
একটি রবীন্দ্র-কবিতা ও আমরা
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার
"এই কবিতায় এসে রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ একাকার হয়ে যান। এই কবিতা আমাদের আত্মোপলব্ধির দিকে নিয়ে যায়। ধর্ম,জাতি, স্ত্রী-পুরুষ, দেশের গন্ডি খুলে তাকে মানুষের পরিচয়ের দিকে নিয়ে যায়, মানুষকে তার আমির দিকে নিয়ে যায়। এই কবিতাই গোরার উপলব্ধি, নিখিলেশের জোর। এক 'আমি'র সঙ্গে লক্ষ 'আমি' যখন জুড়ে যায়, তখন আর পাশের মানুষকে বিজাতীয় বলে মনে হয় না।নিজেকে শ্রেষ্ঠ আর অন্যকে নীচু বলে মনে হবে না। তখন একটা আত্মীয়তা তৈরি হয়। এই আত্মীয়তা তৈরি হওয়াটা এখনো নষ্ট হয়ে যায়নি বলেই এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা নিঃস্বার্থভাবে আপাত অনাত্মীয় মানুষগুলোকে বাঁচাতে এই অতিমারীর সময় নিজেদের জীবন বিপন্ন করে ছুটে বেড়াচ্ছে।" রবিপক্ষ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতা নিয়ে লিখলেন শ্যামশ্রী রায় কর্মকার।
কবিতা নিয়ে লিখব ভাবতে ভাবতে যে কবিতায় এসে দাঁড়ালাম, সেটি মানুষের বহুপঠিত, বহু আলোচিত। তবুও এই সময়ে এসে অন্য কোনো কবিতায় স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারলাম না। কবিতাকে যখন দশকের কবিতায় ভেঙে একটা গোত্রভাগ করে ফেলা হয়েছে, তখন এই কবিতা সমস্ত গোত্রের বেড়া ভেঙে ফেলে এই সময়ে এসে দাঁড়াল। কোন স্বতন্ত্র প্রক্ষেপ নয়, আবহমানের স্বর হয়ে উঠল।
“যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে।
পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।
অজ্ঞানের অন্ধকারে আড়ালে ঢাকিছ যারে
তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান।
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।।”
[অপমান, গীতাঞ্জলি ]
বিশ শতকের গোড়ার দিকে লেখা এই কবিতাকে কি আদৌ দশকের চিহ্ন দিয়ে বাঁধা যাবে? শতকের চিহ্ন দিয়ে? বলা যেতেই পারে- এ ভাষায় কি একবিংশ কথা বলে? লেখে? তখন ভাবতে হবে,- কবিতা শুধু ভাষার খেলা নয়, চমকপ্রদ শব্দের চিৎকার নয়, ছন্দের মাধুরী নয়। এইসব ভাগ আসলে মানুষকে নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলমান, তৃণমূল-বিজেপি, ছোট জাত- বড় জাতে ভেঙ্গে ফেলার মতোই। মানুষ যেমন শুধুমাত্র এটুকুই নয়, তার চাইতে অনেক বেশি কিছু ; কবিতাও তাই।
অ্যালেন গিন্সবার্গের একটি উক্তি মনে পড়ে।
“I saw the best minds of my generation destroyed by madness.”
একবিংশের এই সময়ে একটা গোটা দেশ নির্বাচন নামক একটি madness এর চাকার তলায় কিভাবে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরতে বসেছে, একচক্ষু নীতির চশমা পরা শাসকের খামখেয়ালের চাপে কীভাবে দেশের পিঠ যন্ত্রণায় বেঁকে যাচ্ছে, দেখে ভয় হয়। তখন মনে হয় অন্য কোন কবিতা নয়, রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটি জনে জনে পড়ে শোনাই।
“তোমার আসন হতে যেথায় তাদের দিলে ঠেলে
সেথায় শক্তিরে তবে নির্বাসন দিলে অবহেলে।
চরণে দলিত হয়ে ধূলায় সে যায় বয়ে-
সেই নিম্নে নেমে এসো, নহিলে নাহিরে পরিত্রাণ।
অপমানে হতে হবে আজি তোরে সবার সমান।। ”
[অপমান, গীতাঞ্জলি ]
এই কবিতায় এসে রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ একাকার হয়ে যান। এই কবিতা আমাদের আত্মোপলব্ধির দিকে নিয়ে যায়। ধর্ম,জাতি, স্ত্রী-পুরুষ, দেশের গন্ডি খুলে তাকে মানুষের পরিচয়ের দিকে নিয়ে যায়, মানুষকে তার আমির দিকে নিয়ে যায়। এই কবিতাই গোরার উপলব্ধি, নিখিলেশের জোর। এক ‘আমি’র সঙ্গে লক্ষ ‘আমি’ যখন জুড়ে যায়, তখন আর পাশের মানুষকে বিজাতীয় বলে মনে হয় না।নিজেকে শ্রেষ্ঠ আর অন্যকে নীচু বলে মনে হবে না। তখন একটা আত্মীয়তা তৈরি হয়। এই আত্মীয়তা তৈরি হওয়াটা এখনো নষ্ট হয়ে যায়নি বলেই এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা নিঃস্বার্থভাবে আপাত অনাত্মীয় মানুষগুলোকে বাঁচাতে এই অতিমারীর সময় নিজেদের জীবন বিপন্ন করে ছুটে বেড়াচ্ছে।
রবীন্দ্রোত্তর যুগ পেরিয়ে আমরা যখন আরও অনেক দূরে শঙখোত্তর যুগের দিকে যাচ্ছি, তখনও ঠিক কতজন রবীন্দ্রনাথে বাঁচেন? কে যেন একবার এক আলোচনাকালে বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথে সবই বড় বেশি সুন্দর। এই কথাটির মধ্যে শ্রদ্ধেয় অন্নদাশঙ্কর রায়ের সেই কথাটির অনুরণন ছিল,- “রবীন্দ্রসাহিত্যে devil নেই, কেননা সৃষ্টিতে devil নেই”। মানুষ যখন নিজে শ্রমের মধ্যে থাকে, দারিদ্র্য ও বঞ্চনার মধ্যে থাকে, তখন স্বাভাবিকভাবেই সে সেই জীবনের মধ্যে সৌন্দর্য আবিষ্কার করে না। যদি দূর থেকে নিজের পরিস্থিতিকে দেখার ক্ষমতা অর্জন করতে পারতো, তবে হয়তো নিজেদের পরিস্থিতির মধ্যেও কিছু সৌন্দর্য আবিষ্কার করত। সেই সৌন্দর্য পার্থিব বৈভবের নয়, সেই সৌন্দর্য আত্মিক বৈভবের। আমরা যতই প্রাচুর্যের দিকে যাই, আশ্চর্য ভাবে আমাদের পারস্পরিক বন্ধনের শেকড়গুলো আলগা হয়ে আসে। ১৯৩১ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “আমাদের দেশে যত কিছু দুর্গতি আছে, তার মূলগত কারণ হচ্ছে এই যে এখানে মানুষ মানুষের সঙ্গে মিশতে পারে না”। এই মিলনের মধ্যে দিয়ে সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে যে সৌন্দর্য সূচিত হয় তাকে আবিষ্কারের চোখ মানুষ যাতে হারিয়ে না ফেলে, অন্তত সেই কারণে রবীন্দ্রনাথকে গভীরভাবে পাঠের প্রয়োজন।
আজ বেশিরভাগ মানুষের রবীন্দ্রপাঠ পঁচিশে বৈশাখ, বাইশে শ্রাবণেই সীমিত। রবীন্দ্রনাথকে আমরা গানে যত দৈনন্দিন করে তুলেছি, অন্যান্য পাঠে তা হয়নি। হবার কথাও নয়। পাঠের মানুষ বরাবরই কম। নিবিড় পাঠকের সংখ্যা তো আরো সীমিত। সিলেবাসের দায় না থাকলে কজনই বা এখন গোরা বা রক্তকরবী পড়তে যান! তাঁদের অনেকেই নিখিলেশ, বিমলা, চারু বা সন্দীপকে চিনেছেন সত্যজিতের চোখ দিয়ে। পাঠ মানুষের হৃদয়কে প্রশস্ত করে, চিন্তাকে বিস্তৃত করে। নতুনকে যেমন পড়তে হবে আমাদের, তেমন পুরনোকেও। পুরোনোকে নস্যাৎ করে এগোতে চাইলে নতুনের পদক্ষেপ কখনোই কাঙ্ক্ষিত দৃঢ়তা অর্জন করতে পারবেনা।
যে কবিতাটা নিয়ে লিখতে শুরু করেছিলাম, তার ছন্দ, অলঙ্কার, ভাষা প্রয়োগের চাইতে অনেক বেশি হয়ে উঠেছে তার আত্মা। জীবনে যদি এই বোধ সঞ্চারিত হয়, তবেই এই কবিতার, এই কবির সার্থক উত্তরসূরী হয়ে ওঠা সম্ভব হবে।
বেশ সুন্দর ঝরঝরে একটি ভাবনা ❤️❤️❤️
ধন্যবাদ 🙏
খুব ভালো লাগল শ্যামশ্রী।
ধন্যবাদ সৌমনাদি