‘কথা ও কাহিনীর’ কবিতা কি আজও কবিতা? <br />  সৌভিক গুহসরকার

‘কথা ও কাহিনীর’ কবিতা কি আজও কবিতা?
সৌভিক গুহসরকার

" রবীন্দ্রনাথ যখন কবিতা লেখা শুরু করেন, তখন আখ্যানকাব্যের রমরমা। অথচ তিনি ওদিকে গেলেন না। তিনি বিহারীলাল চক্রবর্তীর লিরিক কবিতার নিচু ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বরকে অনুসরণ করলেন। শুধু গীতিনাট্যের ক্ষেত্রে তিনি আখ্যানবস্তু ব্যবহার করলেন, তাও অতি আলগাভাবে। পরে তিনি যখন সোনার তরী অতিক্রম করছেন তখন তাঁর কবিতায় ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে আখ্যানবস্তু। আসছে হিং টিং ছট, পরশপাথর, দুই পাখি, গানভঙ্গর মতো কবিতা। কিন্তু এইসব কবিতার মধ্যেকার যে আখ্যানবস্তু তা রূপকধর্মী। কবিতার দৈর্ঘ্য অপেক্ষাকৃত ছোট। ব্যবহৃত হচ্ছে পয়ার, ত্রিপদী, অমিত্রাক্ষর। অনেকক্ষেত্রে অমিত্রাক্ষরে থাকছে অন্ত্যমিল। চিত্রায় পাচ্ছি পুরাতন ভৃত্য ও দুই বিঘা জমির মতো সাধারণ জীবন থেকে উঠে আসা আখ্যানকাব্য।" রবিপক্ষ। লিখলেন সৌভিক গুহ সরকার।

‘কথা ও কাহিনীর’ কবিতাগুলো কবিতা নয়, ওগুলোয় গল্প রয়েছে’― এইরকম মন্তব‍্য যখন শুনেছি কোনও কোনও কবি বা নিবিড় কাব্যপাঠকের কাছে, তখন বিশেষভাবে চমৎকৃত হয়েছি। এ কথার অর্থ কী? কোনও কবি যখন বলেন ‘এটা কবিতা নয়’ তখন তিনি কি জেনে গেছেন নিশ্চিতভাবে যে কবিতা কাকে বলে? সময়প্রবাহের কোনও কোনও খণ্ডে এক একটি বিশেষ ঝোঁকের জন্ম হয়। নতুন কবিদের হাতে নতুন বাকভঙ্গিমা উঠে আসে সময়সমাজের বিশেষ ঘূর্ণনে, যা হয়তো সম্পূর্ণ নতুন, তবু তাও পুরনো প্রসিদ্ধ কাব্যরূপকে পুরাতন কলসের মতো বাতিল করে দেওয়াটা বুদ্ধির কথা নয়। বরং এটা বোঝা প্রয়োজন যে কেন একটি বিশেষ সময়ে একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি একধরনের কবিতা লিখলেন? কীসের তাগিদে? কী ছিল তাঁর অভিপ্রায়? অশ্রদ্ধা, প্রত্যাখ্যান আর অবজ্ঞার মধ্যে দিয়ে প্রকৃত জ্ঞানলাভ করা অসম্ভব। পূর্ব-নির্ধারিত কোনও ধারণা নিয়েও কোনও সাহিত্যকর্মের কাছে যাওয়াটাও সমীচীন নয়। ব্যক্তিগত ‘প্রেজুডিস’ সরিয়ে তাকাতে হবে। ‘আমার ভালো লাগে না’ আর ‘কাজটি গুরুত্বপূর্ণ নয়’— এই দুয়ের মধ্যে ফারাক রয়েছে বিস্তর। সাহিত্যের প্রবাহে তার স্থানাঙ্ক নির্ধারণ করাটা যুক্তি সহকারে করতে হবে। না হলে মৌখিক ঔদ্ধত্য অপাংক্তেয় এবং অবান্তর হয়ে ওঠে।

কেউ যদি কথা ও কাহিনীকে ‘গল্পকবিতা’ বলে দাগিয়ে দিয়ে তাদের বাংলার কাব্যপংক্তি থেকে সরিয়ে দিতে চান, তাহলে তিনি যেটা করছেন তা হল, গত কয়েক হাজার বছরব্যাপী সারা পৃথিবীজোড়া ‘ন্যারেটিভ কবিতা’ বা আখ্যানকাব্যের ধারাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন, যে ধারায় জন্মেছে রামায়ণ-মহাভারত, ইলিয়াড-ওডিসি, ডিভাইন কমেডি বা প্যারাডাইস লস্টের মতো মহাকাব্য, কুমারসম্ভব বা ইভ অফ সেন্ট অ্যাগনিসের মতো খণ্ডকাব্য, রাইম অফ দ্য এনশিয়েন্ট মেরিনারের মতো ব্যালাড ইত্যাদি। মুখের কথায় কি এসব উড়িয়ে দেওয়া চলে?

ক্যারাভ্যাজ্জিও বা রাফ্যায়েলের ছবিতে কাহিনিসূত্র রয়েছে বলে কি তা সার্থক চিত্র বলে ধরা হবে না? গাঁয়ের বধূ গানে কাহিনিসূত্র রয়েছে বলে কি তা যথেষ্ট গান হয়ে উঠল না? তাহলে কবিতায় কাহিনিসূত্র থাকলে তা কবিতা বলে ধরা হবে না কীসের যুক্তিতে? পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় লেখা বহুপ্রকারের আখ্যানকাব্য আমরা পাঠ করে আনন্দ পেয়েছি। আখ্যানকাব্যের উৎকর্ষতা মাপতে হবে সেই কাব্যে ব্যবহৃত বিষয়বস্তু, ভাষা, অলংকারের প্রয়োগকুশলতাকে বিচার করে। তাই কথা ও কাহিনীর সঙ্গে হঠাৎ ডুইনো এলিজিস বা ওয়েস্টল্যান্ড বা সাতটি তারার তিমির বা ফিরে এসো চাকাকে তুলনা করা হাস্যকর। ঠিক যেমন হাস্যকর ম্যাকবেথের সঙ্গে ওয়েটিং ফর গোডোকে তুলনা করা। ঠিক যেমন হাস্যকর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের সঙ্গে ইউলিসিসের তুলনা করা। বিষবৃক্ষের সঙ্গে পথের পাঁচালীর তুলনা কীভাবে হবে? কোনটা বেশি উপন্যাস এখানে? কোনটা উপন্যাস নয় এখানে? হলো ম্যান যতটা কবিতা, মাই লাস্ট ডাচেসও কি ততটা কবিতা নয়? দুটোর বিষয়বস্তু আলাদা, সময়কাল আলাদা, আঙ্গিক আলাদা। হলো ম্যান আমাদের জীবনের যে সত্যের দিকে নিয়ে যায়, মাই লাস্ট ডাচেস সেদিকে নিয়ে যায় না। সে আমাদের ভিন্নতর অভিজ্ঞতার সম্মুখে এনে দাঁড় করায়। কিন্তু দুটোই কবিতা। কবিতার ইতিহাসে দুটোই কবিতা বলে স্বীকৃত। কবিতার জগতে গণতন্ত্র থাকাটা খুব জরুরি। যে চেতনা দু-তিন ধারার কবিতার বাইরে কবিতার অন্যান্য শাখাদের অস্বীকার ও নস্যাৎ করে, সেই চেতনায় মৌলবাদ রয়েছে বলেই মনে হয়। জীবনানন্দের অমোঘ পংক্তিগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে— ‘কবিতা কী এ-জিজ্ঞাসার কোনও আবছা উত্তর দেওয়ার আগে এটুকু অন্তত বলতে পারা যায় যে কবিতা অনেকরকম। হোমরও কবিতা লিখেছিলেন, মালার্মে র‍্যাঁবো ও রিলকেও। . . . ’

ঠিক এখান থেকে আমাদের তাকিয়ে দেখতে হবে কথা ও কাহিনী কি বাংলা আখ্যানকাব্যের ক্ষেত্রে আদৌ গুরুত্বপূর্ণ? যদি হয়, তাহলে তার কারণ কী? এই কবিতাগুলির বিপুল জনপ্রিয়তার কারণ কী? কেন এই কবিতাগুলির অজস্র লাইন আজ আমাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে? আখ্যানকাব্যের ক্ষেত্রে ঠিক কোথায় নূতনত্ব আনলেন রবীন্দ্রনাথ?

উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের ফলে বাংলা ভাষায় ঢুকল ভূমধ্যসাগরের ঢেউ। বাংলার সহজাত ন্যারেটিভ কবিতা— যা মঙ্গলকাব্য ও পাঁচালীর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে তা ক্রমে ক্রমে ফুরিয়ে আসতে লাগল। উনিশ শতকের পাঁচের দশকের শেষ থেকে কলম ধরলেন রঙ্গলাল-মধূসূদন। কিছু বছর পরে হেমচন্দ্র-নবীনচন্দ্র। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাপারে বলতে গিয়ে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন— ‘ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হয়ে তিনি ইংরেজি আখ্যান কাব্যের আদর্শে রাজপুত দেশপ্রেমের ঘটনা অবলম্বনে স্বদেশপ্রেমমিশ্রিত ঐতিহাসিক আখ্যানকাব্যের পত্তন করলেন। বলতে গেলে বাংলা কাব্যের পালাবদলের গৌরব সর্বপ্রথম রঙ্গলালের প্রাপ্য।’ তিনি লিখছেন ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ (১৮৫৮)। কিন্তু রঙ্গলালের কবিতার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব যে ছন্দের বিষয়ে তিনি গতানুগতিক। পয়ার-ত্রিপদী ইত্যাদির মধ্যেই তিনি নিজেকে বেঁধেছেন। ভারতচন্দ্র অন্নদামঙ্গলে ছন্দ নিয়ে যে তাণ্ডব করে গেছেন, রঙ্গলাল সেই দ্যুতিকে অতিক্রম করতে পারেন নি। তবে তিনি ইতিহাসকে আশ্রয় করে আখ্যান কবিতা লেখার ধারা তৈরি করলেন। ঠিক একই সময়ে ঝড়ের মতো ঢুকছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মেঘনাদবধ কাব্যে (১৮৬১) তিনি বাংলার আখ্যান কবিতাকে আমূল পালটে দিচ্ছেন। শুধু অমিত্রাক্ষরের প্রবাহ নয়, তিনি তাঁর কল্পনাপ্রতিভাকে সম্পূর্ণ বিস্তার দিয়ে জন্ম দিচ্ছেন নতুন দৃশ্যের। তিনি একটি প্রাচীন ভারতীয় ‘টেক্সট’কে ‘রি-ইন্টারপ্রেট’ করছেন। নিজের মতো করে ভাঙছেন। মিলটন যে ধ্বনিগাম্ভীর্য এনেছিলেন ইংরিজি কবিতায় (যদিও এলিয়ট পরে মিল্টনের বিরুদ্ধে ল্যাটিনাইজ করার অভিযোগ এনেছিলেন— কিন্তু তা ধোপে টেঁকেনি)— সেই ধ্বনিগাম্ভীর্য আনলেন মাইকেল। এরপর আমরা পাচ্ছি ‘বৃত্রসংহার’খ্যাত (১৮৭৫) হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে, পাচ্ছি ‘পলাশীর যুদ্ধ’খ্যাত (১৮৭৫) নবীনচন্দ্র সেন। একজন বৈদিক আখ্যান নিয়ে লিখছেন, অন্যজন লিখছেন ঐতিহাসিক পলাশীর যুদ্ধ নিয়ে। কিন্তু মহাকাব্য রচনা করার নেশায় এবং দ্বিতীয় মাইকেল হবার নেশায় এঁরা নিজেদের কাব্যকে অতি দীর্ঘ করে ফেললেন এবং তাতে বৈচিত্র আনতে সক্ষম হলেন না। এঁদের হাতে অমিত্রাক্ষর খুলল না। এঁদের আখ্যান কাব্যে আখ্যান যতটা থাকল, কাব্য ততটা থাকল না। যদিও কিছু স্মরণীয় পংক্তি এঁরা সৃষ্টি করে গিয়েছেন। অথচ মেঘনাদবধ কাব্য আজও নিজস্ব গরিমায় ভাস্বর। এটিকে আজও বাংলায় ‘কাব্য’ বলে ধরা হয়। এই কাব্যে আখ্যানবস্তু রয়েছে বলেই এর জাত যায় নি।

রবীন্দ্রনাথ যখন কবিতা লেখা শুরু করেন, তখন আখ্যানকাব্যের রমরমা। অথচ তিনি ওদিকে গেলেন না। তিনি
বিহারীলাল চক্রবর্তীর লিরিক কবিতার নিচু ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বরকে অনুসরণ করলেন। শুধু গীতিনাট্যের ক্ষেত্রে তিনি আখ্যানবস্তু ব্যবহার করলেন, তাও অতি আলগাভাবে। পরে তিনি যখন সোনার তরী অতিক্রম করছেন তখন তাঁর কবিতায় ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে আখ্যানবস্তু। আসছে হিং টিং ছট, পরশপাথর, দুই পাখি, গানভঙ্গর মতো কবিতা। কিন্তু এইসব কবিতার মধ্যেকার যে আখ্যানবস্তু তা রূপকধর্মী। কবিতার দৈর্ঘ্য অপেক্ষাকৃত ছোট। ব্যবহৃত হচ্ছে পয়ার, ত্রিপদী, অমিত্রাক্ষর। অনেকক্ষেত্রে অমিত্রাক্ষরে থাকছে অন্ত্যমিল। চিত্রায় পাচ্ছি পুরাতন ভৃত্য ও দুই বিঘা জমির মতো সাধারণ জীবন থেকে উঠে আসা আখ্যানকাব্য। কিন্তু চিত্রাতেই সম্ভবত ‘ব্রাহ্মণ’ কবিতায়, প্রথমবার রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করলেন বৈদিক আখ্যানবস্তু। ছান্দোগ্য উপনিষদ থেকে জাবাল সত্যকামের কাহিনি। পুরাতন ভৃত্য, দুই বিঘা জমি, ব্রাহ্মণ পরে কাহিনীর অন্তর্গত করা হয়। ব্রাহ্মণ কবিতায় সমিল অমিত্রাক্ষরের ব্যবহারে তিনি ফুটিয়ে তুললেন গাঢ় ধ্বনি-গাম্ভীর্য, যা বাংলাকাব্যে মাইকেলের পরে আর দেখা যায় নি। চিত্রা চৈতালি পেরিয়ে তিনি যখন কথা ও কাহিনীতে গিয়ে পৌঁছচ্ছেন, তখন তিনি বাংলা কবিতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছন্দকারিগরে পরিণত হয়েছেন। ছন্দের ভাঙা গড়ার খেলায় তিনি তখন অসামান্য দক্ষ। এবার দেখা যাক কথা ও কাহিনীতে তাঁর পূর্বসূরীদের থেকে কোন কোন জায়গায় আলাদা হয়ে উঠলেন রবীন্দ্রনাথ।

(১) তিনি দ্রুত বুঝতে পেরেছিলেন যে মহাকাব্যের যুগ অতিক্রান্ত। তাই আখ্যানবস্তু দীর্ঘ হলে চলবে না। রঙ্গলালের মতো তিনিও টডের Annals and Antiquities of Rajasthan থেকে কাহিনি গ্রহণ করলেন, কিন্তু সেই কাহিনির বিস্তারকে বেঁধে রাখলেন তিনি।

(২) আখ্যানবস্তু হিসেবে বেছে নিলেন বৌদ্ধ কথা। শিখদের কথা। মারাঠাদের কাহিনি। ভক্তমাল থেকে নিলেন বৈষ্ণব গল্প। বাংলা কাব্যে বৈদিক, পৌরাণিক, ঐতিহাসিক আখ্যান ব্যবহৃত হলেও বৌদ্ধ, শিখ, মারাঠাদের কাহিনিকে নিয়ে এলেন তিনি। বৈষ্ণব কাহিনি অবশ্য সেই সময়ে রজনীকান্তও ব্যবহার করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের কাহিনি নির্বাচন কথা ও কাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পরাধীন ভারতে তখন লেগেছে দেশপ্রেমের আগুন। রবীন্দ্রনাথের কাছে একটি ‘বাইনারি ইকুয়েশন’ স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন জয়ী আর পরাজিতর দ্বন্দ্ব। পদানত থাকার জ্বালা তাঁর মনের মধ্যেও জেগে উঠেছিল। তাই
কথা ও কাহিনীতে অনেক ক্ষেত্রে সেই গল্পই বেছে নিলেন যার ভেতর ‘প্রতিরোধ’ দেখা যাচ্ছে। লড়াই দেখা যাচ্ছে। সেখানে শাসকের সামনে পরাজিত মানুষ আত্মমর্যাদার সঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাদের প্রাণ যাচ্ছে, কিন্তু তাঁরা কেউ আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিচ্ছেন না। কবিতার মধ্যে দিয়ে প্রাচীন ভারতকে মিলিয়ে দিচ্ছেন আধুনিক ভারতের সঙ্গে। পূজারিনী বিদ্রোহী, সে অজাতশত্রুর বিরোধিতা করে। রাজশক্তির বিরোধিতা করছে একজন সামান্য দাসী। আজকের ভাষায় একটা সিস্টেমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে পূজারিনী। সেদিনের অজাতশত্রু ছিল বিদেশি, আজকের অজাতশত্রু দিশি। অজাতশত্রু রূপ পালটেছে। পূজারিনীরা কেউ গৌরী লঙ্কেশ, কেউ কালবুর্গি।

কথা ও কাহিনীতে আরও একটা মোটিফ বারবার উঠে এসেছে— তা হল বিচার। কবিতার পর কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ন্যায়বিচার এবং অন্যায়বিচারের প্রসঙ্গ তুলছেন। বন্দী বীর, মানী, প্রার্থনাতীত দান, পরিশোধ, শেষ শিক্ষা, মস্তকবিক্রয়, অপমান-বর, সামান্য ক্ষতি, রাজবিচার, বিচারক প্রভৃতি কবিতায় বারবার উঠে এসেছে বিচারের কথা। কেন এত বিচার-সংক্রান্ত কবিতা লিখলেন তিনি? আমরা অনুমান করতে পারি, হয়তো ‘জাস্টিস’ বিষয়টি সেই সময়ে তাঁকে ভাবিয়ে তুলছিল। একদিকে পরাধীন ভারতবাসী যে সুবিচার পাচ্ছেন না, এ কথা তিনি মর্মে মর্মে অনুভব করেছেন। অন্যদিকে, জমিদার হিসেবে তাঁকেও প্রজাদের অনেক বাদ-বিবাদের নিষ্পত্তি করতে হচ্ছিল তখন। তাই হয়তো কবিতার মধ্যে দিয়ে নানা ধরনের বিচারের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। আবার একই সঙ্গে এর মধ্যে কিছু কবিতায় উঠে এসেছে পরাজিতর আত্মমর্যাদাবোধের কথা। একটা জাত জয় লাভ করেছে, আরেকটা জাত হেরেছে। এই হারজিতের একই ভাবনাও কাজ করেছে কর্ণকুন্তীসংবাদে। যে জানে সে হেরে যাবে, যে জানে সে পরিত্রাণহীন, যে জানে তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী— সেও কোনও মূল্যেই নিজেকে ছোট করছে না। মোগলের কাছে পদানত রাজপুত বা শিখ কোনও মতেই তার আত্মসম্মান ছাড়বে না। দরকারে সে দেবে, ‘বেণীর সঙ্গে মাথা’। কর্ণও থেকে যাবেন, ‘নিষ্ফলের দলে’, কিন্তু নিজের সত্য থেকে নড়বেন না। বহু পরে জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকাণ্ডের পর, যখন গান্ধীজি প্রতিবাদ করতে ইতস্তত করছেন, যখন চিত্তরঞ্জন দাশও সভা ডেকে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করছেন না— তখন রবীন্দ্রনাথ ত্যাগ করছেন রাজার দেওয়া শিরোপা। তিনি রাজার সভায় গিয়ে বলছেন— চাই না রাজা, চাই না তোমার শিরোপা। ঠিক সেই মূহূর্তে কি তিনিও কথা ও কাহিনীর একটি আখ্যানের চরিত্র হয়ে উঠছেন না? এই অনড় অটলভাব ব্যক্ত হয়েছে নকলগড় ও পণরক্ষা কবিতায়। নকলগড়ে কর্তব্য এবং সম্মানের জন্য মৃত্যুবরণ করল কুম্ভ এবং পণরক্ষায় দুর্গেশ দুমরাজ। এই আখ্যানবস্তুর নির্বাচন আমাদের রৈবিক বিশ্বাসের কাছে নিয়ে যায়। আর ঠিক এখানেই পূর্বসূরীদের থেকে তিনি আলাদা হয়ে যাচ্ছেন। রঙ্গলাল, মাইকেল, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্রের ক্ষেত্রে তাঁদের নির্বাচিত আখ্যানভাগ বাইরের জিনিস, রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে তা ভেতরের জিনিস। কাহিনী শুধুই কাহিনী হয়ে থাকে নি, তা একটি জীবনবোধে পরিণত হয়েছে।

কথা ও কাহিনীর অন্যান্য কবিতা যেমন শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা, অভিসার, স্পর্শমণি, প্রতিনিধি, মূল্যপ্রাপ্তি প্রভৃতি কবিতায় রবীন্দ্রনাথ তুলে ধরতে চেয়েছেন মনুষ্যত্বের কথা, ক্ষমা, দান, দয়া, করুণার আদর্শ। তিনি ক্ষমতাজাত ব্যক্তিগত দম্ভকে তীব্রভাবে কশাঘাত করেছেন। এছাড়াও প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতের বিভিন্ন কাহিনীকে পরপর সাজিয়ে একটা রবীন্দ্রনাথ ‘জাতীয় ফ্যাব্রিক’ তৈরি করতে চেয়েছেন, যা সেই সময়ে অতিগুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। যা তাঁর আগে কেউ সেভাবে করার কথা ভাবেন নি।

কিন্তু আবার হোরিখেলা কবিতাতেও জয়ী-পরাজিত অক্ষ থাকলেও এখানে পরাজিত ভূনাগ রাজার রানী জয়ী কেঁসর খাঁকে ছলে ও কৌশলে হত্যা করল। রবীন্দ্রনাথের কেন বেছেছিলেন এই কবিতাটি? এই প্রতিশোধের গল্পটিকে কবিতায় রূপদান করেছিলেন মানে, তিনি সমর্থন করেছিলেন রানির এই পদক্ষেপ?

কথা ও কাহিনীতে রবীন্দ্রনাথ দুটি কবিতা লিখেছেন, যা পাঠককে তাঁর দৃষ্টিকোণের ব্যাপারে একটু বিভ্রান্ত করতে পারে। একটি কবিতা— স্বামীলাভ। এই কবিতায় তুলসীদাস এক মহিলা— যিনি স্বামীর সঙ্গে এক চিতায় সতী হবার জন্যে এসেছিলেন— তাঁকে বুঝিয়ে সতী হওয়া থেকে নিরস্ত করেন এবং কিছুদিন পরে সেই নারী তাঁকে বলেন যে তিনি তাঁর স্বামীকে পেয়েছেন তাঁর অন্তরে।
অন্য কবিতাটির নাম, বিবাহ। কবিতাটিতে মেত্রী রাজকুমারের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে একটি মেয়ের। বিয়ের মঞ্চে ডাক এল, যুদ্ধে যেতে হবে। মেত্রী-রাজকুমার কন্যার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল যুদ্ধ ক্ষেত্রে। বিয়ে সম্পূর্ণ হল না। কন্যা কী করল? সে পিতা-মাতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মেত্রী দুর্গে চলে গেল। সেখানে গিয়ে দেখতে পেল চিতার ওপর শোয়ানো রয়েছে রাজকুমারের মৃতদেহ। কন্যা তখন সেই চিতায় চড়ে বসল। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। কন্যার ওটাই বিবাহ। অর্থাৎ সতী হল কন্যা। এই দুটি কবিতায় বিপরীত রবীন্দ্রনাথের দুটি মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। একটায় সতী হওয়ার বিপক্ষে থাকছেন, অন্যটায় সতীকে মহিমান্বিত করছেন। মনের গভীরে মধ্যযুগের রাজপুতানার সতীদাহ বা জহরব্রতকে কি তবে তিনি সম্মান করতেন?

(৩) কথা ও কাহিনীর একটি বিরাট গুণ হল এর ছন্দের বৈচিত্র্য। যেহেতু আখ্যানকাব্যগুলি হেমচন্দ্র ও নবীনচন্দ্রের তুলনায় অপেক্ষাকৃত অনেক ছোট, তাই বিভিন্ন আখ্যানে ছন্দ নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন তিনি। বন্দী বীরের সঙ্গে অভিসারের তুলনা, বা শ্রেষ্ঠ ভিক্ষার সঙ্গে নকল গড়ের তুলনা করলেই বোঝা যাবে সেকথা। বাংলার আখ্যান কাব্যে ছন্দের এমন অসাধারণ নৃত্য প্রায় অভূতপূর্ব। এই কবিতাগুলোর ভেতর দিয়ে রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ ‘ওয়ার্কম্যানশিপ’টা বেরিয়ে আসে। ‘পঞ্চনদী তীরে/ বেণী পাকাইয়া শিরে/ দেখিতে দেখিতে গুরুর মন্ত্রে/জাগিয়া উঠিল শিখ—/ নির্মম নির্ভীক’ বা ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য/ চিত্ত ভাবনাহীন’ বা ‘নগরীর দীপ নিভেছে পবনে/ দুয়াররুদ্ধ পৌর ভবনে/ নিশীথের তারা শ্রাবণ গগনে/ ঘন মেঘে অবলুপ্ত’ বা ‘একা কুম্ভ রক্ষা করে/ নকল বুঁদির গড়’ প্রভৃতি পংক্তি আমাদের আমাদের মজ্জায় ঢুকে গেছে। একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করেছি— এইসব পংক্তির এমনই ইন্দ্রজাল যে এক দুবার শুনলেই বুকের ভেতর বসে যায়। এইখানেই বোধহয় কবির সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। এই কবিতাগুলোয় আখ্যান যতটা থাকল, কাব্য ততটাই থাকল।

(৪) আর একটা কথা রবীন্দ্রনাথ হয়তো বুঝেছিলেন যে— টড, অ্যাকওয়ার্থ, অবদানশতক, মহাবস্ত্ববদান, দিব্যাবদানমালা, ভক্তমাল বাঙালি পড়ে দেখবে না কোনোদিন। তাই সেখান থেকে গল্প সংগ্রহ করে তিনি কবিতার মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং বলাবাহুল্য তা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রবাহিত হতে থেকেছে বাংলার হৃদয়ে।

আমরা অনেকেই ছোটবেলায় কথা ও কাহিনীর কবিতা পড়ে বড় হয়েছি। ভাষা ও ছন্দশিক্ষার ক্ষেত্রে এটি বাংলা কবিতার এমন একটি সোপান যা অতিক্রম না করলে বাংলা কবিতায় দীক্ষিত হওয়া প্রায় অসম্ভব। কথা ও কাহিনী বাঙালি আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরেও পড়বে কি না সে কথা ভবিষ্যতের জন্যে মুলতুবি থাক। আমরা শুধু বলতে পারি, আজকের এই ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে—

‘সে মন্দিরে দেব নাই,’ কহে সাধু।
রাজা কহে রোষে,
‘দেব নাই! হে সন্ন্যাসী, নাস্তিকের মতো কথা কহ।
রত্নসিংহাসন ’পরে দীপিতেছে রতন-বিগ্রহ—
শূন্য তাহা?’
‘শূন্য নয়, রাজদম্ভে পূর্ণ,’ সাধু কহে . . .

এই পংক্তিসকল আজও তীব্রভাবে সত্য। এ যদি কবিতা না হয়, তাহলে কবিতা কী?

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes