
সীমা পাত্র-র কবিতা
আমার কোনো দায় নেই
চিরুনির দাঁড়ায় লেগেছিল রুক্ষ সুতোর মত কয়টা চুল।
কবে হাওয়ায় ভেসে উঠোনে পড়েছে সেগুলো।
আমার ভুলে যাওয়া চুল পায়ে জড়িয়ে,
প্রতিবন্ধী হয়েছিল কয়েকটা চড়াই।
প্রাণভোমরা রেখেছি দূরে কোথাও।
কথা হয়,দেখা হয়,পাশাপাশি বসাটা হয়না আর।
প্রাণভোমরারা থাকে আলোকবর্ষ দূরে।
শব্দে-কণ্ঠে-আওয়াজে মাপি গাঢ়ত্ব,ভালোবাসার..
আকাশছোঁয়া স্তম্ভ বসে সার সার।
মাঠ- ঘাট- রাস্তা পেরিয়ে দূর থেকে দূরে চলে যায় যোগাযোগের সুতো।
দূরত্ব কমে, কমে কি?
ওই পাখিগুলো বোঝে না এতশত,
শুধু মরে যায় ঝাঁকে ঝাঁকে।
পুড়ে উড়ে ছাই একটু বাতাসে মিশে যায়।
ভেসে কোনো অখ্যাত নদীতে পড়ে হয়তো..
স্বর্গলাভ! ওসব বিলাসিতা।
বেঁচে থাকার থেকে বড়ো স্বর্গলাভ হয় আর!
মরে যেতে না চেয়েও তবু মরে যায় ওরা রোজ।
এখন যেখানে পিচঢালা রাজপথটা..
সেখানে কখনো মাঠ ছিল, গাছ ছিল ,
ওই অট্টালিকার নিচে ছিল একটা বিশাল জলাশয়।
তবু ওই মানুষগুলো আজ জলের জন্য হাহাকার করে ।
যান্ত্রিকতায় ঘরের উষ্ণতা নামায় রোজ।
তবু ,
সব অভাব মেটে না।
ওরা আদৌ জানে!
জলের বুকে
কবর খুঁড়ে ওদের বাস।
আমি কবে যেন কাকে বলেছিলাম..
মেনে নিতে হয়, মেনে নিতে হয়।
তারপর থেকে কতজন, আমৃত্যু মেনে নিল সব।
মরে গেল ওরা..
অথচ সেদিন ওরা আশা নিয়ে এসেছিল হয়তো আমি বলবো, এরকমটা ঠিক নয়।
আমি বলতে পারিনি।
শুধু রোজ ওদের কবর খোঁড়া দেখে,
আমার ভেতর ভেঙ্গে চুরে যায় সব।
চিরুনির দাঁড়ায় লেগেছিল রুক্ষ সুতোর মত কিছু ভুল..
কবে হাওয়ায় ভেসে উঠোনে পড়েছে সেগুলো।
আমার ভুলে যাওয়া ভুল পায়ে জড়িয়ে
প্রতিবন্ধী হয়েছিল কতজন!
অথচ স্বেচ্ছায় তো করিনি কিছু!
পৃথিবীর ভেতর পাল্টে যাচ্ছে সব।
উল্টো পিঠ দেয়াল ঘেঁসে শুই..
আমার কোনো দায় নেই।।
সম্বিৎ
সূর্যের প্রথম কিরণ জানান দেয় দিনের শুরুর,
বাগানের রঙ্গিন প্রজাপতিগুলো বলে যায় এখনও খুশি হওয়ার কারণ আছে কিছু পড়ে।
মরে যাওয়া ডাল বলে যায় সময় ফুরোচ্ছে,
তাড়াতাড়ি।
ঝিঁঝিঁর ডাক বলে দেয় এখন একটু নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে নেওয়া যায়,
পৃথিবী নিরাপদ এখনও।
নিস্তব্ধ চরাচর ভয় ছড়ায়, ছড়িয়ে দেয় বিপদচিহ্ন, আমার ঘর উঠোন বারান্দায়।
ভয়ে কাঁটা হয়ে চোখ বুজে পড়ে থাকি।
কিছু চোখ বলে দেয় এখনও নিজেকে নিয়ে
ভাসা যায়, ভালোবাসা যায় অনায়াসে।
মাটি মনে করায় শিকড়, বুকের ভেতর শিশিরের ফোঁটা, একান্ত দুঃখ।
আমি ওই ওদের দৃষ্টি ধার করেই বাঁচি।
ওদের কাছেই নিজেকে দেখে অনুমান করি
সুখ, দুঃখ, বিপদ, শান্তির নিজস্ব পরিমাপ।
তাই আর একলা থাকা হয়না আমার।
আমার পঞ্চ ইন্দ্রিয় ধুলো মাখা, ঝুল পড়া,
ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অকেজো,তৃতীয় নয়ণের দৃষ্টি ঝাপসা।।
আমার দু পায়ের শিকল খুলে দাও
সৃষ্টির আদিতে যে বীজটা পোঁতা হয়েছিল
এক নারীর গর্ভে,
গর্ভ থেকে হৃদয় অব্দি সুড়ঙ্গ কেটে মাথা বের করে এসেছিল সেই জীবন।
হিসহিসে সাপের গলায় শেকল পরাত সে অনায়াসে,
বশ করতো সময় , রাস্তা , দুঃখ..
ওর কাছে সব অন্ধকার হয়ে যেত এক একটা নরম নদী,
যাতে পা ডুবিয়ে বসে থাকতো সার সার অশান্ত
আত্মা।
হাওয়ার কাছে মাথা নোয়াতো মানুষ,
স্বীকার করতো বশ্যতা শিকড়ের কাছে।
সেই নারীর মুকুটে আজ কয়েক ফোঁটা শিশির টলমল করছে,
পৃথিবী সাপেদের রাজত্ব
সব শিকড় ছিঁড়েখুঁড়ে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস,
সেই হাহাকার চাপা পড়ে যায় পৈশাচিক উল্লাসে।
সব মহীরুহগুলো আজ নদী হতে চায়,
হিংসার নগ্নতা একপেয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে
চোখ শুকিয়ে গেছে ওদের,
আমার দু পায়ের শিকল খুলে দাও..
হয়তো আমি সেই নারী,
হয়তোবা সেই হৃদয়ের এককোনে রাখা জীবন।
দু ফোঁটা শিশির উপচে পড়ে,
ভেসে যাবে এই গোলাকার গ্রহটা।
এখনও সময় কিছুটা বাকি,
আমার দু পায়ের শিকল খুলে দাও।।
স্বীকারোক্তি
কই কখনও তো বলতে পারলাম না
‘বিশাল বড়ো একটা মানুষ আমি!
পায়ের শিকড় মাটির ভিতরে গেছে,
যতদূর গেলে জোগাড় করা যায় জীবন।
মাথা ফুঁড়ে গেছে আকাশকে
যতটা ওপরে গেলে, কাঁধ লাগেনা আর।
সবটা দেখা যায়, সবটা।’
বলতে পারলাম না, ‘এসে বসো
ছায়া দেবো, দরকারে জল,
শান্তি দেবো, আশ্রয় ‘।
যতটুকু দিয়েছি, তাই দিয়ে চুঁইয়ে পড়েছে
আমার অহংকার।
তোমার অন্ধকারে প্রদীপ জ্বেলে
কানে কানে বলেছি
প্রদীপের তেলটুকু আমার দান।
বড়ো ছোট মনে হয়..
নীচ, হীন, দরিদ্র।
তোমার অসহায় নিচু মাথা,
নিঃশব্দ চলে যাওয়া,
দেখেছি, দেখেছি।
এক চোখ জ্বলছিল ঘৃণায়, দর্পে
আর এক চোখে জল ছিল, ‘নীচ হীন দরিদ্র’..
আমার পায়ের পাশে গাছ নেই আর
না আগাছা, পোকা, এমনকি আবর্জনাও
কই কখনও তো বলতে পারলাম না
বিশাল বড়ো একটা মানুষ আমি
নয়তো গাছ, মাটি, আকাশ!
সবকটা কবিতাই বেশ ভালো লেগেছে।
Khub valo hoyeche buni…..
Love you ❤️❤️❤️..