
স্রোত পর্ব-২০
যশোধরা রায়চৌধুরী
২০
প্রিয়নাথের পেনশন
প্রিয়নাথের গিন্নি সুরমা দেবির চেহারাটা বর্তুলাকার। বাহুমূলের কাছটা মেদবৃদ্ধির ফলে থলথলে। এখন বাড়িতে স্লিভলেস হাতা ব্লাউজের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা বৃহৎ দুটি মাংসথলির মত হাত দেখছিলেন প্রিয়নাথ। আর হাতের বাজুবন্ধ, তামার তৈরি, গ্রহশান্তির জন্য যেটা বহুদিন আগে তৈরি করা হয়েছিল, কীভাবে আটকে রয়েছে সেই মেদ মাংসের ভেতর। দেখে প্রিয়নাথের দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে।
গৃহিণী যদি এই পরিমাণ মিষ্টান্ন সেবন না করতেন। বেলা চারটের সময় কষে ডাল আর ভাতের সঙ্গে একগাদা মাছের মাথা না চিবোতেন, শেষ পাতে দুধ আমটুকুও বর্জন করতেন। তা তো তিনি করবেন না, আর করবেনই বা কেন, শেষ বয়সে এসে তিনি মোক্ষম জেনেছেন,বাসনার সেরা বাস রসনায় ।
সুরমার দিক থেকে যদি ব্যাপারটা দেখা যায় , তাহলেও সেম টু সেম যাকে বলে।
হুঁ , বুড়ো বয়সে ভিমরতি ধরেছে। সারাপাড়া টো টো করে আসবেন, বেলা দশটায় একগাদা মাছ তরকারি ফল কিনে এনে ঢুকবেন। এত বাজার করার কী আছে বাপু। বলেনা, কামনা বাসনা সব গিয়ে ওই জিভে এসে ঠেকেছে।
এ বাদে, প্রিয়নাথ মাঝে মাঝেই পুরো হিসেব দেননা, নিজের পৌরুষের গর্বেই দেননা। আমি হলুম গে বাড়ির কর্তা। আমাকে বাজারের হিসেব চাইছ?
এতদিন চাকরি করেছেন, এখন পেনশন পান, সবটাই তো তাঁর কারিকুরি, এই সল্ট লেকে নাহোক একটা একতলা বাড়ি তো তুলেছেন। এখনো শক্তপোক্ত, সকালে ছটা নাগাদ স্কুটারটা নিয়ে বেরিয়ে যান , এক এক পাড়ার বুড়োবুড়িদের ধরে ধরে হাত পা নাড়াচাড়া দিয়েও আমদানি মন্দ হয়না।
বুড়োবুড়িদেরও ক্ষতি নেই, বরং লাভ। একটু ফিজিওথেরাপিও হয়, মেন্টাল থেরাপিটাই বেশি হয়। যাকে বলে ভোকাল টনিক। মানুষের তো দুঃখের শেষ নেই। ভাল পয়সা রোজগার করেও তো কোন লাভ হবে না যদি না ভোগ করার মত শরীর বুড়ো বয়সে রাখতে পারে। অধিকাংশই ওই রোগের রোগী। ষাটের কোঠাতেই ঝিমিয়ে পড়েছে।
প্রিয়নাথের মত শরীর চর্চা করে ভোগের ক্ষমতা ঠিক রাখা মানুষকে দেখলে ওরাও একটু উজ্জীবিত হয়। ওদের মেন্টাল টনিক দেন প্রিয়নাথ, গান গেয়ে গল্প করে। সব সময় পজিটিভ থেকে।
এ বাড়ি ওবাড়ি চা বিস্কুট, সেদিন হয়ত কারুর ছেলে ছেলের বউ পুরী থেকে ফিরেছে, সেই খাজা পড়ল সঙ্গে। কারুর বিদেশ থেকে ঘুরতে আসা মেয়ে জামাইয়ের আনা ছোট্ট ছোট্ট চকোলেট ফ্রিজ থেকে বেরোল। এসব খেয়ে, তারপর ফেরার পথে বাজারে থেমে, বাজারের মিষ্টির দোকান থেকে ফ্রেশ ফ্রেশ কচুরি তরকারি অথবা গরম ফুলকপির সিঙাড়া, ভেতরে ছোট ছোট কুচি চিনেবাদাম দেওয়া… খেয়ে, ফেরেন।
তারপর দুপুরে গিন্নির হাতের রান্না।
গৃহিণীর শরীরটি ধুমসি হয়ে গেছে বহুদিনই। কিন্তু তাতে কী আর হল। রান্নার হাতটি এখনো চমৎকার। বেজায় ভাল মাছের তেলের বড়া অথবা পোস্তর বড়া বানায়। ঝোল, অম্বল, ঝাল, কোনটাতেই বাদ নেই। বাজার করার সময় কখনো কখনো তাই এক্সেস হয়ে যায়। এটাও নিই, ওটাও নিই। কুমড়ো ফুল, বক ফুল। দেখলে ঠিক থাকতে পারেন না। বেলায় দরাদরিও হয় এন্তার।
তারপর সুরমার মুখঝামটা খেতেই হয়।
আজ প্রিয়নাথের মনটা ভাল নেই। মন ভাল নেই এমন ব্যাপার তাঁর সচরাচর একটা হয়না।
আসলে কয়েকদিন ধরেই খুব অপমানিত বোধ করছেন।
প্রাংশুবাবুর বাড়িতে আগে চাঁদের হাট লেগে থাকত। প্রাংশুবাবু, তাঁর স্ত্রী দুজনেই মাটির মানুষ। প্রাংশু অ্যালজাইমারের পেশেন্ট, এখন প্রায় অথর্ব। চোখের দৃষ্টিতে চেনা নেই। একদা যখন টাকী স্কুলে পোস্টেড ছিলেন প্রিয়নাথ, খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। প্রাংশু তখন সেখানে অ্যাসিস্টেন্ট হেড মাস্টার। সেই থেকে মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে চেনা পরিচয়।
দুই ছেলে প্রাংশুবাবুর, বড় ছেলে বউমা এখন ওঁদের সঙ্গে থাকে না, তাদের বছর উনিশকুড়ির ছেলেটি কিছুদিন আগেও থাকত। সেও চাকরি নিয়ে অন্যত্র গিয়েছে। কী যেন নাম, অর্চি। ছেলে সল্ট লেকের কলেজে পড়ত। কাছে পড়ত এ বাড়ি থেকে। তাছাড়া ঠাকমার রাঁধা রান্না খেয়ে কলেজ যেত। এখন বাড়ির বাইরে হয়েছে তবে বাড়িতে থাকলেও সে অবিশ্যি কথাটথা বলতনা, নিজের ঘরে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকত। আজকালকার ঘাড়ের রোঁয়া ফোলানো যুবা।
তা ছাড়া প্রাংশুবাবুর ছোট ছেলে আর তার বউ, তাদের একটি পনেরো বছরের ছেলে আছে। সে একটা গোবলা গাবলা , গোবেচারা।
প্রাংশুবাবুর এই ছোট ছেলেটি , সোমদত্ত, খুব মিশুকে, সদাহাস্যময়। তার বউটি, নাম স্বস্তিকা। তাকে নিয়েই একটা ঝামেলা ।
কথাটা ভাবতে গিয়েও প্রিয়নাথ সরিয়ে রাখতে চান। ইচ্ছে করে না ভাবতে। কেনই বা মিছিমিছি লোকের কু গাইবেন।
আসলে স্বস্তিকাকে ভগবান অনেক দিয়েছেন। যাকে বলে উচ্ছলিত যৌবন। খুব হাসিখুশি, খুব মিশুকে বলেই মনে হয়েছিল প্রথমটায়। সরকারি আপিসে কাজ করে, সকালের দিকটা ঘরে থাকে, কাজ কর্ম করে, সবটাই ভাল, ভাল।
কিছুদিন যাবত ওর আচরণে কেমন যেন এক অস্বাভাবিকতা দেখেন প্রিয়নাথ। ও যেন প্রিয়নাথকে এড়িয়ে এড়িয়ে যেতে চায়। সেটায় একরকমের সুড়সুড়ি লেগেছিল প্রিয়নাথের মনেও। আহা, নারীর এই লজ্জাবনত দৃষ্টি বড় সুখকর। কতদিন এমনটা দেখেননি। “মা” “মা” করে কথা বললেও, প্রিয়নাথের নিজের মনের অগোচর ছিল না ওই কথাটিও, যে স্বস্তিকার দিকে তাকাতে তাঁর বেশ ভালই লাগে।
স্বস্তিকাও যেন সেই দৃষ্টিটি উপভোগ করতে করতেই কবে কোথায় বেধে গেল।
কিন্তু কেন? এককালে বাংলা গল্প উপন্যাস পড়তেন প্রিয়নাথ। অনেক পড়েছেন শরদিন্দু পরশুরাম। এখনকার লেখাটেখা বিশেষ বোঝেন না। পড়েনও না। টাকা নষ্ট করে গাদা গাদা পূজাসংখ্যা কিনে ফেলে রেখে কী হবে। সে পাট চুকেছে।
পরশুরামের গল্পে সেই যে ছিল, মেয়েদের নাঃ মানেই হ্যাঁ।
সে কথা বার বার মনে হয় প্রিয়নাথের।
স্বস্তিকা তো একসময় তাঁকে খুব কাকু কাকু করত। অনেক মজার কথা বলতেন ওকে, সোমদত্তকে। আজকাল সামনেই আসে না। আর সেটা বড্ড বুকের মধ্যে ঢেউ তুলছিল কদিন তাঁর। এক অন্যরকমের ভাল লাগা। তারপর সেটাতেও ঠান্ডা জল ঢেলে দিল সোমদত্ত নিজেই।
টানা এই গত এক সপ্তাহে ও বাড়ি গিয়েও এক মুহুর্তের জন্য স্বস্তিকাকে দেখতে পাননি। আর সোমদত্তও যেন কেমন একটা কাঠ কাঠ ভাবে কথা বলল। কীসের এই আড়ষ্টতা?
এদিকে হয়েছে আর এক বিপত্তি। প্রিয়নাথের জীবন এখন পেনশন নির্ভর। বন্ধুবান্ধব যারা আছে অনেকেই প্রাক্তন সহকর্মী, সবাই পেনশনার। তারা সবাই মিলেই আলোচনা করেন, গতবছর সরকারি যে পে রিভিশন হল, তার এফেক্ট কিন্তু পেনশনে পাওয়া গেল না। এজি বেঙ্গলে বলে চলেছে, হচ্ছে হবে। এক গাদা টিচারদের কেস নাকি জমা পড়ে আছে। কী এক পেনশন সেল হয়েছে, তারা একটি একটি করে পেনশন কেস ধরবে আর সেটল করবে, রিভিশন করবে।
মানে হতে হতে আরো দুই বছর।
এতদিন ধরে পড়ে থাকা কেস। কবে রিভিশন হবে। এফেক্ট কবে থেকে পাওয়া যাবে। এরিয়ার কিছু পাওয়া যাবে কিনা, যদি এফেক্টিভ ডেট হয় সেই গত বছরের পে রিভিশনের তারিখ, তাহলে তো এরিয়ার পাওয়াই উচিত।
এসব নানা প্রশ্ন জমেছে পেনশনারদের মাথায়। সবটার উত্তর নেই। পাওয়া যাচ্ছে না। এজি বেঙ্গলে প্রতিপত্তি খাটানোর দরকার, চেনাশুনো কাউকে বার করার দরকার।
হঠাৎ মাথার মধ্যে চিড়িক করে উঠল প্রিয়নাথের। আরে, স্বস্তিকা মা না এজি বেঙ্গলের কেরানি? সেইরকমই তো শুনেছিলেন বটে। সোমদত্ত যদিও প্রাইভেট সেক্টরে আছে, স্বস্তিকা সরকারি চাকরি করে তো।
আসলে অনেকদিন স্বস্তিকার সঙ্গে দেখাই নেই। তাই এসব প্রসঙ্গ উত্থাপন করা যায়নি। ইতিমধ্যে বন্ধু পেনশনারদের ফোন আসা শুরু। প্রিয়নাথ , ভায়া, দেখো না, তোমার তো কত চেনাশুনো। হাত পা টিপে তো এখনো প্রায় ঘরে ঘরে অবাধ গতি।
তো, সেদিন সকালে প্রাংশুবাবুকে বরাদ্দ সময়ের চেয়ে বেশিই দিলেন প্রিয়নাথ। অনেক খন ধরে হাত পা ডলে মুচড়ে, জয়েন্টগুলো নেড়েচেড়ে দিলেন। তারপর বৌদিকেও। সকাল গড়িয়ে গেল, সোমদত্ত, দেখলেন টেবিলের ওপর ঢাকা দেওয়া পাঁউরুটি ডিম নিয়ে খেল, তার মানে বোঝা যাচ্ছে, উনি আসার আগেই সব খাবার রেডি করে রেখে গেছে স্বস্তিকা, করে, নিজের শামুকের খোলে গিয়ে ঢুকেছে। মাঝে মাঝে ঘর থেকে কথার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, ইস্কুল যাবে বলে রেডি হচ্ছে টিন্টো। ওদের ছেলে। ঠিক সাড়ে আটটায় ওর স্কুল বাস আসে।
কথাটা গলার কাছে এসে আটকে আছে প্রিয়নাথের। বলেই ফেলবেন, মরিয়া হয়ে গেলেন। সোমদত্তকে বললেন, স্বস্তিকা মা আছেন নাকি? ওর তো এজি বেঙ্গলেই কাজ, তাই না? পেনশন নিয়ে একটা ভীষণ বিপদে পড়েছি সেইটা নিয়ে কথা বলার ছিল।
সোমদত্ত সামান্য থমকে যায়। অথবা সেইটে প্রিয়নাথের দেখার ভুল হয়ত বা। হয়ত এসব কিছুই তেমন ব্যাপার নয়। পুরো ঘটনাই তাঁর মনের কল্পনামাত্র। দু মুহূর্তের মধ্যে সোমদত্ত বন্ধ দরজার আড়াল থেকে ডাকে, স্বস্তিকা, একটু শুনে যাবে, প্রিয়নাথ কাকু কিছু বলবেন তোমায়।
প্রাংশুবাবু ও ঘরেই বসা। শিবনেত্র, বোধ হীন। বৌদি সামান্য কুঁকড়ে। বেতো রোগী তিনি।
সোমদত্ত চেয়ারে নিজের ডিম পাউঁরুটি থেকে মন তুলে স্বস্তিকাকে ডাকছে। ওদিক থেকে উত্তর আসছে না।
দুম করে ওদের ঘরের দরজা খুলে ইস্কুল ড্রেস পরা টিন্টো বেরিয়ে আসে। খুব তাড়া । ব্যাগটা বসবার ঘর থেকে টেনে তুলে নিয়ে কাঁধে গলাতে গলাতে বলে, মা বাথরুমে গেছে, অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছে। এখন কথা বলতে পারবে না।
বলেই সাঁ করে দরজা টেনে বেরিয়ে যায়।
কান মাথা গরম হয়ে যায় প্রিয়নাথের । অপমানে ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে।
প্রিয়নাথ তবু নিজের শান্ত সৌম্যতা বজায় রাখেন, হাসি হাসি মুখে বলেন, ও আচ্ছা, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমারই ভুল, এখন তো অফিসের সময়ই বটে। ঠিক আছে পরে কথা বলব। শরীর স্বাস্থ্য সব ঠিক আছে তো বৌমার? তোমাদের সবার? আচ্ছা উঠি তাহলে। ইয়ে, ওকে একটু জিগ্যেস কোরে রেখো তো রিটায়ার্ড স্কুল টিচারদের পেনশনের রিভিশন কবে নাগাদ শেষ হবে?
সোমদত্ত ডিম পাঁউরুটি থেকে মুখ তোলে না। অন্যমনস্কভাবে বলে – হুম।
বোঝা যায় , ওভাবে খবর পাওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই।
চা না খেয়েই উঠে যান প্রিয়নাথ আজ। বৌদি সাধাসাধি করতেই থাকলেন যদিও। তবু।
আচ্ছা, পরশুরাম ঠিক লেখেনি তাহলে, মেয়েদের নাঃ মানেই হ্যাঁ নয়, সব সময়ে!

