
অজিত সিং বনাম অজিত সিং
অষ্টত্রিংশতি পর্ব
তৃষ্ণা বসাক
অজিত সিং প্রথমে ছিল বঙ্গলক্ষ্মী চানাচুর, তারপর এল আজাদ হিন্দ চানাচুর, তারপর একের পর এক বিপ্লব চানাচুর, সর্বহারা চানাচুর, উন্নততর সর্বহারা চানাচুর, এখন চলছে বিশ্ববাংলা। এখানেই কি ভাবছেন গল্প ফুরিয়ে গেল? এবার আসছে একে ফিফটি সিক্স চানাচুর। নাম যাই হোক, সোল এজেন্ট আমি।’ ‘বেওয়ারিশ’ গল্পের চানাচুরওলা এবার ঢুকে পড়েছে বাংলার শিল্পক্ষেত্র থেকে শিক্ষাজগতের ক্ষমতার অলিন্দে।খুন, যৌনতা, প্রতিশোধ, নিয়তিবাদের রুদ্ধশ্বাস সুড়ঙ্গে সে টের পাচ্ছে- -বহুদিন লাশের ওপর বসে বারবার হিক্কা তুলেছি আমরা -বহুদিন মর্গের ভেতরে শুয়ে চাঁদের মুখাগ্নি করেছি আমরা -অন্ধ মেয়ের মউচাক থেকে স্বপ্নগুলো উড়ে চলে গেছে (জহর সেনমজুমদার) এই সবের মধ্যে বাংলার কি কোন মুখ আছে আদৌ? থাকলে কি একটাই মুখ? না অনেক মুখ, সময়ের বিচিত্র রঙে চোবানো? বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে বাংলার অজস্র মুখের ভাঙ্গাচোরা টুকরো খুঁজে চললেন তৃষ্ণা বসাক, তাঁর নতুন উপন্যাস ‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’-এ । সব কথনই রাজনৈতিক, সেই আপ্তবাক্য মেনে একে কি বলা যাবে রাজনৈতিক থ্রিলার? সিটবেল্ট বাঁধুন হে পাঠক, ঝাঁকুনি লাগতে পারে। প্রকাশিত হল উপন্যাসের ৩৮তম পর্ব। এই উপন্যাসের সব চরিত্র কাল্পনিক।

৩৮
হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে গেছিলেন আজ। মর্নিং ওয়াক নয়, ইভনিং ওয়াক। খুব সকালে কোনদিনই উঠতে পারেন না, যেহেতু শুতে শুতে বরাবর রাত হয়ে যায়।রাতেই যত সারাদিনের না ছোঁয়া কাজ, পড়াশোনা, তার ওপর একটা কাগজে কলম লেখেন, কাগজটার নাম, জনবার্তা। এইসব করে শুতে শুতে একটা বেজে যায়, তারপরে হাতে একটা বই থাকে, সেটা যদি টানে তবে কতদিন রাত ফুরিয়ে যায়। কিন্তু ইদানীং কোন বই টানছে না এত।আসলে কে লিখবে? সবাই তো পণ্যায়নের ফসল। মুলো খেলে মুলোর ঢেঁকুর উঠবেই। মানুষের কথা কে লিখবে? মানুষ মানে খেটে খাওয়া মানুষ। যারা কারখানায় কাজ করে, ক্ষেতে চাষ করে। হঠাৎ তাঁর যুধাজিতের কথা মনে পড়ল। তাঁর দিদির জামাই যুধাজিত। আই টি সেক্টরে আছে। বারো ঘণ্টা খেয়ে নিচ্ছে অফিস, বাড়ি এসেও কাজ করে যেতে হয় তাকে। দিদির মেয়ে শালিনী একই সেক্টরে, অন্য কম্পানিতে ছিল। কিন্তু দুজনেই এক জায়গায় থাকলে ওরা বাচ্চা নিতে পারবে কী করে? এমনিতেই খিটিমিটি লেগে আছে। শালিনীর অফিসের চাপ অনেক বেশি, ওর ডেজিগনেশন উঁচু যুধাজিতের থেকে। বাড়ি কেন শালিনী সামলাচ্ছে না, এ নিয়ে ওর ইন ল থেকে যুধাজিত সবাই অভিযোগ করে যায়। দিদি অনেকবার বলে ‘দেখ মেয়ে তো আমার ইন্ডিপেন্ডেন্ট, মুভ আউট করতেই পারে। কিন্তু তাহলে তো সারাজীবন একাই থাকতে হবে। আমি মরে গিয়েও একটুও শান্তি পাব না। আবার চাকরি ছাড়তেও বলতে পারি না। তুই তো দেখেছিস, চাকরি ছেড়েছি বলে সারাজীবন আমি কী পরিমাণ সাফার করেছি। আমাকে একজন বলেছিল উপার্জন ছাড়া মেয়েরা ছেঁড়া ন্যাকড়া ছাড়া কিছু নয়। বিশ্বাস করিনি। এখনো করি না। এখনো মনে করি না যে টাকাটাই একজন মানুষের আউটপুট হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত। তার পরিশ্রম, দায়িত্ব, সেবা এগুলোর কোন মূল্য থাকবে না? তাই আমি মনে করেছিলাম তোর জামাইবাবু, সন্দীপনের যথেষ্ট রোজগার, ব্যস্ত থাকে এত, আমি আর টাকার পেছনে দৌড়ব না, বাড়িকে সময় দেব, মেয়েকে সময় দেব আর সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ব এদিক ওদিক, যেটা এত ভালবাসি আমি। আমি আজও বিশ্বাস করি, আমার ভাবনায় কোন ভুল ছিল না। কিন্তু সন্দীপন আমাকে অপমান, অসম্মান করল সারাজীবন, আর আমি আর বেরোতে পারলাম না ওর দেওয়া তথাকথিত নিরাপত্তার ছাতা থেকে, যদিও আমি নিজে জানি কত পলকা আর ঠুনকো, কত অনিশ্চিত ওই ছাতাটা।
শালিনী তো এইসব দেখতে দেখতে বড় হয়েছে, ও কী করে ছাড়বে বল চাকরি?নিজের সন্তানের থেকেও নিজের স্বাধীনতা বড় ওদের কাছে। এদিকে আমি ভাবছি আজকাল স্বাধীনতা কি মানুষকে একা করে দ্যায়? আর কি জানিস, খাঁচায় থাকতে থাকতে ওড়ার অভ্যেসটাই চলে যায়। এই যে সন্দীপন চলে গেছে এতগুলো বছর, আমি তো যা খুশি করতে পারি, যেখানে খুশি যেতে পারি, কিন্তু পারছি কি? কোথায় যেন একটা শিকল পরানো আছে। পায়ে নয়, মনে। তোরা যখন শিকল ভাঙ্গার কথা বলতিস, এই শিকলগুলোর কথা খেয়াল করিস নি?
এখন কি ভাবছি জানিস, শালিনীর তো খুব ভালো রেজাল্ট ছিল, ও যদি অ্যাকাডেমিকসে আসত? তুই কিছু করতে পারিস না রে?’
সত্যিই কি কিছু করতে পারেন তিনি? ক্ষমতার অলিন্দে তো নেই অনেক দিন। বাইরে থেকে যা করা। সেখানেও তো আগে মেয়ের জন্য করতে হবে তাঁকে। স্ত্রী যদি জানে নিজের মেয়ের জন্য না করে দিদির মেয়ের জন্যে করছেন…
কিন্তু তিনি ভাবছিলেন অন্য কথা। এই শালিনী, যুধাজিত- এরাও কি শ্রমিক নয়? এই যে তাঁর দিদি, সারাজীবন সংসারে খেটে গেল, এরাও তো শ্রমিক। এদের কথা কে বলবে?
হাঁটতে হাঁটতে তিনি খেয়াল করলেন না একদম অচেনা একটা জায়গায় ঢুকে এসেছেন। তাঁদের বাড়ির এত কাছে এরকম একটা জায়গা আছে, তাই তো জানতেন না।
তাঁর বাড়ির উল্টোদিকেই একটা ঝিল। যার জন্যে খুব গরম পড়লেও সন্ধের পর থেকে ভারি ঠান্ডা একটা হাওয়া আসে তাঁর দক্ষিণমুখো বাড়ির ঘরে, বারান্দায় টেরেসে। গৃহপ্রবেশে এসে এক বন্ধু বলেছিল ‘এদিকে তো বামপন্থার ধ্বজা ওড়াস, আর বাড়ি করেছিস দক্ষিণ খোলা!’ সবাই হেসে উঠেছিল এই কথায় । বন্ধুটি উৎসাহ পেয়ে বলতে শুরু করল ‘ভাই তোদের কোন বামপন্থীদের বউকে আমি হাউস ওয়াইফ দেখিনি। প্রত্যেককে কলেজে, নিদেন পক্ষে স্কুলে ঢুকিয়ে ছেড়েছিস। যে পরিবারে, তোর মতো রোজগেরে আছে, সেখানে আবার একজনের চাকরির মানে অন্য একটি পরিবার যাদের সত্যিই চাকরির দরকার তাদের বঞ্চিত করা’
ওখানে ইরা মুখার্জি ছিলেন, ইলেক্ট্রনিক্সের অধ্যাপক, তাঁর থেকে খানিক ছোটই, সে তো ফুঁসে উঠল ‘তাহলে কি এত পড়াশোনা শেখার পর মেয়েরা ঘরে বসে তুলসীতলায় প্রদীপ দেখাবে আর উঠোনে গোবর ছড়া দেবে? এটাই বলতে চাইছেন আপনি?’
সেই বন্ধুটি, উৎপল, সে খুব সিরিয়াস মুখ করে বলেছিল ‘তা কেন? আমি তো বলেছি যে কোন একটা চাকরি, পরিবার পিছু। নিজেদের মধ্যে ঠিক করে নিতে হবে কে চায়। যদি স্ত্রীর শিক্ষগত যোগ্যতা বেশি থাকে, যদি পার্টিকুলার কাজটির জন্যে সে বেশি উপযুক্ত হয়, তখন সেই পাবে। স্বামী সংসার সামলাবে, সেই হোমমেকার হবে’
ঘরে আর এক প্রস্থ হাসির ঢেউ খেলে গিয়েছিল।
ইরা মুখার্জিও হাসতে হাসতে বলেছিলেন ‘শতাব্দীর সেরা জোক। এরকম যদি হত, তবে তো বামপন্থী আন্দোলনের কোন দরকারই হত না। আমাদের তো শ্রেণিহীন সমাজের জন্যেই এত লড়াই’
উৎপল ইরার মুখের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে বলেছিল ‘শ্রেণীহীন সমাজ! মেয়েদের মুক্তির কথা বলা হয়েছে বুঝি বামপন্থায়? কারা বলবে সে কথা? পলিটব্যুরোয় মেয়েরা কোথায় বলুন তো? পলিত বুড়ো বলি ওটাকে আমি। আমাদের শাস্ত্রে আছে নারী শূদ্র আর মনুষ্যেতর প্রাণিদের আলাদা করে রাখার কথা। আপনারা তার থেকে এগোলেন কোথায়? নেতাদের সবাই তো উচ্চবর্ণ, ভটচাজ, বসু, মুখার্জি, যারা যুগযুগ ধরে সুবিধে পেয়ে এসেছে, তারাই আপনাদের পার্টির মাথায়। পলিটব্যুরো কেন, রাজ্য নেতৃত্বেই বা মেয়েরা কোথায়? শুধুই তারা আয় তবে সহচরী। বছরের পর বছর ধরে বাড়ির মা বোনেরা রুটি করে দিয়েছে কমরেডদের, বিপদে লুকিয়ে রেখেছে, তেভাগা আন্দোলনে মেয়েদের ভূমিকাটা কেউ মনে রেখেছে? মণিকুন্তলা সেন, বিমলা মাজী। ব্যর্থ নমস্কারে ফিরিয়েছি তাদের। পরিবারতন্ত্র বল, যাই বল, কংগ্রেস থেকে তো মহিলা প্রধানমন্ত্রী পেলাম আমরা। তোরা কী দিলি?’
তিনি বলেছিলেন ‘তোরা তোরা করছিস কেন উৎপল? তুইও তো আমাদের একজন। তোর তো সদস্য পদ আছে। দোষ ত্রুটি সবার আছে, সেগুলো নিয়ে কথা বলতে হবে তো, তুই মিটিং গুলোয় আয়, কথা বল। দেখবি দূর থেকে যা মনে হচ্ছে তার অনেকটাই ভুল। আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হয় তো।’
‘তুই কি ভেবেছিস আমি বলিনি? অনেক বলেছি। কিন্তু পুত্তলিকার কান আছে শুনিতে পায় না, চোখ আছে দেখিতে পায় না। কী জানিস, আমরা হিন্দু মৌলবাদী বলি, মুসলিম মৌলবাদী বলি, কিন্তু এই বঙ্গের সি পি এম র মতো মৌলবাদী দল আর দেখিনি, এদের মধ্যে নতুন কোন কথা ঢোকানো যায় না। আজ তোরা আমার কথা বুঝতে পারছিস না। কারণ তোরা এক জায়গায় ভাই ভাই হয়ে আছিস। কিন্তু একদিন যদি এর বাইরে ছিটকে বেরিয়ে আসতে হয়, উল্টোদিক থেকে দেখতে হয়, তাদের একজন হয়ে, যারা অন্য দল বা দলহীন নিরপেক্ষ হয়ে বাঁচছে, কোন সুবিধে পাচ্ছে না স্রেফ অনুগত নয় বলে, তবে বুঝতে পারবি তোরা কী’
ঘরে অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এসেছিল কিছুক্ষণের জন্যে। সেই মুহূর্তে তাঁর স্ত্রী, যে ঠিকই শুনেছে এইসব আলোচনা তার ব্যস্ত আসা যাওয়ার মাঝে, এসে সবাইকে খেতে ডেকে আলোচনার ইতি টেনেছিল।
হাসি মুখে বলেছিল ‘খালি পেটে ধর্ম হয় না, তর্কও না, ঠাকুর বলেছেন। খেয়ে এসে যত খুশি ঝগড়া করুন’
উৎপল আহত মুখে বলেছিল ‘বউদি প্লিজ, একটা জরুরি আলোচনা হচ্ছিল, তাকে ঝগড়া নাম দিয়ে বিষয়টা এড়িয়ে যাবেন না। এ আমার, এ তোমার পাপ।‘
ওর কথায় সাংঘাতিক অপমানিত হয়েছিল স্ত্রী, কিন্তু গৃহস্বামিনী র কর্তব্যের খাতিরে মুখে হাসি টেনে বলেছিল
‘আচ্ছা আচ্ছা, ঝগড়া নয় আলোচনা, সেটা এখন মুলতুবি থাক, খেতে চলুন সবাই’
খেয়ে এসে সবাই ফেরার জন্যে ব্যস্ত হয়েছিল যথারীতি। দু চার কথা যা হয়েছিল তা ওই খাওয়া দাওয়া নিয়েই। এর মধ্যে উৎপল কখন যে এক ফাঁকে বেরিয়ে গিয়েছিল কেউ বুঝতে পারেনি।
আজ হাঁটতে হাঁটতে সেই কথাগুলো মনে পড়ছিল কেন কে জানে। বিশেষ করে উৎপলের কথাগুলো। আজ তো তাঁরা সবাই টেবিলের উল্টোদিকেই বসে।
ঝিল পেরিয়ে, বাচ্চাদের পার্ক পেরিয়ে তিনি ডানদিকে বেঁকলেন। এদিকের দুটো ঝিল পরপর। একদম শেষ ঝিলটার পর হসপিটাল বাঁদিকে, ডানদিকে তিনি কখনো যান নি। আলো পড়ে এসেছে প্রায়। ঝিলের জলে দু চারজন ছেলে ফুটবল পেটানো শেষ করে হাত পা ধুচ্ছে, একটি দুটি বৌ স্নান করছে, পাড়ের কাছে বেগুনি কচুরিপানা ফুল ফুটে আছে, তার ওপর শেষ সূর্যের আভা। তাঁর হঠাৎ কী মনে হল পাশের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। প্রথমে পরপর অনেকগুলো বাড়ি। তাঁদের আবাসনের পাশের আবাসন প্রিমরোজ রেসিডেন্সি। তাদের সীমানা এই ঝিলের পরেই। এদিকটায় যদিও পাঁচিল নেই, কিন্তু প্রিমরোজের বাড়ির চেহারা দেখলেই বাইরের বাড়িগুলো থেকে আলাদা করা যায় । এর পরে যতদূর জানেন কোন একটি ব্যাংকের কর্মী আবাসন। খুব সাধারণ চেহারার বাড়ি পরপর, তার আগে প্রিমরোজের বাড়ি । এদিকের বাড়িগুলো, একইরকম হলেও তাঁর মনে হল এরা অনেকখানি স্পেসের মধ্যে কেমন ভারতের শেষ স্বাধীন সম্রাটের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কেন যে এমন উদ্ভট উপমা তাঁর মাথায় এল কে জানে। রাজা, রাজতন্ত্র, সম্রাট, সাম্রাজ্যবাদ, এসব তো তাঁর কাপের চা নয়। ওসব নিয়ে কোন মোহ নেই তাঁর। হঠাৎ তাঁর একজনের কথা মনে হল। সম্রাজ্ঞী তিনি দেখেন নি। কিন্তু তাকে দেখলেই তাঁর সম্রাজ্ঞীর কথাই মনে হত। যদিও কোনদিন সে কথা তাকে বলেননি। উপেক্ষাই করেছেন বরাবর। শরীর শরীর। এমন এক শব্দ, যা কেন যে ঘৃণা জাগায়, যেন তাঁর, তাঁদের কোন শরীর নেই, আহার নিদ্রা মৈথুন প্রাকৃতিক কাজ নেই কোন, তাঁরা এক একজন একটি তত্ত্ব হিসেবে জন্মেছেন, অর্থাৎ হার্ডওয়ার নয়, সফটওয়ার। অথচ দুনিয়া চলে গেল ফার্মওয়ারের দিকে, হার্ডও নয়, সফটও নয় যা। দুয়ের মিলিত বন্ধন। কনভার্জেন্স, বুঝতেই পারেননি। দুনিয়া বদলে গেছে। ব্লু কালার শুধু না, হোয়াইট কলারের শ্রমিকরাও শ্রমিক। কাস্তে হাতুড়ির পাশে মাউসকেও রাখতে হবে।
অমরনাথ আপন চিন্তায় ডুবে হাঁটছিলেন। তিনি খেয়াল করলেন না তাঁর চারপাশ কত নির্জন হয়ে এসেছে। প্রথম প্রথম দু একজন সিকিওরিটি গার্ড বাঁশি বাজাতে বাজাতে সাইকেলে করে যাচ্ছিল। তারপর আর তাদের দেখা যাচ্ছে না। ছোট ছোট অকিঞ্চিতকর বাড়ি সব, টিন বা টালির চাল দেওয়া, একটা উঠোনে দেখলেন উনুন জ্বালানো হয়েছে। এখনো ধরে ওঠেনি। ধরে উঠলেই উনুন ভেতরে নিয়ে যাওয়া হবে, উনুন যা যা দিতে পারে তার অপেক্ষায় কত কে খিদে নিয়ে বসে আছে। উনুনের ধোঁয়ায় তাঁর চোখ জ্বালা করে উঠল। তাঁর নাকে এল গরম রুটি সেঁকার গন্ধ, তিনি দেখতে পেলেন কড়াইয়ের একপাশে খুন্তি দিয়ে চেপে রাখা সদ্য ভাজা আলুভাজা। লম্বা লম্বা একটু মোটা মোটা করে কাটা আলু ভাজলে কী এক অনবদ্য স্বাদ হয়। একটু নরম নরম বালি বালি মতো। গরম রুটির ফুলকো ছিঁড়ে তার মধ্যে আলুভাজা ছিঁড়ে রোল করে নেওয়া, আহ তার পর মুখে পুরে দেওয়া। তখন এত খিদেও পেত। দুপুরে খেয়ে ওঠার এক ঘণ্টার মধ্যেই খিদে পেয়ে যেত। তখন ফল পাকুড় নিজেদের গাছের, সে সব তো ছিলই। কিন্তু অন্যের গাছ থেকে চুরি করা আম জাম পেয়ারার স্বাদই অন্যরকম। তার পর চারটে না বাজতেই ইস্কুলমাঠে ফুটবল পিটোনো, কখনো বন্ধুদের সঙ্গে ঝামেলা হলে বাসরাস্তা ধরে হেঁটে অনেকদূর চলে যাওয়া, কিংবা নদীর দিকে। হাঁটতে হাঁটতেই নিজেকে মেরামত করে নেওয়া, যাতে পরের দিন আবার বন্ধুদের সঙ্গে এমন ভাবে শুরু করা যায়, যেন কিছুই হয়নি। আর ফিরে এসে দেখতেন উঠোনে উনুনটা জ্বলছে, ধরেই এসেছে। তিনিই ওটা তুলে রেখে আসতেন রান্নাঘরে। পেছনের পুকুরে হাত পা ধুয়ে আসতে না আসতেই তাঁর সামনে চলে আসত গরম গরম রুটি আর আলুভাজা। রুটি তো মা বেশি করেই করতেন, কারণ তিনি যে কটা খাবেন তার তো ঠিক নেই। অবশ্য ছটা পেরিয়ে সাতট চাইতেই মা বলতেন ‘একটু পরেই তো রাতের খাওয়া । আর খেতে হবে না’
একটু রাগ হত। আর খিদেও পেত সেই সময়। এখন সেরকম খিদে আর পায় না। আর মাকে বলে বলে একটা জিনিস কখনো পাননি। আলুভাজা গুলো একটু সরু করে কেটে মুচমুচে ভাজা। মা বলতেন রুটির সঙ্গে ওইরকম ভালো লাগবে না। একদিন ভাতের সঙ্গে করে দেব। ডাল দিয়ে ভালো লাগবে। বেগুন ভাজা পটল ভাজা, বকফুলের বড়া পলতাপাতার বড়া এতসব করে দিলেও ওই মুচমুচে আলুভাজা মা কোন দিন করে দেননি ভাতের সঙ্গে। আলুভাজা হলে চাকাচাকা আলুভাজা। দু একদিন মনে করিয়ে দিয়েছেন, তারপর তো ভুলেই গেছেন।আর অন্য অন্য টান তৈরি হয়ে গেছে জীবনের। মুচমুচে আলুভাজা তুচ্ছ হয়ে গেছে। তারপর তো গ্রাম ছেড়েই চলে আসা। আজ এতদিন পরে উঠোনে জ্বলন্ত উনুনটা দেখে বুকের মধ্যে কত নিচে লুকিয়ে থাকা অভিমান জেগে উঠল। মার কাছে চেয়েও যে আলুভাজা পাননি, সেই টুকুই না, জীবনে যা যা পাননি, তার সব কিছুই নিয়ে ওই উনুন একা একা দাঁড়িয়ে আছে। ওর মধ্যে জ্বলছে তাঁর সমগ্র জীবন। হঠাৎ তাঁর মনে হল কী অদ্ভুত, বাড়িতে কেউ নেই নাকি? একটা উনুন একা একা জ্বলছে উঠোনে। নাকি এভাবেই জ্বলতে হয় একা একা? হঠাৎ তাঁর চারপাশে চারজন লোক এসে দাঁড়াল। তিনি চমকালেন না। যেন এরকমই কথা ছিল। যেন তিনি এখানে এইটা হবে জেনেই, নিজের রাস্তার বাইরে হেঁটে আসছিলেন। তিনি তবু দেখার চেষ্টা করলেন এরা কারা, তাঁর চেনা কেউ নাকি। দেখা গেল না, এক তো সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে। আলো বলতে ওই জ্বলে ওঠা উনুনের আঁচ। আর তার ওপর এদের মুখে মুখোশ পরা।
ওদের মধ্যে একজন বলল ‘আপনাকে যেতে হবে। বাধা দিয়ে কোন লাভ নেই। এটা আমাদের এলাকা’
তিনি ভাবছিলেন পৃথিবীর এলাকা ভাগ কবে থেকে হল? এ কি জন্মের সময়ের পাপ? এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় পা দিলেই ধরা পড়তে হবে। তাঁর তো এখানে আসার কথা নয়। নাকি এটা সাইন্স ফিকশনের মতো কিছু। সময়ের একটা গর্তে পা পড়ে তিনি অন্যখানে চলে এসেছেন?
তিনি বললেন ‘এখনই যেতে হবে?’
‘এখনই’
‘সময় হয়ে গেছে?’
‘এই তো সময়’

