অজিত সিং বনাম অজিত সিং <br /> তেতাল্লিশতম পর্ব <br /> তৃষ্ণা বসাক

অজিত সিং বনাম অজিত সিং
তেতাল্লিশতম পর্ব
তৃষ্ণা বসাক

৪৩

কীসের ছবি তুলব? এই ঘরটার?
কুন্তলের গলায় একইসঙ্গে বিরক্তি আর বিস্ময় ফুটে ওঠে।
খুব স্বাভাবিক। বারবার ফোন করে ডাকা হল তাকে। ছবি তুলতে হবে। কীসের ছবি সেটা জানতে চাইলে বলা হয়েছিল, এই বাড়ির মধ্যের বিভিন্ন ছবি।
কুন্তলের কিছু মনে হয়নি তখন। অনেক কাজ আসছে আজকাল এইরকম। বাড়ির ছবি তোলার। বাড়ি দিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রোমোটারকে। তাই স্মৃতি হিসেবে রেখে দেওয়া হচ্ছে সেসব। কুন্তল ভেবেছিল সেরকম কিছু। তাছাড়া ভালো টাকা দিচ্ছে, তাই ভাবার কিছু নেই। কিন্তু এখানে এসে থেকে কাজটাই বুঝতে পারছে না সে।
কলকাতা থেকে বেশি দূর না, একটা খুব পুরনো বাড়ি। সামনের অংশটা পোড়ো । বটের চারা নয়, রীতিমতো ঝুরি নামান বটগাছ দেওয়াল থেকে। এক ঝলক দেখেই বুঝল দারুণ ফোটোজেনিক এসব। ওর ধারণা ঠিক ছিল। বাড়ির এই অংশটা ভাড়া দেওয়া হয় সিনেমা আর মডেলিং-র জন্যে। মাঝে মাঝে টুকটাক মডেলিং শুট করে থাকে কুন্তল। তখন পরিত্যক্ত কার শেড, বাতিল গুদাম বা এরকম পুরনো বাড়িই ওর পছন্দ। ও ঠিক করল একবার এখানে আসবে জেসিকাকে নিয়ে ফোটো শুট করতে।কোন প্রডাক্টের জন্যে নয়, ও জেসিকার পোর্ট ফলিও বানিয়ে দেবে এখানে ছবি তুলে। ও ভাবছিল জেসিকা যখন আর্থ কালারের শাড়ি পরে চুল খুলে, দস্তার গয়না পরে এই ইঁট বার করা দেওয়ালে বটের ঝুরির সামনে দাঁড়াবে, তখন কি অসাধারণ লাগবে ওকে।
বডি পেন্টিং ওয়ার্কশপে দেখা ওর সঙ্গে, ওর গায়ে সুতোও ছিল না তখন, অসম্ভব এক্সপ্রেসিভ চোখ, কিন্তু মনে হচ্ছিল তাতে অনেক দুঃখ লুকিয়ে আছে, হয়তো এভাবে নিসুত হয়ে শরীরটাকে ক্যানভাস করে দিতে ওর আপত্তি আছে। কুন্তল দেখেছিল, ওর ফিগার শুধু দারুণ তাই নয়, ও যথেষ্ট লম্বাও। বডি পেন্টিং-এ ও ক পয়সাই বা পাবে? ওর আসল জায়গা মডেলিং।
কথা সেইভাবেই শুরু হয়েছিল। যদিও কাজ হয়ে গেলেই বাড়ি চলে যাবার জন্যে ছটফট করত জেসিকা। প্রথম প্রথম কাজ ছেড়ে দেবার আগে অব্দি ওর এত সময় ছিল না, কিন্তু পরে যখন ওই চ্যানেল ও ছেড়ে দিল, র‍্যাদার ওকে ছাড়িয়ে দিল, ওর হাতে অনেক দিন পরে প্রচুর সময়। আর এই প্রথম একটা চাকরি পেয়ে ও চাকরি ছাড়েনি সে, এই প্রথম সেই কেরিয়ারের শুরুতে শোনা সাবধান বাণী তার ওপর কোন চাপ তৈরি করতে পারল না। সেই যে সবাই বলত কেরিয়ারে যেন কোন ব্রেক না পড়ে।এত বছর সে কোন ডটেড লাইন আসতে দেয়নি তার কেরিয়ারে। টানা অবিচ্ছিন্ন একটা রেখার মতো ছিল তার গ্রাফ। কিন্তু এইবার তার মনে হল কি ফালতু এসব কন্সেপ্ট। কী চাকরি করেছে সে, যার ব্রেক আদৌ ম্যাটার করে? এই প্রথম তার মনে হল চুপ করে ভাববে সে, উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরবে এদিক ওদিক। তাই মার সঙ্গে স্কুলে যাওয়া, ওদের ওয়েব সাইট বানানো এইসবে জড়িয়ে পড়েছিল।খুব ভালো লাগছিল। আর মাঝে মাঝে ওয়েডিং ফোটোগ্রাফি বা সিনেমার স্টিল ফটো এইসব অফার আসছিল টুকটাক। এত বছরে যোগাযোগ তো ভালই হয়েছে। তাই উপার্জন হচ্ছিল মন্দ না। আর তখনই সে জেসিকাকে নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবতে শুরু করে। মনে হল মেয়েটা নিজেকে নষ্ট করছে।শীত গ্রীষ্ম বর্ষা নিজের শরীর আর্টিস্টের সামনে খুলে দিয়ে ও কী পাবে? না নাম, না পয়সা। কিন্তু মডেলিং বা সিনেমায় ও যা অর্জন করবে, তা ওর নিজের, সেখানে পণ্য নির্মাতা বা সিনেমা পরিচালকের চেয়েও লোকে বেশি চেনে মডেল বা হিরোইনকে। সেইসব ভাবছিল কুন্তল, সারাদিন ধরে অন্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে ও জেসিকার কথা ভাবছিল। ওকে একটা ঝকঝকে ভবিষ্যৎ কি সে দেখাতে পারে না?
কিন্তু ভাবনাই শুধু, জেসিকাকে এসব বলার সুযোগ ছিল না, কারন তার ফোন নম্বর নেওয়া হয়নি। ফোন নম্বর নেবার মতো পরিস্থিতিই তৈরি হয়নি।
একদিন রাতে, শনিবার ছিল সেটা, সেই বন্ধু হিরণ্ময় ডাকল তাকে পরের দিন ওয়ার্কশপ আছে, তার বাড়ির খুব কাছেই। হরিনাভির পেছনে বাগানতলা, সেখানে একটা পুরনো বাড়িতে হবে, কুন্তল রাজি হয়ে গেল কারণ রোববার বাড়িতে থাকতে তার ভালো লাগে না, এতদিন লাগত, কারণ তখন ছুটি বলতে কিছু ছিল না, বহু কষ্টে এক আধ দিন ডে অফ পাওয়া যেত, কিন্তু ব্যাঙ্ক পোস্ট অফিস এইসব কাজ সারার জন্যে সেটা সাধারণত কোন উইক ডেই হত। তাই সেসময় একটা রবিবারের জন্য টান ছিল তার। আজকাল তো সবই রবিবার, সেদিন বাড়ির সঙ্গ এড়িয়ে যেতে পারলেই ভালো যেন। দ্বিতীয়ত জায়গাটা বাড়ির কাছে। আজকাল কলকাতা যেতে কি যে বিরাগ তার।
বাগানতলার রাস্তায় ঢুকে একটু ভেতরেই বাড়িটা। দেখে একটু আশ্চর্যই হল সে। এই বাড়িটা এখনো প্রোমোটারের হাতে যায়নি কেন? অনেকটা জায়গা বাড়ির চারপাশে। মোরাম বিছোনো রাস্তা সোজা গাড়ি বারান্দায় গিয়ে উঠেছে। তিন ধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠলেই বিরাট হলঘর। একসময় এই হলঘরে সশস্ত্র বিপ্লবীদের অনেক সভা হয়েছে জানাল হিরণ্ময়। গেটে যে নামটা লেখা ছিল তাতে অবশ্য কুন্তল সেটা বুঝেই গেছিল। হলঘরের দেওয়াল জুড়ে অনেক ছবি, মূলত দেশমাতৃকার ছবি, নানান বেশে, নানান পরিবেশে। বংগভঙ্গ আন্দোলনের সময় জগন্ময় হালদারের আঁকা।হঠাৎ কুন্তলের মাথায় একটা চিন্তা এল। ইস সে কি বোকা।হিরণ্ময় হালদার। জগন্ময় হালদার। তার মানে!
ও প্রশ্ন করতে যাবার আগেই হিরণ্ময় হেসে বলল ‘হ্যাঁ ঠিকই ধরেছিস, উনি আমার পূর্বপুরুষ। তবে সরাসরি নন। উনি বিয়ে করেননি। আমার ঠাকুর্দার ভাই।’
কুন্তল উত্তেজিত হয়ে বলে ‘শালা করেছ কি! এত বড় বাড়ি তোমার! কোটি টাকার সম্পত্তি মাইরি’
হিরণ্ময় মুচকি হেসে বলল ‘সে গুড়ে বালি। এ বাড়ি দেশের কাজে দান করা। একটা ট্রাস্টি বোর্ড আছে। কিন্তু তারা সবাই মরে হেজে গেছে, একজন অতি বৃদ্ধ, তাকেই ধরে আমি মাঝে মাঝে আসি, তিনি মরলে কী হবে জানি না, পার্টির ছেলেরা প্রায়ই হুমকি দ্যায়, এখানে মালটিস্টোরিড তুলতে চায় প্রোমোটাররা। বুকোর নাম শুনেছিলে তো?’
নামটা চেনা লাগে কুন্তলের। কোথায় যেন দেখাচ্ছিল। কোথায় শুনেছে সে এই নামটা মনে করতে পারে না।
‘আরে এই এলাকার টেরর ছিল। ও তো গিলেই নিচ্ছিল বাড়িটা, কিন্তু এখানে কিছু পুরনো লোক আছে, তাদের কাছে জগন্ময় হালদার নামটার একটা মানে আছে। তারা আটকে দ্যায়। আর ওদিকে বুকোও টেঁসে যাওয়ায় আপাতত শান্তি কল্যাণ’
কুন্তল লাফিয়ে উঠে বলে ‘এইবার মনে পড়েছে, বাইপাসের দিকে শুট আউটে মরেছে না এই বুকো? বড় কোন গ্যাং আছে এর পেছনে’
হিরণ্ময় ব্যাপারটা পাত্তা না দিয়ে বলল ‘ওরা তো এইভাবেই মরে। যে মেরেছে, সেও মরবে কদিন পরে’
সেই মুহূর্তে একটা গাড়ি এসে থামল গাড়ি বারান্দায়। আর সেখান থেকে তিনজন নামল।প্রথম দুজনকে চেনে না কুন্তল, কিন্তু সবার শেষে যে নামল, সে জেসিকা। কিন্তু সেটা তো ও আন্দাজেই বুঝল। কারণ জেসিকা পরে আছে একটা লাল কালো ডুরে শাড়ি, কপালে ছোট্ট লাল টিপ, কানে রূপোর ঝুমকো ছাড়া আর কোন অলংকার নেই। কুন্তলের মনে হল দেওয়ালে জগন্ময় হালদারের বঙ্গ জননীর সঙ্গে এই জেসিকার ভীষণ মিল। এর আগে এক বারই রঙ ছাড়া দেখেছে সে জেসিকাকে। শরীরের রঙ উঠিয়ে সে জিনস আর টি শার্ট পরে লাফিয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল।
সেই জেসিকা আর এই জেসিকায় কোন মিল নেই। কুন্তল অবাক হয়ে দেখছিল ওকে। হিরণ্ময় বলল ‘জেসিকা, এসো কুন্তলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।তুমি ওকে দেখেছ আগে।দুর্দান্ত ফটোগ্রাফার কুন্তল। আগের দু দিন ও আমাদের ওয়ার্কশপ কভার করেছে, এবারও করবে।ও করছে বলে আমি খুব গ্রেটফুল। কারণ এই ধরনের ওয়ার্কশপ কভার করার যোগ্যতা সবার থাকে না। হি ইজ ভেরি রিলায়েবল অ্যান্ড রেস্পেক্টফুল, ও শুধু একজন অসাধারণ ফটোগ্রাফার নয়, একজন অসাধারণ মানুষও’
জেসিকা এর উত্তরে কিছু বলল না, শুধু ওর আয়ত চোখ মেলে ওকে দেখল চুপ করে। এমন অতলান্ত চাহনি যে কুন্তলের অস্বস্তি হচ্ছিল, যেন ওর ভেতর পর্যন্ত পড়ে নিচ্ছে মেয়েটা।
হিরণ্ময় বলল ‘যাও ভেতরে যাও, ভাল করে ব্রেকফাস্ট করো, আমরা ব্রেকফাস্ট খেয়ে টানা তিনটে অব্দি কাজ করব। তারপর লাঞ্চ। লাঞ্চের পর আর কাজ নয়, আলো পড়ে আসবে। তখন স্রেফ আড্ডা। তুমি তখন চলেও যেতে পারো।’
কুন্তল এসব ঠিক শুনছিল না। ও ভাবছিল জেসিকাকে কখন বলবে কথাটা। এখানে হিরন্ময়ের সামনে বললে ও খুব হার্ট হবে। কারণ বডি পেন্টিং-র জন্যে মডেল পাওয়া যায় না। জেসিকাকে ভাঙ্গিয়ে নিলে হিরণ্ময় হয়তো তার সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখবে না। জেসিকার ফোন নম্বর চাইতে হবে। কিন্তু কখন?
টিফিন দেওয়া হল লুচি, সাদা আলুর তরকারি তার সঙ্গে দরবেশ আর জলভরা । বাগানে গাছ তলায় বেদিতে বসে খাচ্ছিল সবাই, হিরণ্ময় কী কারণে ভেতরে গেল আর সেই সুযোগ পেয়ে গেল কুন্তল। জেসিকা একা একজায়গায় বসে খাচ্ছিল। কুন্তল দেখল মাত্র দুটো লুচি খাচ্ছে জেসিকা। অবশ্য এতে অবাক হবার কিছু নেই।মডেলদের ডায়েটে লুচি একদম নো নো।
সেই লুচি দিয়েই শুরু হল কথা।
‘মাত্র দুটো লুচি খাচ্ছেন যে? আরে মোটা হবেন না। এক একজনের ধাত থাকে মোটা হবার। জল খেলেও মোটা হয়। আর আমাকে দেখুন যেদিন দশটা লুচি খাই মা ভাবে শরীর খারাপ হল বুঝি। ভাত যা খাই বেড়াল ডিঙ্গোতে পারবে না। কিন্তু দেখুন তো শরীরে এক ফোঁটা বাড়তি ফ্যাট নেই। আসলে ধাত’
এত বকবক করল কুন্তল, তার উত্তরে এক চিলতে হাসল জেসিকা। তারপর বলল ‘একদিন খুব সকালে আসতে পারবেন আমার ওখানে? দারুণ ব্রেকফাস্ট খাওয়াব। অন্যরকম। চিনেদের ঘরে বানানো, ডামপ্লিং, নুডলস’
‘আপন কি টেরিটির কাছে থাকেন?’
এর উত্তরে এক চিলতে হাসল জেসিকা। সেই হাসিতে ভরসা পেয়ে কুন্তল বলল
‘কিছু যদি মনে না করেন, তবে বলি একটা কথা’
হয়তো এ মেয়েকে এমন কথা প্রায়ই শুনতে হয়, কিন্তু তার উদ্দেশ্য থাকে আলাদা, তাই খুব উদাসীন ভাবে জেসিকা বলল ‘বলুন না, কিন্তু তাড়াতাড়ি। এবার কাজ শুরু হবে’
‘বলছি কি, এসব করে ক পয়সাই বা রোজগার করবেন? আর সারাদিন এভাবে রঙ মেখে থাকা, খুব অস্বস্তিকর, তার চেয়েও বড় কথা মডেলিং-এ আপনার দারুণ ভবিষ্যৎ আছে। একটা সময় আমি মডেলদের ছবি তুলতাম, র‍্যাম্প কভার করেছি, তো আমি ওই জগতটা বুঝি, এই যে আপনার মধ্যে একটা ডিস্ট্যান্ট লুক আছে না, যেন অনেক দূর থেকে সব কিছু দেখছেন, চারপাশে যা ঘটছে আপনাকে ছুঁতে পারছে না, এই অ্যাটিটিউডটা দারুণ যায় মডেলিং-এ। প্লাস আপনার হাইট, আপনি খুব ভালো মডেল হতে পারবেন।’
জেসিকাকে কি এইরকম কথা কেউ বলেনি? ও একটা অবাক হওয়া চোখে তাকিয়ে ছিল কুন্তলের দিকে। তারপর একটা কথা বলেছিল, যেটার মতো অদ্ভুত কথা জীবনে শোনেনি ও। জেসিকা বলেছিল ‘ফ্ল্যাশ লাইটের ঝলকানির মধ্যে র‍্যাম্পে হাঁটতে আমার বোধহয় ভালো লাগবে না। আমার এইরকম ছোট ছোট জায়গায় ছোট ছোট কাজ ভালো লাগে, টাকাটা আমার কাছে খুব ইম্পরটেন্ট নয়, টাকা যখন খুব দরকার হয়, বিদেশিদের এস্কর্ট করি, এক এক রাতে খুব মোটা রোজগার হয়ে যায়। এখানে আসি এটা এঞ্জয় করি বলে। তবে মাঝে মাঝে কোন প্রডাক্টের মডেল হতে পারি, ফর আ চেঞ্জ’
কুন্তল একটা জোর ধাক্কা খেল। এ তো ড্যামসেল ইন ডিস্ট্রেস নয়।যাকে উদ্ধার করে তার মেল ইগো চরিতার্থ হতে পারবে। এ মেয়েকে এতদিন দেখে তার বেচারি, দুখী কত কী ই মনে হয়েছে, অবশ্য রঙ ছাড়া খুব সামান্যই দেখেছে সে জেসিকাকে। তার মনে হয়েছে নেহাতই পেটের দায়ে সে এসেছে নিজের নগ্ন শরীর আর্টিস্টের কাছে মেলে দিতে, এর পেছনে রয়েছে তার বাধ্যতা। কুন্তল মনে মনে নিজেকে চড় মারল দু চারটে। কেন যে জেসিকার কাছে এ কথা বলার আগে হিরণ্ময়ের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলে নিল না ও? কেন মেয়ে দেখলেই ছেলেদের তাকে উদ্ধার করার বাসনা জেগে ওঠে?
জেসিকার মুখে কিন্তু তাপ উত্তাপ নেই কোন। সে তার খাবার শেষ করে মুখ ধুতে গেল, একটু দূরে দেওয়াল ঘেঁষে একটা ট্যাপ কল রয়েছে, তাকে ঘিরে ছোট্ট একটুখানি বাঁধানো চত্বর। সেখানে শিরিশ ফুল উড়ে উড়ে পড়ছে, কালো শাড়ির লাল পাড়ের পাশে পাশে ঘুরছে, সেই দৃশ্য দেখে মনে হল কিছু যেন বাকি থেকে গেছে জীবনকে জানার। এই মেয়েটা, যাকে সে ভেবেছিল করুণ এক কাহিনী আছে যার, যা বেচে বেচেই খেতে হবে তাকে, আসলে সে তো স্বয়ম্প্রভা, এবং কতটা সৎ ও স্বচ্ছ, নিজে যা করে তা লুকোতে চায় না কখনো। এবং পাপ মানে যে আসক্তি সেটা আজ বুঝতে পারল কুন্তল। জেসিকা টাকার, স্রেফ টাকার জন্যে যা করে, সমাজের চোখে সেটা পাপ, কিন্তু সেই পাপ হাঁসের গায়ের জলের মতো ও ঝেড়ে ফেলতে পারে, টাকা দিয়ে ও কেনে অনেকটা অবসর সময়, যা নিজের পছন্দের কাজে সে খরচ করতে পারে।
মুখ ধুয়ে ফিরে এসে কুন্তলকে বলল ‘থ্যাংক্স’
কুন্তল একেই লজ্জায় মরে যাচ্ছিল, থ্যাংক্স শুনে ও অবাক হয়ে বলল ‘কেন?’
‘কারণ আপনি আমার জন্যে ভেবেছিলেন আর ইউ সাউন্ড জেনুইন। কেউ কারো জন্যে সত্যি ভাবছে এটা দেখে খুব আনন্দ হয় এখনো। যাক আমি মাঝেসাঝে প্রডাক্ট মডেলিং করব, আপনার সঙ্গে একদিন বেরিয়ে পড়তে হবে। এখন টাটা’
চলে গেছিল জেসিকা,কিন্তু আসলে যায়নি, কুন্তলের বুকে স্থায়ী আসন পেতে বসেছিল। যার জন্যে এই গ্রামেও ছবি তুলতে এসে কেবলই ওর কথাই মনে পড়ছিল। জেসিকার সঙ্গে খুব যে আর দেখা হয়েছিল তা না। একটা একজিবিশনে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে, আর একবার ভোরের চিনে ব্রেকফাস্ট খেতে ওখানে। সেই দেখা হওয়ায় পরিপার্শ্ব অনেক বেশি ঘিরে ছিল। সেখানে চারপাশের রঙ, কণ্ঠস্বর, পাতার নাচন, রোদের তাপ, খাবার থেকে ওঠা গরম ধোঁয়া, বাড়িতে বানানো সসের ঝাঁঝালো গন্ধ- এগুলো ওদের কোষে কোষে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। সেই প্রথম ওর মনে হয়েছিল, মানুষ, মানুষের প্রেম, প্রেম ছাড়াও তাদের মধ্যের কোন সম্পর্ক, সবই আসলে মহাজাগতিক সিম্ফনির একটা ছোট্ট, খুব ছোট্ট অংশ। তারা যে কথা বলেছিল, হেসেছিল, ভালবেসেছিল বা বাসেনি- এগুলো বড় কথা নয়, বড় কথা হল ওই চারপাশের রূপ রস গন্ধ স্পর্শ শব্দ ময় জগত। জগত অর্থাৎ কিনা যা গতিশীল। এই গতির মধ্যে দু মুহূর্তের সম্পর্কে স্থিতির চিন্তাই খুব হাস্যকর, তবু এই গতি আর স্থিতির টানাপোড়েনেই পৃথিবী এগিয়ে চলছে।জেসিকার সঙ্গে ওর সম্পর্কটা ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে বুঝতে পারে না কুন্তল, খুব বোঝার চেষ্টাও করে না।
আপাতত ও ভাবছে এই বাড়িটাকে নিয়ে। কীসের এবং কেন ছবি ওর মাথায় ঢুকছে না। নাহ, টাকা যখন পাচ্ছে, এত ভেবে লাভ নেই।
ও লেন্স টেন্স গুছোচ্ছে, তখন একটি ছেলে এসে ঢুকল।
‘এবার সময় হয়ে গেছে, কাজ শুরু করতে হবে’
ওর কথার মধ্যে অদ্ভুত একটা উত্তেজনা ছিল, তার মানে বুঝতে পারল না কুন্তল।
‘আমি তো রেডি। কিন্তু কী তুলব সেটা তো বলতে হবে।’
‘আপনাকে আমি পরপর কয়েকটা ঘরে নিয়ে যাব, সেই ঘরে কয়েকজন মানুষ আছেন। তারা যা খুশি করতে পারেন, কেউ হয়তো ঘুমোচ্ছেন, কেউ খাচ্ছেন, কেউ কাজ করছেন, কেউ কিছুই করছেন না। আপনাকে তাঁদের ছবি তুলতে হবে’
অদ্ভুত, খুব অদ্ভুত।
‘আমি যে ছবি তুলব, তা এঁরা জানেন? মানে হঠাৎ করে ছবি তুলতে গেলে এরা আপত্তি করবেন না?’
‘এঁরা কিছু বলবেন না। এঁরা সব হারিয়ে যাওয়া লোক। কেউ নিজের বাড়ি থেকে, কেউ নিজের পার্টি থেকে, কেউ বা নিজের সময় থেকে হারিয়ে গিয়েছেন’
পা থেকে মাথা অব্দি একটা কাঁপুনি ছড়িয়ে যায়। হারিয়ে গেছেন সময় থেকে?
‘তার, তার মানে এরা কি বেঁচে আছেন?’
‘সেটাই তো জানতে চান ম্যাডাম। এঁরা কি বেঁচে আছেন? থাকলে কীভাবে বেঁচে আছেন? এঁরা কি ফিরে আসার স্বপ্ন দেখেন? সেই স্বপ্ন দিয়ে কি কোন আগুন জ্বালানো যায়?’
‘ম্যাডাম? কে ম্যাডাম’
আরও চমকে যায় কুন্তল। এই অদ্ভুত পরিকল্পনার পেছনে যে এক নারী রয়েছেন এটা তার ঠিক হজম হতে চায় না। তার মনে হয় এটা একরকম নৈরাজ্য তৈরি করবে। হারিয়ে যাওয়া মানুষ ধরে ধরে নিয়ে আসা, তাদের দিয়ে আগুন জ্বালানো মানে? বিপ্লব কী? যে বিপ্লব শুধু মানুষ মারে, পেটে এক মুঠো ভাত দিতে পারে না, তেমন বিপ্লবে কোন আস্থা নেই কুন্তলের। কিন্তু এটাও ঠিক, বহু বছর পরে সে বিপ্লবের নাম শুনল। যেন এটা একটা অস্পৃশ্য শব্দ, কেউ উচ্চারণ করে না, যেন বাড়ির বখে যাওয়া ছেলে, কেউ বলে না তার কথা।
সে আস্তে আস্তে বলল ‘কে তোমাদের ম্যাডাম জানি না, কিন্তু তিনি কি জানেন না, বিপ্লবই হারিয়ে গেছে?’

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (1)
  • comment-avatar
    Ranjana Bhattacharya 2 years

    গল্পের চরিত্রগুলোর সাথে আত্মীয়তা অনুভব করি। একসাথে হাঁটি, চলি, কথা বলি। আর বলতে থাকি তারপর?

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
    410 Gone

    410 Gone


    openresty