
ভারতীয় সিনেমায় যৌনতার ভাষ্য
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
ভারতীয় সিনেমায় যৌনতার ইতিহাস এক অর্থে ভারতের সামাজিক ইতিহাসেরই প্রতিফলন। এই ভূখণ্ডে যে সমাজ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ধর্ম, নৈতিকতা, বর্ণ ও শ্রেণির কাঠামোতে নিজেকে সংযত রেখেছিল, সেই সমাজে চলচ্চিত্র যখন প্রথম আত্মপ্রকাশ করে, তখন তার পর্দা যেন হয়ে ওঠে আকাঙ্ক্ষার, নিষেধের, ও অবদমনের সম্মিলিত আয়না। ভারতীয় সিনেমার সূচনালগ্ন থেকেই যৌনতা এখানে উপস্থিত — কখনও অদৃশ্যভাবে, কখনও সঙ্কেতে, কখনও বা খোলাখুলিভাবে দেহের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে। কিন্তু এই যৌনতা কখনওই শুধু কামনার প্রকাশ ছিল না; বরং সেটি হয়ে উঠেছিল সামাজিক নিয়ন্ত্রণ, পুরুষতন্ত্র, শ্রেণি-শোষণ এবং সংস্কৃতির আদর্শিক ভেতরকার লড়াইয়ের রূপক। এই লড়াই বলিউডের চকমক, প্যারালাল সিনেমার মাটির গন্ধ, তামিল ও মালয়লম সিনেমার বাস্তববাদ, কিংবা ভোজপুরী ও মারাঠি চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিক উত্তাপ — সর্বত্র ছড়িয়ে আছে।
যখন দাদাসাহেব ফালকে ১৯১৩ সালে রাজা হরিশচন্দ্র নির্মাণ করলেন, তখনই ভারতীয় সিনেমা নৈতিকতার দড়িতে বাঁধা এক যাত্রা শুরু করল। নারী চরিত্রের ভূমিকায় পুরুষ অভিনেতা, দেবতার রূপে পুরুষতান্ত্রিক আদর্শের পুনরুৎপাদন — সবই ছিল এক ধরনের যৌন রাজনৈতিক বিন্যাস। ঔপনিবেশিক ভারতের প্রেক্ষাপটে দেহ ছিল তখনই এক নিয়ন্ত্রিত স্থান, ব্রিটিশ শাসনের নৈতিকতার ছায়ায় যা ক্রমাগত ‘ভদ্রলোক’ সংস্কৃতির মুখোশ পরে ফেলেছিল। ফলে ভারতীয় সিনেমার প্রথম যুগে যৌনতার উপস্থিতি মূলত ছিল ‘অভিজ্ঞান’, ‘সংকেত’ এবং ‘চোখের ভাষা’-য় সীমাবদ্ধ। তবু, দেবিকারাণি ও হিমাংশু রায়ের অছুত কান্যা (১৯৩৬) বা কিষাণলাল ভান্ডারকর-এর ধূপছাঁও (১৯৩৫)-এর মতো ছবিতে দেহের টানাপোড়েন, জাত-বিভাজন ও নিষিদ্ধ প্রেমের আভাসে যৌনতার এক সামাজিক রাজনৈতিক পাঠ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
বলিউডের স্বর্ণযুগ, অর্থাৎ ১৯৫০ থেকে ১৯৭০— এই সময় যৌনতার ভাষা আরও জটিল ও দ্বৈতরূপে আবির্ভূত হয়। একদিকে রাজ কাপুরের আওয়ারা (১৯৫১) বা শ্রী ৪২০ (১৯৫৫)-তে নায়িকার দেহ সামাজিক মুক্তির প্রতীক, আবার সঙ্গম (১৯৬৪)-তে বা ববি (১৯৭৩)-তে সেটি হয়ে ওঠে মধ্যবিত্ত নৈতিকতার সঙ্কটের মঞ্চ। নন্দা, মধুবালা, নার্গিস, পরে জিনত আমান ও পারভিন ববিরা এই যৌনতার প্রতীক হয়ে ওঠেন, কিন্তু তাঁদের দেহের ভাষা কখনও তাঁদের নিজের নয় — সবসময়ই পুরুষ পরিচালক, পুরুষ ক্যামেরা, পুরুষ দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা গঠিত। লরা মুলভের ‘মেল গেজ’-এর তত্ত্ব এখানে নিখুঁতভাবে প্রযোজ্য। রাজ কাপুর যখন রাম তেরি গঙ্গা মেইলি (১৯৮৫)-তে নদীর জলে স্নানরত মন্দাকিনীকে চিত্রায়িত করেন, তখন তিনি শুধু নারীর দেহ নয়, বরং সেই দেহের উপর রাষ্ট্র, ধর্ম, এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টির আধিপত্যকেই স্থায়ী করে দেন।
একই সময় অন্য দিক থেকে আসে বিপরীত সুর। গুরদত্তের প্যায়াসা (১৯৫৭) বা কাগজ কে ফুল (১৯৫৯)-এ যৌনতা হয়ে ওঠে মানবিক নিঃসঙ্গতার এক প্রতীক, যেখানে নারীর শরীর নয়, বরং তার সমাজে টিকে থাকার মর্যাদাহীনতা মুখ্য হয়ে ওঠে। ওয়াহিদা রেহমানের গুলাব, যে এক পতিতা, সে আসলে শহরের হৃদয়হীনতার প্রতিবিম্ব; তার দেহ সমাজের অবমাননার স্মারক। বলিউডের এই দুই স্রোতের মধ্যে — একদিকে বাণিজ্যিক ভোগবাদ, অন্যদিকে কবিতার মতো সংবেদনশীল বাস্তবতা — ভারতীয় যৌনতার ভাষ্য ক্রমে দ্বিধাগ্রস্ত হতে থাকে।
সত্তরের দশকে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও শহরের বেকারত্ব যখন সমাজকে নাড়িয়ে দেয়, তখন যৌনতা সিনেমায় নতুনভাবে রাজনৈতিক হয়ে ওঠে। জঞ্জীর (১৯৭৩)-এর অমিতাভ বচ্চনের পুরুষালি ক্রোধ, ডন-এর মাফিয়া-পৌরুষ, বা দিওয়ার-এর নৈতিক সংকট — সবই যৌনতা ও ক্ষমতার জটিল সমীকরণ। এই সময় পুরুষতন্ত্রের প্রাধান্য আরও ঘন হয়; নায়িকা হয় প্রলোভনের বস্তু, নায়ক হয় ক্রোধের মূর্তি। একই সময়ে হিন্দি বি-গ্রেড সিনেমা এবং ভোজপুরী চলচ্চিত্র যৌনতাকে সম্পূর্ণ পণ্য হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। রাজা রাম, হাওয়া হাওয়াই থেকে কামসূত্র-ধারার ভিজ্যুয়াল পর্নোগ্রাফি—দেহ এখানে কেবল বিক্রির উপকরণ। দর্শকের ‘গেইজ’ হয়ে ওঠে বাজারের ‘কনজিউমার’।
তবে বলিউডের মধ্যেও বিপরীত স্রোত প্রবাহিত ছিল। শ্যাম বেনেগালের ভূমিকা (১৯৭৭) বা আঙ্কুর (১৯৭৪)-এ নারীর দেহ শুধু আকাঙ্ক্ষার স্থান নয়, বরং সামাজিক প্রতিরোধের ক্ষেত্র। স্মিতা পাটিলের মুখে, চোখে, শরীরে যে তীব্র আত্মস্বর, তা আসলে ইতিহাসে প্রথমবার ভারতীয় পর্দায় নারীকে নিজের দেহের ওপর অধিকার দেওয়া শুরু করে। একই সময়ে মৃণাল সেনের ভুবন সোম (১৯৬৯)-এ সুহাসিনী মুলে-র চরিত্রের ভেতরে যে চঞ্চলতা, তা যৌনতার নিষ্পাপ মানবিক দিকটিকে ফিরিয়ে আনে। যৌনতা এখানে আর কাম নয়, বরং মানব সম্পর্কের জটিলতার এক রাজনৈতিক পাঠ।
অষ্টাদশ শতাব্দীর সাহিত্যের মতোই বলিউডের পরবর্তী দশক, বিশেষ করে নব্বই ও দু-হাজার দশক, যৌনতাকে গ্লোবাল পুঁজিবাদের পণ্য হিসেবে পুনরুদ্ধার করে। মোহরা (১৯৯৪)-এর “তিপ তিপ বরসা পানি” থেকে জিসম (২০০৩)-এর বিকিনি-নির্ভর ফ্রেম, কিংবা কবির সিং (২০১৯)-এর নারীবিদ্বেষী আবেগ—সবই দেহের বিক্রয়যোগ্যতার উদযাপন। বিজ্ঞাপন, গান, সিনেমা—সব জায়গায় নারী দেহ এক বিনিময়যোগ্য প্রতীক হয়ে ওঠে। পুরুষ দেহের যৌনতা, বিপরীতে, ধীরে ধীরে একধরনের আধিপত্যের প্রতীক রূপে গড়ে ওঠে। দোস্তানা (২০০৮) বা কপূর অ্যান্ড সন্স (২০১৬)-এর মতো চলচ্চিত্র সমকামিতাকে গ্ল্যামারাইজ করলেও, সেটি প্রায়শই বাস্তব সংগ্রামের বদলে বাজারযোগ্য ‘কুলনেস’-এর জায়গায় অবস্থান নেয়।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু চলচ্চিত্র যৌনতার এই পণ্যায়িত ভাষার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। অনুরাগ কাশ্যপের দেব.ডি (২০০৯)-এ পারোর দেহ বা চন্দার আত্মনির্ভরতা যৌনতার পুরোনো ব্যাখ্যাকে ভেঙে দেয়। দীপা মেহতার ফায়ার, আর্থ, ওয়াটার ত্রয়ীতে যৌনতা হয়ে ওঠে প্রতিবাদের রাজনীতি — নারী শরীরকে দমন নয়, মুক্তির পথ হিসেবে দেখানো হয়। এই সময়ের সিনেমায় দেহ আর নিষিদ্ধ নয়, বরং অভিজ্ঞতার এক উপকরণ। লিপস্টিক আন্ডার মাই বুরখা (২০১৭)-এর আরাধনা বা রেহানা জিতেনের মতো চরিত্ররা প্রমাণ করে, ভারতীয় সিনেমার পর্দায় এখন যৌনতা মানেই প্রতিরোধ, আত্মদাবি ও সামাজিক পরিবর্তনের দাবি।
বলিউডের যৌনতার এই ইতিহাস তাই কেবল রোম্যান্স বা দেহের গ্ল্যামার নয়; বরং এটি ভারতের সমাজ, ধর্ম, অর্থনীতি, এবং রাজনীতির ভেতরকার নীরব এক যুদ্ধ। যৌনতা এখানে একইসঙ্গে পাপ ও পূণ্য, লজ্জা ও গর্ব, দমন ও মুক্তি। আর এই দ্বন্দ্বই ভারতীয় চলচ্চিত্রকে আজও এত গভীর ও বহুমাত্রিক করে রাখে।
ভারতীয় প্যারালাল সিনেমা এক অর্থে যৌনতা, রাজনীতি ও সমাজচিন্তার জটিল সংমিশ্রণ। ষাটের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত এই ধারার সিনেমা ভারতীয় চলচ্চিত্রভাষাকে পাল্টে দিয়েছিল, কারণ তারা যৌনতাকে আর শুধুই রোম্যান্টিক বা নান্দনিক উপাদান হিসেবে দেখেনি, বরং একে দেখেছিল দেহরাজনীতির অভ্যন্তরে, যেখানে কামনা, বঞ্চনা, শ্রম, শ্রেণি ও নারী-পুরুষের ক্ষমতার সম্পর্ক একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। প্যারালাল সিনেমা জন্মেছিল নৈতিক ও নান্দনিক উভয় প্রতিবাদের জায়গা থেকে—একদিকে বলিউডের গ্ল্যামার-নির্ভর পণ্যায়নের বিরুদ্ধে, অন্যদিকে রাষ্ট্র ও সমাজের দমনমূলক কাঠামোর বিরুদ্ধে। এই ধারার পরিচালকরা—মৃণাল সেন, শ্যাম বেনেগাল, গোবিন্দ নিহালনি, মণি কৌল, গৌতম ঘোষ—যৌনতাকে এমনভাবে ব্যবহার করেছেন যা ভারতীয় সিনেমায় আগে দেখা যায়নি; এখানে যৌনতা আর প্রলোভন নয়, বরং সামাজিক অস্তিত্বের উপমা, রাজনৈতিক প্রতীক এবং মানবিক সঙ্কটের ভাষা।
মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রে যৌনতা প্রায়ই উপস্থিত থাকে শ্রেণি ও রাজনীতির প্রেক্ষাপটে, যেখানে সম্পর্ক ও আকাঙ্ক্ষা সমাজের প্রতিফলন। ভুবন সোম (১৯৬৯)-এর গল্পটি দেখলে বোঝা যায় কীভাবে এক প্রশাসনিক আধিকারিক, নিজের নিঃসঙ্গ জীবনে, এক তরুণী গ্রামীণ নারীর সঙ্গে পরিচয়ে নিজের দেহ, মানস ও নৈতিকতার নতুন উপলব্ধি পায়। সুহাসিনী মুলে অভিনীত গৌরী চরিত্রটি কামনার বিষয় নয়, বরং সেই ‘অন্য’ যা শহুরে পুরুষের আত্মাভিমানকে ভেঙে দেয়। সেন যৌনতাকে কখনও নগ্নরূপে দেখান না, কিন্তু তাঁর চলচ্চিত্রে মানুষের মধ্যে যে আকর্ষণ, দূরত্ব ও অসম্পূর্ণতা, সেটিই রাজনৈতিক। কালো সোমবার, একদিন প্রতিদিন, আকালের সন্ধানে—এসব ছবিতে দেহ ও দৈনন্দিন জীবনের সংঘর্ষে যে কামনা, তা সামাজিক সংকটেরই প্রতিফলন।
শ্যাম বেনেগালের আঙ্কুর (১৯৭৪) ভারতে যৌনতা ও শ্রেণির সম্পর্ক নিয়ে সম্ভবত প্রথম সচেতন রাজনৈতিক ভাষ্য। লক্ষ্মী (শবানা আজমি) একজন দাসী, জমিদারের ছেলে সুর্যের (অনন্ত নাগ) সঙ্গে তাঁর দেহিক সম্পর্ক ক্ষমতার সম্পর্কেরই প্রতিফলন। এই যৌনতা সমান দুই মানুষের নয়, বরং একতরফা সামাজিক শোষণের রূপ। লক্ষ্মীর গর্ভধারণ এখানে প্রতিবাদের প্রতীক—সে নিজের দেহের উপর নিজের অধিকার ঘোষণা করে, এমন এক সমাজে যেখানে নারী দেহ পুরুষ ও প্রভুত্বের মধ্যে ভাগ হয়ে আছে। নিশান্ত (১৯৭৫)-এ যৌনতা সরাসরি হিংসার রূপ নেয়; জমিদারবাড়ির পুরুষরা যে নারী শরীরকে ভোগ করে, সেখানে কামনা নয়, আছে নিপীড়ন ও ক্ষমতার তৃষ্ণা। কিন্তু বেনেগালের কৌশল ছিল এই দেহরাজনীতিকে মানবিক বাস্তবতার ভেতর থেকে দেখানো—তিনি কখনও যৌনতাকে সেনসেশনাল করে তোলেননি, বরং সমাজের প্রতিচ্ছবি হিসেবে ধরেছেন।
গোবিন্দ নিহালনির আর্ধ সত্য (১৯৮৩) পুরুষ দেহের রাজনীতি নিয়ে এক গভীর অনুসন্ধান। ওম পুরি অভিনীত সুভাষ নাগারকরের দেহে যৌনতা প্রকাশ পায় ক্রোধ, অপমান ও কর্তৃত্বের মাধ্যমে। সে পুলিশ অফিসার, তার দেহই রাষ্ট্রের প্রতীক, কিন্তু একই সঙ্গে সেই দেহ ক্লান্ত, অবদমিত ও আত্মবিধ্বস্ত। তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক, সহকর্মীদের সঙ্গে সংঘাত, অপরাধীদের সঙ্গে সহিংসতা—সবই যৌনতার এক নতুন পাঠ তৈরি করে যেখানে কামনা মানে ক্ষমতা, আর দেহ মানে প্রতিরোধ। নিহালনি এখানে পৌরুষের সংকটকে উন্মোচন করেন, যা ভারতীয় সিনেমায় যৌনতার নারীবাদী দৃষ্টিকোণের বিপরীতে এক ভিন্ন স্তর যোগ করে। পার (১৯৮৪)-এ নাসিরুদ্দিন শাহ ও শাবানা আজমির দেহের মিলন মানে শুধু প্রেম নয়, সামাজিক ভ্রাতৃত্ব, অভিবাসী শ্রমিকের অসহায়তার ভাষা।
মণি কৌলের সিনেমায় যৌনতা একেবারেই বিমূর্ত, দার্শনিক এবং নন্দনীয় অর্থে অনির্দিষ্ট। তাঁর দুvidha (১৯৭৩)-তে নববধূ ও ভূতের সম্পর্ক আসলে কামনা ও নিষেধের উপকথা। নববধূ এক ভূতের প্রেমে পড়ে, যে তার স্বামীর রূপ ধারণ করে। এখানে যৌনতা সরাসরি নয়, বরং সময়, অভাব ও আকাঙ্ক্ষার দ্বন্দ্ব। মণি কৌলের দৃষ্টি আধুনিকতাবাদী; তিনি দেহকে উপস্থাপন করেন এক সাংস্কৃতিক প্রতীকের মতো—যেখানে নারী যৌনতায় নয়, আত্মসন্ধানে যুক্ত। নযান্তর (১৯৮৫)-এ রোহিণী হাতঙ্গাডের চরিত্রে দেখা যায়, এক শহুরে নারীর দেহকামনা ও শিল্পসৃষ্টির তৃষ্ণা একই সঙ্গে চলমান; এই মিলনই কৌলের চলচ্চিত্রভাষার সৌন্দর্য।
গৌতম ঘোষ যৌনতাকে প্রকৃতি ও ইতিহাসের সঙ্গে মিলিয়ে দেন। পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৯৩)-তে কুবের ও কপিলার সম্পর্ক নদীর স্রোতের মতোই—অসংযত, মৌলিক ও বিধ্বস্ত। এখানে দেহের মিলনই জীবনের প্রতিরোধ। গৌতম ঘোষের ক্যামেরা দেহকে কখনও নগ্নভাবে নয়, বরং আলোকছায়া, জলের প্রতিফলন ও সংগীতের মিশেলে তুলে ধরে। তাঁর অন্তর্জলি যাত্রা (১৯৮৭)-তে মৃত্যুর প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা ব্রাহ্মণের দেহও একধরনের যৌন প্রতীক—মৃত্যু ও কাম একে অপরের প্রতিবিম্ব।
এই পরিচালকদের কাজের মধ্যে একটি সাধারণ সুত্র রয়েছে—তাঁরা যৌনতাকে কখনও নৈতিকতার প্রশ্নে দেখেননি; বরং সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, শ্রেণি ও সংস্কৃতির ভেতরকার অস্থিরতা হিসেবে দেখেছেন। তাঁদের চলচ্চিত্রে নারী ও পুরুষ উভয়ের দেহ একধরনের ‘টেক্সট’, যা পাঠ করা যায় ইতিহাসের দিক থেকে। যখন শ্যাম বেনেগাল ভূমিকা (১৯৭৭)-এ স্মিতা পাটিলকে এক অভিনেত্রীর ভূমিকায় দেখান, তখন তিনি শুধু একজন শিল্পীর দেহই নয়, তার স্বাধীনতার দাবি তুলে ধরেন। মৃণাল সেন মহাপৃথিবী বা একদিন প্রতিদিন–এ দেখান কীভাবে যৌনতা শহরের ভেতরে ক্রমশ নিঃসঙ্গ ও রাজনৈতিক হয়ে উঠছে।
প্যারালাল সিনেমার যৌনতা তাই প্রতিরোধের ভাষা। এটি ভোগবাদী বাজারের বিপরীতে দাঁড়ায়, এটি রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার মুখে প্রশ্ন তোলে, এটি নারীকে ভোগের বস্তু নয়, বরং সৃষ্টিশীল সত্তা হিসেবে পুনরুদ্ধার করে। এই চলচ্চিত্রগুলিতে যৌনতা মানে ‘অশ্লীলতা’ নয়, বরং আত্মসমালোচনার উপকরণ। বলিউড যেখানে শরীর বিক্রি করে, সেখানে প্যারালাল সিনেমা শরীরকে ব্যাখ্যা করে।
ভারতীয় আঞ্চলিক সিনেমা বরাবরই সমাজের গভীর বাস্তবতার কাছাকাছি থেকেছে। যেখানে বলিউডের দৃষ্টিভঙ্গি প্রায়শই মহানগরী মধ্যবিত্তের নৈতিকতা আর বাজারকেন্দ্রিক দেহচেতনায় সীমাবদ্ধ, সেখানে আঞ্চলিক ভাষার সিনেমাগুলি গ্রামীণ সমাজ, শ্রেণি, ধর্ম ও জাতের মধ্যে যৌনতার বাস্তব রাজনীতি অন্বেষণ করেছে। দক্ষিণ ভারতের সিনেমা থেকে শুরু করে উত্তর-পূর্বের স্বাধীন চলচ্চিত্র, প্রত্যেক অঞ্চলের শিল্পীরা যৌনতা ও দেহকে দেখেছেন অভিজ্ঞতার জায়গা থেকে, যেখানে শরীর মানে শুধু কামনা নয়, বরং ইতিহাস, পরিচয়, বঞ্চনা ও প্রতিরোধের স্থান।
মালয়লম সিনেমা এই প্রক্রিয়ার অন্যতম গভীর ধারক। ঊনবিংশ শতকের সাহিত্যিক পরম্পরা থেকে আসা মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি—থাকাজি শিবশংকর পিল্লাই বা ও. ভি. বিজয়ন-এর মতো লেখকদের বাস্তবতাবাদ—মালয়লম চলচ্চিত্রে যৌনতার দৃষ্টিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। আদুর গোপালকৃষ্ণণের এলিপ্পাথায়াম (১৯৮১) বা মুক্কুর্থি (১৯৮২)-তে যৌনতা কোনও দৃশ্যমান প্রেম নয়, বরং অস্তিত্বের ক্লান্তি। তাঁর ছবির নারী চরিত্ররা প্রায়শই ঘরের ভিতরে বন্দি, কিন্তু তাঁদের শরীরের ভাষায় ফুটে ওঠে যে নীরব প্রতিরোধ, সেটাই মালয়লম সিনেমার অন্তর্নিহিত যৌন রাজনীতি। গিরীশ কাসারাভল্লির তাবারনামা এবং শাজি এন. করুণের পিরাভি দেহ ও মৃত্যুর সম্পর্ককে এমন সূক্ষ্মতায় ধরেছে যে সেখানে যৌনতা আর শারীরিক নয়—অস্তিত্বের, সন্তানের জন্মের, বা মাতৃত্বের এক অন্তর্নিহিত মিথ।
পরবর্তী প্রজন্মে রঞ্জিথ ও লিজো জোস পেল্লিশেরি যৌনতাকে সমাজ ও ধর্মের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। রঞ্জিথের ইন্ডিয়ান রুপি বা লেজেন্ড অফ গডস অ্যান্ড মেন (২০১৩)-তে দেহ মানে আর নিষিদ্ধ আকাঙ্ক্ষা নয়, বরং ধর্মীয় নৈতিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মানবজীবনের উদ্দামতা। পেল্লিশেরির আঙ্গামালি ডায়েরিজ (২০১৭) বা জাল্লিকাট্টু (২০১৯)-তে যৌনতা মিশে আছে পুরুষালি প্রতিযোগিতার ভেতর—একটা গরুর পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে যে পৌরুষের উন্মত্ততা তৈরি হয়, সেখানে কামনা ও হিংসা একে অপরের প্রতিরূপ। পেল্লিশেরির ক্যামেরা দেহের ঘ্রাণ, ঘাম, রক্ত, চামড়া—এইসবকেই রাজনৈতিক করে তোলে; তিনি ভারতীয় যৌনতাকে প্রথমবার প্রকৃতির মধ্যে ফিরিয়ে আনেন, যেখানে মানুষ পশুর সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যায়।
তামিল সিনেমা বরাবরই সমাজের বর্ণভিত্তিক বৈষম্য ও যৌনতার নিষেধ নিয়ে কাজ করেছে। পেরুমল মুরুগনের সাহিত্য যেমন জাত, যৌনতা ও ধর্মীয় ভয়ের মধ্যে লুকোনো নিষিদ্ধ প্রেমকে প্রকাশ করে, তেমনি লীনা মণিমেকালাই, পা. রঞ্জিথ, বালা বা ভেত্রি মারনের সিনেমাগুলিও যৌনতাকে রাজনীতির অঙ্গ করে তোলে। বালার সেথু (১৯৯৯) বা নান কাদাভুল (২০০৯)-এ নারী দেহ ভিক্ষুক সমাজের মধ্যেও এক প্রতিরোধের রূপ নেয়। পা. রঞ্জিথের কাবালি (২০১৬) বা সারপাতা পরাম্বরাই (২০২১)-এ যৌনতা আর প্রেম নয়, আত্মসম্মান; সেখানে নারী দেহ আর অধীন নয়, বরং বর্ণ ও শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামী সঙ্গী। লীনা মণিমেকালাইয়ের সিনামা বন্দর (২০১৫)-এ বা তাঁর ডকুমেন্টারি কাজগুলিতে যৌনতা প্রকাশ পায় উন্মুক্ত, নারীবাদী এবং প্রান্তিক কণ্ঠস্বরের দিক থেকে—যেখানে নারী, দলিত ও কুইয়ার মানুষদের শরীর একসঙ্গে সামাজিক প্রতিরোধের মঞ্চে আসে।
মারাঠি সিনেমায় যৌনতাকে দেখা গেছে সমাজের নৈতিকতার মুখোমুখি দাঁড়ানো এক বাস্তব মানবীয় অভিজ্ঞতা হিসেবে। রবি জাধবের নাটসম্রাট (২০১৬) বা বালগন্ধর্ব (২০১১)-এর মতো ছবিতে যৌনতা মঞ্চ ও জীবনের দ্বন্দ্বের জায়গা থেকে আসে—অভিনয় ও বাস্তবের সীমানা মুছে দেয়। কিন্তু তাঁর বালাক পালক (২০১৩)-এ শিশুর যৌনতা নিয়ে যে নির্ভীক আলোচনা, তা ভারতীয় সিনেমায় বিরল। এখানে যৌনতা কোনও ‘স্ক্যান্ডাল’ নয়, বরং বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার অংশ। সুরেশ দেশপান্ডের কোকানস্তি বা নন্দিতা দাসের ফির মিলেঙ্গে যৌনতাকে মানবিক ও নৈতিক প্রশ্নে ফেরত আনে—প্রেম, রোগ, মৃত্যুর ভেতর দেহের মর্যাদা খুঁজে পায়।
উত্তর-পূর্ব ভারতের সিনেমায় যৌনতা প্রায়শই রাজনৈতিক পরিচয়ের সঙ্গে যুক্ত। মণিপুরের পরিচালক হায়নু শর্মা, অসমের রিমা দাস, মেঘালয়ের প্রজ্ঞা তামাং বা অরিবাম শ্যাম শর্মা—তাঁদের ছবিতে যৌনতা মানে প্রকৃতির ভেতর মানুষের একাকিত্ব। রিমা দাসের ভিলেজ রকস্টারস (২০১৭)-এ বা বুলবুল ক্যান সিং (২০১৮)-তে যৌনতা আসলে ‘হওয়া’র প্রক্রিয়া, এক কিশোরীর নিজের দেহকে চিনে নেওয়ার যাত্রা। এখানে দেহ সমাজের প্রতিরোধ নয়, বরং প্রকৃতির অংশ। উত্তর-পূর্বের সিনেমাগুলি যৌনতাকে পুরুষতন্ত্র বা ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং শরীর ও ভূগোলের সম্পর্কের দিক থেকে দেখে—মানুষ, মাটি ও জল একত্রে এক যৌন অনুভূতির উৎস হয়ে ওঠে।
এই আঞ্চলিক ভাষার সিনেমাগুলির মধ্যে একটা গভীর সাদৃশ্য আছে—তারা সবাই যৌনতাকে স্থানীয় অভিজ্ঞতা থেকে বোঝে। বলিউড যেখানে যৌনতাকে গ্লোবাল বাজারে প্যাকেজ করে দেয়, সেখানে মালয়লম, তামিল, মারাঠি বা আসামিয়া সিনেমা সেটিকে স্থানীয় সময়, স্থান ও মানুষের জীবনের সঙ্গে জুড়ে দেয়। এখানে যৌনতা মানে নিষিদ্ধ নয়; বরং মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এদের সিনেমায় দেহ যেমন শ্রম করে, তেমনি ভালোবাসে; কামনা যেমন বিদ্রোহ করে, তেমনি মুক্তিও দেয়।
ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে নারী পরিচালকদের উপস্থিতি শুধু দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটায়নি, বরং যৌনতার ভাষাকেও নতুন অর্থ দিয়েছে। যেখানে পুরুষ পরিচালকদের চোখে যৌনতা প্রায়শই আকর্ষণ বা সংকোচের স্থান, সেখানে নারী পরিচালকদের ছবিতে যৌনতা হয়ে ওঠে এক রাজনৈতিক আত্মপ্রত্যয়—নিজেকে পুনর্দখল করার, নিজের দেহের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার ভাষা। ভারতীয় সিনেমায় নারীর শরীর দীর্ঘদিন ধরে পণ্যায়নের মধ্য দিয়ে উপস্থিত হয়েছে; কিন্তু এই পরিচালিকারা সেই শরীরকে ফেরত দিয়েছেন তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা, লজ্জা, আনন্দ, বেদনা ও ক্রোধের স্বর।
দীপা মেহতা তাঁর তথাকথিত ‘এলিমেন্টস ট্রিলজি’ — ফায়ার (১৯৯৬), আর্থ (১৯৯৮) এবং ওয়াটার (২০০৫) — এর মাধ্যমে ভারতীয় যৌনতার আধুনিক আত্মপরিচয়কে সবচেয়ে সাহসিকতার সঙ্গে প্রকাশ করেন। ফায়ার-এর রাধা ও সীতা কেবল দাম্পত্যের শূন্যতায় বন্দি দুই নারী নয়, তাঁরা সেই সমাজের প্রতীক যেখানে নারীর শরীরকে পুরুষসুখের উপকরণ হিসেবে দেখা হয়। তাঁদের সম্পর্কের মধ্যে যে শারীরিক সান্নিধ্য গড়ে ওঠে, সেটি কোনও ‘বিকৃতি’ নয়, বরং অভাব থেকে জন্ম নেওয়া মানবিক প্রেম। এই ছবিতে যৌনতা কোনো শরীরী উন্মাদনা নয়, বরং এক মানবিক চাহিদার প্রকাশ—একটি নীরব বিপ্লব। মেহতা এখানে সমাজের নৈতিক দমননীতি, ধর্মীয় পুরুষতন্ত্র ও দাম্পত্যের নিস্পৃহতা—সবকিছুর বিরুদ্ধে নারীর ভালোবাসাকে রাজনৈতিক করে তোলেন।
আর্থ ছবিতে তিনি যৌনতাকে নিয়ে আসেন অবিশ্বাস, বিশ্বাসঘাতকতা ও আত্মসম্মানের দিক থেকে। শাবানা আজমির চরিত্রটি যখন জানতে পারে তার স্বামী অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে, তখন সে যে মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা ভোগ করে, তা শুধুই ব্যক্তিগত নয়; এটি ভারতীয় নারীর এক সামষ্টিক অভিজ্ঞতা। মেহতা এখানে দেখান যে যৌনতা মানে কেবল শরীরের মিলন নয়—এটি বিশ্বাস, আস্থা ও আত্মসম্মানের জটিল জাল। ওয়াটার-এ গিয়ে যৌনতার ভাষা আরও প্রতীকী হয়—বিধবার দেহকে ধর্মীয় শুদ্ধতার নামে কীভাবে নিষিদ্ধ করা হয়, সেই সমাজের নোংরামি এখানে নগ্ন হয়ে ওঠে।
মীরা নায়ার ভারতীয় যৌনতার আন্তর্জাতিক মুখ তুলে ধরেছেন। মনসুন ওয়েডিং (২০০১)-এ বিয়ের অনুষ্ঠান, সম্পর্ক, অর্থনীতি ও যৌনতার মধ্যেকার সংযোগকে তিনি এমন সূক্ষ্মতায় দেখিয়েছেন যা ভারতীয় সমাজের প্রতিটি পরিবারে লুকিয়ে আছে। এখানে যৌনতা আনন্দের উৎসও, আবার আঘাতের স্মৃতিও—বিয়ের আনন্দের আড়ালে শিশুকামনার ভয়ঙ্কর স্মৃতি ফেটে পড়ে। নায়ারের কামসূত্র: আ টেল অফ লাভ (১৯৯৬) পশ্চিমে বহু বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল, কিন্তু ছবিটি যৌনতাকে এক ঐতিহ্যবাহী শিল্প হিসেবে পুনর্নির্মাণ করে। নারীদেহ এখানে লালসার নয়, শিল্পের ও আত্মজ্ঞানীর বিষয়—যেখানে কামনা মানে শেখা, জ্ঞান, প্রেম ও আত্মচেতনা।
নায়ারের দৃষ্টিভঙ্গি আরও রাজনৈতিক হয়ে ওঠে দ্য নেমসেক (২০০৬)-এ। এখানে যৌনতা মানে প্রবাসী জীবনের মধ্যেকার পরিচয়ের সংকট; পশ্চিমের মুক্ত যৌন সংস্কৃতি ও ভারতীয় সামাজিক কাঠামোর সংঘর্ষ। আশিমা ও গোগলের সম্পর্কের মধ্যে যৌনতার উপস্থিতি কখনও স্পষ্ট, কখনও সাংকেতিক; কিন্তু সবসময়ই তা আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধানের অংশ।
বাংলা চলচ্চিত্রের তরুণ পরিচালক অনন্যা চট্টোপাধ্যায় এই ধারাকে নতুন করে ধরেছেন হলি বাসি ও কালী কাহিনির মতো স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রে। তাঁর ছবিতে যৌনতা এক ‘বলার অধিকার’-এর রূপ নেয়। যেখানে নারী নিজের শরীরের স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, ও ভয়ের কথা বলতে শেখে, সেখানে যৌনতা হয়ে ওঠে আত্মজীবনী। অনন্যার ক্যামেরা কখনও নারীর দেহকে দূর থেকে নয়, বরং ভিতর থেকে দেখে—যেন নারীর চোখ দিয়ে নারী নিজেকে অবলোকন করছে।
লীনা মণিমেকালাই তামিল সিনেমায় যৌনতাকে সরাসরি রাজনৈতিক অস্ত্রে রূপান্তরিত করেছেন। তাঁর ডকুমেন্টারি গডডেসেস, সিনামা বন্দার বা মধুরাই রেড—সব জায়গাতেই যৌনতা মানে প্রতিরোধ। তিনি দেখান, কুইয়ার নারী, দলিত নারী, যৌনকর্মী—এই সব দেহগুলিই সমাজের ‘অশুচি’ বলা হয়, অথচ তারাই সমাজের নৈতিক মুখোশ খুলে দেয়। তাঁর ছবিতে কামনা ও ধর্ম, দেহ ও রাজনীতি, ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রতিরোধ—সব একত্রে মিশে যায়। সিনামা বন্দার-এর সেই দৃশ্যে যেখানে নায়িকা মন্দিরে নগ্ন হয়ে প্রতিরোধ জানায়, সেটি শুধু সাহসিকতার দৃশ্য নয়, বরং দমননীতির বিরুদ্ধে শরীরের অস্ত্র হয়ে ওঠা এক চিত্ররূপক।
রিমা দাস, উত্তর-পূর্ব ভারতের চলচ্চিত্রের এক ভিন্ন মুখ, যৌনতাকে ভেতরের নীরবতায় দেখেছেন। ভিলেজ রকস্টারস বা বুলবুল ক্যান সিং-এ তাঁর চরিত্ররা যৌনতা শেখে প্রকৃতি থেকে। কিশোরী মেয়েটির জল, গাছ, বৃষ্টি—এই সবের সঙ্গে মেলবন্ধন দেহের এক স্বাভাবিক প্রকাশ। এখানে যৌনতা কোনও নিষিদ্ধ বিষয় নয়, বরং প্রকৃতির চক্রের অংশ। রিমার সিনেমা যৌনতাকে মুক্ত করে নগর সভ্যতার অপরাধবোধ থেকে, সেখানে দেহ মানে প্রকৃতির অনুরণন।
এই পরিচালিকারা যৌনতাকে যেভাবে দেখেছেন, তা একদিকে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিকে ভেঙেছে, অন্যদিকে নতুন এক সিনেমাটিক ভাষা তৈরি করেছে। তাঁদের ক্যামেরা দেহকে ‘ভোগ্য’ নয়, বরং ‘বর্ণনাকারী’ করে তোলে। তারা কেবল নারী শরীর দেখান না, বরং শরীরের অভিজ্ঞতা, আবেগ, ব্যথা, উল্লাস—সবকিছুকে রাজনৈতিক করে তোলেন।
তাঁদের ছবিগুলি প্রমাণ করে যে যৌনতা কোনও নিষিদ্ধতা নয়, বরং ক্ষমতার জায়গা। দীপা মেহতা বা মীরা নায়ারের কাছে যৌনতা মানে আত্মপ্রকাশ; লীনা মণিমেকালাইয়ের কাছে প্রতিরোধ; রিমা দাসের কাছে প্রকৃতি; আর অনন্যা চট্টোপাধ্যায়ের কাছে স্মৃতি। এই ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা একসঙ্গে ভারতীয় নারীবাদী চলচ্চিত্র-ভাষার এক নতুন মানচিত্র রচনা করেছে, যেখানে দেহ আর নীরব নয়, সে কথা বলে, প্রশ্ন করে, প্রতিবাদ করে, ভালোবাসে—নিজের শর্তে।
ভারতীয় মূলধারার সিনেমা, বিশেষত বলিউড, দীর্ঘদিন ধরে যৌনতাকে দেখেছে এক জটিল, দ্বৈত এবং প্রায়শই ভোগবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে। এখানে যৌনতা কখনও নিষিদ্ধ ফলের মতো আকর্ষণীয়, কখনও আবার নৈতিকতার ছদ্মাবরণে আড়াল করা এক দেহভাষা। ব্রিটিশ উপনিবেশ-উত্তর ভারতের সমাজে যখন যৌনতা ছিল পর্দার আড়ালে, তখনই সিনেমা হয়ে উঠেছিল তার সবচেয়ে বড় আড়াল এবং প্রকাশ—একসঙ্গে। ১৯৫০-এর দশকের রোমান্টিক সিনেমাগুলি—রাজ কাপুরের আওয়ারা, শ্রী ৪২০, বা সঙ্গম—সবই যৌনতার আভাসে পরিপূর্ণ, কিন্তু সরাসরি বলার সাহস রাখেনি। নারীর দেহ এখানে প্রেমের প্রতীক, কিন্তু তার আকাঙ্ক্ষা সবসময় পুরুষের দৃষ্টিতে বন্দি। আওয়ারার নায়িকা যখন বৃষ্টিতে ভিজে গান গায় “আও জাও তুম”, তখন তা একদিকে নিষ্পাপ প্রেম, অন্যদিকে দেহের সঙ্কেত—কিন্তু সেই সঙ্কেতের নিয়ন্ত্রণ পুরুষ পরিচালকের হাতে।
ষাট ও সত্তরের দশকে বলিউডে যৌনতাকে একধরনের নান্দনিক ‘ভ্রম’ হিসেবে উপস্থাপন করা হতে থাকে। আরাধনা বা অমর প্রেম ছবিতে শর্মিলা ঠাকুরের দেহভাষা ও চাহনি যেন প্রেমেরই অন্য রূপ—এখানে কামনা কখনও সরাসরি নয়, বরং আবেগের আড়ালে ছদ্মরূপে। এই সময়েই জন্ম নেয় তথাকথিত ‘ভ্যাম্প’-এর ধারণা, যেখানে যৌনতাকে অসৎ, অনৈতিক, বিপজ্জনক নারী হিসেবে প্রতীকায়িত করা হয়—বিন্দু বা হেলেনের চরিত্রগুলিতে আমরা দেখি সেই সমাজের ভীতি, যেখানে নারী স্বাধীন হলে সে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
আশির দশকে বাণিজ্যিক সিনেমার বয়ান আরও পরিবর্তিত হয়। ভোগবাদী সংস্কৃতি এবং ভিসিআর যুগের আবির্ভাবের সঙ্গে যৌনতা হয়ে ওঠে ‘বিক্রির বস্তু’। রমা অর শ্যাম থেকে রম তেরি গঙ্গা ম্যায়লি, জিস দেশ মেঁ গঙ্গা বেহতি হ্যায় থেকে ট্রাইডেন্ট, প্রতিটি ছবিতেই দেখা যায় যৌনতার নান্দনিকতা আর বাণিজ্যের মিশ্রণ। রাজ কাপুরের শেষ দিকের সিনেমায় নগ্ন দেহ বা আংশিক নগ্নতা ‘প্রেমের প্রতীক’ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও আসলে তা ছিল বাজারের জন্য এক আকর্ষণ তৈরি করা। রম তেরি গঙ্গা ম্যায়লি-র সেই বিখ্যাত দৃশ্য, যেখানে মন্দাকিনী সাদা সাড়ি পরে ঝরনায় ভিজছে—দর্শক তা ভালোবাসে, কিন্তু সেই ভালোবাসার ভেতরেই নিহিত থাকে voyeurism, এক voyeuristic gaze যা নারীকে কামনার বস্তুরূপে প্রতিষ্ঠা করে।
নব্বইয়ের দশকে উদারীকরণ ভারতীয় সিনেমার যৌনতার ধারণাকে আমূল পাল্টে দেয়। MTV-সংস্কৃতি, বিজ্ঞাপন, গ্লোবাল ফ্যাশন এবং পপ সংস্কৃতি যৌনতাকে রুচি ও বিক্রির প্রধান উপাদানে পরিণত করে। জোয়া আখতার ও করন জোহর প্রজন্মের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে যৌনতা আর লজ্জার বিষয় নয়—এটি এক প্রকার ব্র্যান্ডিং। দোস্তানা বা কবীর সিং কিংবা ধুম সিরিজে নারীদেহের উপস্থাপনা পুরোপুরি ফ্যাশনের অনুষঙ্গ, যেখানে যৌনতা মানে স্টাইল, ভোগ, গ্ল্যামার এবং প্রতিযোগিতা। করন জোহরের সিনেমায় প্রেমের পরিণতি হিসেবে নয়, বরং আত্মপরিচয়ের এক দিক হিসেবে যৌনতা আসে, কিন্তু সেটিও প্রায়শই প্যাকেজিং-এর অংশ হয়ে পড়ে—দেহ আর পোশাকের ফেটিশে রূপান্তরিত।
তবে এই পণ্যায়নের ভেতর দিয়েই কিছু চলচ্চিত্রে উঠে আসে প্রতিরোধের ক্ষীণ কণ্ঠ। বিশাল ভরদ্বাজের মকবুল বা হায়দার, অনুরাগ কাশ্যপের দেভ ডি এবং গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর—এই ছবিগুলি যৌনতাকে শুধু আকর্ষণ নয়, বরং নৈতিক সঙ্কট, সামাজিক শূন্যতা ও মানসিক ভাঙনের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে। দেভ ডি-র পারো বা চন্দা চরিত্র যৌনতার মাধ্যমে সমাজের ভণ্ড নৈতিকতাকে চ্যালেঞ্জ জানায়। পারো নিজের আকাঙ্ক্ষাকে দমন করে না, বরং প্রকাশ্যে ঘোষণা করে—সে নিজের ইচ্ছা ও শরীরের অধিকার নিজে বুঝে। আর চন্দা, যে যৌনপেশায় ঠেলে দেওয়া হয়, সে নিজের শরীরকে বিক্রি করে বাঁচার অস্ত্র বানিয়ে ফেলে। এই সিনেমাগুলিতে দেহ মানে কেবল কামনা নয়, বরং শ্রেণি ও ক্ষমতার বিরুদ্ধে এক প্রতিরোধ।
এই সময়েই উদ্ভব ঘটে নারী পরিচালকদের এক সাহসী ধারার, যারা মূলধারার বলিউডের মধ্যে থেকেও যৌনতাকে নতুনভাবে চিনিয়েছেন। লিপস্টিক আন্ডার মাই বোরখা (আলঙ্ক্রিতা শ্রীবাস্তব, ২০১৬) এক মাইলফলক—এখানে মধ্যবিত্ত গৃহিণী, কলেজছাত্রী, বৃদ্ধা নারী—সবাই যৌনতার মাধ্যমে নিজেদের স্বাধীনতা খোঁজে। সিনেমাটি দেখায়, যৌনতা কেবল শারীরিক নয়, এটি কল্পনার স্বাধীনতা। “আমার ভেতরের রোজি সেক্স করতে চায়”—এই সংলাপটি এক নিঃশব্দ বিদ্রোহ, যা ভারতীয় নারীর হাজার বছরের দমননীতিকে চ্যালেঞ্জ জানায়।
তবু বলিউডের অধিকাংশ ছবিতেই যৌনতা এখনো পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে বন্দি। নায়িকা যত আধুনিকই হোক, তার কামনা পুরুষের অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকে। কবীর সিং এই পুরুষতন্ত্রের এক নির্মম প্রতিফলন—যেখানে পুরুষের রাগ, অধিকার, এবং সহিংসতাই প্রেমের ভাষা। এই ছবির বিপরীতে দাঁড়ায় থাপ্পড় (অনুভব সিনহা, ২০২০), যেখানে নারী প্রথমবার বলে ওঠে—“একটা থাপ্পড়ই তো মেরেছে, কিন্তু মারার অধিকার কে দিয়েছে?”—এই প্রশ্নের ভেতরেই লুকিয়ে আছে ভারতের নারীচেতনার সবচেয়ে মৌলিক যৌন-রাজনীতি।
দক্ষিণ ভারতের বাণিজ্যিক সিনেমাতেও একইভাবে যৌনতার পণ্যায়ন ঘটে, কিন্তু সেখানে দেহকে ক্ষমতার প্রতীকে রূপান্তরিত করা হয়। তামিল সিনেমায় হিরোর হাইপার-মাসকুলিনিটি, বা তেলুগু ছবিতে “আইটেম সং”—সবই নারীদেহকে ভোগের মাধ্যম বানায়। কিন্তু একইসঙ্গে, এই প্রেক্ষাপটে কিছু সিনেমা, যেমন আটাকাথি, সুপার ডিলাক্স, বা আরাচার যৌনতাকে নিয়ে এসেছে এক গভীর দার্শনিক ও কৌতুকপূর্ণ অবস্থানে। সুপার ডিলাক্স-এ তামিল অভিনেত্রী সামান্থার চরিত্র যখন তার প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্কের দায় নেয় না, তখন সে বলিউডের প্রতিটি নায়িকার ‘সতীত্ব’-এর ধারণাকে উলটে দেয়।
মারাঠি সিনেমার নাগরাজ মঞ্জুলে-র ফ্যান্ড্রি বা সাইরাত-এ যৌনতা আসে শ্রেণি ও জাতির প্রশ্নে—এক দলিত প্রেমিকের দেহ ও আকাঙ্ক্ষা যে উচ্চবর্ণ সমাজের চোখে অপরাধ, সেটি এখানে ফুঁড়ে ওঠে। এইসব ছবিতে যৌনতা মানে বিদ্রোহ; শরীর মানে রাজনীতি।
বলিউডে যৌনতাকে যেভাবে পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত করা হয়েছে, তা একদিকে বাজারের চাহিদা, অন্যদিকে পুরুষতান্ত্রিক চেতনার প্রতিফলন। নারীদেহ এখানে এক “visual commodity”—ক্যামেরা তাকে ছুঁয়ে দেখে, কিন্তু কখনো শোনে না। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই দৃশ্যমানতাই হয়ে উঠছে প্রশ্নের জায়গা। আজকের প্রজন্মের নারী পরিচালক ও অভিনেতারা, যেমন তাপসী পান্নু, বিদ্যা বালান বা স্বরা ভাস্কর, যৌনতাকে লজ্জার নয়, গর্বের বিষয়ে পরিণত করছেন। তুমহারি সুলু বা লাস্ট স্টোরিজ-এর মতো ছবিতে যৌনতা আত্ম-আবিষ্কারের অনিবার্য পর্ব।
ভারতীয় মূলধারার সিনেমায় যৌনতা তাই এখন এক রণক্ষেত্র—যেখানে একদিকে পুরুষতন্ত্র তাকে পণ্য বানাতে চায়, অন্যদিকে নারীরা তাকে নিজেদের অস্ত্র করছে। সিনেমা এই দ্বন্দ্বকে প্রতিফলিত করছে—একদিকে গ্ল্যামার ও গানের বন্যা, অন্যদিকে নিঃশব্দ প্রতিরোধের কণ্ঠ।
২১ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে ভারতীয় সিনেমায় যৌনতার ধারণা যেমন বদলেছে, তেমনি বদলেছে তার সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষিত। ইন্টারনেট, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম, বিশ্বায়ন, নারীবাদ ও কুইয়ার আন্দোলনের ফলে যৌনতার ভাষা আজ আর একরৈখিক নয়, বরং বহুস্বরিক। পুরুষ ও নারী দেহের বাইরেও এখন আলোচনায় এসেছে তৃতীয় লিঙ্গ, অ-বাইনারি যৌনতা, এবং দেহ ও পরিচয়ের অসংখ্য মধ্যবর্তী অবস্থান। একসময় বলিউডে যেখানে যৌনতা মানেই “সঙ্গীতের রোমান্টিক দৃশ্য” বা “আইটেম গান”, সেখানে আজ সিনেমা ও ওয়েবসিরিজ এই নিষিদ্ধতাকে ভেঙে ফেলে তার সামাজিক-রাজনৈতিক সত্তা নিয়ে কথা বলছে।
ওটিটি প্ল্যাটফর্মের আগমন ভারতীয় চলচ্চিত্রে সবচেয়ে বড় বিপ্লব ঘটায় এই কারণে যে এখানে সেন্সরবোর্ডের বাধ্যবাধকতা নেই, ফলে যৌনতা এখন প্রথমবারের মতো নিজের ভাষা খুঁজে পেতে শুরু করে। Made in Heaven, Sacred Games, Delhi Crime, Paatal Lok, Lust Stories, Gehraiyaan, Modern Love Mumbai—এই সিরিজ ও চলচ্চিত্রগুলো যৌনতাকে শুধু আকর্ষণের বিষয় নয়, বরং অস্তিত্বের, স্বীকৃতির ও প্রতিরোধের জায়গা হিসেবে তুলে ধরে।
Made in Heaven-এর কুইয়ার চরিত্র করণ মেহরা (অভয় দেও-এর পরিচালনায়) ভারতের সমসাময়িক সমাজে সমকামিতা নিয়ে যে নিঃশব্দ ভয় ও লজ্জা কাজ করে, সেটিকে সরাসরি উন্মোচিত করে। করণকে যখন পুলিশ গ্রেফতার করে “গে” হওয়ার অপরাধে, তখন সেই দৃশ্যটি শুধু ব্যক্তিগত নয়—এটি ভারতীয় রাষ্ট্রের দমননীতির প্রতীক। তবু করণের প্রেম, তার শরীরের প্রতি ভালোবাসা, তার কামনা—সবই এক মানবিক মর্যাদার ঘোষণা। এই সিরিজ দেখায় যে যৌনতা মানে রাজনৈতিক অস্তিত্ব—নিজের পরিচয় জানার ও বলার অধিকার।
Lust Stories (অন্তোলজি ফিল্ম, ২০১৮) আধুনিক ভারতীয় নারীর দেহ ও আকাঙ্ক্ষাকে প্রথমবার এত স্পষ্টভাবে বলিউডে উপস্থিত করে। জোয়া আখতার, অনুরাগ কাশ্যপ, দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায় ও করণ জোহর—চার পরিচালকের চার গল্পে আমরা দেখি এক নতুন ভারতে নারী কেবল আকর্ষণের বস্তু নয়, বরং কামনার সক্রিয় অংশগ্রাহী। কিয়ারা আডভানির চরিত্রটি যখন স্বমেহনের দৃশ্যে আত্মতৃপ্ত হয়, তখন সেটি ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে এক মোড়—কারণ এখানে প্রথমবার এক নারী নিজের আনন্দের মালিক হয়, কোনও পুরুষের উপস্থিতি ছাড়াই। এই দৃশ্যকে অনেকেই কেলেঙ্কারি বলেছিল, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি যৌনতার আত্মমুক্তি।
অন্যদিকে Gehraiyaan (শকুন বাত্রা, ২০২২) সম্পর্ক, পরকীয়া ও মানসিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যৌনতার জটিলতা তুলে ধরে। দীপিকা পাড়ুকোনের চরিত্র আলিশা কোনও “অনৈতিক নারী” নয়; সে আধুনিক সময়ের উদ্বিগ্ন মানুষ, যে নিজের আকাঙ্ক্ষা, অতীত ও অপরাধবোধের সঙ্গে লড়ছে। এখানে যৌনতা আত্মবিনাশের পথে নয়, বরং আত্মপরিচয়ের অনিবার্য অভিজ্ঞতা।
ওটিটি যুগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হল, যৌনতা এখন শ্রেণি ও লিঙ্গের সঙ্গে সরাসরি রাজনীতিক হয়ে উঠেছে। Paatal Lok বা Delhi Crime-এর মতো সিরিজে দেহকে আর কেবল কামনার জায়গা নয়, বরং ক্ষমতা, শোষণ ও প্রতিরোধের ক্ষেত্র হিসেবে দেখানো হয়। Paatal Lok-এর এক দলিত নারী পুলিশ অফিসারের দৃঢ়তা, বা Delhi Crime-এর নারী তদন্তকারীর মানসিক লড়াই—সবই সেই পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এক নীরব বিপ্লব।
কুইয়ার সিনেমার উত্থান এই সময়ের সবচেয়ে বড় পরিবর্তনগুলির একটি। Margarita with a Straw (শোনালি বোস, ২০১৪), Aligarh (হানসল মেহতা, ২০১৬), Badhaai Do (২০২২) বা Sheer Qorma—এই ছবিগুলিতে যৌনতা মানে প্রেম, মানে সত্তা। Margarita with a Straw-এর লায়লা শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী, কিন্তু তার দেহের আকাঙ্ক্ষা আছে, ভালোবাসার ক্ষমতা আছে। সমাজের চোখে সে “অক্ষম”, কিন্তু সিনেমা তাকে ফিরিয়ে দেয় তার ইন্দ্রিয়ের মর্যাদা। Aligarh-এ অধ্যাপক শ্রীনিবাস সিরাসের নিঃসঙ্গতা দেখায় যে যৌনতা কেবল আনন্দ নয়, এটি গোপনীয়তার অধিকার। “আমার ঘরের দরজা বন্ধ করা কি অপরাধ?”—এই এক প্রশ্নে তিনি রাষ্ট্রের নৈতিকতাকে চ্যালেঞ্জ করেন।
Badhaai Do ছবিটি এক নতুন পথ খুলে দেয় যেখানে এক সমকামী পুরুষ ও এক সমকামী নারী “সামাজিক মুখোশ” হিসেবে বিয়ে করে, অথচ গোপনে তারা নিজেদের ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখে। এটি ভারতীয় যৌনতার সবচেয়ে আধুনিক রূপ—যেখানে যৌনতা আর গোপনের নয়, প্রকাশের দাবি।
কুইয়ার নারী পরিচালকদের কাজ, যেমন অনন্যা চট্টোপাধ্যায় বা লীনা মণিমেকালাইয়ের সমসাময়িক ছবিগুলিতে দেখা যায় যৌনতাকে রাষ্ট্রবিরোধী প্রতিবাদের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার। তাঁরা দেহকে রাজনীতির কেন্দ্র করে তুলেছেন—যেখানে ভালোবাসা মানে প্রতিরোধ, এবং দেহ মানে ঘোষণা।
এই সময়ের সিনেমা যৌনতার সঙ্গে যুক্ত করছে ধর্ম, জাত, শ্রেণি ও অর্থনীতির জটিলতা। Article 15, Fandry, Sir, The Great Indian Kitchen—এই ছবিগুলি দেখায় যৌনতা শুধু ব্যক্তিগত বিষয় নয়, বরং সামাজিক কাঠামোর প্রতিফলন। The Great Indian Kitchen (জীও বেবি, ২০২১)-এ যৌনতা এক নিঃশব্দ কারাগার—নারী প্রতিদিন রান্না করে, পরিষ্কার করে, ঘুমোয়, এবং স্বামীর যৌন দাবিতে সাড়া দেয়। কিন্তু ছবির শেষে সে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে, এবং প্রথমবার নিজের দেহের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়। এই নীরব প্রস্থানই প্রকৃত বিপ্লব।
ওটিটি যুগে আরও এক নতুন দিক দেখা দিয়েছে—নারী এবং পুরুষ উভয়ের মানসিক যৌনতা বা emotional intimacy। Modern Love Mumbai বা Feels Like Ishq-এর মতো সিরিজে দেখা যায় যৌনতা মানে আর শারীরিক সংস্পর্শ নয়, বরং আবেগ, সংলাপ, এবং সংযোগের জায়গা। শহুরে মানুষের নিঃসঙ্গতা যৌনতার নতুন ভাষা তৈরি করছে—এখানে আকাঙ্ক্ষা আর দমন নয়, বরং বেঁচে থাকার অভিব্যক্তি।
তবে এই মুক্তির যুগেও পণ্যায়ন পুরোপুরি মুছে যায়নি। ওটিটি প্ল্যাটফর্মের অনির্দিষ্ট দর্শকসীমা অনেক সময় যৌনতাকে আবারও বিক্রির উপাদান বানায়—“ইরোটিক থ্রিলার” ঘরানা তার উদাহরণ। কিন্তু পার্থক্য হল, এখন দর্শক আর একমুখী নয়। সে প্রশ্ন তোলে, বিশ্লেষণ করে, সামাজিক মিডিয়ায় বিতর্ক তোলে। ফলে যৌনতা এখন এক বহুলোকতান্ত্রিক আলোচনার ক্ষেত্র, যেখানে লজ্জা নয়, আছে মতামত।
ভারতীয় চলচ্চিত্র এখন এক সংক্রমণ পর্যায়ে—একদিকে যৌনতার বাজার, অন্যদিকে তার আত্মপ্রকাশের রাজনীতি। এই দ্বৈততার ভেতরেই জন্ম নিচ্ছে নতুন ভাষা। নতুন প্রজন্মের নির্মাতারা, যেমন রাহুল রাই, অনুরাগ কাশ্যপ, রিমা দাস, আলঙ্ক্রিতা শ্রীবাস্তব, লীনা মণিমেকালাই, জোয়া আখতার, এমনকি দক্ষিণের পরিচালক জি. আর. আদিত্য বা ভাসন্ত বালা—সবাই বুঝতে শিখেছেন, যৌনতা মানে কেবল শরীর নয়, এটি সামাজিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতা।
আজকের ভারতীয় সিনেমা যৌনতাকে আর “অপরাধ” হিসেবে নয়, বরং আলোচনার বিষয় করে তুলছে। এর ভেতরেই আছে নতুন নৈতিকতা, নতুন নান্দনিকতা, এবং নতুন রাজনৈতিক বোধ। যৌনতা এখন সিনেমায় হয়ে উঠছে স্বাধীনতার উপমা—যেখানে নারী, পুরুষ, কুইয়ার—সবাই সমানভাবে নিজেদের দেহ, আকাঙ্ক্ষা ও ভালোবাসার অধিকার দাবি করছে।
এই নতুন ভাষা সাহসী, অনিশ্চিত এবং অন্তরঙ্গ—যেখানে ক্যামেরা আর voyeur নয়, বরং সাক্ষী। ভারতীয় সিনেমা সেই সাক্ষ্যলিপি লিখছে—দেহ ও রাজনীতির নতুন ইতিহাসের।
ভারতীয় সিনেমা তার শতবর্ষের ইতিহাসে প্রেম, আকাঙ্ক্ষা, দেহ, ভালোবাসা—সবই বহুবার দেখিয়েছে, কিন্তু খুব কমই এমনভাবে দেখিয়েছে যেখানে যৌনতা এক নন্দনশাস্ত্র বা দার্শনিক অনুসন্ধানের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। জাপানি পরিচালক ইয়াসুজিরো ওজু যেমন পরিবারের নিঃশব্দ ভাঙনে যৌনতার অনুপস্থিতিকে এক প্রতীকী ভাষায় প্রকাশ করেন, বা হংকং-এর ওং কার ওয়াই যেমন দেহের মধ্যে সময়, স্মৃতি ও আকাঙ্ক্ষার অনিশ্চয়তাকে বন্দি করেন, কিংবা জঁ-লুক গোদার যেমন যৌনতাকে বিপ্লব ও ভাষার অবক্ষয়ের সঙ্গে মেলান—সেই স্তরের আত্মদর্শন ভারতীয় সিনেমায় খুব কমই দেখা যায়। প্রশ্ন হল, কেন? কেন এই দেশে যৌনতা নিয়ে সিনেমা এতদিন হয় নীরব থেকেছে, নয়তো একরকম চুপিসারে তাকিয়ে থেকেছে পর্দার আড়াল থেকে?
ভারতের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ইতিহাসে যৌনতা কোনো নিষিদ্ধ বিষয় নয়—কামসূত্র, অমরকোষ, অজন্তা-এলোরা, খাজুরাহো, ভগবত পুরাণ—সবখানেই যৌনতার এক মুক্ত নন্দনভাষা আছে। কিন্তু ঔপনিবেশিক যুগের পর ভারত যে আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে তৈরি হয়, সেখানে যৌনতার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি একধরনের দ্বৈতবোধে গড়ে ওঠে। ইংরেজি শিক্ষা ও ভিক্টোরীয় নীতিশাস্ত্র ভারতীয় সমাজে এক ধরণের নৈতিক শুদ্ধতাবাদ প্রতিষ্ঠা করে—যেখানে যৌনতা মানে ব্যক্তিগত লজ্জা, আর দেহ মানে পাপের সম্ভাবনা। এই মানসিক কাঠামোই পরে ভারতীয় চলচ্চিত্রে প্রবেশ করে।
১৯৫০ থেকে ৭০-এর দশক পর্যন্ত বলিউডে যৌনতা হয় রোম্যান্সের প্রলম্বন, নয়তো নৃত্য ও গানের ভেতরে রূপান্তরিত হয়ে যায়। রাজ কাপুরের আওয়ারা বা সংগম-এ যৌনতার ইঙ্গিত আছে, কিন্তু সেটি কবিত্বে ঢাকা, গানের প্রতীকী ভাষায় ঢাকা। পরিচালকরা জানতেন, দর্শক এই বিষয়টিকে চুপচাপ বোঝে, কিন্তু প্রকাশ্যে বলতে চায় না। এই গোপন সমঝোতাই ভারতীয় সিনেমার অন্যতম নৈতিক ভিত্তি হয়ে ওঠে—যৌনতা থাকবে, কিন্তু মুখে বলা যাবে না।
পশ্চিমে ওজু বা গোদার যৌনতাকে দেখেছিলেন মানবজীবনের অনিবার্য অভিজ্ঞতা হিসেবে—এমনকি নন্দনতত্ত্বের অংশ হিসেবে। ওজুর Tokyo Story বা Late Spring-এ যৌনতা অনুপস্থিত, অথচ তার অনুপস্থিতিই ছবির দার্শনিক হৃদয়। সেখানে শরীরহীন ভালোবাসা, দমিত আকাঙ্ক্ষা, এবং পরিবারের নিঃশব্দ শৃঙ্খলা যৌনতাকে এক নৈতিক দর্শনের স্তরে নিয়ে যায়। গোদার Contempt বা Pierrot le Fou-তে শরীরকে ব্যবহার করেন ভাষার অবক্ষয়ের রূপক হিসেবে। যৌনতা সেখানে এক রাজনৈতিক অভিব্যক্তি—“আমি ভালোবাসি, তাই আমি বিদ্রোহ করি।” কিন্তু ভারতীয় সিনেমায়, বিশেষত বলিউড ও মূলধারার আঞ্চলিক সিনেমায়, এই প্রশ্নগুলি তোলা হয়নি। কারণ এখানে দেহকে সবসময় দেখা হয়েছে নৈতিক ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণের পরিপ্রেক্ষিতে, অস্তিত্বগত নয়।
মৃণাল সেন, সৎযজিৎ রায় বা অদূর ভবিষ্যতে গৌতম ঘোষদের চলচ্চিত্রে রাজনৈতিক দেহ উপস্থিত থাকলেও, যৌনতার দর্শন খুব কম জায়গায় এসেছে। খারিজ, আকালের সন্ধানে, প্রতিদ্বন্দ্বী বা চারুলতা-য় আমরা দেখি সম্পর্ক, নিঃসঙ্গতা, ব্যর্থতা—কিন্তু যৌনতা সেখানে প্রতীকী। কারণ ভারতীয় মধ্যবিত্ত সমাজ যৌনতাকে কেবল সামাজিক নীতির সীমার মধ্যে দেখতে চায়। সিনেমা যখন সমাজের আয়না, তখন সেই সমাজের লজ্জা পর্দায় এসে প্রতিফলিত হয়।
অন্যদিকে, ভারতীয় রাষ্ট্রযন্ত্রেরও একটি দীর্ঘ সেন্সর ইতিহাস আছে। ১৯৫২ সালের সিনেমাটোগ্রাফ অ্যাক্ট থেকে শুরু করে আধুনিক CBFC পর্যন্ত—যৌনতা মানেই “কাট” বা “ক্লিন ভার্সন”। ফলে চলচ্চিত্র নির্মাতারা নিজেরাই শিখে ফেলেছেন কীভাবে ইঙ্গিতের ভেতর দিয়ে কথা বলতে হয়। এই সাংস্কৃতিক আত্মনিয়ন্ত্রণের ফলে যৌনতাকে এক অস্তিত্বগত অনুসন্ধান হিসেবে দেখার সুযোগই তৈরি হয়নি।
ওং কার ওয়াই-এর In the Mood for Love বা Happy Together দেখলে বোঝা যায়, যৌনতা এখানে কোনও দৃশ্য নয়, বরং সময়ের ছন্দ। দেহ স্পর্শের আগেই এক নীরব দূরত্ব তৈরি হয়, আর সেই দূরত্বই হয়ে ওঠে কামনার ভাষা। ভারতীয় সিনেমায় এমন দৃশ্য খুবই দুর্লভ, কারণ এখানে ক্যামেরা যৌনতাকে হয় voyeur হিসেবে দেখে, নয়তো censor-এর ভয় নিয়ে পরিচালিত হয়। ওং কার ওয়াইয়ের মতো নির্মাতা যেখানে কামনার অমীমাংসিততাকে সময়ের নন্দনতত্ত্বে পরিণত করেন, সেখানে ভারতীয় সিনেমা যৌনতাকে এখনও গল্পের ‘প্লট টার্ন’ হিসেবে ব্যবহার করে।
এই পার্থক্যের পেছনে সমাজের রাজনৈতিক ইতিহাস গভীরভাবে জড়িত। স্বাধীনতার পর ভারতীয় রাষ্ট্র এক জাতীয়তাবাদী প্রকল্প তৈরি করেছিল—যেখানে “সভ্য ভারতীয় নারী” এবং “নৈতিক পরিবার” ছিল জাতির প্রতীক। ফলত দেহ বা কামনার উন্মুক্ত উপস্থাপন রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির বিরোধিতা হিসেবে ধরা পড়ত। সিনেমা, যা সবচেয়ে প্রভাবশালী জনপ্রিয় শিল্প, সেই রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার প্রচারমাধ্যম হয়ে ওঠে। যৌনতা মানে বিপথ, নায়িকার পবিত্রতা মানে জাতীয়তার রক্ষাকবচ। তাই সিনেমায় প্রেম থাকতে পারে, কিন্তু যৌনতা নয়।
এই অবদমন কেবল সামাজিক নয়, রাজনৈতিকও। কারণ যৌনতা মানে নিয়ন্ত্রণহীনতা, আর নিয়ন্ত্রণহীনতা মানে রাষ্ট্রের ভয়। তাই চলচ্চিত্রে যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার মানে ছিল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। সেন্সর বোর্ড কেবল নৈতিক সংস্থা নয়, এটি এক রাজনৈতিক সংরক্ষক—যে ঠিক করে দেয় কোন আকাঙ্ক্ষা “গ্রহণযোগ্য”।
তবে ব্যতিক্রমও আছে। কামসূত্র-প্রেরিত Fire (দীপা মেহতা, ১৯৯৬) যখন দুই নারীর ভালোবাসার গল্প বলে, তখন রাষ্ট্র ও সমাজ উভয়েই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। সেই প্রতিক্রিয়াই প্রমাণ করে, ভারতীয় সমাজ এখনও যৌনতাকে সামাজিক বিপদের রূপে দেখে। অথচ একই সময়ে ওং কার ওয়াই-এর Happy Together সমলিঙ্গপ্রেম নিয়ে কান উৎসবে প্রশংসিত হয়। দুটি ছবির মধ্যে পার্থক্য কেবল সিনেমাটিক নয়, সভ্যতার ইতিহাসগত।
ভারতীয় সিনেমা যে অবদমনের রাজনীতি বহন করে, তা শুধু রাষ্ট্রীয় নয়, দর্শকেরও। দর্শক নিজেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে যৌনতাকে “রোম্যান্স” হিসেবে গ্রহণ করতে, কিন্তু “চিন্তার বিষয়” হিসেবে নয়। দেহকে দর্শন হিসেবে দেখার এই অক্ষমতা ভারতীয় সংস্কৃতির আধুনিকতাবোধের সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করে। পশ্চিমে গোদার বা বার্নার্দো বার্তোলুচ্চি বা আন্দ্রেই টারকোভস্কি যৌনতাকে আত্মা, ভাষা ও সময়ের প্রশ্নে রূপান্তরিত করতে পেরেছিলেন, কারণ সেখানে চিন্তার পরিসর ছিল মুক্ত। ভারতে এখনো চিন্তার সঙ্গে নৈতিকতার দড়ি বাঁধা।
যখন অনুরাগ কাশ্যপ বা আলঙ্ক্রিতা শ্রীবাস্তব যৌনতাকে নতুন প্রেক্ষিতে দেখাতে চেয়েছেন, তখনও তাঁরা তা করেছেন বাস্তবতার ভেতর, দর্শনের স্তরে নয়। Lust Stories বা Lipstick Under My Burkha-তে যৌনতা আছে, কিন্তু সেটি মূলত সামাজিক প্রতিরোধ। আত্ম-অন্বেষণের দিকটি এখনো অনুপস্থিত। ওজুর নিস্তব্ধতা বা গোদারের কোলাজ-ধর্মী বয়ান, যেখানে দেহ মানে সময়, নীরবতা ও শব্দের টানাপোড়েন—সেই গভীর চলচ্চিত্রভাষা এখনও ভারতীয় সিনেমায় তৈরি হয়নি।
কারণ ভারতীয় সিনেমা এখনও ভাষাকে গল্পের আনুগত্যে রাখে, দর্শনের নয়। এই ভাষা যখনো “প্লট”-এর দাস, তখন যৌনতা তার দর্শন তৈরি করতে পারে না। গোদার, তারকোভস্কি, বা ওং কার ওয়াইদের সিনেমা যৌনতাকে ভাষার কেন্দ্রে বসিয়েছে, কারণ তারা জানত—দেহ মানে ভাষার প্রথম বাক্য। ভারতীয় চলচ্চিত্র সেই বাক্যটি এখনো উচ্চারণ করেনি।
তাহলে কি এই অনুপস্থিতি একধরনের অবদমনের রাজনীতি? নিঃসন্দেহে হ্যাঁ। এটি এমন এক রাষ্ট্রীয় ও সাংস্কৃতিক রাজনীতি যা কামনাকে নিয়ন্ত্রণ করে জাতির নৈতিক কাঠামো তৈরি করে। এটি এমন এক মধ্যবিত্ত ভয় যা স্বাধীনতা চায়, কিন্তু আকাঙ্ক্ষাকে ভয় পায়। এটি এমন এক সংস্কৃতি যা প্রেমকে দেবত্বে উন্নীত করে, কিন্তু দেহকে পাপ মনে করে।
এই অবদমনের ফলেই যৌনতাকে কেন্দ্র করে দার্শনিক বা নন্দনতাত্ত্বিক চলচ্চিত্র ভারতীয় ভাষায় তৈরি হয়নি। এখানে যৌনতা মানে হয় মেলোড্রামা, নয়তো পণ্য। এখানে আকাঙ্ক্ষা কখনোই ধ্যান নয়, বরং পরিহারযোগ্য দুর্বলতা।
তবু এই নীরবতার ভিতরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এক নতুন স্রোত তৈরি হচ্ছে। ওটিটি যুগের কিছু নির্মাতা দেহ ও আকাঙ্ক্ষাকে আর ভয় পাচ্ছেন না; তাঁরা তাকে দেখছেন মানবতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে। হয়তো ভবিষ্যতের ভারতীয় সিনেমাই সেই অনুপস্থিত দর্শন পূর্ণ করবে—যেখানে যৌনতা আর শুধু প্রেম বা রাজনীতি নয়, বরং অস্তিত্বের ভাষা হয়ে উঠবে।
তখন হয়তো ভারতীয় সিনেমাও বলতে পারবে ওজুর মতো—“জীবন মানে এক নিঃশব্দ স্পর্শের অপেক্ষা,” অথবা ওং কার ওয়াইয়ের মতো—“কখনও কখনও প্রেমের চেয়েও গভীর হয় আকাঙ্ক্ষার অসমাপ্ততা।”
যতদিন না ভারতীয় চলচ্চিত্র সেই অসমাপ্ততার দার্শনিক সৌন্দর্য অনুধাবন করে, ততদিন যৌনতা এই দেশে রয়ে যাবে এক রাজনৈতিক নীরবতা—এক অনুচ্চারিত ভাষা, যার প্রতিধ্বনি শোনা যায়, কিন্তু উচ্চারণ করা যায় না।

