রাজনৈতিক ছবির পাঁচকাহন   <br /> তিমিরবরণ মিশ্র

রাজনৈতিক ছবির পাঁচকাহন
তিমিরবরণ মিশ্র

ভারতীয় সিনেমার আধুনিক ইতিহাস আসলে পাঁচটি আলোকবিন্দু দিয়ে পড়া যায়—মণি কৌল, মৃণাল সেন, শ্যাম বেনেগাল, গোবিন্দ নিহালনি এবং গৌতম ঘোষ। তাঁরা কেবল চলচ্চিত্র নির্মাতা নন, তাঁরা ভারতীয় সমাজের চিন্তার স্থপতি। প্রত্যেকে এক ভিন্ন যুগের, কিন্তু তাঁদের আত্মা একই প্রশ্নে নিবদ্ধ—ভারত নামের রাষ্ট্রে মানুষ আসলে কোথায় দাঁড়িয়ে? স্বাধীনতার পর এই দেশ যতবার নিজের পরিচয় খুঁজেছে, প্রতিবার তার ভেতর থেকে উঠে এসেছে শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী, নির্বাসিত ও প্রান্তিক মানুষের মুখ। আর সেই মুখের ইতিহাসই এই পরিচালকদের ক্যামেরায় ধরা পড়ে—যেখানে রাজনৈতিক বাস্তবতা ও শিল্পের ভাষা এক হয়ে যায়। তাঁরা প্রত্যেকে একেকজন দার্শনিকের মতো, যারা সিনেমাকে ব্যবহার করেছেন ইতিহাসের পাঠ্যরূপে, সমাজের আত্মসমালোচনার আয়না হিসেবে।

যদি সত্যজিৎ রায় হয় ভারতীয় সিনেমার মানবতাবাদের ক্লাসিক কণ্ঠস্বর, তবে এই পাঁচ পরিচালক হচ্ছেন তার পরবর্তী প্রজন্মের দ্বিধাগ্রস্ত বিবেক। তাঁরা প্রশ্ন করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন, ভেঙেছেন প্রচলিত চলচ্চিত্রভাষা। মণি কৌল সিনেমাকে মুক্ত করেছেন নাটকীয়তা থেকে, একে দিয়েছেন ধ্যানের ভাষা। মৃণাল সেন সিনেমাকে পরিণত করেছেন রাজনৈতিক বিতর্কের মাঠে, যেখানে শহর, রাজনীতি, শ্রেণি, বেকারত্ব ও আদর্শহীনতা নিয়ে মানুষ নিজের মুখোমুখি হয়। শ্যাম বেনেগাল রাষ্ট্র ও সমাজের বাস্তব ইতিহাসকে ধরেছেন সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিতে, যেখানে জাতপাত, শ্রেণি, নারী, জমি—সবই রাষ্ট্রের মেরুদণ্ডের অংশ। গোবিন্দ নিহালনি রাষ্ট্রীয় সহিংসতা, শ্রমজীবী মানুষের প্রতিরোধ, পুলিশ ও প্রশাসনের নৈতিক টানাপোড়েনকে দেখিয়েছেন অকপটে। আর গৌতম ঘোষ এই সবের মাঝখানে মানুষের নীরব অন্তর্জগত ও প্রকৃতির চিরন্তন স্রোতকে চলচ্চিত্রে রূপ দিয়েছেন—যেন নদী, বৃষ্টি, আলো ও মানুষের আত্মা এক হয়ে গেছে। এই পাঁচ পরিচালকের সিনেমা মিলিয়ে তৈরি হয় এক বিশাল ভারত—রাজনৈতিক, দার্শনিক, নান্দনিক এবং মানবিক এক জগৎ, যা একদিকে সাবঅল্টার্ন, অন্যদিকে গভীরভাবে সার্বজনীন।

মৃণাল সেনের সিনেমায় ভারত এক অস্থির, প্রশ্নে ভরা দেশ। স্বাধীনতার উত্তরণের পর, যখন ভারত রাষ্ট্রীয় স্বপ্ন ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে ছিন্নবিচ্ছিন্ন, তখন তাঁর ক্যামেরা তাকিয়ে থাকে রাস্তায়, ছাদের ওপর, ট্রামলাইনের ধারে দাঁড়ানো মধ্যবিত্ত তরুণের মুখে। ১৯৫৫ সালে তাঁর প্রথম ছবি রাত্রির অতিথি মুক্তি পায়, কিন্তু প্রকৃত মৃণাল সেনের জন্ম হয় ষাটের দশকে, যখন কলকাতা এক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নকশাল আন্দোলন, বেকারত্ব, নৈতিক সঙ্কট, পুঁজিবাদী শহুরে হাহাকার—এই সবই তাঁর সিনেমার পটভূমি।

তাঁর ভুবন সোম (১৯৬৯) দিয়ে যে ধারা শুরু হয়, তা ভারতীয় সিনেমার এক মৌলিক মোড়। সরকারি আধিকারিক ভুবন সোম (উত্তম কুমার নয়, উত্তর কুমারের বিপরীতে এক নতুন সংযত অভিনয়শৈলী)—একজন কঠোর, শৃঙ্খলাপরায়ণ, কিন্তু মানসিকভাবে একা মানুষ। তাঁর জীবনের নিয়মনিষ্ঠা একরকমের নিঃসঙ্গতা তৈরি করে, যা হঠাৎ ভেঙে যায় গাঁওয়ের মেয়ে গৌরীর সঙ্গে সাক্ষাতে। সিনেমাটি এক অর্থে রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের প্রতীক ও গ্রামীণ জীবনের প্রাণশক্তির সংঘাত। কিন্তু এখানে রাজনীতি সরাসরি নয়, বরং সূক্ষ্ম। গৌরীর হাসিতে, গরুর গলায় ঝুলে থাকা ঘণ্টার শব্দে, বৃষ্টির দৃশ্যে মৃণাল দেখিয়েছেন পরিবর্তনের সম্ভাবনা—যেখানে মানুষের মন, রাষ্ট্রের কাঠামোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।

ভুবন সোম-এর সাফল্যের পর মৃণাল সেন ক্রমশ রাজনৈতিক হয়ে উঠলেন, কিন্তু তাঁর রাজনীতি ছিল আত্মসমালোচনামূলক। ইন্টারভিউ (১৯৭১), ক্যালকাটা ৭১ (১৯৭২), পদাতিক (১৯৭৩)—এই “ক্যালকাটা ট্রিলজি” ভারতীয় সিনেমায় এক নতুন বাস্তববাদ প্রতিষ্ঠা করে। এই তিনটি ছবিতে কলকাতা হয়ে ওঠে চরিত্র—এক দগ্ধ, নোংরা, ক্লান্ত, কিন্তু জীবন্ত শহর, যা নিজের মধ্যবিত্ত সন্তানদের দিশাহারা করে দেয়। ইন্টারভিউ-তে এক যুবক চাকরির সাক্ষাৎকারে যেতে চায়, কিন্তু প্যান্ট পায় না—এমন এক সাধারণ কাহিনি দিয়ে মৃণাল দেখান সমাজের শ্রেণিগত হাস্যকরতা। তাঁর সংলাপ, “প্যান্ট না থাকলে মানুষ কি আর মানুষ থাকে না?”—এই এক প্রশ্নেই গোটা পুঁজিবাদী সভ্যতার মূল্যবোধ ভেঙে পড়ে।

ক্যালকাটা ৭১-এ মৃণাল আরও সরাসরি। শহরের চারটি সময়—১৯৩৩, ১৯৪৩, ১৯৬৯ ও ১৯৭১—এর চারটি গল্পে তিনি দেখান বাঙালির দারিদ্র্য, ক্ষুধা, প্রতিবাদ ও নৈতিক পতন। এই সিনেমা শুধুমাত্র রাজনীতি নয়, এটি এক ঐতিহাসিক দলিল। সেখানে ভয়েসওভার বলে ওঠে, “কলকাতা আজ এক লাশের শহর।” এটি কেবল সময়ের প্রতিচ্ছবি নয়, বরং ইতিহাসের ভাষ্য—যেখানে রাজনীতি আর ব্যক্তিজীবন একই ক্যানভাসে মিশে যায়। পদাতিক-এ নকশাল আন্দোলনের একজন তরুণ বিপ্লবীর অন্তর্দ্বন্দ্ব, তাঁর ঘরবাড়ি থেকে নির্বাসন, আত্মগ্লানি ও প্রশ্নবিদ্ধতা মৃণাল এক স্বীকারোক্তিমূলক ঢঙে দেখান। সিনেমাটি শেষ হয় প্রশ্নে—“কী করা উচিত?”—এটি যেন পরিচালক নিজেও সমাজকে প্রশ্ন করছেন।

সত্তর ও আশির দশকে মৃণাল সেন ক্রমশ আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠেন, কিন্তু তাঁর রাজনীতি দেশজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না। আকালের সন্ধানে (১৯৮০)-তে তিনি দেখান কীভাবে ইতিহাস ও বর্তমানের সম্পর্ক তৈরি হয়। একদল শহুরে চলচ্চিত্রকর্মী ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে সিনেমা করতে যায় গ্রামে, কিন্তু তারা নিজেরাই গ্রামীণ বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে পড়ে। এখানে সিনেমা তৈরির প্রক্রিয়াই সিনেমার বিষয়—একটি মেটা-সিনেমা। গ্রামের এক বৃদ্ধা বলে ওঠেন, “আপনারা আবার আমাদের কষ্টকে সিনেমা করবেন?”—এই সংলাপটি যেন মৃণাল সেনের নিজের আত্মসমালোচনা। তিনি জানতেন, মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর দৃষ্টিতে গ্রামীণ দুঃখ শুধু ‘বিষয়বস্তু’, কিন্তু বাস্তবে সেটি জীবনের অভ্যন্তর।

খারিজ (১৯৮২)-তে তাঁর রাজনৈতিক মানবতাবাদ আরও তীক্ষ্ণ। এক মধ্যবিত্ত ঘরে এক কিশোর গৃহকর্মীর মৃত্যু—সাধারণ ঘটনা—কিন্তু সেই মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া সমাজের মুখোশ উন্মোচন করে দেয়। সংলাপের অভাবে, নিঃশব্দতায়, মৃণাল দেখান শ্রেণিবিভাজনের নিষ্ঠুরতা। তাঁর ক্যামেরা বাড়ির কোণে পড়ে থাকা কাপড়, গ্লাস, বিছানা—সবকিছুর ওপর থেমে যায়। যেন প্রতিটি বস্তুই সাক্ষী হয়ে দাঁড়ায় মধ্যবিত্তের অপরাধের।

খন্ডহর (১৯৮৪) এবং একদিন অচানক (১৯৮৯)-এ মৃণাল সময়ের স্রোতকে ধরেন—বিলুপ্ত গ্রাম, হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা, মধ্যবিত্তের আত্মবিস্মৃতি। খন্ডহর-এর সংলাপ—“আমাদের জীবনে কিছুই ঘটে না”—এই নৈঃশব্দ্যের ভেতরে আছে অস্তিত্ববাদী যন্ত্রণা। আবার একদিন অচানক-এ হঠাৎ একজন বাবা হারিয়ে যান, কোনও ব্যাখ্যা ছাড়াই, যেন সমাজের অভ্যন্তরীণ অর্থশূন্যতার প্রতীক।

মৃণাল সেনের সিনেমায় রাজনীতি কখনো বক্তৃতা নয়, বরং নৈতিক অনুসন্ধান। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি কখনও বিপ্লবী ছিলাম না; আমি সব সময় একজন পর্যবেক্ষক ছিলাম।” তাঁর এই পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাই তাঁকে করে তোলে মার্ক্সবাদী চিন্তার মানবিক রূপকার। তাঁর রাজনীতি ব্যক্তি ও সমাজের টানাপোড়েন থেকে জন্ম নেয়। তিনি বিশ্বাস করতেন, চলচ্চিত্র কেবল প্রতিবাদের ভাষা নয়, আত্মসমালোচনার আয়নাও।

মৃণাল সেন ছিলেন এক অনির্বাণ প্রশ্ন। তাঁর চরিত্ররা কখনও সম্পূর্ণ নায়ক নয়, তারা ভুল করে, হারায়, আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু তাদের মধ্যে থাকে চিন্তার অগ্নিশিখা। যেমন মহাপৃথিবী (১৯৯১)-তে শহর ও গ্রামের সম্পর্ক, দূষণ, প্রযুক্তি ও মানুষ—সবকিছু মিলিয়ে তিনি শেষবারের মতো আধুনিক ভারতের এক বিশৃঙ্খল প্রতিচ্ছবি আঁকেন।

তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সময়ের সঙ্গে বিবর্তিত হয়। ষাটের দশকে তিনি যেভাবে সমাজতান্ত্রিক আশাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন, আশির দশকে ততটাই হয়ে ওঠেন আত্মসমালোচক। তাঁর সিনেমার চরিত্ররা তাই কখনও সাদা-কালো নয়—তারা এক দীর্ঘ বিতর্কের ভেতর দিয়ে যায়। মৃণাল সেনের জন্য সিনেমা ছিল এক ‘রাজনৈতিক ডায়েরি’, যেখানে প্রতিটি ফ্রেমে প্রশ্ন লেখা থাকে।

মৃণাল সেনের পরে যে প্রজন্ম ভারতীয় সিনেমায় রাজনৈতিক ভাবনাকে এগিয়ে নিয়ে গেল—শ্যাম বেনেগাল, গোবিন্দ নিহালনি, গৌতম ঘোষ ও মণি কৌল—তাঁরা সকলেই কোনো না কোনোভাবে মৃণালের উত্তরসূরি। কিন্তু তাঁদের প্রত্যেকের রাজনৈতিক সুর ভিন্ন—কারও ক্যামেরা রাষ্ট্রের দিকে, কারও মানুষের ভেতরে, কারও প্রকৃতির দিকে।

যেখানে মৃণাল সেন শহরের রাজনীতি ও নৈতিক বিভ্রান্তির অন্তর্জগৎকে অন্বেষণ করেছিলেন, সেখানে শ্যাম বেনেগাল তাকালেন বৃহত্তর রাষ্ট্র ও সমাজের দিকে—যেখানে ইতিহাস, অর্থনীতি, শ্রেণি ও শ্রম মানুষের নিয়তি নির্ধারণ করে। তিনি ছিলেন এমন এক চলচ্চিত্রকার, যিনি ভারতীয় রাষ্ট্রকে ভেতর থেকে বিশ্লেষণ করেছেন; তাঁর সিনেমা যেন ইতিহাসের সমাজতাত্ত্বিক প্রতিবেদন। কিন্তু এই প্রতিবেদন কখনও শুষ্ক নয়—এটি গভীর মানবিক। বেনেগালের ছবিতে মানুষের পরিশ্রম, আত্মসম্মান, এবং জীবনের সঙ্গে লড়াই করা মর্যাদা সব সময় প্রথম সারিতে থাকে।

১৯৭৪ সালে অঙ্কুর মুক্তি পেলে ভারতীয় সমান্তরাল সিনেমা নতুন ভাষা পেল। গ্রামীণ জমিদারি প্রথার পতন, শ্রমিক ও প্রভুর মধ্যে শ্রেণি-সংঘর্ষ—এই বিষয়গুলো তখনও পর্যন্ত শহুরে দর্শকের কাছে দূরের। কিন্তু বেনেগাল এই ছবিতে দেখালেন যে, ভারতের আসল বাস্তবতা গ্রামের মাটিতে লুকিয়ে। লক্ষ্মী, এক দরিদ্র দম্পতির নারী, যার শরীর এবং শ্রম উভয়ই শোষিত হয় প্রভুর দ্বারা—এই চরিত্রে বেনেগাল একদিকে নারী নিপীড়নের বাস্তবতা, অন্যদিকে রাষ্ট্রের শ্রেণিকাঠামোর অমানবিকতা দেখিয়েছেন। অঙ্কুর-এর এক মুহূর্তে যখন লক্ষ্মী চিৎকার করে বলে, “এই অন্যায় বন্ধ হবে না?”—সেই প্রশ্ন যেন গোটা ভারতের কৃষিজীবী শ্রেণির আর্তনাদ।

এই ছবির সাফল্যই তৈরি করল বেনেগালের পরবর্তী ধারাবাহিকতাকে। তাঁর নিশান্ত (১৯৭৫), মন্থন (১৯৭৬), ভূমিকা (১৯৭৭), জুনুন (১৯৭৮) ও কন্দহার (১৯৮৪)—সবই রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তির টানাপোড়েনের নান্দনিক অনুসন্ধান। নিশান্ত-এ জমিদারদের যৌন ও সামাজিক নিপীড়ন, গ্রামের নীরবতা, এবং শেষ পর্যন্ত সেই নীরবতার বিস্ফোরণ—এই তিন স্তরে তিনি দেখিয়েছেন কেমন করে মানুষ ন্যায়বিচারের জন্য অবশেষে বিদ্রোহে পৌঁছে যায়। মন্থন-এ আবার গোটা রাজ্য জুড়ে গরুর দুধ সংগ্রহকারীদের সহযোগী আন্দোলনের গল্প, যা ভারতের সমবায় আন্দোলনের বাস্তব ইতিহাস থেকে নেওয়া। ছবির প্রতিটি দৃশ্যে গ্রামীণ পরিশ্রম ও সংগঠিত প্রতিবাদের সৌন্দর্য রয়েছে—এটি ছিল প্রথম ভারতীয় চলচ্চিত্র যা এক লক্ষ দুধচাষি শ্রমিকের টাকা দিয়ে নির্মিত। এখানে শিল্প একেবারেই জনগণের হাতে ফিরে আসে।

ভূমিকা-তে বেনেগাল চলচ্চিত্রকে ব্যবহার করেন আত্মজৈবনিক আত্মসমালোচনার মতো। এই ছবিতে একজন অভিনেত্রীর জীবনযাত্রা, তাঁর ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, সামাজিক চাপ, এবং শিল্পজগতে নারীর অবস্থান ফুটে ওঠে। স্মিতা পাটিলের মুখে বেনেগাল নারীর আত্মবিশ্বাস ও অসহায়তা একসঙ্গে প্রকাশ করেছেন। এখানে রাজনীতি মানে শুধু রাষ্ট্র নয়, সমাজের লিঙ্গবৈষম্যও। ভূমিকা আসলে এক প্রকার ‘নারীবাদী ইতিহাস’, যা ভারতীয় সিনেমাকে নতুন ভাষা দেয়।

জুনুন-এ ইতিহাস ও রাজনীতির মিশ্রণ আরও গভীর হয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পটভূমিতে তৈরি এই চলচ্চিত্রে বেনেগাল দেখান ধর্ম, জাতি ও প্রেমের সংঘর্ষ। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পাশাপাশি ব্যক্তিগত সম্পর্কের নৈতিক সঙ্কট এখানে ইতিহাসের রক্তাক্ত প্রেক্ষাপটে স্থাপিত। তাঁর ইতিহাস কখনো শুষ্ক তথ্য নয়, বরং রক্তমাংসের মানুষের অভিজ্ঞতা। জুনুন-এর প্রতিটি ফ্রেমে দেখা যায়—রাষ্ট্রের রাজনৈতিক লড়াই শেষ পর্যন্ত ব্যক্তির হৃদয়ের লড়াইয়ে রূপ নেয়।

অন্যদিকে কন্দহার (১৯৮৪)-এ, যেটি আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকায় নিঃস্ব মানুষদের জীবনের গল্প, সেখানে রাষ্ট্রের সামরিকতা ও মানুষের দারিদ্র্য এক হয়ে যায়। বেনেগালের চলচ্চিত্রগুলো এইভাবেই স্থানীয় হয়ে ওঠে সার্বজনীন—তাঁর প্রতিটি চরিত্রই এক বৃহত্তর সামাজিক কাঠামোর প্রতিনিধি।

বেনেগালের দৃষ্টিতে রাষ্ট্র কোনও স্থির কাঠামো নয়—এটি মানুষের কাজের ফল, যা পরিবর্তিত হতে পারে। মন্থন বা সুস্মান (১৯৮৭)-এর মতো ছবিতে তিনি দেখান যে, সাধারণ মানুষ সংগঠিত হলে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিতে পারে। কিন্তু মম্মো (১৯৯৪)-এর মতো ছবিতে রাষ্ট্রের অমানবিকতাই উঠে আসে—যেখানে এক মুসলিম নারীকে, যিনি দেশভাগের পরে পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন, নিজের শহরে ফিরে আসতে দেওয়া হয় না। রাষ্ট্রের চোখে তিনি “অন্য” হয়ে গেছেন। এই “অন্যতা”-ই বেনেগালের রাজনৈতিক সিনেমার মূল শব্দ।

বেনেগাল সিনেমায় কখনো বক্তৃতা দেন না; তিনি দেখান মানুষ কীভাবে নিজের জীবনের মধ্য দিয়ে ইতিহাসকে বোঝে। তাঁর ছবির সংলাপ সাধারণ, কিন্তু পরিস্থিতি গভীর। তিনি বিশ্বাস করতেন, রাজনীতি মানে মানুষের জীবনযাত্রার সামগ্রিক ব্যবস্থা—জমি, শ্রম, লিঙ্গ, ধর্ম, শ্রেণি—সব একসঙ্গে। তাঁর সিনেমায় আলো-ছায়া, মাটি, ঘাম, ধূলি—সবই রাজনীতির অংশ।

১৯৯০-এর পর বেনেগাল তাঁর চলচ্চিত্রে নতুন সুর আনেন—ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন। বোস: দ্য ফরগটেন হিরো (২০০৪)-এ তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনকে নিয়ে রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের এক বিকল্প পাঠ তৈরি করেন। সেখানে দেশপ্রেম আর রাষ্ট্রনীতির দ্বন্দ্ব উঠে আসে স্পষ্টভাবে। নেতাজি হয়ে ওঠেন কেবল ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব নয়, এক রাজনৈতিক ধারণা।

শ্যাম বেনেগাল ভারতীয় সিনেমার মধ্যে এক ‘ইতিহাস-সচেতন সমাজতত্ত্ব’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি যেমন নিপীড়িত শ্রেণির কণ্ঠস্বরকে সামনে এনেছেন, তেমনই রাষ্ট্রের কাঠামোকে সমালোচনা করেছেন। তাঁর সিনেমা একধরনের চলমান দলিল, যেখানে মানুষের শ্রম, প্রতিবাদ, ও স্বপ্ন সংরক্ষিত থাকে।

যদি মৃণাল সেনের সিনেমা হয় শহরের বিবেক, তবে বেনেগালের সিনেমা গ্রামের বিবেক—দুজন মিলে ভারতীয় রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের দুই দিক তৈরি করেন। একজন প্রশ্ন করেন আদর্শ নিয়ে, অন্যজন উত্তর খোঁজেন সংগঠনে।

বেনেগালের এই ঐতিহ্য থেকেই উঠে আসেন তাঁর সহকারী ও উত্তরসূরি—গোবিন্দ নিহালনি, যিনি রাষ্ট্রের যন্ত্রণা ও সহিংসতার নগর-বাস্তবতাকে তুলে ধরেন এক অমোঘ বাস্তবতায়।

ভারতীয় সমান্তরাল সিনেমার এক প্রান্তে যেখানে বেনেগাল ছিলেন সমাজতাত্ত্বিক বাস্তবতার নির্মাতা, সেখানে গোবিন্দ নিহালনি হলেন রাষ্ট্রীয় সহিংসতার নথিকার। বেনেগালের সহকারী হিসেবেই তাঁর চলচ্চিত্রযাত্রা শুরু, কিন্তু নিহালনির নিজস্ব ভাষা ছিল অনেক বেশি শার্প, নগরমুখী ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে ক্লস্ট্রোফোবিক। তাঁর সিনেমা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ যন্ত্রণা, নৈতিক ক্ষয় এবং ব্যক্তির ওপর সেই ব্যবস্থার চাপ—এই তিনটির ভেতরকার সম্পর্ককে উন্মোচন করে।

১৯৮০ সালে মুক্তি পাওয়া আক্রোশ ছিল ভারতীয় সমান্তরাল সিনেমার এক মৌলিক বিস্ফোরণ। এই ছবির গল্প লিখেছিলেন বিজয় তেন্ডুলকর, আর নিহালনি সেটিকে রূপ দিয়েছিলেন কড়া বাস্তবতায়। ছবিটি শুরু হয় এক আদিবাসী শ্রমিকের স্ত্রীর ধর্ষণ ও হত্যার মামলার মাধ্যমে, যেখানে সমাজের সব স্তর—পুলিশ, আইনজীবী, রাজনীতি—একজোট হয়ে সত্যকে চাপা দেয়। নায়কের মুখে কোনও সংলাপ নেই, তার নীরবতা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এক চিৎকারে পরিণত হয়। আক্রোশ নামের মধ্যেই নিহিত নিহালনির রাজনৈতিক দর্শন—প্রতিরোধের ভাষা কখনও কখনও নীরবতাই। শেষ দৃশ্যে যখন নিপীড়িত শ্রমিক নিজেই তাঁর বোনকে হত্যা করে, যেন তাকে ভবিষ্যতের একই শোষণ থেকে রক্ষা করছে, তখন রাষ্ট্র, ন্যায়বিচার ও মানবিকতার সীমারেখা একসঙ্গে ভেঙে পড়ে।

আক্রোশ দেখায় রাষ্ট্রের সহিংসতা কেবল অস্ত্র বা সেনাবাহিনীর হাতে নয়, এটি নিহিত আইনের ভেতরে, বিচারব্যবস্থার প্রক্রিয়ায়, মানুষের নীরবতায়। এই বাস্তবতাকে নিহালনি তাঁর পরবর্তী চলচ্চিত্রগুলোতে আরও গভীর করে তোলেন। আর্ধ সত্য (১৯৮৩) এই ধারার চূড়ান্ত রূপ—এটি ভারতীয় নগররাষ্ট্রের অন্তর্গত নৈতিক অবক্ষয়ের এক অমোঘ প্রতিচ্ছবি।

আর্ধ সত্য-এর নায়ক অনন্ত ভেলঙ্কর, যিনি এক সৎ পুলিশ অফিসার, কিন্তু পুরো ব্যবস্থার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে নিজেই নিজের ভিতর ভেঙে পড়েন। ছবির মূল সংলাপ—“পাওয়ার ইজ দ্য আল্টিমেট ট্রুথ”—এই রাষ্ট্রীয় দর্শনের সারমর্ম। নিহালনি এখানে দেখান, ক্ষমতা কেবল উপরে থাকা রাজনীতিবিদের হাতে নয়, বরং প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে আছে। অনন্ত যখন বুঝতে পারে সে যাদের রক্ষা করছে, তাদেরই প্রভুত্ব বজায় রাখতে সে ব্যবহার হচ্ছে, তখন তার ব্যক্তিগত ক্রোধ রাষ্ট্রের প্রতিরোধে পরিণত হয়। ওম পুরীর মুখে নিহালনি যেন গোটা ভারতের মধ্যবিত্ত বিবেককে কথা বলাতে চেয়েছেন।

এই ছবিটি যেমন রাজনৈতিক, তেমনি মনস্তাত্ত্বিকও। নিহালনির ক্যামেরা অনন্তর চোখের ক্লোজআপে আটকে থাকে—যেন রাষ্ট্রের সিস্টেম তার মনের মধ্যে ঢুকে পড়ছে। তাঁর আলোছায়া, নির্মাণ, সাউন্ড—সবই কঠোর, তীক্ষ্ণ। এখানে কোনও কাব্যিকতা নেই, আছে তীব্র বাস্তববাদ। তবে এই বাস্তববাদ মৃণাল সেনের মতো সমাজচিন্তার নয়, এটি রাষ্ট্রীয় অবচেতনকে ধরতে চায়।

পার্টি (১৯৮৪)-তে নিহালনি শ্যাম বেনেগালের সামাজিক বাস্তবতার পরিসরকে নিয়ে যান বুদ্ধিজীবী মহলে। এখানে এক উচ্চবিত্ত সাহিত্যিক পার্টির মধ্যে দিয়ে শহুরে উদারপন্থী বুদ্ধিজীবীদের ভণ্ডামি, আত্মতৃপ্তি ও রাজনীতির প্রতি তাদের নির্লিপ্ততা তুলে ধরা হয়। পার্টিতে সবাই কথা বলে সমাজ পরিবর্তনের, কিন্তু বাইরে যে শ্রমিক, কৃষক, বিদ্রোহী—তাদের কেউ দেখতে পায় না। পার্টি যেন আক্রোশ-এর উল্টোপিঠ—ওখানে নিপীড়িতরা কথা বলতে পারে না, এখানে শিক্ষিতরা শুধু কথাই বলে। দুটি সিনেমা মিলে তৈরি করে ভারতের দুই মুখ—একটি নীরব, আরেকটি বাচাল; কিন্তু উভয়েই অসাড়।

নিহালনির রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্পষ্ট মার্ক্সবাদী, তবে প্রচারণার নয়, বরং মানবিক ক্ষয়ের পর্যবেক্ষক হিসেবে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে রাষ্ট্র কখনও নিরপেক্ষ নয়; এটি সব সময় শক্তিশালীর পক্ষে কাজ করে। এই ধারণা তামস (১৯৮৭)-এ আরও দৃঢ়ভাবে প্রকাশ পায়। এই টেলিভিশন চলচ্চিত্রটি ছিল দেশভাগের সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার গল্প, এবং এতটাই তীব্র যে প্রথম সম্প্রচারের পর ভারতে রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি হয়। নিহালনি এখানে দেখিয়েছেন, ধর্মীয় বিদ্বেষ কিভাবে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় মানুষের ভেতর ঢুকে যায়। তামস-এ রমেশ সিপ্পির চরিত্র যখন নিজের প্রতিবেশীকে মেরে ফেলে শুধুমাত্র অন্য ধর্মের বলে, তখন দর্শক বুঝতে পারে রাষ্ট্রীয় সীমানা আসলে মানুষের হৃদয়ে তৈরি এক দাগ মাত্র।

নিহালনির চলচ্চিত্রে হিংসা কখনও বাহ্যিক নয়, এটি বিবেকের ভেতর ঘটে। তাঁর দ্রোহকাল (১৯৯৪)-এ একজন পুলিশ অফিসার নিজের সহকর্মীর মৃত্যু, প্রতিশোধ এবং রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের মধ্যে পড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। এই ছবিতে নিহালনি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের ভাষা ব্যবহার করেন—যেখানে “দেশরক্ষা” নামের ছত্রছায়ায় হত্যা ও মিথ্যা বৈধ হয়ে যায়। তাঁর সিনেমায় তাই রাষ্ট্র কোনো মূর্ত সত্তা নয়, এটি এক আত্মিক দানব, যা মানুষের নৈতিকতাকে খেয়ে ফেলে।

নিহালনি ছিলেন এক গভীর রাজনৈতিক মানবতাবাদী। তিনি কখনও বক্তৃতা দেননি, বরং দৃশ্যের মধ্য দিয়েই তাঁর অবস্থান জানিয়েছেন। আর্ধ সত্য-এর শেষে অনন্ত যখন নিজের বন্দুক নিজের দিকে তোলে, সেটি কেবল ব্যক্তিগত আত্মহত্যার ইঙ্গিত নয়—এটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আত্মমুক্তি। নিহালনি বুঝতেন, বিপ্লব সব সময় বাহিরে ঘটে না, অনেক সময় তা ঘটে অন্তরে।

১৯৯০-এর পর তিনি হাজার চৌরাসি কি মা (১৯৯৮) নির্মাণ করেন, মহাশ্বেতা দেবীর উপন্যাস অবলম্বনে। এই ছবিতে এক মধ্যবিত্ত মা আবিষ্কার করে যে তার নিহত পুত্র ছিল নকশাল আন্দোলনের কর্মী। রাষ্ট্র তাকে ‘দেশদ্রোহী’ বলে চিহ্নিত করেছে, কিন্তু মায়ের চোখে সে অন্যায়বিরোধী এক যোদ্ধা। এই ছবিটি ভারতের বামপন্থী আন্দোলন ও রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সেই মানসিক সংঘাতকে সামনে আনে, যা মৃণাল সেনের সময় থেকে শুরু হয়ে নিহালনির চলচ্চিত্রে এক কঠোর বাস্তবতায় পৌঁছায়।

নিহালনির ভাষা ছিল অনাড়ম্বর, কিন্তু প্রতিটি দৃশ্যের গঠন ছিল গভীরভাবে দর্শনশ্রয়ী। তাঁর চলচ্চিত্রের আলো সবসময় অর্ধেক আলোকিত—যেন প্রতিটি চরিত্রই সত্য আর অসত্যের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে। তাঁর সংলাপ কখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয় না, বরং প্রশ্ন তোলে। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব, আইন, বিচার—সবকিছু নিয়ে এক প্রশ্নচিহ্ন রেখে যায়।

গোবিন্দ নিহালনি এমন এক ভারতকে চিত্রিত করেছেন, যেখানে ন্যায়বিচার আর রাজনীতি একে অপরের সঙ্গে চিরস্থায়ী সংঘর্ষে লিপ্ত। তাঁর নায়করা ক্লান্ত, ক্রুদ্ধ, কিন্তু তবু বিবেকবান। তাঁরা পরাজিত হলেও পরাজয়েই নিহিত তাদের মানবতা।

যেখানে বেনেগাল রাষ্ট্রকে সমালোচনার মধ্যেও পুনর্গঠনের সম্ভাবনা হিসেবে দেখেছিলেন, নিহালনি সেখানে রাষ্ট্রকেই মানববিরোধী এক যন্ত্র হিসেবে দেখেছেন। বেনেগালের মন্থন-এ সমবায়ের শক্তি রাষ্ট্রকে পাল্টাতে পারে, কিন্তু নিহালনির আর্ধ সত্য-এ রাষ্ট্রই ব্যক্তিকে গিলে ফেলে। এই দুই চিত্র একসঙ্গে মিলে আধুনিক ভারতের রাজনৈতিক সিনেমার দ্বৈত মুখ গঠন করে—আশা ও হতাশার, সংগঠন ও নিঃসঙ্গতার।

নিহালনির সিনেমা শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে এক সতর্কতা—রাষ্ট্র যত বড় হয়, মানুষ তত ক্ষুদ্র হয়। তাঁর ছবির অন্ধকার কোনো স্টাইল নয়, এটি বাস্তবের প্রতিচ্ছবি। এই নৈরাশ্যের মধ্যেই নিহিত আছে তাঁর সর্বোচ্চ সততা।

গৌতম ঘোষ ভারতীয় সিনেমার পরিসরে এমন এক বিরল সেতুবন্ধন, যেখানে রাজনীতি আর কবিতা পরস্পরকে আঘাত করে না, বরং পরস্পরের হাত ধরে এগোয়। তিনি যেমন মৃণাল সেনের সমাজসচেতনতা, তেমনই ঋত্বিক ঘটকের মানবিক বিষাদ, এবং সত্যজিৎ রায়ের নীরব নান্দনিকতা—এই তিন ধারাকে একত্রে আত্মস্থ করেছেন। কিন্তু তাঁর সিনেমা কেবল উত্তরাধিকার নয়, এটি নতুন ভাষা তৈরি করেছে—যেখানে নদী, বৃষ্টি, কাদা, বাতাস, সময়—সবকিছু হয়ে ওঠে রাজনীতির প্রতীক।

গৌতম ঘোষের চলচ্চিত্রজীবন শুরু হয়েছিল ডকুমেন্টারি নির্মাতা হিসেবে। এই বাস্তব পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তাঁর ফিচার চলচ্চিত্রগুলোকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে। ১৯৮১ সালে মাঙ্ঝি তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি, এবং এই ছবিতেই দেখা যায় তাঁর মূল দৃষ্টিভঙ্গি—কৃষকজীবনের বাস্তবতা, শোষণ ও মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক। মাঙ্ঝি কোনও একক ব্যক্তির গল্প নয়; এটি সমষ্টিগত জীবনের ইতিহাস। এখানে একজন কৃষক নিজের জমি হারিয়ে যে অসহায়তার মধ্যে পড়ে, তা কেবল সামাজিক নয়, অস্তিত্বেরও। এই ছবির নির্জনতা, নীরবতা এবং আলো—সবকিছু গৌতম ঘোষের ভবিষ্যৎ সিনেমাগুলির ছায়াপাত করে।

কিন্তু পারের (১৯৮৪) মাধ্যমেই তিনি ভারতীয় সিনেমার মানচিত্রে এক অবিস্মরণীয় ছাপ ফেললেন। অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম যেমন নদীকে জাতিগত ও ঐতিহাসিক প্রতীকে পরিণত করেছিল, তেমনি পারের-এ নদী হলো ইতিহাসের সীমানা ও মানবতার পরিমাপ। এখানে দুই বাঙালি, এক ভারতীয় ও এক বাংলাদেশি, দুর্ঘটনাবশত সীমান্ত পার হয়ে যায়—এবং নদীর ওপারে, সীমান্তরক্ষীদের বন্দুকের আওতায়, তাদের মানবিকতা পরীক্ষা হয়।

পারের সেই সংলাপ—“মানুষ কবে পার হলো, নদী কবে পার হলো?”—এই প্রশ্ন আসলে ইতিহাসের সমস্ত দেশভাগের কেন্দ্রে থাকা প্রশ্ন। গৌতম ঘোষ এখানে রাষ্ট্রকে দেখান এক কৃত্রিম রেখা হিসেবে, যা মানুষের সম্পর্ককে খণ্ডিত করে। তাঁর ক্যামেরা বারবার ফিরে যায় নদীর ওপর, আকাশের দিকে, কাদায় পড়া পায়ের ছাপে—এই দৃশ্যগুলোই যেন রাষ্ট্রীয় নথির বিপরীতে জীবনের বাস্তব দলিল।

গৌতম ঘোষের সিনেমায় প্রকৃতি কখনো পটভূমি নয়, এটি চরিত্রের মতোই সক্রিয়। পারের-এ নদী যেমন স্মৃতি ও মৃত্যুর সীমারেখা, আবার আরণ্যক (১৯৮৭)-এ বন হয়ে ওঠে সভ্যতার আত্মসমালোচনার মঞ্চ। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “আরণ্যক” থেকে অনুপ্রাণিত এই ছবিতে গৌতম ঘোষ নগরসভ্যতার মানুষের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ককে পুনরুদ্ধার করতে চান। এখানে রাজনীতি আছে, কিন্তু তা রাষ্ট্রীয় নয়—এটি অস্তিত্ববাদী। মানুষ কিভাবে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, এবং সেই বিচ্ছিন্নতা কিভাবে মানসিক ও সামাজিক সংকটের জন্ম দেয়—এই প্রশ্নে ছবিটি আধুনিক।

তাঁর অন্তর্জলি যাত্রা (১৯৮৭)-এ রাজনীতি আসে পুরাণ ও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। ছবির সময়কাল উনিশ শতকের কলকাতা, কিন্তু প্রতিটি ফ্রেম আজকের সমাজের প্রতিফলন। এখানে এক ব্রাহ্মণ পরিবার ঘাটে আসে মৃতদেহের দাহের জন্য, কিন্তু ধীরে ধীরে মৃত্যুর সামাজিক আচার নিজেই জীবিত মানুষদের বন্দি করে ফেলে। এই চলচ্চিত্রে পুরাণ, ধর্মীয় প্রথা ও আধুনিকতার সংঘাত একসঙ্গে মিশে যায়। “ঘাট” হয়ে ওঠে এক প্রতীক—যেখানে জীবন ও মৃত্যুর সীমানা ঝাপসা হয়ে যায়।

এই চলচ্চিত্রে গৌতম ঘোষ সেই চিরন্তন প্রশ্ন তুলেছেন—মানুষের মুক্তি কি প্রথার ভিতরে সম্ভব, নাকি প্রথার বিরুদ্ধেই জন্ম নিতে হবে নতুন জীবনের? তাঁর চিত্রভাষা নিস্তব্ধ, সংলাপ সংযত, কিন্তু প্রতিটি ফ্রেমে মাটির গন্ধ আছে। এই সিনেমা এক অর্থে ভারতের ধর্মীয় রাজনীতির ওপর নীরব ব্যঙ্গও।

পদাতিক, কালপুরুষ, মনোরমা বা ইমারতী নয়—গৌতম ঘোষের বিশেষত্ব তাঁর সময়বোধে। তিনি সময়কে চিত্র করেন, কেবল গল্প বলেন না। গণেশযাত্রা, পাতালঘর, মঁসিয়র হুলোর ছায়া—সব ক্ষেত্রেই দেখা যায় ইতিহাস ও ব্যক্তিগত স্মৃতি পরস্পরের ভেতর গলে যাচ্ছে। তাঁর ক্যামেরা ধীর, কিন্তু প্রতিটি নড়াচড়া অর্থবহ।

১৯৯৩ সালের তাহাদের কথা তাঁর সবচেয়ে রাজনৈতিক ছবি। এটি রাষ্ট্রহীন, নাগরিকত্বহীন, উদ্বাস্তু মানুষের গল্প। এই ছবির মধ্য দিয়ে গৌতম ঘোষ দেখিয়েছেন—রাষ্ট্র যে নাগরিকের কথা বলে, সেই নাগরিককেই কিভাবে ‘অন্য’ করে দেয়। একদিকে এটি বাংলাদেশি শরণার্থীদের বাস্তব ইতিহাস, অন্যদিকে এটি এক সার্বজনীন প্রশ্ন—মানুষের মর্যাদা কি রাষ্ট্র নির্ধারণ করবে?

তাঁর পদ্মনদীর মাঝি-তেও এই প্রশ্ন ভিন্ন রূপে ফিরে আসে। এখানে মাঝি কুবেরের মুখে আমরা শুনি, “নদীই আমাদের মা, কিন্তু মা কাকে চিনবে, আমরা কি তাকে চিনতে পারি?” এই সংলাপের মধ্য দিয়ে গৌতম ঘোষ রাষ্ট্রীয় সীমান্তের বাইরে এক বৃহত্তর মানবিক রাজনীতি প্রস্তাব করেন—যেখানে মানুষ ও প্রকৃতি একসঙ্গে বাঁচে, কোনও জাতি বা ধর্মের বিভাজন ছাড়াই।

গৌতম ঘোষের সিনেমা রাজনৈতিক, কিন্তু তার রাজনীতি নীরব। তিনি কখনও বক্তব্য দেন না, কিন্তু প্রতিটি দৃশ্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার নীরব সমালোচনা। তিতাস একটি নদীর নাম বা ঋত্বিক ঘটকের সুবর্ণরেখা যেমন নদীকে সময়ের রক্তক্ষরণ হিসেবে ব্যবহার করেছিল, গৌতম ঘোষ তেমনি নদী, বৃষ্টি, কাদা, আলো—সবকিছু দিয়ে রাজনীতির এক কবিতার ভাষা তৈরি করেন। তাঁর চলচ্চিত্রে রাজনীতি আর নান্দনিকতা আলাদা নয়, বরং তারা একে অপরের প্রতিফলন।

তাঁর ছবির চরিত্ররা সচরাচর চিৎকার করে না, তারা হেঁটে যায়, তাকায়, নীরব থাকে। কিন্তু সেই নীরবতার ভেতরেই রাজনীতির অভিঘাত লুকিয়ে থাকে। তাহাদের কথা-র এক দৃশ্যে, উদ্বাস্তু নারী সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলে, “ওই পারেই তো আমাদের ঘর।” সেই সংলাপ কেবল একজন মানুষের নয়, বরং সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের আর্তনাদ।

গৌতম ঘোষের সিনেমার বিশেষত্ব এটাই—তিনি প্রান্তিক, দরিদ্র, নীরব মানুষকে কেন্দ্র করে এমন এক চলচ্চিত্রভাষা তৈরি করেছেন, যেখানে দর্শক রাষ্ট্রের বাইরে দাঁড়িয়ে মানবতার চোখে পৃথিবীকে দেখে। তাঁর সিনেমায় রাজনীতি চিৎকার নয়, এটি স্রোতের মতো ধীরে প্রবাহিত হয়।

গৌতম ঘোষ তাই শুধু পরিচালক নন, তিনি ইতিহাসের অন্তরালে থাকা মানুষের কবি। তাঁর ক্যামেরা যে মুখগুলো দেখে—তারা কোনও সংবাদের নায়ক নয়, কিন্তু তাদের জীবনই ভারতীয় সভ্যতার বাস্তব দলিল।

এভাবেই মৃণাল সেন, শ্যাম বেনেগাল, গোবিন্দ নিহালনি ও গৌতম ঘোষ—এই ধারাবাহিকতায় ভারতীয় রাজনৈতিক সিনেমা এক সম্পূর্ণ চক্র গঠন করে—যেখানে রাষ্ট্র, সমাজ, ইতিহাস ও মানুষ একে অপরের আয়না। আর এই পরিসরে সবচেয়ে অন্তর্মুখী কিন্তু দার্শনিক নির্মাতা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছেন মণি কৌল—যাঁর সিনেমা রাজনীতিকে রূপান্তরিত করে অস্তিত্বের তত্ত্বে, সময়ের বিমূর্ততায়।

মণি কৌল ভারতীয় সিনেমার ভাষায় এক বিপ্লব এনেছিলেন—কিন্তু তা কোনো রাজনৈতিক স্লোগানের বিপ্লব নয়, বরং এক দার্শনিক ও নান্দনিক চেতনার বিপ্লব। তাঁর সিনেমা দেখতে গেলে বোঝা যায়, রাজনীতি শুধুমাত্র রাষ্ট্র বা সমাজব্যবস্থার প্রশ্ন নয়; এটি সময়, স্মৃতি ও দেহের অভিজ্ঞতারও প্রশ্ন। মণি কৌল ছিলেন ঋত্বিক ঘটকের ছাত্র, কিন্তু তাঁর ভাষা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ঋত্বিকের সিনেমা যেমন আবেগ, ছন্দ ও উচ্চারণে ভরপুর, মণি কৌলের সিনেমা তেমনই নীরব, ধীর, আত্মবিমুখ। এই নীরবতা, এই ধীরতা—এটাই তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান।

তাঁর প্রথম ছবি উসকি রোটি (১৯৬৯) ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় মোড়। ছবিটি নির্মিত হয়েছিল গুরচরণ দাসের ছোটগল্প অবলম্বনে। এক পাঞ্জাবি নারী প্রতিদিন রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে তাঁর স্বামীর জন্য—তাঁর হাতে গরম রুটি, কিন্তু স্বামী আসে না। এই সাধারণ ঘটনা মণি কৌলের হাতে হয়ে ওঠে সময়ের দর্শন। এখানে গল্প বলতে গেলে প্রায় কিছুই ঘটে না—দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি, দীর্ঘ নীরবতা, মুখে হাওয়া লাগা, ধুলোর উড়ান—এসবই হয়ে ওঠে সিনেমার ভাষা।

উসকি রোটি-তে তিনি ক্যামেরাকে ব্যবহার করেন ধ্যানের যন্ত্র হিসেবে। সময় আর ঘটনাকে আলাদা করেন না। এক ফ্রেম দীর্ঘ সময় স্থির থাকে, এবং সেই স্থিরতার মধ্যে দর্শক বুঝতে পারে নারীটির নিঃসঙ্গতা ও অপেক্ষা কীভাবে এক অস্তিত্ববাদী প্রতীক হয়ে উঠছে। এই ছবিতে মণি কৌল রাজনৈতিক বক্তব্য দেন না, কিন্তু তাঁর এই ধীরতা—দর্শককে বাধ্য করে পুঁজিবাদী দ্রুততার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে। সময়কে ধীর করা, জীবনকে মন্থর করা—এটাই তাঁর বিপ্লবী ভাষা।

এর পরের ছবি আশাদ কা এক দিন (১৯৭১), মৈত্রেয়ী দেবীর উপন্যাস অবলম্বনে, যেখানে তিনি সময় ও স্মৃতির ভেতর দিয়ে প্রেম ও বেদনার রূপ বিশ্লেষণ করেন। ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র কবি কালিদাস ও মল্লিকা—কিন্তু এখানে কালিদাস কোনও ঐতিহাসিক চরিত্র নয়, বরং আত্মপরিচয়ের প্রতীক। এই সিনেমার সংলাপ কবিতার মতো, আলো যেন নিজেই ছন্দ তৈরি করে। এখানে ইতিহাস নেই, বরং ইতিহাসের ভেতর সময়ের আবেশ।

মণি কৌলের সিনেমায় নারী চরিত্র সবসময় সময়ের প্রতীক। দুবি (১৯৭9), নাজার (১৯৮৯), দাস্তকার—সব ক্ষেত্রেই নারী মানে সময়ের প্রবাহ, অপেক্ষা ও স্মৃতির পাথরচিহ্ন। তাঁর সিদ্ধেশ্বরী (১৯৮৯) ভারতীয় সিনেমার এক অনন্য সৃষ্টি—যেখানে সংগীতশিল্পী সিদ্ধেশ্বরী দেবীর জীবনী হয়ে ওঠে এক ধ্রুপদী আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান। এখানে সংগীত, শরীর, সময় ও আত্মা পরস্পরের মধ্যে মিশে যায়। এই ছবির বর্ণনা রৈখিক নয়—এটি যেন সঙ্গীতের আলাপের মতো।

রাজনীতি, ধর্ম, সময়—এই তিনটি উপাদান মণি কৌলের সিনেমায় মিলেমিশে যায়। তাঁর দৃষ্টিতে রাজনীতি মানে কেবল সিস্টেমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নয়, বরং জীবনের প্রতিটি স্তরে সময়ের অভিজ্ঞতাকে পুনরুদ্ধার করা। পুঁজিবাদ, প্রযুক্তি, শহুরে তাড়াহুড়ো—সবকিছু মানুষকে সময় থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। মণি কৌল এই বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে দাঁড়ান তাঁর ক্যামেরা দিয়ে।

তাঁর সিনেমা ‘অ্যান্টি-ন্যারেটিভ’, অর্থাৎ গল্পের বিরুদ্ধ। কিন্তু এর অর্থ গল্পের অনুপস্থিতি নয়, বরং গল্পের গতি, ধ্বনি, শ্বাস, ছন্দ—সবকিছুকে নতুনভাবে সাজানো। উদাহরণস্বরূপ, দুবি-তে নদীর প্রতিটি ঢেউ, বাতাসের প্রতিটি শব্দ, নারী চরিত্রের প্রতিটি দৃষ্টি—এগুলোই গল্পের অংশ। দর্শককে এখানে কিছু বোঝার জন্য নয়, অনুভব করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়।

মণি কৌলের সিনেমা ভারতীয় শিল্পসংস্কৃতির গূঢ় ধারার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত—বিশেষত ধ্রুপদী সংগীত, রাগ, তান, আলাপের কাঠামোর সঙ্গে। সিদ্ধেশ্বরী-তে তিনি চলচ্চিত্রকে রাগের আলাপে পরিণত করেন। প্রতিটি দৃশ্য রাগের মতো ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়, তারপর মিলিয়ে যায়। সময় এখানে রৈখিক নয়, বৃত্তাকার। এই বৃত্তাকার সময়-চেতনা ভারতীয় দর্শনের মূল সুর—যা পশ্চিমের লিনিয়ার ইতিহাসবোধের বিরুদ্ধে।

রাজনীতি এখানে লুকানো নয়—এটি গভীর। মণি কৌল দেখিয়েছেন, সংস্কৃতি ও দর্শনকেই রাজনীতির হাতিয়ার করা যায়, যদি তা প্রতিষ্ঠিত সময়ের কাঠামোকে প্রশ্ন করে। তাঁর সিনেমা প্রতিটি দৃশ্যে এই কাঠামো ভেঙে দেয়। তিনি দর্শককে কাহিনির ভেতর নিমজ্জিত না করে, কাহিনির বাইরে ফেলে দেন—যাতে দর্শক নিজেই চিন্তা করে, নিজেই পুনর্গঠন করে।

১৯৯২ সালের নাজার এক ভিন্ন স্তরে পৌঁছায়। এখানে তিনি নায়িকা কিরণ খেরকে নিয়ে নির্মাণ করেন এক আত্মচেতনার গল্প—এক নারীর অভ্যন্তরীণ সময়ের অনুধাবন। এটি যেমন সম্পর্কের গল্প, তেমনি চলচ্চিত্রের ভিতর চলচ্চিত্র তৈরির গল্প। তিনি এই সিনেমায় আলোক, শব্দ, ক্যামেরার দৃষ্টি—সবকিছুকে ভেঙে দেন, পুনর্গঠন করেন।

মণি কৌলের ভাষা এতটাই দার্শনিক যে অনেক দর্শক প্রথম দেখায় বিভ্রান্ত হয়। কিন্তু এই বিভ্রান্তিই তাঁর উদ্দেশ্য। তিনি দর্শককে আরাম দেন না। যেমন জীবনকে বোঝা যায় না সরলরেখায়, তেমনি তাঁর সিনেমাকেও বোঝা যায় না সরল গল্পে। এই অস্পষ্টতাই তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্য—জীবনের অস্পষ্টতা স্বীকার করা, সেটিকে অনুভব করা।

তাঁর এক সাক্ষাৎকারে মণি কৌল বলেছিলেন, “I don’t make films to tell stories, I make them to see how time breathes.” এই উক্তিটি তাঁর সিনেমার মর্ম। সময় কেমনভাবে নিঃশ্বাস নেয়, কেমনভাবে শব্দ করে, কেমনভাবে চুপ করে থাকে—এই সবই তাঁর ফ্রেমের রাজনীতি।

যদি মৃণাল সেন সমাজ ও রাষ্ট্রের সংঘাতকে তীব্র ব্যঙ্গ ও গতি দিয়ে প্রকাশ করেন, শ্যাম বেনেগাল বাস্তবতা ও মানবতাবাদে, গোবিন্দ নিহালনি ক্ষমতার কাঠামোতে, গৌতম ঘোষ প্রকৃতির নিঃশব্দ কবিতায়—তবে মণি কৌল রাজনীতিকে রূপান্তরিত করেন চেতনার আকারে। তাঁর সিনেমা অস্তিত্বের রাজনীতি, সময়ের রাজনীতি।

মণি কৌলের চলচ্চিত্রভাষা ভারতীয় সিনেমাকে আন্তর্জাতিকভাবে অনন্য করেছে। তাঁর প্রভাব দেখা যায় কিয়োসি কুরোসাওয়া থেকে পেদ্রো কস্তা পর্যন্ত নানা পরিচালকের মধ্যে, কিন্তু তাঁর শিকড় সম্পূর্ণ ভারতীয়। দুবি, সিদ্ধেশ্বরী, নাজার, আশাদ কা এক দিন—এই সমস্ত ছবিতে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে চলচ্চিত্র দর্শন, সংগীত ও আধ্যাত্মিকতার এক মিশ্র ভূখণ্ড হতে পারে।

তাঁর মৃত্যুর পর এক সাক্ষাৎকারে অরবিন্দন বা কুমার সাহানি বলেছিলেন—“মণি কৌল আমাদের শিখিয়েছেন, সিনেমা কেবল দৃশ্য নয়, এটি চিন্তার এক রূপ।” এই চিন্তার রূপই তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান। তাঁর সিনেমা প্রতিবাদের নয়, কিন্তু তা প্রতিটি ফ্রেমে প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতাকে অস্বীকার করে।

এইভাবেই মণি কৌল হয়ে ওঠেন ভারতীয় আধুনিক চলচ্চিত্রের দার্শনিক। তাঁর চলচ্চিত্রে রাজনীতি কোনও বিষয় নয়, এটি দৃষ্টি। সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক, ব্যক্তির সঙ্গে সময়ের সম্পর্ক, সময়ের সঙ্গে স্মৃতির সম্পর্ক—এই ত্রিভুজের মধ্যে তিনি রাজনীতি খুঁজে পান।

এবং এখানেই ভারতীয় রাজনৈতিক চলচ্চিত্রচিন্তার চূড়ান্ত পরিণতি। মৃণাল সেন যেখানে শুরু করেছিলেন রাস্তায়, শ্যাম বেনেগাল নিয়ে গিয়েছিলেন সমাজে, গোবিন্দ নিহালনি নিলেন রাষ্ট্রের ভিতরে, গৌতম ঘোষ ফিরিয়ে আনলেন মাটির দিকে, আর মণি কৌল—তিনি ফিরিয়ে নিলেন সময়ের অন্তরে।

তাঁদের সম্মিলিত সাধনায় ভারতীয় সিনেমা কেবল রাজনৈতিক বক্তব্যের মাধ্যম হয়নি, বরং এক চিন্তাশীল সভ্যতার আয়না হয়ে উঠেছে—যেখানে মানুষ, ইতিহাস, প্রকৃতি ও সময়—সব মিলেমিশে গড়ে তুলেছে স্বাধীন চলচ্চিত্রভাষা, এক স্বতন্ত্র ভারতীয় আধুনিকতা।

স্বাধীনতার পর ভারতীয় সিনেমা একসময় সমাজচিন্তার সবচেয়ে উজ্জ্বল মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের বাণিজ্যিক সিনেমার ভেতরেও মানবিক আদর্শ, দেশভাগের বেদনা, শ্রেণি ও নৈতিকতার প্রশ্ন উঠে আসত। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, বিমল রায়, গুরু দত্ত বা রাজ কাপুর — সবাই তাঁদের নিজস্ব উপায়ে সমাজের প্রশ্নে সাড়া দিতেন। ষাট ও সত্তরের দশকে সেই সাড়া আরও সরাসরি রাজনৈতিক হয়ে উঠল, যখন মৃণাল সেন বা শ্যাম বেনেগালের মতো পরিচালকরা রাষ্ট্র, শহর, বেকারত্ব, যুববিদ্রোহ ও নৈতিক সংকট নিয়ে একে একে সিনেমা তৈরি করলেন। সেই ধারার ভেতরেই মণি কৌল সিনেমাকে দর্শনের স্তরে নিয়ে গেলেন, গোবিন্দ নিহালনি রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও নৈতিক সংকটের দিকে মনোযোগ দিলেন, গৌতম ঘোষ প্রকৃতির মধ্যে মানুষকে ফের খুঁজলেন। কিন্তু আশির দশকের পর, বিশেষ করে নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে ভারতীয় সিনেমায় এক মৌলিক পরিবর্তন দেখা দেয়—যেখানে রাজনীতি ধীরে ধীরে পিছিয়ে যায়, আর তার জায়গা নেয় বাজার, ভোক্তা, আত্মপরিচয়ের নতুন এক ধারণা।

এই পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থার রূপান্তর। ১৯৯১ সালে ভারতের অর্থনৈতিক উদারীকরণের পর যে নতুন অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা তৈরি হয়, তা শুধু বাজারে নয়, মানুষের চিন্তায়ও এক নতুন মধ্যবিত্ত মানসিকতা তৈরি করে। সিনেমা তখন রাষ্ট্র বা সমাজের প্রতিবিম্ব নয়, বরং শহুরে ভোগবাদের আয়না হয়ে ওঠে। হিন্দি সিনেমা বিশেষত এই সময় থেকে নতুন কায়দায় বদলে যায় — একদিকে মশলাদার প্রেম, বিলাসিতা ও ব্যক্তিগত সাফল্যের গল্প (দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে যায়েঙ্গে, কভি খুশি কভি গম), অন্যদিকে শহুরে বিচ্ছিন্নতা ও ব্যক্তিগত মানসিক উদ্বেগ (দিল চাহতা হ্যায়, রক অন প্রভৃতি)। এসব সিনেমায় রাজনীতি অনুপস্থিত নয়, কিন্তু তা আর সমাজ বা রাষ্ট্রের বিরোধ নয়, বরং আত্মপরিচয় ও ব্যক্তিসত্তার সংকটের আকারে উঠে আসে।

মৃণাল সেন বা নিহালনির সময় দর্শক দেখেছিল বেকারত্ব, দারিদ্র্য, কৃষক-শ্রমিক আন্দোলন, রাষ্ট্রীয় সহিংসতা বা নৈতিক পতনের প্রশ্ন সিনেমার কেন্দ্রে। নব্বইয়ের পর সেই প্রশ্নগুলো ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল। কারণ সমাজই বদলে যাচ্ছিল। টেলিভিশন ও গ্লোবাল মিডিয়া এক নতুন “ভিজ্যুয়াল কালচার” তৈরি করেছিল, যেখানে দর্শক বাস্তবতার বদলে রোম্যান্টিক ও পালানো বাস্তবতাকে চাইতে শুরু করে। সিনেমা হয়ে ওঠে বিনোদনের শিল্প, আত্মপর্যালোচনার শিল্প নয়।

তবে এই সরে যাওয়া পুরোপুরি বিলুপ্তি নয়; বরং রাজনৈতিক চেতনা নতুন রূপে পুনর্জন্ম নেয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০০০-এর দশকে অনুরাগ কাশ্যপ, বিশাল ভরদ্বাজ, রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরা প্রমুখ পরিচালকরা অন্য ধরনের রাজনীতি আনলেন — এটি রাষ্ট্র বা আদর্শের নয়, বরং সমাজের অন্ধকার মনস্তত্ত্বের রাজনীতি। ব্ল্যাক ফ্রাইডে বা গ্যাংস অব ওয়াসেপুর সরাসরি রাষ্ট্রীয় বা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার গল্প হলেও, সেগুলো মৃণাল সেনের মতো মতাদর্শিক প্রতিক্রিয়া নয়, বরং বাস্তবতার অন্ধকার বিশ্লেষণ। সিনেমা এখানে প্রতিবাদের চেয়ে পর্যবেক্ষণের শিল্প হয়ে যায়।

একই সময়ে আঞ্চলিক সিনেমা, বিশেষত মালয়লম, তামিল, বাংলা ও মারাঠি সিনেমা, এক ভিন্ন দিক ধরে এগোয়। মলয়লম সিনেমায় আধুনিক রাজনৈতিক ভাবনা আম্মু, জল্লিকাট্টু, জয় জয়া জয় হে–এর মতো ছবিতে আত্মপ্রকাশ পায়, কিন্তু এই রাজনীতি প্রাত্যহিক ও অস্তিত্বমূলক। আগে যেখানে রাজনীতি মানে ছিল মার্ক্সবাদী বা সমাজতান্ত্রিক আদর্শ, এখন রাজনীতি মানে ব্যক্তিগত নৈতিকতা, লিঙ্গ, দেহ, পরিবেশ ও ভাষার লড়াই। যেমন হিন্দি সিনেমায় আর্টিকেল ১৫ বা নিউটন, তামিল সিনেমায় কর্ণন বা জয়ভীম — এই সিনেমাগুলো আবার রাজনৈতিক আলোচনাকে ফিরিয়ে আনে, কিন্তু সেটি আর রাষ্ট্রবিরোধী নয়, বরং ন্যায়ের নৈতিক বোধের রূপে।

এই পরিবর্তনের পেছনে দুটি বড় কারণ কাজ করে — এক, শিল্পের আর্থিক নির্ভরতা ও সেন্সর ব্যবস্থার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ; দুই, দর্শকের নতুন রুচি ও মানসিক অবস্থান। সত্তর ও আশির দশকের দর্শক ছিলেন রাজনৈতিক বাস্তবতার অংশগ্রহণকারী — তারা জানতেন জরুরি অবস্থা, খাদ্যাভাবে, ধর্মীয় বিভাজনে সমাজ কীভাবে ভুগছে। আজকের দর্শক তথ্যযুগের মানুষ; তার রাজনীতি হলো টুইট, মিম, অনলাইন প্রতিবাদ। ফলে সিনেমা বাস্তব আন্দোলনের বদলে প্রতীকী অবস্থান নেয়। রাজনৈতিক বক্তব্যকে এখন গল্পের ছদ্মবেশে ঢেকে দেওয়া হয়, যেন তা বিনোদনের ছাঁচে ফিট হয়।

তবে এই “সরে যাওয়া” অনেক সময়ই আড়াল করা উপস্থিতি। শ্যাম বেনেগালের উত্তরাধিকার দেখা যায় আজকের ছপাক, থার্টি নেমড মে, পিঙ্ক–এর মতো ছবিতে, যেখানে নারীস্বাধীনতা ও দেহরাজনীতি নতুন অর্থ পায়। গোবিন্দ নিহালনির বাস্তববাদী ক্যামেরা রীতি প্রভাব ফেলেছে অমিত মসুরকর বা রাজকুমার হিরানির মতো পরিচালকদের সিনেমাতেও, যদিও তাঁরা রাজনৈতিকতার বদলে মানবিক ব্যঙ্গের দিকটি গ্রহণ করেছেন।

বাংলা সিনেমায়ও পরিবর্তন স্পষ্ট। ঋত্বিক বা মৃণাল সেনের উত্তরাধিকার বহন করেছেন কিছু পরিচালক—রিতুপর্ণ ঘোষ তাঁর নিজস্ব আবেগিক রাজনীতির মধ্য দিয়ে, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় বা অতনু ঘোষ শহুরে বৌদ্ধিক মানসিকতা নিয়ে। কিন্তু এঁদের সিনেমা সরাসরি রাষ্ট্র বা শ্রেণির রাজনীতি নয়; এটি আত্ম, পরিবার ও পরিচয়ের রাজনীতি। ফলে রাজনৈতিক চেতনা এখানে ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে।

এই রূপান্তর আসলে বিশ্বচলচ্চিত্রের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটের অংশ। আশির দশকের পর বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক সিনেমার ধারা বদলে যায় — ফরাসি নিউ ওয়েভের উত্তরাধিকার মিইয়ে আসে, লাতিন আমেরিকার তৃতীয় বিশ্বের সিনেমা আন্দোলন স্তিমিত হয়, সমাজতন্ত্র পতনের পর আদর্শের জায়গা নেয় ব্যক্তির মুক্তি ও মানসিক পরিসর। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। ফলে ভারতীয় পরিচালকরা মার্ক্সবাদী বা সমাজতান্ত্রিক মতবাদের বদলে অস্তিত্ববাদ, মনস্তত্ত্ব, লিঙ্গ ও পরিচয়বোধের দিকে চলে যান।

তবু এই পরিবর্তনের ভেতরেও কিছু প্রতিরোধ আছে। উদাহরণস্বরূপ, মারাঠি পরিচালক নন্দিতা দাস, সুধীর মিশ্র,  বা নীরজ ঘায়ওয়ানের মতো নির্মাতারা আবার রাজনৈতিক সিনেমাকে নতুন ভঙ্গিতে ফিরিয়ে আনেন। তাঁরা রাষ্ট্রবিরোধিতা নয়, বরং প্রাত্যহিক ন্যায়বোধ, জাত, লিঙ্গ ও ইতিহাসের প্রশ্ন নিয়ে কথা বলেন। যেমন মাসান, সেরিয়াস ম্যান, মণিকর্ণিকা বা জুবিলি—এই সিনেমাগুলো আর আগের মতো “রাজনৈতিক” নয়, কিন্তু রাজনীতিকে মানুষের জীবনের ছায়া হিসেবে স্থাপন করে।

যদি তুলনা করা যায়, মৃণাল সেন বা গোবিন্দ নিহালনির সময় রাজনীতি ছিল বহির্জগতের প্রশ্ন, এখন তা অন্তর্জগতের প্রশ্ন। আগে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছিল, এখন আত্মার ভিতরের অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই। এই পরিবর্তন কোনো পশ্চাদপসরণ নয়, বরং সমাজচেতনার নতুন স্তর। তবে সমস্যা হলো, এই নতুন স্তর অনেক সময় ভোগবাদ ও আত্ম-আবিষ্টতায় ডুবে যায়, ফলে সিনেমা হয়ে পড়ে পরিশ্রুত নান্দনিক পণ্য।

রাজনৈতিক সিনেমার এই সরে যাওয়ার আরেকটি কারণ হলো শিল্পের পরিসরের সংকোচন। আজ যেভাবে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম সিনেমার প্রেক্ষাগৃহ দখল করেছে, তাতে দর্শক আর সিনেমাকে “ঘটনা” হিসেবে দেখে না। মৃণাল সেনের পদাতিক বা নিহালনির আরধ সৎয় যখন মুক্তি পেয়েছিল, সেটি ছিল বুদ্ধিজীবী আলোচনার কেন্দ্র। এখন সিনেমা দ্রুত গ্রাস করা হয়, স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায়। এই ক্ষণস্থায়ীতার যুগে সিনেমা রাজনৈতিক হোক, তা দর্শক চায় না; বরং তাৎক্ষণিক আনন্দ বা চিন্তার ঝলকই যথেষ্ট।

তবে এই সরে যাওয়া মানেই যে রাজনৈতিক ভাবনা শেষ, তা নয়। বরং এখন সেটি আরও সূক্ষ্ম, প্রতীকময় ও ব্যক্তিনির্ভর হয়ে উঠেছে। যেমন কুড়ানঙ্গি নাইটস, চূড়েলস, বুলবুল, জয়া জয়া জয়া হে—এইসব সমসাময়িক কাজ নারীবাদ, লিঙ্গ ও ক্ষমতার নতুন রাজনীতি হাজির করছে। এটি একধরনের মাইক্রো-পলিটিক্স—যেখানে প্রতিরোধ ব্যক্তিগত, কিন্তু তার প্রভাব সামাজিক।

ফলে বলা যায়, মণি কৌল, মৃণাল সেন বা গোবিন্দ নিহালনির মতো রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের যুগ শেষ হয়নি; বরং রূপান্তরিত হয়েছে। তাঁদের সিনেমা ছিল চিন্তার সিনেমা, আজকের সিনেমা অভিজ্ঞতার। আগে রাজনীতি ছিল চেতনার কেন্দ্র, এখন তা নান্দনিকতার প্রান্তে লুকানো।

এই লুকানো রাজনীতি হয়তো আরও বিপজ্জনক, কারণ তা দর্শকের অচেতন মনকে প্রভাবিত করে। মৃণাল সেন একবার বলেছিলেন, “সিনেমা যদি সময়ের সঙ্গে পালিয়ে না যায়, তবে সে সময়কে বদলাতে পারে।” আজকের ভারতীয় সিনেমা সময়ের সঙ্গে পালাচ্ছে, কিন্তু মাঝেমধ্যে তার ফ্রেমে এখনো জেগে ওঠে প্রতিবাদের এক ঝলক—যেমন রাজ্যের গ্রামীণ জীবন বা প্রান্তিকতার গল্পে।

তাই বলা যায়, ভারতীয় সিনেমা থেকে রাজনীতি পুরোপুরি সরে যায়নি, বরং তার রূপ পাল্টেছে। মার্ক্সবাদী সমাজচিন্তার জায়গা নিয়েছে মানসিক, লিঙ্গভিত্তিক, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক রাজনীতি। গোবিন্দ নিহালনি বা শ্যাম বেনেগালের মতো পরিচালকের সরাসরি রাষ্ট্রীয় সমালোচনা আজ বিরল, কিন্তু তাদের উত্তরাধিকার বহন করছে এক নতুন প্রজন্ম, যারা রাজনীতিকে আত্মের প্রশ্ন হিসেবে দেখে।

আজকের ভারতীয় চলচ্চিত্রের এই অবস্থা একদিকে বাস্তবতার স্বীকারোক্তি, অন্যদিকে নীরব প্রতিবাদ। কারণ যতদিন সিনেমা মানুষের কথা বলবে—ভয়, অসমতা, প্রেম, দেহ, সময়, মৃত্যু—ততদিন সে রাজনৈতিকই থাকবে, যদিও তা আর মঞ্চের ভাষায় নয়, বরং নীরবতার শব্দে।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes