
সৈকত ঘোষের বিলুপ্ত পাখিদের কলারটিউন ভালোবাসা ও আইডেন্টিটির তীব্র অন্বেষণ
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
বিলুপ্ত পাখিদের কলারটিউন সৈকত ঘোষ প্রকাশক: ছিন্নপত্র প্রকাশন ৩৬ বাংলাবাজার (২য় তলা), ঢাকা-১১০০। মূল্য: ১৩০ টাকা
বিলুপ্ত পাখিদের কলারটিউন। কবি সৈকত ঘোষের এগারোতম কাব্যগ্রন্থ। বয়সে তরুণ হলেও কবিতা চর্চায় যতটুকু পথ এখনো পর্যন্ত সৈকত পেরিয়ে এসেছে, তাতে বেশ একটা পাকা জায়গা করে নিয়েছে পাঠকের হৃদয়ে। তার কবিতায় প্রতিনিয়ত চলতে থাকে ভাঙচুর, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নতুন নতুন শব্দের প্রয়োগ আর নতুন বাক্যবিন্যাস। এই গ্রন্থটিও তার ব্যতিক্রম নয়।
জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে যা পড়ে থাকে, তার নাম ভালোবাসা। এই অনুষঙ্গ গুলোই ঘুরে ফিরে এসেছে সৈকতের কবিতায়। জীবন নিয়ে উচ্ছ্বাস, কিম্বা মৃত্যু নিয়ে অহেতুক দুশ্চিন্তা এবং সতর্কতা তার নেই, কিন্তু ভালোবাসা নিয়ে আছে অনেক রিজার্ভেশন। সেখানে সে একেবারে আপোষহীন। খেদ, ক্লেদ বা ক্লান্তির প্যানপ্যানানি ছেড়ে তার সমস্ত বক্তব্য সটান পৌঁছে যায় ডেসটিনেশনে। সেখানে কোনও আউটসোর্সিং নেই। যেমন ‘ট্রিগারে হাত রেখে বলছি/জীবনের বাইশ গজে আমি কর্ণ হতে পারি/প্লিজ, পলাতক বোলো না’(পলাতক)। কিম্বা ‘তোমার লাবণ্য দেখবো না/অনেকক্ষণ একটানা তাকিয়ে থাকার পর/রেস্তোরাঁ নিভে যায়/আমি কাঁটা চামচে ছিঁড়ে খাই নিজেকে’(একটা অলিভ সন্ধের পর)। এই কবিতারই শেষ লাইনেই সে আবার নির্দ্বিধায় লিখে দেয় – ‘ছুটির দরখাস্তে আমি প্রেমের কবিতা লিখেছি…’।
সহজিয়া জীবনের কাছে ফিরে আসার দায় সবার না থাকলেও হয়তো একটা টান থাকে, সেই জীবনের টার্মস এন্ড কন্ডিশনস্ মেনেই চলে পুরোটা যাপন। এই কাব্যগ্রন্থে সৈকতের জীবনচেতনা সিম্পল ফ্যান্টাসি নয়, মৃত্যুকে পরখ করে দেখে যেন এক সার্টিফিকেশন। এই সিদ্ধান্ত সে জানিয়ে দেয় কোনোকিছুর সঙ্গেই কম্প্রোমাইজ না করে; ‘উৎস সন্ধানে বেরিয়ে খোলস ত্যাগ করে মৃত্যু। পাশাপাশি শূন্যস্থান।…… এলোমেলো রাত, জড়ুল চিহ্ন-অসহায় পাশবালিশ জানে সাময়িক মৃত্যুর পর কিভাবে জন্ম নিতে হয় (নির্মাণপর্ব)। জীবনের প্রতি কমিটমেন্ট কতটা গভীর হলে এরকম উচ্চারণ সম্ভব তা বুঝে নিতে অসুবিধা হয়না।
বিনা মন্তব্যে কয়েকটি লাইন এমনিই তুলে দেওয়া যাক ঃ
‘দূরত্ব আসলে বিস্ময় চিহ্নের মতো, কাছে গেলে ঝড় থেমে যায়। স্টপেজ মিস করা শরীর প্রতি রাতে খুন করে তোমাকে’…(খনন)। ‘নিজের সামনে নিজেকে খুলে দাঁড়াবার নাম বিপ্লব’(বিপ্লব)। ‘যে দৃষ্টি তোমাকে সুর দিয়েছে, যে আগুন দিয়েছে আশ্বাস – তাকেই তো কবিতা বলো তুমি’(আবিষ্কার)। ঈশ্বর জন্ম নেওয়ার আগেই মানুষের কাছে হেরে বসে আছে’(আমেন)।
বিপন্নতা, যন্ত্রণা, একলা মানুষের পাঁজর ভাঙা রোজনামচা, এসব যে কি পরিমাণ উতলা করে তোলে কবিকে, এক একসময় কতটা ক্রোধ সংক্রামিত হয়ে যায় তার বোধের ভিতরে, তার নজির পাওয়া যায় ‘অন্ধকারের তাবিজ’ কবিতায়। ‘মানুষ কাঁদছে, মানুষ জ্বলছে। মহাকাল গিলে নিচ্ছে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ। আজ রাতে তাকে ধ্বংস করতে চাই। মুঠো শক্ত হয়ে আসছে। আকাশ নিভে যাওয়ার আগে অন্তত একবার, একবার তাকে দেখতে দাও। ……………পুনর্বাসনের নামে তুমি চক্রব্যূহে রেখে আসছো সন্তান’।
বিচ্ছিন্নতা নয়, বন্ধন; অচলায়তন নয়, তাকে চুরমার করে তীব্র ছুট; অদ্ভুত ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিতে তার জুড়ি নেই। এই লাইনগুলিই তার প্রমাণ ঃ ‘আমি দৃশ্য জুড়ে জুড়ে একটা আলোকবর্ষ লিখি। এ এক অদ্ভুত আবহবিকার, পায়ের পাতায় জন্ম নেন ঈশ্বর’(গ্রে-ম্যাটার)। তেমনি রাতের কলকাতার লাইফলাইন চিনিয়ে দেয় মাত্র কটি শব্দেই ঃ ‘এইমাত্র প্রজাপতি হয়ে গেল পার্কস্ট্রিট, এইমাত্র ত্রিভুজ খুলে দিল রেঁস্তোরা সংলাপ’(থার্টি ফার্স্ট নাইট)।
সৈকতের কবিতায় শ্লেষ আর স্যাটায়ার এসেছে একেবারে সহজেই, খুব স্বাভাবিক গতিতে। ‘এ পৃথিবী লুফে নেবে শ্রমের জ্বালানি, কৃষকের বুক, মেধার পিলসূচ। তারপর আলোর বেগে ফুল ফুটবে। চোখ পুড়িয়ে দেবে পুঁজিবাদের উল্লাস। আমরা শুকিয়ে যাবো দিনদিন। অক্ষর শুকিয়ে যাবে। ভাবনা বেচে দেবে পাইরেটেড খানকিতন্ত্র’(উল্লাস)।
দৈনন্দিন ব্যবহারে যে শব্দগুলো আমাদের খুব পরিচিত আর প্রিয় হয়ে উঠেছে সেরকম অনেক শব্দই সৈকতের কবিতায় অনায়াসে জায়গা করে নিয়েছে। অবশ্যই তার সঙ্গে লেগে আছে সূক্ষ্ম জীবনবোধ আর ফ্যান্টাসির অদ্ভুত মিশেল। কখনো হোঁচট খেতে হয় না। যেমন এই লাইনটি – ‘তুমি বলেছিলে এই সম্পর্কটা একটা অ্যাপের মতো,/ প্রয়োজন ফুরালে আনইনস্টল করে দিও’(প্রাক্তন)। এরকম অজস্র শব্দ ঘুরেফিরে এসেছে তার কবিতায়। কিন্তু দু-একটি বাদ দিলে কখনও মনে হয়নি সেগুলো জোর করে আরোপিত। এছাড়া কিছু কবিতায় চিত্রকল্প এতই সুন্দর যে মনে হয়ে শব্দগুলি নিছকই ট্রান্সপারেন্ট কভার। যেমন ‘প্রতিটা উত্তরের পাশে নিরুত্তর বসে থাকে সময়/যে ফুল ফোটার আগে দরজা খুলে দেয়’
সৈকতের কবিতার ভাষাতেই বলা যায়, তার কিছু জেতার অহংকার নেই, নেই কিছু হারাবার ভয়। ডেবিট ক্রেডিটের খাতায় সময়কে বেঁধে রাখতে চায়নি কখনো। পুরোটা জার্নিতে আছে নিজেকে নির্মাণ করার একটা প্রক্রিয়া, স্বপ্ন শিকারের ব্যস্ততা, একটা রোম্যান্টিক ভাবনা শৃঙ্খল। তাই কবির চোখে ভেসে ওঠে ‘বন্ধ কারখানার গেটে কারা যেন সেঁটে দিয়েছে গোলাপি পোস্টকার্ড’। ‘আমি নিজেকে খুঁড়ে দেখি, এ রূপ এ অনুলেখা কোথাও কোনও শব্দ নেই। শূন্যের মধ্যে কোটি কোটি শূন্য, কোটি কোটি আঁকড়ে ধরা’। তার কল্পনার অবয়বের প্রতি যে আকর্ষণ তার কোন কাঁটাতার নেই। তার বুকে মৃত্যুও সুন্দর। তাই ভীষণ কনফিডেন্সের সঙ্গে বলতে পারে ‘তুমি বাইপাস থেকে শোভাবাজার, নিউটাউন থেকে নন্দন, পার্কস্ট্রিট থেকে তিলজলা হয়ে যে কোনও সময়ে সুইচওভার করবে মৃত্যুতে’।
আসলে একটা নিরবচ্ছিন্ন খোঁজ, অব্যক্ত যন্ত্রণা আর নিজেকে বারবার ভিন্ন ল্যান্ডস্কেপে রেখে আরাধ্য ভালোবাসা আর পুরো নাগরিক যাপনকে বিভিন্ন পারস্পেকটিভ থেকে দেখা, এগুলোই তার রুটম্যাপ। ভালোবাসা ও আইডেন্টিটির অন্বেষণই তার কবিতার মূল সুর। এ থেকেই জেনে নেওয়া যায় তার ভাবনার গভীরতা, যা আসলে তার কবিতার কথাতেই ‘সুগন্ধি আলো’র মতো। তার মতো করেই বলতে পারি, তার কবিতায় ‘আমরা অজান্তেই আলো কুড়িয়ে নিই, কুড়িয়ে নিই মুঠো ভর্তি যুদ্ধ প্রস্তুতি।
পরিশেষে বলতেই হয় রাজদীপ পুরীর নান্দনিক প্রচ্ছদ, শান্তিময় মুখোপাধ্যায়ের ব্ল্যার্ব এবং ছিন্নপত্র প্রকাশনের ছিমছাম প্রোডাকশন বইটিকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে।
বিলুপ্ত পাখিদের কলারটিউন
সৈকত ঘোষ
প্রকাশক: ছিন্নপত্র প্রকাশন
৩৬ বাংলাবাজার (২য় তলা), ঢাকা-১১০০।
মূল্য: ১৩০ টাকা

