
যন্ত্রণা, হাহাকার, বিষাদ যেখানে এক
অমিতাভ মৈত্র
আড়াই বছর বয়সের ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে ঝ্যাং জিনলেই জন্ম থেকেই থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। চিনের সিচুয়ান প্রদেশের বাসিন্দা ঝ্যাং লিয়ং একজন গরিব চাষি। স্বামী-স্ত্রী মিলে মাসে রোজগার ২৮৭ পাউন্ডের সমান। সামান্য রোজগার বলা যায়। মেয়ে জিনলেইকে সুস্থ করতে তাদের রোজগারের প্রায় সবটুকুই খরচ হয়ে যায়। মেয়ের চিকিৎসায় এ পর্যন্ত প্রায় ১৭০০০ পাউন্ড চলে গেছে। সম্ভাব্য সবকিছু নিঃশেষে বিক্রি হয়ে গেছে। প্রতিবেশীদের থেকে নতুন করে আর ধার পাওয়ার আশা নেই। তাঁরা জানেন এখন তাঁরা স্রেফ মেয়ের মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছেন। চাষের কাজে যান না আর কেউ। নিজেদের কথা আর তাঁরা ভাবেন না। যতোটা পারেন সঙ্গ দেন মেয়েকে। শিশুটিও যন্ত্রণা ভুলে হাসি ফিরিয়ে দেয় মা বাবাকে। চিকিৎসকরা খোলাখুলি জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের মতো আর্থিক অবস্থায় মেয়েটিকে সুস্থ রাখার চিন্তা করাও অন্যায়।
ছোট্ট জিনলেই এখন বাড়ির উঠোনে বসে দেখে বাবা ঘেমে নেয়ে মাটি খুঁড়ছে। হেসে মাঝে মাঝে হাত নাড়ছে তার দিকে। জিনলেইও হাসে। হাত নাড়ে। মৃত্যুর মধুর এই বাস্তবতাকে ঝ্যাং লিয়ং মেনে নিয়ে কবর খুঁড়ছে মেয়ের জন্য। নতুন কোপানো মাটি সরিয়ে রোজ তারা সেই কবরের মাটিতে শুয়ে বিশ্রাম নেয়, খেলে। এই নতুন খেলা মেয়েটির ভাল লাগছে। অনেক ওপরের আকাশ গাছপালা পাখি দেখে আনন্দে গলা জড়িয়ে ধরে বাবা/মায়ের। হাসে। মেয়েটিকে ঝ্যাং লিয়ং বলে, এটা তার নতুন বাড়ি হবে শিগগিরি। আদরের মেয়েটিকে মৃত্যুর সাথে পরিচিত করাতে নয়, বরং অমোঘ ও অবশ্যম্ভাবী ভবিষ্যতের জন্য চোখের জলে ভাসতে ভাসতে একজন বাবা আর একজন মা নিজেদের প্রস্তুত করে নিচ্ছে তাদেথ ফুটফুটে হাসিখুশি শিশুটির মৃত্যু-দৃশ্যের জন্য।
আমাদের সংবাদমাধ্যম এখানে এসে থেমে যাবে। থেমে যাব, ভুলে যাব আমরাও। এতো রকম মনোহর উত্তেজনা সারাক্ষণ ঘটে চলেছে চারপাশে-আমাদেরও কী দোষ আছে! যেখানে সংবাদ থেমে যায় সেখানে বিষাদ এসে কালো করে দেয় সবকিছু। সেই ঘন তমসায় মুখ চেপে গুমরে সারাজীবনের মতো কেঁদে যাওয়া ঝ্যাং লিয়ং আর তার স্ত্রীকে আমরা খুঁজবো না। শোক যখন উপরিতলের, তখন কান্নার শব্দে, বুকফাটা আর্তনাদে তাকে চেনা যায়। বিষাদ একরকম ধ্বংসাত্মক অর্জন, একরকমের ঋণাত্মক জ্ঞান। বিষাদে কান্না থাকে না। ভাগ্যিস থাকে না!
২
সাড়ে তিন বছরের ছোট্ট মেয়েটি মাকে বলেছিল, “বাবা আমাকে চাকু মারে।” মা বিশ্বাস করেনি। তার পাতানো স্বামী সনাতনকে সে বিশ্বাস করেছে। যখন যে ব্যাখ্যা দেয়, মেনে নিয়েছে। কিছুদিন পর শিশুটির যৌনাঙ্গ থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। পাতানো স্বামী সনাতন বলে ”বদ রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে, তাই এসব হচ্ছে।” চোখের চারপাশের জমাট রক্তের দাগ সনাতনের উন্মাদ আঘাতের মূক সাক্ষী। দু’দিন জ্ঞান ফিরল না শিশুটির। পাতানো বাবার নির্মম মারের চোটে দুটো হাতই ভেঙে গেছে শিশুটির। মা নিশ্চিন্ত। নিরুদ্বিগ্ন। নতুন স্বামীর স্নেহে অন্ধ। সে কেন দেখবে পাতানো বাবাকে দেখলেই মেয়েটি ভয়ে সাদা হয়ে যায়, ঘুমের মধ্যে গুমরে কাঁদে? সে কেন খোঁজ রাখবে মেয়েটির শরীরে এতো সূঁচ ঢুকে যাচ্ছে কেন? দুদিন জ্ঞান ফেরেনি মেয়ের। মা চিন্তাহীন। ডাক্তার দেখানো হবে না, কাউকে জানানো হবে না। দুদিন পর যখন জ্ঞান ফিরল কথা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে শিশুটির। চোখের দৃষ্টি নষ্ট হয়ে গেছে সামান্য নড়চড়াও করতে পারে না। গলা কাটা পশুর মতো ক্ষীণ একটা জান্তব শব্দ ওঠে মাঝে মাঝে। পাড়া পড়শির চাপে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হল শিশুটিকে। মা চায়নি। স্যালাইন লাগানোর সময় বহুদিন পর একটি মাত্র কথা বলে মেয়েটি তার মাকে-“মা, আমি মরে যাব।”-মেয়েটি কথা রাখে। মেয়েটি মরে যায়।
সারা শরীরে সাত-আটটি শক্ত সূচ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল এক মাস ধরে। চিৎকার বন্ধ করতে মুখ চেপে ধরা হতো। বাষট্টি বছরের একটা লোক ধর্ষণ করতো সাড়ে তিন বছরের শিশুটিকে। তখনও তার মুখ চেপে ধরা হতো চিৎকার বন্ধ করতে। কাউকে বলে লাভ নেই তার চিৎকার কোথাও পৌঁছাবে না-শিশুটির মধ্যে এই বোধ, এই চেতনা জন্ম নিলো। শরীরে নিঃশেষে প্রবিষ্ট সূচ নিয়ে পাতানো বাবার ব্যক্তিত্বে আচ্ছন্ন মাকে চুপি চুপি একবার মাত্র বলেছিল “বাবা আমাকে চাকু মারে।” সূচ শব্দটি জানে না যে সে! শিশুটির উচ্চারিত চাকু শব্দটিকে দেখল মা, শিশুটিকে দেখল না। মেয়ের ছেলেমানুষী দেখে হেসে উঠল। এভাবেই হেসে উঠবেন বিচারক। বিচার ব্যবস্থা তো এই শব্দছকের ওপরেই দাঁড়িয়ে।
আমার ইচ্ছে করে ছোট্ট একটি আলো-কণা হয়ে এই শিশুটির মনের মধ্যে খুঁজে বেড়াতে। কী ভাবত সে, মুখ গুঁজে, শরীরে, সূচের যন্ত্রণা সহ্য করতে গলা কাটা ধর্ষণ সহ্য করতে করতে, মেরে দুটো হাত ভেঙে দেওয়ার যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে! একবার মাত্র, বধির ঈশ্বরকে বলার মতো, মাকে বলতে পেরেছিল। একটু বাঁচতে চেয়েছিল বোধহয়। একটু হয়তো আশা করেছিল- যাদের কান আছে তারা শুনবে। এক হিংস্র অমানুষিক পৃথিবীর সুস্থতার উজ্জ্বল প্রমাণ দিতে যখন সে গোঙাতো চোখ বুঁজে, ভুল করেও আর কখনো কাউকে তার বেঁচে থাকার রক্তপাতময় মাশুল গুণে যাবার কথা বলেনি সে। বাঁচার কথা ভাবেনি।
যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত কাফকা যখন প্রথম রক্তবমি করেছিলেন, তাঁর মনে হয়েছিল তিনি মাকে জড়িয়ে ধরে আছেন ছোটবেলার মতো। কাফকা মহান। তিনি লিখে গেছেন। তাঁর মহান গুণগ্রাহী বন্ধুরাও তাঁর কথা জানিয়ে গেছেন মানুষকে। এই শিশুটির সেই যোগ্যতা বা খ্যাতি নেই। কিন্তু অসুস্থ কাফকা বা ক্রুশ কাঠে ঝুলে থাকা একটি রক্তাক্ত শরীর, যার মাথায় কাঁটার মুকুট আর হাতে পায়ে হাতুড়ি মেরে পেরেক ঢুকিয়ে দেওয়া- সেই মানুষটির একবার মাত্র চিৎকার “My lord, my lord! Why hast thou forsaken me!” এর পাশে রক্তাক্ত, ভীত, শিশুটির মাত্র একটিবার মা’র কাছে চুপিচুপি বলে যাওয়া ‘মা, আমি মরে যাব’ বিন্দুমাত্র কম আর্তিময় নয়। এক জায়গাতেই সে হেরে যায়-সে বিখ্যাত নয়। তার কথা কেউ জানবে না।
কাফকা বা খ্রিস্ট তাদের সাড়ে তিন বছর বয়সে ধারণাও করতে পারতেন না যে যন্ত্রণা এবং যে বিষাদ- সাড়ে তিন বছরের একটি শিশুকে তা সহ্য করতে হত মুখ বুঁজে। যখন সে দিনরাত যন্ত্রণায় গোঙায়, রোগা অভুক্ত মনমরা একটা বিষাদ সঙ্গ দেয় তাকে। সে একা। তার বিষাদও সমান একা। কাফকার লিটারারি বিষাদের বা খৃষ্টের মহিমা উদ্ভাসিত বিখ্যাত বিষাদের জমকালো পোশাক এই শিশুটির বিষাদ পাবে না। এই মারাত্মক পুরস্কার পেয়ে যাওয়া শিশুটিল জন্য আজ সেই সব শ্রদ্ধাপূর্ণ অভিজাত, সুদূর বিষাদও একটু যেন আনমনা হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছে এবার সে অন্য একটা নাম নেবে কিনা।
৩
আমার দু’তিনটে বাড়ি পরে একটি ছেলে আর একটি মেয়ে, মাতৃপিতৃহীন ভাইবোন, একটা জিভকাটা, মুখ সেলাই করা বাড়িতে থাকে। চল্লিশের কাছাকাছি বয়স এখন দু’জনেরই। পনেরো বছর আগে মাঝেমাঝে কখনো দেখতাম ছেলেটাকে বাড়ির ছাদে গলায় চেন বাঁধা একটি দেশী কুকুরের সঙ্গী হয়ে, আবার কখনো ছেলেটিকে হয়তো দু’তিনমাস পরে একদিন হেঁটে বেড়াতে দেখতাম। পনেরো বছরের মধ্যে আর কেউ দেখেনি ছেলেটাকে। মেয়েটিকে দেখা যায় মাঝে মাঝে যখন সে কিছু কিনতে বাড়ির বাইরে বেরোয়। কুড়ি বছর আগে আগুনে পুড়ে মা মারা গেছে ওদের। তারপর থেকে ওদের বাবার হিংস্র চিৎকার শোনা যেত ছেলে-মেয়ের উদ্দেশে, মায়ের মৃত্যুর জন্য তাকে মনে মনে দায়ী করার জন্য। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর কোনো ঘোষণা ছাড়াই এক ভাষাহীনতার পৃথিবীতে পা রাখে দু’জনে। রাস্তায় বেরোলেও মেয়েটি ঘাড় শক্ত করে, কারো সাথে কোনো কথা না বলে, হেঁটে যেত। দোকানে স্লিপ দিয়ে জিনিস কিনে, নিঃশব্দে দাম দিত। অনেক বছর আগে অন্ধকারে একবার ধাক্কা লেগেছিল ওর সাথে। প্রায় অস্ফূট ‘সরি’ বলে কিছু না দেখেই চলে যায়। বছর দশ আগে তাদের বাবা মারা গেছেন। তাঁর গলাও আর শোনা যায় না। কুকুরটিও মারা গেছে। কুকুরের চিৎকারে বাড়িটা একসময় হয়তো বুঝাতে পারতো সে বেঁচে আছে। হয়তো ঐ শব্দটুকুই ছেলেটি আর মেয়েটিকে বোঝাতো যে তারাও বেঁচে আছে কোনওভাবে। ভাষা থেকে মুখ ফিরিয়ে, জীবন থেকে সম্পূর্ণ মুখ ফিরিয়ে, বেদনায় অন্ধকারে যে ছেলেটি আর মেয়েটি আস্তে আস্তে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে নিজেদের। অভিজাত অহংকারী বিষাদ এদের জন্যও একটা অন্য নাম দিতে চায় নিজেকে।
৪
পরিশিষ্ট অথবা উপক্রমণিকা-
বিষাদ এক জমাট কৃষ্ণগহ্বর, যে তার অপরিসীমে হারিয়ে যেতে দেয় সব। মহাশূন্যের মতো পরিব্যাপ্ত সে। নিজের চেতনার জাগরণে, নিজের অসহায় পাথরে নিজেকে আছড়ে, নিজের চিৎকার ও যন্ত্রণায় কোনো উপশম নেই জেনে মানুষ যখন নির্জন হয়ে যায়, বিষাদ তখন কাছে আসে। বিষাদ এক অভিশপ্ত অর্জন। কাফকা, খৃষ্ট আর আমাদের অত্যাচারে মরে যাওয়া শিশুটি এখানে অসহায়ভাবে রক্তাক্তভাবে সমান।
অসুস্থ মায়ের শরীরে ওষুধের মালিশ দিয়ে যে শিশুটি সুস্থ করতে চাইত মাকে, অনেক পরে গোটা পৃথিবী তাকে বিখ্যাত ভাস্কর হেনরি মুর বলে জানবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মাটির নিচে টিউব রেল স্টেশনে যুদ্ধবিধ্বস্ত যন্ত্রণাবিদ্ধ মানুষের স্তূপের মধ্যে একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত অসামরিক কর্মী হিসেবে ঘুরে বেড়াতেন হেনরি মুর। রাত্রে ঘরে ফিরে অসহায় যন্ত্রণায় সেই সব দৃশ্য আঁকতেন। সেই সব ছবি, সেই সব মূর্তির মধ্যে ছেলেবেলার সেই হাত বুলিয়ে দেওয়া শুশ্রূষা ফিরে এল অবচেতনে। সব কিছু যেন মুছে দেওয়া হচ্ছে। পৃথিবীকে যেন এভাবেই উপশম দেবার চেষ্টা করছেন হেনরি মুর শান্ত করে দিচ্ছেন সব তীব্রতা।
যদি কবরে খেলতে থাকা শিশুটি কিংবা শরীর ভর্তি সূচ নিয়ে মরে যাওয়া শিশুটি বা ভাষা ছেড়ে যাওয়া ভাইবোন যদি কখনো দাঁড়াতো হেনরি মুরের সামনে- তাদের পাথরের মূর্তি নিশ্চয়ই সেই শুশ্রূষা পেত আমরা যা দিতে পারিনি। আমরা যা দেব না।
অসাধারণ একটি লেখা পড়লাম। আবিস্কার করলাম একজন লেখককে অনেক দিন পর….