
জগাদার গবেষণাপাতা:পঞ্চম পর্ব
শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী
সমস্ত অতিমারী,এই চাই ওই চাই,মিটিং মিছিল উপেক্ষা করে একদল ছোট্ট ক্ষুদে পড়ুয়া পরীক্ষা দিচ্ছে স্কুলে।কান চেপে পড়তে চাইছে।কান চেপে কারণ সকাল সাতটা থেকে রাত সাড়ে এগারোটা পাড়ার ক্লাবের 'উউ আট্টামান মাভা' চাঁদি ফাটিয়ে দিচ্ছে তাদের।পরীক্ষার ভিতরের শনিবার রবিবার।স্কুলের সিলেবাসে 'পুষ্পা' নেই।কিন্তু উপায় নেই।কিছু বললে বাইক চেপে ক্লাবের ছেলেরা সোনার গৌড় করে দেবে ভদ্রলোকের আবাসনটাকে।এমনিতেই যে তারা দয়া করে থাকতে দিচ্ছে এখানে,এটাও কি কম?
এক সম্মোহনীচিকিৎসা সেশনের সময় হঠাৎ পাওয়া বিলুপ্ত গোড়াবণ পাখি
সমস্ত অতিমারী,এই চাই ওই চাই,মিটিং মিছিল উপেক্ষা করে একদল ছোট্ট ক্ষুদে পড়ুয়া পরীক্ষা দিচ্ছে স্কুলে।কান চেপে পড়তে চাইছে।কান চেপে কারণ সকাল সাতটা থেকে রাত সাড়ে এগারোটা পাড়ার ক্লাবের ‘উউ আট্টামান মাভা’ চাঁদি ফাটিয়ে দিচ্ছে তাদের।পরীক্ষার ভিতরের শনিবার রবিবার।স্কুলের সিলেবাসে ‘পুষ্পা’ নেই।কিন্তু উপায় নেই।কিছু বললে বাইক চেপে ক্লাবের ছেলেরা সোনার গৌড় করে দেবে ভদ্রলোকের আবাসনটাকে।এমনিতেই যে তারা দয়া করে থাকতে দিচ্ছে এখানে,এটাও কি কম?এই পরিস্থিতিতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল জেমস এসডাইল সাহেবের কথা।সালটা ১৮৪৬ সালের কাছাকাছি।পৃথিবীতে আবার জেমস ব্রেইডের উদ্যোগে হিপনোসিস বা সম্মোহন বিদ্যা নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়েছে।ইংল্যাণ্ডে প্রফেসর ইলিয়টসন তাঁর পদমর্যাদা খুইয়ে বসে আছেন।তাঁর অন্যায় তিনি তার সেই সালের ‘হার্ভিয়ান ওরেশন’এ বক্তৃতার বিষয় রেখেছিলেন ‘সম্মোহন’।বিশ্ববিদ্যালয় বিতাড়িত ইলিয়টসন মনোবিজ্ঞান আর সম্মোহন নিয়ে একটি পত্রিকা বের করছেন।নাম ‘জয়েস্ট’।ঠিক এই সময়ে পরাধীন ভারতে এসডাইল সাহেব মেডিক্যাল বোর্ডের সামনে সম্মোহন প্রয়োগ করে করা পঁচাত্তরটি শল্যচিকিৎসার কথা লিখলেন।সেসব গবেষণাপত্র গ্রাহ্য হলো না।বোধহয় তৎকালীন মেডিকেল বোর্ড আর বাংলার ডেপুটি জেনারেল এসডাইলের গবেষণায় কিঞ্চিত সন্দিহান ছিলেন।কারণ তৎকালীন ভারতবর্ষের অবস্থা বর্তমান দেশের অবস্থার থেকে খুব যে পৃথক ছিল তা নয়।অসীম সহ্যশক্তি নিয়ে পরাধীন ভারতের পঁচাত্তরটি রোগী এসডাইলের অপারেশনের যন্ত্রণা যে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেননি,আর এই কৃতিত্ব যে শুধুই সম্মোহনবিদ্যার,এর প্রমাণ এসডাইলের কাছে ছিল না।
পাড়ায় এই উৎসব গোছের মরশুম বাদ দিয়ে বের হলেই শোনা যাবে বড়দা,বড়দিদের আলোচনা।তাদের ছোটবেলাকার শিক্ষাব্যবস্থা আর আজ কোথায়।তখন বিজ্ঞানে আটানব্বই পাওয়া মানে সে এক সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার।আর এখন ঘরে ঘরে ‘একশোয় একশো’!অথচ!!এসব শুনতে শুনতে পক্ষীগবেষক সালিম আলির ‘ওয়ার্ডস ফর বার্ডস'(পাখিদের জন্য শব্দ) বইটির কথা মনে পড়ে গেল।৪ জুলাই,১৯৬৪ গৌহাটির অলইণ্ডিয়া রেডিওতে তিনি আসামে অবলুপ্ত জলজ পাখিদের কথা বলছিলেন।বলতে বলতে উঠে আসছিল সেই সব খেয়ালি শবরদের কথা যাঁরা জঙ্গলি সারস গুলি করে মারার পর একবার দেখতেও যান না তাদের মৃতদেহ।এঁদের দাপটে অবলুপ্তির পথে সাদা ডানাওয়ালা কাঠ হাঁস বা ‘হোয়াইট উইঙড উড ডাক’।সারি দিয়ে রয়েছে রেডক্রেস্টেড পোচার্ড।মুখোশযুক্ত পিনফুট।ভারতের পক্ষীমানবের এই গবেষণাসমৃদ্ধ আন্দোলন অবশ্য একদিনের ছিল না।১৮ অক্টোবর ১৯৫৫,বম্বে রেডিওস্টেশনে তিনি আরেকটি অবলুপ্তির পথে পা বাড়িয়ে থাকা পাখির কথা বলেছিলেন।’গ্রেট ইণ্ডিয়ান বাস্টার্ড’ বা গোরাবণ।রাজস্থান ও পার্শ্ববর্তী পাকিস্থানে এদের দেখা মিলত।দেখতে আলুথালু।মাংসটিও বেশ সুস্বাদু।এই দুটি গুণই শিকারীদের পক্ষে ও গোরাবণের অস্তিত্বর বিপক্ষে গিয়েছে।এইসব পড়তে পড়তে ভাবছিলাম গিয়েছে তো গিয়েছে।’ডোডো’ পাখির একটা ছবি ঝুলিয়ে মোঘলসম্রাট যেমন আজও তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন,এই গোড়াবণেরও তেমনই একটা ছবি ঝুলিয়ে রাখলেই তো হয়।একটা পাখি থাকল কী মরল,তাতে কার কী এসে গেল?ঠিক যেমন প্রশ্ন আসে।এতো পড়াশোনা করে খেটেখুটে গবেষণা করে লাভ কী?এদেশে এক কিলো মুলোর দাম পুরনো ‘ঢোরাইচরিতমানস’এর বইটির থেকে বেশি।পড়ে শুনে না আছে চাকরি,না আছে সম্মান।শিক্ষক,ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তার উকিল,সবাই অশিক্ষিত পুষ্পাদের তালেতালে নাচছেন।হয়ত এতে সমাজবিজ্ঞানীরা খুশি হচ্ছেন।আহা।দরিদ্র নিপীড়িত শ্রেণী সমাজের পিরামিডে ওঠবার সুযোগ পাচ্ছেন।পরম দুঃখ এখানেই যে পিরামিডে উঠে তাঁরা কিন্তু তাঁদেরই একসময়ের সতীর্থদের কাছ থেকে তোলা আদায় করতে ছাড়ছেন না।এই সময় কেন স্কুলের ভালো ছাত্রছাত্রী?কেন পুষ্পা নয়?ভাবতে ভাবতেই আবার মনে পড়ে গেল সেলিম আলির একটি কথা।২৯ জুলাই ১৯৬৭ বম্বে অল ইণ্ডিয়া রেডিওতে তিনি কেন পাখিদের বাঁচানো প্রয়োজন,সে প্রসঙ্গে বলছেন,”সবচেয়ে সমস্যা হল,পাখিদের ক্ষতিকারক দিকটি-যেমন শস্য খেয়ে ফেলা,সহজেই চোখে দেখা যায়,ঘৃণা করা যায়,তাদের উপকারিতা কিন্তু অতো সহজে দেখা যায় না কারণ তা বিজ্ঞাপিত হয় না কোথাও।”উদাহরণ স্বরুপ পাখিদের শস্যধ্বংসকারী মথ খেয়ে ফেলার কথা লিখেছেন।লিখেছেন বাস্তুতন্ত্র রক্ষার কথাও।
সে নাহয় হলো।সেলিম আলি তার গবেষণার ক্রেডিটডেবিট শিট দিয়ে বোঝাতে চাইলেন কেন লক্ষ্মীপেঁচা শুধুই ফসলের ক্ষতি করে না।সারা বছর একটি লক্ষ্মীপেঁচা ৮৮০ টি ইঁদুর খায়।এই ইঁদুরগুলি বেঁচে থাকলে মাঠে ফসলের উৎপাদন দুই তৃতীয়াংশ কমতে পারত।আমি এই মুহূর্তে ‘আট্টামান মাভা’ বনাম ‘সোশ্যাল স্টাজি’ পেপারে ভালোভাবে পড়াশোনা করার ক্রেডিটডেবিট নিজস্ব অক্ষমতায় দিতে পারলাম না।যতোবার দিতে যাচ্ছি ততোবার শ্রিভাল্লির ফুলবেলপাতা আর দুধের টিন জিতে যাচ্ছে।তবু জোর করেই ওই অসহায় শিক্ষার্থীদের পাশে যদি সত্যিই সমাধানের পথ বাতলাতে হয়,তাহলে কোন গোড়াবণের সন্ধান করব,ভাবতে ভাবতেই খুঁজে পেলাম এসডাইলের সেই হিপনোসিস গবেষণাপত্র।এসডাইল সব মিলিয়ে শুধু সম্মোহন কাজে লাগিয়ে প্রায় সাড়ে তিনশোটি অপারেশন করেছিলেন ‘ব্যথাহীন’ ভাবে।একধরনের নির্দেশ বা ‘হিপনোটিক সাজেশন’এর মাধ্যমে।মনোবিজ্ঞানে এর নাম ‘ইনডাকশন’।সে তো হল।পারিপার্শ্বিক অন্য ইন্দ্রিয়গুলোকে অবশ করে একটিকেই খুলে রাখার নাম ‘সম্মোহন’।মনোবিজ্ঞানীরা একে অবচেতনের তল খুঁজে বের করতে কাজে লাগান।আমরা একে এই ছোট্ট অবলুপ্তির পথে চলে যাওয়া শিক্ষানবিশদের সাহায্যার্থে ব্যবহার করলাম নাহয়।সমস্যা অন্যখানে।গবেষণা বলছে মানুষের মস্তিষ্কে এমন কিছু ঝাড়লন্ঠনের মতো কোষ থাকে,যারা অবদমন বা ‘ইনহিবিশন’এর কাজ করে।বিজ্ঞানী সোমোগাই এদের ‘শাণ্ডেলিয়র’ সেল বলেছেন।যাদের মস্তিষ্কে এই ‘প্ল্যাসেবো পাথওয়ে’ বেশি ক্রিয়াশীল তারাই একমাত্র সম্মোহিত হবেন।অর্থাৎ তাদের মস্তিষ্কে ওই বাইরে থেকে ঢুকে এসে দাপাদাপি করা ‘ধাধিনা নাতিনা’ রুখে দেওয়া যাবে।সে না হয় হলো?সেলিম আলির চোখ নিয়ে এইবার ভাবতে থাকি।তাহলে বাকিদের কীই হবে?যাদের মাথায় ওই ঝাড়লন্ঠনটা নেই।তারা কি গোড়াবণ হয়ে যাবে?নাকি তাদের কপালে পুষ্পার মতো সারাজীবন ঘাড়ভেটকে চলা লেখা আছে।ভাবি আর ভাবি।ভাগ্গিস ভাবতে ট্যাক্স লাগে না।
বি দ্র– পাদটীকা: ‘গোড়াবণ’ রাজস্থানে একটি অবলুপ্তির পথে হেঁটে যাওয়া পাখি।তার ইংরাজদের দেওয়া নাম ‘গ্রেট ইণ্ডিয়ান বাস্টার্ড’।জগাদা তাকেই ‘গোরাবণ’ বানিয়েছে।গোমুখো রাবণের মতো।যদিও আসলে পাখিটি দেখতে মোটেই রাবণের মতো নয়।

