
কেদারনাথ সিং-এর কবিতা
অনুবাদ- সন্দীপন চক্রবর্তী
কেদারনাথ সিং-এর ‘বাঘ’ কাব্যগ্রন্থটি থেকে চারটি টুকরোর অনুবাদ। বস্তুত ‘বাঘ’ যেন একটিই দীর্ঘ কবিতা, স্তরে স্তরে খোলা, যার কেন্দ্রীয় চরিত্র এক বাঘ। কোনো কোনো সমালোচক এই কাব্যগ্রন্থের উপর টেড হিউজের ‘ক্রো’-এর খানিক ছায়া দেখতে পান।
মুখবন্ধ
বিম্ব নয়
প্রতীক না
তার নয়
হরকরাও না,
আমিই বলব
কেননা আমি,
আমিই শুধু জানি –
আমার পিঠে
আমার সময়ের পাঞ্জার
কত্তগুলো নিশান
আমার সময়ের পাঞ্জা
কতই যে অভিন্ন
আমার নখের ঝলমলানি থেকে
আমার মনে যে খুশি
আসলে সেটাই তো
আমার শ্বাসরোধের কষ্ট
আর তলায় যে জ্বালা
মগজে তো সেটাই
বিচারের হুমকি
এই সময়ে আমার জিভ
তার উপর যে বিরাট এক মিথ্যে
সেটাই – সেটাই তো আমার কালের
সবচে’ বড় সত্যি!
এই নাও আমার হাত
এই হাত তোমায় দিলাম
আর নিজের কাছে রাখলাম শুধু
আপন ঠোঁটের এই
থরথরানিটুকু…
একজন কবির
আর কী-ই বা চাই!
২.
আজ সকালের খবরের কাগজে
ছিল ছোট্ট একটা খবর –
কাল রাতে নাকি শহরে
এসেছিল বাঘ!
কেউ তাকে দেখেনি,
অন্ধকারে শোনেনি কেউ
তার চলার আওয়াজ,
রক্তের কোনো ছিটেফোঁটাও
পড়ে ছিল না কোনো রাস্তায়,
কিন্তু সবার বিশ্বাস
সকালের খবরের কাগজে ছাপা খবর তো আর
ভুলভাল হতে পারে না –
অবশ্যই, অবশ্যই কাল রাতে এ শহরে
এসেছিল বাঘ
সত্যি এটাই যে, সন্দেহ করতে পারি না
বাঘের আসা নিয়ে।
আবহাওয়া যেমনই হোক,
যা জোর হাওয়া দিচ্ছে –
এর মধ্যে যখন খুশি যেখানে খুশি
এসে পড়তে পারে বাঘ।
কিন্তু প্রশ্ন এটাই –
শেষমেশ এতদিন পর
এই এত্ত বড় শহরটায়
বাঘ এসেছিল কেন?
সে কি ভুখা ছিল?
অসুস্থ?
শহরের ব্যাপারে কি তার
পালটে গেছিল ধারণা?
এটা কী আজব, যে
সে এল
পুরো শহরটাকে সে
গাঢ় এক তিরস্কার
আর ঘেন্না নিয়ে দেখল
আর যেখানে যা যা ছিল
সেগুলো সেখানেই ছেড়েছুড়ে
বিরক্ত আর চুপচাপ
বেরিয়ে গেল বাইরে!
সকালের রোদ্দুরে
নিজের নিজের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে
সবাই চুপ।
কিন্তু আমি শুনতে পাচ্ছি
সবাই কথা বলছে
পা-কে জিজ্ঞেস করছে জুতো
ঘাড়কে জিজ্ঞেস করছে চুল
নখকে জিজ্ঞেস করছে কাঁধ
শরীরকে জিজ্ঞেস করছে চামড়া
কবে আসবে
আবার কবে আসবে সেই বাঘ?
৩.
গল্পে ভরা এই দেশটায়
আমিও এক গল্প
আর বাঘও এক গল্প
সেজন্য বেশ কয়েকবার
যখন সে লুকোনোর কোনো
জায়গা পায় না ঠিকঠাক,
আস্তে আস্তে উঠে যায়
আর গিয়ে বসে পড়ে
কোনো গল্পের ছদ্মবেশে
তারপর যতই খোঁজো না
জঙ্গলের আঁতিপাঁতি খুঁজে মরলেও
আর কোথাও তাকে পাবে না।
বেচারা মোষ
সন্ধ্যে থেকে সকাল
চুপচাপ বাঁধা থাকে
জলের এক পাতলা রশি দিয়ে –
বাঘের আর তেষ্টাও পায় না
আর সে আসেও না
দিনের পর দিন
জলে ছেড়ে যাওয়া
নিজের দুর্দান্ত লম্বা ছায়াটা দেখতে
আর যখন রাজা আসেন
আর হাঁক পড়ে জঙ্গলে
আর সমস্ত বন্দুক তাক করা হয়
সেইদিকেই
যেদিকটায় থাকতে পারে বাঘ –
এটাই সত্যি যে
সেই সময়ে বাঘ
না থাকে এখানে, না ওখানে।
নিজের শিকারের রক্ত
পান করার পর
আরাম করে সে বসে থাকে
কোনো গল্পের ছদ্মবেশে!
৪.
বিশাল এই দেশের
দূর উত্তরপ্রান্তে
আছে প্রাচীন এক নগরের
ছোট্ট ধ্বংসস্তূপ,
বৈভবের দিনে সেখানেই
কখনো-কখনো আসতেন বুদ্ধ
কখনো-সখনো এসে পড়ত
বাঘও
দুজনে আসত আলাদা-আলাদা।
বুদ্ধ যদি আসতেন পূবদিক থেকে,
তো বাঘ কী করবে
কখনো সে আসত পশ্চিম থেকে
কখনো-বা এমন কোনো অজানা দিক থেকে
কারো কাছে যার
আভাসমাত্র ছিল না
কখনো কখনো দুজন
পড়ে যেত মুখোমুখি।
চোখ তুলে বাঘ
তাকিয়ে থাকত বুদ্ধের দিকে
আর নতশির বুদ্ধ
এগিয়ে যেতেন…
চলতে থাকল এভাবেই