
অভিজিৎ তরফদার-এর গল্প ‘ বিকার’
বিকার
১
যেতে-আসতে দু’বার আওয়াজ দিয়ে গেল কনডাকটর, -‘মাঝখানে ভিড় করবেন না…জায়গা ফাঁকা করুন…প্যাসেঞ্জারদের বেরোতে দিন।’ কথার ফাঁকে ঝোলা গোঁফের আড়াল থেকে মুচকি হাসল। হাসির মানেটা অমল জানে,’চালিয়ে যাও গুরু। সঙ্গে আছি।’
উৎসাহ পেয়ে অমল এক স্টেপ আগে বাড়ল। তবে পা বাড়ানোর আগে আশপাশ ভালো করে দেখে নিল। কনডাকটর সিগনাল দিয়েছে মানেই ‘ফাঁকা মাঠ, গোল করে যাও’, তা নাও হতে পারে। আজকাল সবাই সেয়ানা। চোখ নয় তো শকুনের দৃষ্টি। দেশের ভালো-মন্দের দায় যেন ওরাই নিয়ে বসে আছে। এতটুকু এধার-ওধার করেছ কি সঙ্গে সঙ্গে -‘দাদা! ওটা কি হচ্ছে?’ হচ্ছে হচ্ছে। তোর বাপের কী? তোর সঙ্গে হচ্ছে? শালা!
দেখেশুনে নিশ্চিন্ত হল অমল। না, ঝামেলা পাকানোর মতো এক পিসও নজরে পড়ছে না। এবার আর এক স্টেপ। মেয়েটার ঠিক পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে অমল। গায়ে গা লেপটে আছে। লেডিস সিট সব ভরতি। সামনে এগোবে তেমন জায়গাও পড়ে নেই। তাও মেয়েটা চেষ্টা করল অমলের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে একটুও যদি এগনো যায়। মেয়েটা যত ইঞ্চি এগলো অমল ঠিক ততখানিই নিজেকে বাড়িয়ে দিল। একহাতে কাঁধের ঝোলাটা সামলিয়ে অন্য হাতে বাসের রড ধরে কোনওরকমে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। শীতের শেষ, গরম এখনো পড়তে শুরু করে নি। তাও দরদর করে ঘামছে। মাঝেমাঝেই ঘাড় ঘুরিয়ে অমলকে দেখবার চেষ্টা করছে। অমল, যেন বাইরে ক্যাবারে শো হচ্ছে, চোখ সরালে মিস হয়ে যাবে, মন দিয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে আছে, বাসটা স্পিড-এর মাথায় ডানদিকে ঘুরল।
মেয়েটা হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তেও কাঁধের ব্যাগটা সামলাতে ওপরের হাত আলগা করল। পড়েই যেত অমল না থাকলে। দু’হাত দিয়ে জাপটে ধরে সামলে দিল অমল। তার মধ্যেই যা করার করে নিল। অমল দেখল মেয়েটার মুখ এখন টুকটুকে লাল। পরের স্টপে কারওকে কিছু না বলে মাথা নিচু করে নেমে গেল।
২
কলোনিতে মেয়ের ছড়াছড়ি। টুসু, ফুলি, পদ্ম, বিভা। তার মধ্যে কারও নাম যদি হয় রঞ্জনা, কী মনে হয়? যা মনে হয়, প্রথমটা শুনে অমলেরও তা-ই হয়েছিল। আশেপাশে যারা ঘুরে বেড়াচ্ছে সকলেই বাপের দেওয়া নাম পতাকার মতো তুলে ধরে আছে। মদন, পটলা, গজেন। যে ডাক্তারের নার্সিংহোমে ও এখন হত্যে দিয়ে পড়ে আছে,’শ্যামলাল’, তার নামটাই বা এমন কি সরেস? সেখানে ‘অমল’! চোখ বন্ধ করে ডাকলে যেন আবেশ আসে। বৃষ্টিশেষে কদমফুলের মতো গন্ধ পাওয়া যায়।
রঞ্জনারও নাকি সেটাই হয়েছিল। ইশকুলে একবার নাকি নাটক হয়েছিল। সেই নাটকে ‘অমল’ বলে কেউ একটা ছিল। সেই থেকে রঞ্জনার মন পড়েছিল ‘অমল’ নামের কারও সঙ্গে। সত্যিকারের ‘অমল’-এর সঙ্গে সম্বন্ধ আসতে রঞ্জনা তাই আর দু’বার ভাবেনি।
এসবই অবশ্য অনেক বছর আগেকার কথা। এর মধ্যে অমল-রঞ্জনার সংসারে যা যা ঘটে
গিয়েছে সেগুলো এই সুযোগে বলে নেওয়া যাক।
(ক) বিয়ের একবছরের মাথায় রঞ্জনা ও অমলের একমাত্র সন্তান কঙ্কণার জন্ম হয়েছে। বলা বাহুল্য, নামটা রঞ্জনার দেওয়া। পেটে বোমা মারলেও অমলের মাথা থেকে ও নাম বেরতো না। ছোটো করে ‘কণা’ বলে ডাকে অমল। মেয়ে তাতে সাড়া দেয়।
(খ) অমল যে পাঁউরুটি কারখানায় কাজ করত সেটায় লালবাতি জ্বলেছে। কোনও পাওনাগন্ডা না মিটিয়েই মালিক মুলুক ভেগেছে। যাবার আগে কারখানার জমিটা অবধি প্রোমোটারকে বেচে দিয়েছে মালিক। সেই থেকে বন্ধ কারখানার গেটে শতরঞ্জি বিছিয়ে লাল শালুতে দাবিদাওয়া লিখে কর্মচারিরা বসে থাকে। অমলেরও যেদিন ডিউটি পড়ে যেতে হয়। তবে চোখকান খোলা রেখে। যে কোনওদিন প্রোমোটারের লোক পিটিয়ে ওখান থেকে তুলে দেবে।
(গ) রঞ্জনা ‘উপশম’ নার্সিংহোমে কাজ জুটিয়ে নিয়েছে। আয়া হয়ে ঢুকেছিল। এখন বড় বড় ডাক্তাররাও অপারেশন শুরু করার আগে দেখে নেয় ধারেকাছে রঞ্জনা আছে কীনা। থাকলে তবে পোশাক পাল্টায়। শ্যামলাল ডাক্তার রঞ্জনাকে চোখে হারায়।
এসবই এতগুলো বছরের আখ্যান। তাহলে এই মুহূর্তে কে কোথায় আছে?
কণা ইশকুলের পাট চুকিয়ে কলেজে ঢুকেছে। মায়ের মাথা পেয়েছে মেয়েটা। শিয়ালদার কাছে ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ে। অনার্স আছে। একা-একাই যাওয়া-আসা করে। কলোনির তুলনায় বয়স বেড়ে যাচ্ছে এই বিবেচনায় অনেকেই বিয়ের সম্বন্ধ এনেছে। রঞ্জনা গম্ভীর মুখে শোনে, হেল-দোল করে না। বরং আজকাল লেখাপড়াতেও কাজে লাগে বলে একটা স্মার্টফোন কিনে দিয়েছে। মা ধারে-কাছে না থাকলে মেয়ে ফোনে ফেসবুক করে। দেখেও মাকে খবরটা না জানানোর কৃতজ্ঞতায় কণা বাবাকে ভাত বেড়ে দেয়। সেটুকুতেই চোখে জল এসে যায় অমলের।
পাঁউরুটি কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে অমল যে হাতগুটিয়ে বসেছিল তা নয়। একটা সিনেমা হলে আলো দেখিয়ে বসার জায়গা খুঁজে দিত। সেটাও তালা-বন্ধ। শুনছে শপিং মল হবে। অমলের ধারণা অমল যেখানেই যাবে সেখানে ছ’মাসের মধ্যে লালবাতি জ্বলবে। শেষমেষ একটা সিকিওরিটি এজেন্সিতে লোক নেওয়া হবে শুনে লাইনে দাঁড়িয়েছিল। অমলের চেহারা দেখে আর হাতের বাইসেপস টিপে লাইন থেকেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিল তারা।
অমলের বেকারত্বের পাল্লা যত ভারী হতে লাগল রঞ্জনার ভাগ্যরেখাও তাল মিলিয়ে ওপরে চড়তে শুরু করল। রাতে বাড়ি ফেরাও কমিয়ে দিতে লাগল রঞ্জনা। প্রথমদিকটায় অমল জিজ্ঞেস করত। জবাব আসত, জরুরি কাজ পড়ে গিয়েছিল। রঞ্জনা একসময় জবাব দেওয়া বন্ধ করে দিল। অমলও আর জানতে চায় না। যে কালো গাড়িটা রঞ্জনাকে নার্সিংহোমে আনা-নেওয়া করে একদিন ফেরার পথে সেটাকে নার্সিংহোম থেকে বেরিয়ে অন্য কোথাও যেতে দেখেছে। গাড়িতে রঞ্জনা ছাড়া শ্যামলাল ডাক্তারও ছিল। অমল কিছু বলে নি। বলে নি কারণ এরই মধ্যে সেই ঘটনাটা ঘটে গিয়েছে।
একটা বিয়েবাড়ি ছিল। কলোনিরই কারো বিয়ে। আসার পথে কণা ঘুমিয়ে কাদা। কণাকে শুইয়ে রঞ্জনা কাছে এসেছিল। ঝলমলে শাড়ি আর ঝুটো গয়নায় রঞ্জনাকে দেখাচ্ছিলও খাসা। অমলেরও যে ইচ্ছা ছিল না তা নয়। কিন্তু ঘনিষ্ঠ হতে গিয়ে অমল দেখল সে পারছে না। পারছে না মানে কিছুই পারছে না। বেইজ্জতের একশেষ। রঞ্জনা তার গালে একটা থাপ্পড় কষিয়ে উঠে গিয়েছিল। বিছানার একপাশে কাঁচুমাচু মুখ করে ভেজা কাকের মতো বসে থেকেছিল অমল।
সে অবশ্য হয়েও গেল অনেকগুলো দিন। তারপরেও যে অমল চেষ্টা করে নি তা নয়। ফল যে আলাদা কিছু হয়েছে তা নয়। সেই থেকে রঞ্জনার মাঝে মাঝেই রাতে না-ফেরা শুরু হয়েছে। অমলও, সব বুঝেও, না-বোঝার ভান করে পড়ে থেকেছে।
এসবই পালটে গেল একদিনের ঘটনার পর। সেদিন অমলের একটা কাজ জুটেছিল। গঙ্গার ধারে যে নতুন রাস্তা গজিয়েছে, বাবুঘাট হয়ে সোজা উত্তরে, সেখানেই রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে পাবলিককে টুপি পরাচ্ছিল অমল। ঢাউস কাগজের টুপি, টুপির গায়ে কোম্পানির বিজ্ঞাপন। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা তো বটেই, বড়রাও কেউ কেউ মাথা বাড়িয়ে টুপি পরছিল। দু’শ টুপির বরাত নিয়ে বসেছিল। দেখতে দেখতে দু’দফায় চারশ টুপি ফুরিয়ে গেল। অমলেরও কিছু আমদানি হল।
এইসব দিনগুলোয় ফুরফুরে লাগে অমলের। আরও ক’টাদিন বাঁচতে ইচ্ছা করে। কণার বড় হওয়া, বিয়ে কিংবা চাকরি, দেখে যেতে সাধ হয়।
একটু হেঁটে ডায়মন্ডহারবার রোডের মুখে পৌঁছল অমল। বেহালার দিকের বাসগুলো এখান থেকেই বাঁদিকে ঘোরে। সবক’টারই ছাদে-বাম্পারে প্যাসেঞ্জার। দু’তিনটে বাস ছেড়ে শেষপর্যন্ত একটায় নিজেকে গুঁজে দিতে পারল। প্যাসেঞ্জাররাই একসময় ঠেলতে ঠেলতে তাকে বাসের ভেতর ঢুকিয়ে দিল। তবে এসময় কোথায় জায়গা হবে তাতো আর নিজের হাতে থাকে না, একসময় দেখল সে দাঁড়িয়ে আছে লেডিজ সিটের সামনে আর তাকে ঘিরে আছে ষোলো থেকে ষাট নানা বয়সের মেয়ে। এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল অমলের।
চারপাশে যেদিকে তাকাও মেয়ে আর মেয়ে। কেউ বেঁটে কেউ লম্বা। কেউ ফর্সা কেউ কালো। কেউ রোগা কেউ মোটা। এইভাবে এত মেয়ের সংস্পর্শে একসঙ্গে আগে কখনো আসেনি অমল। শরীরে শরীর লেপটে রয়েছে। একটা মানুষের পিন্ড যেন বাসবন্দী হয়ে উড়ে চলেছে। অমল বলে আলাদা কেউ নেই। অসংখ্য নারীদেহের একজন হয়ে অমলও উড়ছে। চোখ বন্ধ করে ফেলল অমল। মনে মনে ভাবতে শুরু করল। অমলের সামনে যে, ধরা যাক তার নাম পিয়ালি, যার পেছন আর অমলের সামনে এখন একাকার, কেমন দেখতে পিয়ালি? কিংবা মিতালি, পেছন থেকে জাপটে ধরে আছে অমলকে, যার বুক ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে অমলের পিঠ, সে-ই বা কেমন? ভাবতে ভাবতে রোমাঞ্চ হতে লাগল অমলের, রোমাঞ্চ থেকে উত্তেজনা।
সেদিন রাতে জোর করে কাছে টানল রঞ্জনাকে। মেয়ে বড়ো হতে তার ঘর আলাদা হয়েছে। রঞ্জনা অবাক হল। আবার ছাড়িয়েও নিল না। যখন হয়ে গেল, উঠে যেতে যেতে রঞ্জনাই সার্টিফিকেটটা দিয়ে গেল,’আজ খুব ভাল পারলে যে? ব্যাপার কী? ওষুধ টষুধ খাচ্ছো নাকি?’
কথাটা মিথ্যে বলে নি রঞ্জনা। সত্যিই ওষুধ খেতে শুরু করে দিল অমল। তবে কী ওষুধ কেমন ওষুধ সে ছাড়া অন্য কেউ জানে না। যেদিন যেদিন রঞ্জনার রাত-ডিউটি থাকে না সেইদিনগুলোয় অভিযানে বেরোয় অমল। নিজেকে বানিয়ে নিয়ে ঘরে ফেরে। রঞ্জনাও পথ চেয়ে অপেক্ষা করে। হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো যেন ফিরে আসতে লাগল।
(৩)
অমল মাঝেমাঝে ভাবে যে পরিমাণ অভিজ্ঞতা তার ঝুলিতে জমেছে তাতে স্বচ্ছন্দে একটা কোচিং সেন্টার খুলে ফেলা যায়। আজকাল কোচিং সেন্টারগুলোর খুব রমরমা। হই হই করে চলছে। চালু হতে না হতে লাইন পড়ে যায়। খুলবে নাকি একখানা? অমল জানে এমন একখানা সত্যিই যদি খোলা যায় ছাত্রের অভাব হবে না। মুশকিল একটাই, বিজ্ঞাপন দেবে কী করে? একবার জানাজানি হলে পাবলিক পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেবে। পুলিশের ভয় তো আছেই। অথচ যারা প্যাঁদাবে তাদের মধ্যেও বেশিরভাগ গোপনে গোপনে একই রোগ পুষে রেখেছে, বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে না এই যা।
কী শেখানো হবে অমলের কোচিং-এ?
প্রথম: ঠিকঠাক বাসরুট নির্বাচন। কয়েকটা বাসরুট আছে, যেমন চব্বিশ, চুয়াল্লিশ, পঁয়তাল্লিশ এগুলোর প্রত্যেকটা খনি। এসব রুটে পকেটমাররাও ফাঁকা মাঠে গোল দেয়। অনেকের সঙ্গে মুখচেনাও হয়ে গেছে অমলের। অমলকে বাসে উঠতে দেখে চোখ টিপে মুচকি হাসে। মানেটা : দাদা, আমি আমারটা দেখছি, তুমি তোমারটা। কেউ কারোকে ঘাঁটাব না, ব্যাস।
দ্বিতীয়: ঠিকঠাক বাস বেছে নেওয়া। সরকারি যেসব বাসের একখানাই দরজা ভুল করেও সেদিকে পা বাড়ায় না অমল। একে তো আকাশছোঁয়া ভাড়া। তার চেয়েও বড় কথা যে কোনও অ্যাকশনে পালাবার পথ আগেভাগে দেখে না রাখলেই বিপদ। এক-দরজা বাসে দরজা আগলে কেউ দাঁড়িয়ে পড়ল তো হয়ে গেল। কলে-পড়া ইঁদুরের মতো অবস্থা। তাই প্রাইভেট বাস, দু’দিকে দু’খানা দরজা এমনটাই অমলের পছন্দ। আর একটা জিনিসও দেখে নিতে হয়। তুমুল ভিড়, হাঁসফাঁস অবস্থা, তেমন বাসে না ওঠাই ভাল। একে তো খেলার জায়গার অভাব। তার চেয়েও বড় কথা ঝামেলা হলে ভিড় বাসে চট করে নেমে পড়া যায় না।
তৃতীয়: ঠিকঠাক সময় পছন্দ করা। সকাল আটটা থেকে বেলা বারোটা, আবার ওদিকে বিকেল পাঁচটা থেকে রাত ন’টা, খেলাধুলোর পক্ষে এই সময়দু’টো মোটেও অনুকূল নয়। দমবন্ধ ভিড়। বিপদও বেশি। অনেক হিসেব করে শেষ পর্যন্ত দুপুর দু’টো থেকে চারটে এই সময়টাই সবচেয়ে নিরাপদ বলে অমলের মনে হয়েছে। তার আরও একটা কারণ এই সময় বেশিরভাগ প্যাসেঞ্জারের চোখ ভাতঘুমে জড়িয়ে আসে। ঢুলতে ঢুলতে কে কার সঙ্গে কি নকশা করছে সেদিকে নজর দিতে ইচ্ছা করে না।
চতুর্থ: টার্গেট ঠিক করা। সবক’টা পয়েন্টের মধ্যে এটাই সবচেয়ে ওপরে। বয়স কুড়ির কম হলে চলবে না। ওই বয়সের মেয়েরা আজকাল অনেকেই জুডো বা ক্যারাটে শিখছে। একখানা যদি ঠিকমতো ঝেড়ে দেয় উঠে দাঁড়াবার জো থাকবে না। আবার চল্লিশ-টল্লিশ যাদের বয়স, ইশকুলের মাস্টারনি নইলে অফিসে কাজ করে, এমন চিলচিৎকার জুড়বে, বাসবোঝাই লোক পিটিয়ে হাড়মাংস আলাদা করে দেবে। তাতেই শেষ হবে না। মোবাইলে ছবি তুলে পৃথিবীসুদ্ধ লোককে জানিয়ে তবে তাদের শান্তি। অন্যদের নিয়ে চিন্তা করে না অমল, চিন্তা একজনকে নিয়েই। সেও দিনরাত ফেসবুক করে। তার যদি চোখে পড়ে! বাবকে চিনতে পারে! তাই অমল বেছে নেয় কুড়ি থেকে তিরিশ এই বয়সের মেয়ে, কাঁধে ভারী বইয়ের ব্যাগ অথবা ঝোলা, একটা হাত ঝোলা সামলাতে ব্যস্ত, অন্যটা ওপরের রডে, কোনওরকমে ব্যালান্স করতে করতে চলেছে এইরকম টার্গেট।
আজ জায়গাটা চমৎকার বেছেছে অমল: মৌলালি। উঠবে মৌলালিতে, কাজ শুরু করতে করতে মল্লিকবাজার। পকেটমারদের স্বর্গরাজ্য। অমলেরও পছন্দের এলাকা। ভাবতে ভাবতেই বাসটা সামনে এসে দাঁড়াল। জরিপ করল অমল। ভিড় কমও নয়, বেশিও নয়, যেমনটা অমলের পছন্দ। পেছনের দরজা দিয়ে উঠে পড়ল। আগেই দেখে নিয়েছে; কনডাকটর দরজার কাছেই দাঁড়িয়েছিল। উঠেই টিকিট কেটে ফেলল। এই একটা কাজ ফেলে রাখতে নেই। একে তো কনডাকটর সবসময় চোখে চোখে রাখে, তাছাড়া বারবার টিকিট চাইতে এলে কাজে ব্যাঘাত হয়, বিরক্তি লাগে। টিকিট কাটা শেষ, নিশ্চিন্ত। এবার গুটিগুটি এগিয়ে গেল লেডিজ সিটের দিকে।
একটা বছর কুড়ির মেয়ে, কাঁধে বইয়ের ঝোলা, কলেজটলেজ থেকে ফিরছে হয়তো, ঢলঢলে গড়ন, ফিগারটা ভারী চমকের, পেছন থেকে মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু পিঠভরতি চুল, পেছনে গিয়ে দাঁড়াল অমল, একবার দেখে নিল কেউ দেখছে কীনা। তারপর শুরু হল অ্যাকশন।
ভিড় বাড়ছে। একই রুটের আর একটা বাস এসে গিয়েছে পেছনে। হর্ন দিচ্ছে। অমলদের বাসটাও ছুটছে পাগলের মতো। ছুটতে ছুটতে ব্রেক কষছে মাঝেমাঝে। হুমড়ি খেয়ে পড়ছে মানুষ। পেছন থেকে জাপটে ধরছে অমল। মেয়েটা মুখ ঘোরায় নি। কিন্তু ওর ঘাড় বেয়ে নেমে আসছে ঘামের স্রোত। মেয়েটার ভেতরে কী হচ্ছে অমল জানে। অমলের কিছু যায় আসে না। আজ রঞ্জনার ছুটি। স্নান করে গন্ধ মেখে অমলের জন্য অপেক্ষা করবে রঞ্জনা। তার আগে নিজেকে রেডি করতে হবে অমলকে। অমল আরো জোরে চেপে ধরে সামনের মেয়েটাকে।
হঠাৎই তীব্র হর্নের আওয়াজ। গেল গেল শব্দ। ব্রেক। সামনে কিছু পড়েছিল। সেটাকে বাঁচাতে গিয়েই এতকিছু। প্যাসেঞ্জারদের অনেকেই ছিটকে পড়েছিল। তাদের মধ্যে ছিল মেয়েটাও। বইভর্তি ব্যাগটা কুড়িয়ে ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে চোখ পড়ে গেল অমলের ওপর।
শেষ মুহূর্তে মুখটা ঘুরিয়ে নিতে চেষ্টা করল অমল। পারল না। মেয়েটা সামনে এসে দাঁড়াল। দু’চোখে বিস্ময়।
বলে উঠল, – ‘বাবা!’