঘোড়া ব্যাপার নয় বলছেন? আচ্ছা, উনিও তো
ইঞ্জিনিয়ার, কত সালের পাস আউট, এই যে পেয়েছি।
অত আগে তো ডস চলত, মেল পাঠানো- এইসব এত
চালু ছিল না, মানে আমি বলতে চাইছি উনি ব্রাইট
স্টুডেন্ট হতে পারেন, কিন্তু কম্পিউটার লিটারেসি কতটা
ছিল, শিখে নেয় মানুষ অবিশ্যি, কিন্তু তার জন্যে তাকে
একটা কাজের মধ্যে থাকতে হয়, উনি তো ছমাসের
মাথায় চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন, তারপর আর করেননি,’
প্রদীপ্ত কীরকম একটা ধাক্কা খেল। এতগুলো বছর দোলন
কোন চাকরি না করে একটা বুনো হাঁসের পেছনে ছুটে
গেছে, যার জন্যে একটা কোথাকার কে অর্ধশিক্ষিত পুলিশ
দোলন ইমেল খুলতে পারে কিনা তার জন্য সন্দেহ প্রকাশ
করছে! হায় কি মহতী বিনষ্টি। কেন সে এরকম হতে
দিল? কেন সে দোলনকে ঠেলে দিল আত্ম বিলোপের
দিকে? কত কী, কত কী করার ছিল জীবনে! চাকরি
তুচ্ছ, সন্তান তুচ্ছ, শুধু দুজনের জন্য ছোট ছোট ভালো
লাগা নিয়ে, পৃথিবীর অনাবিষ্কৃত আনন্দগুলো নিয়ে বেঁচে
থাকা- বড় সুখ তার। তার গা বাঁচানো সিদ্ধান্তের জন্যেই
দোলনের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল, তার জীবনটাও।
কোথায় যে পড়ে আছে দোলন, সে হঠাৎ দেখতে পেল
এক অন্ধকার রাস্তার ধারে ছেঁড়াখঁড়া শরীর নিয়ে পড়ে
আছে দোলন। বাইরের জগতের দূষণের হাত এড়িয়ে সে
তো দিনদিন আরও সুন্দর হয়ে উঠছিল। তার শরীর
কানায় কানায় ভরে উঠেছিল বর্ষার নদীর মতো, সেটা
চোখ এড়ায়নি ওর, তবু সে শরীর তাকে জাগায়নি
বহুদিন, সেই শরীরের কথা ভেবে চোখে জল এল আজ।
সে রুদ্ধ কণ্ঠে বলল ‘অফিসার, ও বেঁচে আছে তো?’
‘সেটা দেখতে হবে। আগে ওঁর সবরকম ইনফো চাই।
ল্যাপটপটা দেখা যাবে একটু?’
অন করে প্রদীপ্ত ল্যাপটপটা। ও আগে এটা ব্যবহার
করত। কোন পাসওয়ার্ড অব্দি নেই এর। এমনিই খোলা
গেল।
প্রদীপ্ত ওর সব দরকারী ফাইল সরিয়ে ফেলেছিল, তাই
এখানে যা আছে সব দোলনেরই। ডেস্কটপটা প্রায় ফাঁকা
ফাঁকা। দু চারটে ফোল্ডার। খুব স্বাভাবিক। দোলন কীই
বা করতে পারত? হয়তো সিভিটা দেখত খুলে , কিছু
পেপার এনে দিয়েছিল, সেগুলো পড়ত, আর মেল পাঠাত।
অফিসার একটু নাড়াচাড়া করেন মাউস। তাঁর চোখে
বিস্ময় ফুটে ওঠে। ‘আপনি শিওর এটা থেকে উনি মেল
করতেন?’
‘হ্যাঁ তাই তো বলেছিল। একবার দেখাতেও চেয়েছিল।
আমি ব্যস্ত ছিলাম’
‘’আপনাদের ওয়াই ফাই কানেকশন আছে তো?’
‘তা তো আছে’
‘তার পাসওয়ার্ড চেয়েছিলেন ম্যাডাম কোনদিন? বা
আপনি দিয়েছিলেন?’
প্রদীপ্ত চমকে ওঠে। না তো! তার মানে দোলন যা
বলত, তার কোন গুরুত্ব ওর কাছে ছিল না।
‘এখান থেকে মেল পাঠানো অসম্ভব। কারণ এখানে কোন
নেট কানেকশনই নেই। ওয়াই ফাই রেজিস্টার করাই নেই।
এক মোবাইল ডেটার হট স্পট দিয়েও করা যেত, কিন্তু
ওঁর তো কোন স্মার্ট ফোন ছিল না।‘
চমকে বসে পড়ে প্রদীপ্ত। ওর মনে হয়েছিল যাকে ই-মেল
পাঠাত তাকে ধরলেই খুঁজে পাওয়া যাবে দোলনকে।
আবার সে একটা এস্কেপ রুট খুঁজছিল। কত দ্রুত
দোলনকে ঘাড় থেকে নামানো যায়।
‘তাহলে !’অস্ফুট আওয়াজ বেরোয় ওর মুখ থেকে।
‘উনি কাকে মেল পাঠতেন বলেছিলেন আপনাকে?’
প্রদীপ্ত মনে করার চেষ্টা করে। কয়েকটা ঢেউ ওর মাথায়
উঠে আবার পড়ে যায়।দেখো দেখো কী লিখেছে আমাকে!
প্রদীপ্তর হঠাৎ মনে হল, মনে পড়ল, এই মেলের সময়
থেকেই দোলনের মধ্যে একটা পরিবর্তন আসে, ও আগের
থেকে অনেক সুস্থ আর স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে, মনে হয়েছিল
প্রদীপ্তর। সত্যি কথা বলতে কি, সেটা দেখেই প্রদীপ্ত হাঁফ
ছেড়ে বেঁচেছিল মনে মনে, সে ভুবনেশ্বরের অফারটা নিয়ে
ফেলেছিল, মনে হয়েছিল দোলন সব সামলে নিতে পারবে।
এখন সেই সিদ্ধান্তটাই তাকে গালে ঠাস করে চড় কষাল।
সে থেকে গেলে এমন হতে পারত না।
-মনে পড়ল নামটা?
-বিদিশা, সম্ভবত ওর ব্যাচমেট।
-সম্ভবত কেন?
– বেশ কয়েক বছর জুনিয়র ওরা। আমার অনেস্টলি
মনে নেই।
অফিসারের মুখে হাসি খেলে গেল।
-ইঞ্জিনিয়ারিঙে হাতে গোনা মেয়ে থাকে, সেটা ছেলেদের
খেয়াল থাকে না এই আষাঢ়ে গল্প আমাকে বিশ্বাস করতে
বলবেন না প্লিজ।
-অনেস্টলি আমার মনে নেই। দোলন তো কারো সঙ্গেই
বিশেষ মিশত না, ক্যাম্পাসের মধ্যেই কোয়ার্টার থেকে
ক্লাস, ক্লাস থেকে কোয়ার্টার এইটুকুই যা, ওর কোন বন্ধু
ছিল না।
-তাহলে আপনি যে বললেন ও ব্যাচমেট বিদিশা বলে
কাউকে মেল করত?
-ও সেটাই বলেছিল। সত্যি বলতে কি আমি ভেবেছিলাম
এইভাবে ও আস্তে আস্তে জীবনে ফিরবে। তাই অত তলিয়ে
ভাবিনি, ঠিক কার সঙ্গে কথা বলছে ও। তবে হ্যাঁ, এই
মেয়েটা মনে হয় বিদেশে থাকত, এটাই বলেছিল।
-এদিকে আপনি বলছেন ওর ক্লাসে আর কোন মেয়ে
ছিল বলে আপনার মনে পড়ছে না।
এবার রেগে উঠল প্রদীপ্ত।
-তখন থেকে ফালতু ব্যাপার নিয়ে হ্যাজাচ্ছেন। একটা
ভার্চুয়াল মেল, জলজ্যান্ত মানুষটা কোথায় গেল খুঁজে বার
করুন। একটু ফিল্ডে নেমে খুঁজুন।
-সেই খোজার জন্যেই তো জানা দরকার, উনি কাদের
সঙ্গে মিশতেন, কোথায় যেতেন… যাই হোক এই
ল্যাপটপটা আমি নিয়ে যাচ্ছি। কাজ হয়ে গেলেই ফেরত
পাবেন।
দুম করে ল্যাপটপ তুলে নিয়ে চলে গেল লোকটা। সে
বেরিয়ে যেতে প্রদীপ্ত দাঁত চেপে বলল ‘বোকাচোদা’
রাধা এসে বলল ‘দাদা একটু চা দিই আপনাকে?’
প্রদীপ্ত মাথা নাড়ল। ওর মনে হল তখন পুলিশটাকে চা
খাওয়ান উচিত ছিল হয়তো। ও ঠিক জানে না, যাদের
বাড়িতে কোন দুর্ঘটনা ঘটে, মৃত্যু হত্যা, নিখোঁজ এইসব-
সেসব বাড়িতে পুলিশ এলে তাদের চা অফার করা হয়
কিনা। এটা তো বেসিক ভদ্রতা। কিন্তু এই ভদ্রতা করবে
কে এখানে? দিলেও হয়তো খেত না লোকটা। রাধা চা
এনে বলল ‘দাদা সব রান্না করা আছে, খেয়ে নেবেন।
বউদির ভাত করিনি। মাছ তরকারি সব আছে। এলে
শুধু ভাতটা করে নেবেন। আর ফিরে এলে একটা ফোন
করে খবর দেবেন কিন্তু’
শেষ কথাটা বলার সময় ধরে এল ওর গলা।
প্রদীপ্ত অবাক হয়ে ওকে বলে ‘তুমি কি সত্যিই ভাবছ
দোলন ফিরে আসবে?’
‘এ আবার কি কথা। অসুস্থ মানুষ। আগে মোটে বেরোত
না। এখন আপনি চলে গেলেন, একদম একা হয়ে গেল
মানুষটা। মন খারাপ ভুলতে টুকটুক করে বেরোচ্ছিল
ইদানীং রোজ। তাও আমি পইপই করে বলতাম বেরিও
না ওরকম। সামনের রাস্তায় যা গাড়ি ঘোড়া। বলত,
আমি তো দূরে যাই না। আমি তাও বলতাম, বেরোনোর
দরকার কি তোমার? দাদা ব্যবস্থা করে গেছে। সব
বাজার দোকান আমরাই আনি। তো বলত আমি
চারজনকে খুঁজছি’
চারজনকে খুঁজছি! হাড় হিম হয়ে গেল প্রদীপ্তর।
সে বলল ‘রাধা বুঝতে পারছ না, তোমার বউদি ফিরবে
না, ওকে খুন করেছে ওরা, ওই চারজন?’
‘আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে? অসুস্থ মানুষ, সব
ভুলে যায়, হয়তো কোথাও গিয়ে বাড়ির ঠিকানা ভুলে
গেছে, আর ফিরতে পারছে না। যাই বলুন দাদা,
আপনার বউদিকে এভাবে ফেলে চলে যাওয়াটা একদম
ঠিক হয়নি। কী এমন কাজ, কলকাতায় হল না, পুরী
যেতে হল? আর পুরীতে গেলেন যদি, বউদির নামে
একটা পুজো দিয়েছেন নিশ্চয়?’
পুজো! অসহায় লাগে প্রদীপ্তর। আর পুরী কেন! হঠাৎ
তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা জনাকীর্ণ রাস্তায়
ট্রাফিক সিগনালে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে দোলন।
রাস্তা পেরোবে কি পেরোবে না বুঝতে পারছে না। রাধা
ঠিকই বলেছে বাড়ির রাস্তা ভুলে গেছে দোলন।
সে বলল ‘আচ্ছা, কোথায় যেতে পারে জানো? মানে
কোথায় কোথায় যেত?’
‘একদিন তো ডাক্তারের কাছে গেছিল জানি। সেদিন
ফেরার পথে কটা জিনিস কিনে এনেছিল। আমাকে
দেখিয়েছিল। আপনি তো কিছু কিনে দেননি অনেকদিন।
মেয়েদের কত কিছু লাগে। বলছিল খুব শিগগির নাকি
কাজে জয়েন করবে তাই সব রেডি করছে।
এই দেখুন না এই প্যাকেটটা।’
সোফায় উপুড় করে রাধা। একপাতা সেফিটিপিন। টিপ,
রুমাল আর একটা গোলাপ ফুল দেওয়া ব্রা, লেস দেওয়া
অপূর্ব। দোলন, দোলনের স্তনদুটি, দারিংবাড়ির শালবন,
শালবনে সরসর করে বয়ে যাওয়া হাওয়া, মান্দাসারুর
সেই গাছে বাঁধা দোলনা। দোলনায় দুলতে দুলতে দোলন
গাইছিল ‘আজু সখি মুহু মুহু গাহে পিক কুহু কুহু’। ও
পেছনে দাঁড়িয়েছিল। কফিশপের ছেলেটাকে বলেছিল ছবি
তুলে দিতে। খুব কম ছবি আছে ওদের একসঙ্গে। আর
তার মধ্যে বাঁধানো তো কমই। দোলন কখনো কখনো
বললেও সে বলেছে এই কোয়ার্টারে এই তো দুটো মোটে
ঘর, কোথায় ছবি টাঙ্গাব?তবু দোলনের জেদে দেওয়ালে
কোলাজ করে রাখা আছে এই ছবি, বিয়ের ছবি, ওর
বাবা মার ছবি।
প্রদীপ্ত রাধাকে বলে ‘এসব তুলে রেখে দাও, যেমন ছিল।
ভেতরের ঘরে রেখে দাও’
রাধা প্যাকেটে গুছিয়ে রাখে। প্রদীপ্ত টিভির পেছন থেকে
একটা ডাস্টার পেয়ে যায়, সে দেওয়ালের ছবি গুলো
পরিষ্কার করতে শুরু করে। রাধা বলে ‘আমি আসি দাদা,
বিকেলে তো আসব আবার। আপনি এখন চান করে খেয়ে
নিন। বউদি ঠিক ফিরে আসবে, টিভিতে একটা বিজ্ঞাপন
দিয়ে দিন না। আজকাল বউদি খুব টিভি দেখত,
অষ্টপ্রহর চলত টিভিটা। ঠিক দেখুন রাস্তায় কোন টিভির
দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে টিভি দেখছে। নিজেকে দেখলেই
সব মনে পড়ে যাবে’
দারুণ একটা সমাধান দিয়েছে যেন, এইভাবে পরিতৃপ্ত মুখে
বেরিয়ে যায় রাধা। প্রদীপ্ত যেন কিছু শুনতেই পায়নি,
এইভাবে ছবি মোছে, মুছতেই থাকে। দোলনায় বসে আছে
দোলন, পেছনে সে- দুজনের মুখে গলে গলে পড়ছে
আনন্দ। এই ছবিটা কি তাদেরই? তারাই, নিজেরা এত
খুশি হতে পেরেছিল কখনো? বাইরের কোন প্রাপ্তি,
চাকরি, প্রমোশন, পি এইচ ডি, সমাজ ছাড়াই? তাহলে
সেটা কেন ধরে রাখা গেল না? সে, সে-ই রাখতে
পারল না ধরে। দোলনকে নিজের ঘাড় থেকে ঝেড়ে
ফেলার জন্যে সে তাকে বারবার প্ররোচিত করে চলল
ইন্টারভিউর জন্য? এই বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আরও কত
জায়গা ছিল, সেদিকে মুখ ঘোরাতেই দিল না দোলনকে।
চিরকালের পড়ুয়া মেয়ে দোলন। ওর মা ওকে নিজের
ইচ্ছের ছাঁচে গড়ে তুলেছিল, তাই সে সেই ছাঁচ থেকে
কখনো বেরোতে পারেনি, সেটাকে এক্সপ্লয়েট করল প্রদীপ্ত।
মায়ের বদলে প্রদীপ্তর কথাকেই বেদবাক্য মনে করত
মেয়েটা। সে বিশ্বাস করত প্রদীপ্ত যা সিদ্ধান্ত নেবে সব
তার ভালর জন্যে। তবু শেষদিকে, একদম শেষ
ইন্টারভিউটা সে একদম দিতে চায়নি। রিভোল্ট
করেছিল। বলেছিল ‘আমি নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছি প্রদীপ্ত,
আপাতত আমি আমার সন্তান ছাড়া আর কিছুই ভাবতে
চাই না। ওকে বছর তিনেকের করে তারপর অন্য কিছু
ভাবব। তুমি দেখো আমার চাহিদা কত কম, নিজের
জন্যে কোনদিন একটা শাড়ি বা সালোয়ার কিছুই কিনিনি।
তাই তুমি যা রোজগার করছ, আমাদের জন্যে যথেষ্ট।
এতেই খুব ভালো চলে যাবে। আমাকে জোর করো না।
জীবনে এই প্রথম আমি নিজের প্রায়োরিটি বুঝতে পেরেছি
আমি। আমাকে জোর করো না’
কাকুতি মিনতি করেছিল দোলন। সে শোনেনি। তার
বিশ্বাস ছিল এবার দোলনের হবেই। প্রদীপ্তর বৌ সে, তার
কি একটা ওজন নেই? তাতেই ওকে নিতে বাধ্য
ওরা।কিন্তু সে বুঝতেই পারেনি ভালো রেজাল্ট বা পরিচিত
বৃত্ত- এগুলো শেষ অব্দি কোনটাই বিবেচ্য নয়। একটা
জিগ স পাজল আগে থেকে করা আছে। তার সঙ্গে ম্যাচ
করবে এমন একটা টুকরো চায় ওরা। সেই টুকরোটা যদি
সব দিক থেকে বড় হয় তাহলে মুশকিল। যদি সেটা
একটা নিজস্ব স্বাদ গন্ধ হীন একটা পাঁউরুটির মতো হয়,
তবে ওরা তাকে ছেঁটে কেটে ইচ্ছেমত ঝলে ঝালে অম্বলে
ব্যবহার করতে পারে, কিন্তু অতিরিক্ত হয়ে গেলেই
মুশকিল। তাকে ওদের কাজে লাগবে না। ওদের সেটিং টা
নষ্ট হয়ে যাবে। দোলন সেই সেটিং টাতে ফিট করেনি।
ওর এত ভালো অ্যাকাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড, ওর ব্যক্তিত্ব,
ওর পবিত্রতা- সব মিলিয়ে ও ওদের কাছে একটা থ্রেট,
একটা অস্বস্তি। সেটা কেন বোঝেনি প্রদীপ্ত। কান্নায় ভেঙে
পড়ল সে। দোলনের বাবার ছবিটা দেখল সে। কী কষ্ট
ওঁর চোখ দুটোতে। কত যন্ত্রণা নিয়ে চলে গেছেন উনি।
সেই সময় ফোন বাজে। সেই অফিসার। ‘শুনুন আমরা
খোঁজ নিয়েছি। ওই বছর দোলনচাঁপা ধরের ব্যাচে কোন
মেয়েই ছিল না, বিদিশা তো দূরের কথা!’
ভয়টা ছড়িয়ে পড়ছে। অদ্ভুত ভয়। লেখাটা আজকের মতো থেমে গেলেই অসহায়, পরিস্থিতির শিকার মুখগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। অনেক চরিত্র অথচ কোনোটাই হারিয়ে যাচ্ছে না। প্রত্যেকটি চরিত্রের নিজস্ব যন্ত্রণা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে তারা একে অপরের থ্রেট হয়ে উঠছে।