
ভারতীয় সিনেমার নীলকণ্ঠ
হিন্দোল ভট্টাচার্য
ঋত্বিক ঘটক ছিলেন ভারতীয় সিনেমার এক অবিস্মরণীয় সংলগ্ন সত্তা, যিনি সিনেমাকে কেবল শিল্প হিসেবে নয়, সময়ের গভীর সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক সংকটের ভাষা হিসেবে দেখেছিলেন। তাঁর সিনেমা কখনোই সহজ বিনোদন ছিল না; তা ছিল আত্মশুদ্ধির এক যাত্রা, মানবতার হারানো মূল্যবোধের এক শোকগাথা। ভারতীয় চলচ্চিত্রে যখন বাণিজ্যিকতার প্রলোভন ও মধ্যবিত্ত আত্মতুষ্টির মায়া বেড়ে উঠছে, তখন ঋত্বিক ঘটক সেই পথের একদম বিপরীতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, “Cinema is a weapon, a powerful weapon in the service of truth.” এই সত্য-সন্ধানই তাঁর জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। তাঁর প্রতিটি ছবি যেন এক একটি দ্রোহ, যেখানে দেশভাগের ক্ষত, মানুষের নির্বাসন, ইতিহাসের অনিশ্চয়তা, এবং প্রেমের গভীর মানবিক ব্যঞ্জনা একসঙ্গে মিশে যায়।
ঋত্বিক ঘটকের শেষ ছবি ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ এই ভাবনাগুলির চূড়ান্ত সমাহার। ছবিটি নির্মিত হয় ১৯৭৪ সালে, যখন ঋত্বিক জীবনের শেষ প্রান্তে, মানসিক ও শারীরিক ক্লান্তিতে জর্জরিত, তবু সৃষ্টিশীলতার আগুনে দীপ্ত। এই চলচ্চিত্রে তিনি নিজেই অভিনয় করেন নীলকণ্ঠ বাগচী চরিত্রে—এক জন পাগল, শিক্ষক, মদ্যপ, এবং এক সীমান্তহীন মানবিক সত্তা, যে নিজের ভিতরে লড়াই করে যাচ্ছে বুদ্ধি, যুক্তি, তর্ক ও গল্পের মধ্য দিয়ে। এই চরিত্রের মধ্যেই ঋত্বিক নিজের সমস্ত দার্শনিক, রাজনৈতিক ও অস্তিত্ববাদী ভাবনা উজাড় করে দিয়েছেন। চলচ্চিত্রের শুরুতেই নীলকণ্ঠ বলেন, “আমি এক যাযাবর, কোনো ঘর নেই, কোনো দেশ নেই—তবু আমি মানুষ।” এই সংলাপই ঘটকের সমগ্র দর্শনের প্রতিধ্বনি। দেশভাগের পর তিনি যেভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষদের কষ্টকে নিজের শরীরে ধারণ করেছিলেন, সেই যন্ত্রণা তাঁর সমস্ত ছবির রক্তধারায় প্রবাহিত।
ঋত্বিক ঘটকের সিনেমার ভাষা তাঁর সময়ের সব পরিচালকের থেকে আলাদা। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা যেখানে সংযত, শাস্ত ও মানবিক বাস্তবতার চিত্র, সেখানে ঘটকের সিনেমা হলো বিস্ফোরণ—কবিতা, নাটক, চিৎকার, কান্না, স্মৃতি ও আশার এক সুরেলা সংঘর্ষ। তাঁর সিনেমা মিথ, লোককথা, ইতিহাস ও রাজনীতির এক অনন্য মিশ্রণ। ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘সুবর্ণরেখা’ থেকে ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’—সবখানেই তিনি সেই অনির্বচনীয় মানবিক ট্র্যাজেডির কাহিনি বলেন, যেখানে দেশভাগ শুধু রাজনৈতিক নয়, অস্তিত্বের এক বিভাজন। তাঁর প্রিয় সংলাপ—“দিদি, আমি বাঁচতে চাই”—শুধু নীতার নয়, ঘটকের নিজস্ব আর্তি, এক শিল্পীর, যে সমাজের মধ্যে সত্যের জন্য চিৎকার করছে।
ঋত্বিকের চলচ্চিত্র ভাবনায় এক গভীর সাহিত্যিক গন্ধ আছে। তিনি রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল, জীবনানন্দের উত্তরসূরি এক চলচ্চিত্রকবি। তাঁর প্রতিটি শট যেন একটি কবিতা, প্রতিটি সংলাপ এক একটি মন্ত্র। তিনি একবার বলেছিলেন, “Cinema is like poetry in motion; every cut, every dissolve, every silence must have a rhythm.” এই রিদম তিনি পেয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের অভ্যন্তরীণ সুর থেকে। তাঁর সিনেমায় বারবার দেখা যায় ছন্দ ও শব্দের সংবেদনশীলতা—যেভাবে রবীন্দ্রনাথের গানে বেদনা ও আশার মিশেল ঘটে, সেভাবেই ঘটকের সিনেমায় বাস্তব ও মিথ একাকার হয়ে যায়। যেমন ‘মেঘে ঢাকা তারা’-য় মেঘের প্রতীক বারবার ফিরে আসে নীতার জীবনে ছায়ারূপে, তেমনি ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’-তে যুক্তি ও তর্কের সংঘাতে জন্ম নেয় এক নতুন ধরনের গল্প, যেখানে বাস্তবতার ভিতর দিয়ে স্বপ্নের আলো জ্বলে।
ঋত্বিক ঘটকের ভাবনার আন্তর্জাতিকতা নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। তিনি নিজে একাধিকবার স্বীকার করেছিলেন যে, আইজেনস্টাইন, পুডভকিন, ব্রেখট, গোদার, পাসোলিনি, বুনুয়েল—এই সকল ইউরোপীয় ও রুশ শিল্পীদের প্রভাব তাঁর কাজে গভীরভাবে উপস্থিত। কিন্তু তিনি কখনোই তাঁদের নকল করেননি। বরং তিনি বলতেন, “I am not a disciple of Eisenstein; I am his inheritor.” তিনি আইজেনস্টাইনের মঁতাজের ধারণাকে ভারতীয় মাটিতে রূপান্তরিত করেছিলেন। তাঁর ছবিতে মঁতাজ কখনোই শুধুই প্রযুক্তিগত নয়—এটি হলো আবেগের সংঘর্ষ, সময়ের ভাঙন, স্মৃতির পুনর্গঠন। যেমন ‘সুবর্ণরেখা’-য় রেললাইন বারবার ফিরে আসে—একদিকে প্রগতি, অন্যদিকে বিভাজন; একদিকে গন্তব্য, অন্যদিকে অন্ধকার। এই মঁতাজের ভাষা বিশ্বচলচ্চিত্রে নতুন ব্যাকরণ যোগ করেছে।
গোদার একবার বলেছিলেন, “Ritwik Ghatak was perhaps the only filmmaker from India whose films spoke an international language of sorrow.” এই বক্তব্যের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক গভীর সত্য। ঘটকের সিনেমা যেমন জাতিগত ও রাজনৈতিক ইতিহাসের বয়ান, তেমনি তা সার্বজনীন মানবতার কণ্ঠস্বর। তিনি বাঙালির যন্ত্রণাকে এমনভাবে রূপায়িত করেছিলেন, যা আফ্রিকার উপনিবেশ, ইউরোপের যুদ্ধোত্তর সমাজ, কিংবা লাতিন আমেরিকার বিপ্লবী বাস্তবতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। তাঁর চলচ্চিত্র এক ধরনের তৃতীয় বিশ্বের ট্র্যাজেডি—যেখানে শোষণ, স্থানচ্যুতি, এবং আত্মপরিচয়ের সংকট মিলেমিশে এক সার্বজনীন দুঃখের ভাষা তৈরি করে। এজন্যই পিটার ওয়েলেন, কুমার শাহানি, মণি কৌল থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রজন্মের অনেকে তাঁকে “the first truly global Indian filmmaker” বলে অভিহিত করেছেন।
‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ এই আন্তর্জাতিকতারই এক চূড়ান্ত অভিব্যক্তি। ছবিটি কাঠামোগতভাবে প্রায় থিয়েটারের মতো—ব্রেখটীয় এলিয়েনেশন, দার্শনিক সংলাপ, রাজনৈতিক ব্যঙ্গ, এবং এক অন্তহীন প্রশ্নবোধের নাটক। এখানে কাহিনি নয়, ভাবনাই মুখ্য। নীলকণ্ঠ বাগচীর ভেতর দিয়ে ঋত্বিক নিজেই এক আত্মসমালোচনার পথ ধরেন। তাঁর স্ত্রী দুর্গা (যাঁর ভূমিকায় বীণা) এবং ছাত্র শঙ্খ (অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়)—এই দুই চরিত্র যেন সমাজ ও পরবর্তী প্রজন্মের প্রতীক। নীলকণ্ঠের কথায়, “তুমি জানো, শঙ্খ, এই দেশটা মরে যাচ্ছে। মানুষ ভুলে গেছে কান্না করতে।” এই সংলাপ শুধু ছবির নয়, গোটা সময়ের এক ব্যথিত দলিল। ১৯৭০-এর রাজনৈতিক অস্থিরতা, নকশালবাড়ির উত্তাল দিন, মধ্যবিত্ত সমাজের আত্মগ্লানি—সবকিছু মিলেমিশে তৈরি করে এক তীব্র আত্মচেতনা। নীলকণ্ঠ যেন একপ্রকার ভগ্ন যুগের দ্রষ্টা, যিনি জানেন, “We are finished, my friend, but we must sing.”
ঋত্বিক ঘটক তাঁর সিনেমায় শব্দ ও সংগীতের ব্যবহারকে এক নতুন স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি সংগীতকে কখনোই পটভূমি হিসেবে নয়, বরং একটি চরিত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। রবীন্দ্রসংগীত, লোকগান, বাউলসুর, কীর্তন—সবকিছু তাঁর ছবিতে আসে অর্থবহ প্রতীক হিসেবে। ‘মেঘে ঢাকা তারা’-য় ‘জয় জয় দেবী’ সংগীত যেমন নীতার অন্তর্লীন শক্তির প্রকাশ, তেমনি ‘কোমল গান্ধার’-এ ‘একি লাবণ্য পূর্ণ প্রাণে’ হয়ে ওঠে ঐক্যের সন্ধান। তাঁর সিনেমায় শব্দ যেন সময়ের প্রতিধ্বনি। ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’-তে বারবার শোনা যায় শঙ্খধ্বনি ও হাঁড়ির শব্দ—যা একদিকে আচার, অন্যদিকে ধ্বংসের প্রতীক। এই দ্ব্যর্থকতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে ঘটকের শিল্পের শক্তি—তিনি একই সঙ্গে সমাজের রীতি ও তার ভাঙনের কথা বলেন।
ঋত্বিক ঘটকের জীবনের যন্ত্রণাগুলোও তাঁর সিনেমার অংশ। তিনি শৈশবে দেখেছিলেন দেশভাগের বিভীষিকা, পূর্ববঙ্গ থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের অসহায়তা। এই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই তাঁর প্রতিটি ছবিতে রাজনৈতিক হয়ে ওঠে। তিনি বলতেন, “Partition was not only political; it tore apart the human soul.” তাই তাঁর চলচ্চিত্রে কোনো মেকি দেশপ্রেম নেই, আছে হারানো স্বপ্নের শোক। ‘সুবর্ণরেখা’-র একটি দৃশ্যে যখন ঈশ্বর ও সীতা নদীর ধারে বসে, হঠাৎ বাচ্চার কণ্ঠে শোনা যায়, “মা, এই নদীটা কেন এমন লাল?”—এই প্রশ্নটি যেন ঘটকের নিজের প্রশ্ন, ইতিহাসের রক্তধারায় ভিজে যাওয়া মানুষের প্রতি এক আর্তনাদ।
ঋত্বিক ঘটকের প্রভাব ভারতীয় চলচ্চিত্রের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। মণি কৌল একবার বলেছিলেন, “Without Ritwik, Indian cinema would have been a flat surface. He gave it depth.” তাঁর মঁতাজ, প্রতীক, সাউন্ডস্কেপ, এবং চরিত্রের ট্র্যাজিক ট্রান্সফরমেশন ভারতীয় আর্ট সিনেমার ভাষাকে নতুন সংজ্ঞা দেয়। ‘কোমল গান্ধার’-এর মধ্যে যেমন নাট্যজগতের বাস্তব ও কল্পনার দ্বন্দ্ব আছে, তেমনি তা ভারতের সামাজিক বিভেদের প্রতীকও। তাঁর সিনেমা ছিল আধুনিকতার সঙ্গে ঐতিহ্যের মিলনক্ষেত্র—যেখানে বাউল আর আইজেনস্টাইন একসঙ্গে কথা বলে। এই দ্বৈততা থেকেই তৈরি হয় তাঁর চলচ্চিত্রভাষার জাদু।
তাঁর সমসাময়িক সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেনের সঙ্গে তুলনা করলে বোঝা যায়, ঘটকের পথ কত ভিন্ন। রায় ছিলেন পরিমিত ও ক্লাসিক্যাল; মৃণাল রাজনৈতিক ও সমাজনিষ্ঠ; কিন্তু ঋত্বিক ছিলেন অন্তর্দর্শনের আগুন—যিনি নিজের ক্ষত দিয়ে সময়ের মুখে আঙুল তুলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “I am not interested in beauty; I am interested in truth.” এই সত্যের প্রতি অবিচল নিষ্ঠাই তাঁকে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র ইতিহাসে অনন্য করে তুলেছে।
ঋত্বিকের সিনেমায় ‘লোককথা’ ও ‘আধুনিকতা’র সংমিশ্রণ এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ভারতীয় সংস্কৃতির মাটি থেকেই জন্ম নিতে হবে আধুনিক চলচ্চিত্রের ভাষা। তাই তাঁর সিনেমায় দেখা যায় পুরাণ, লোকসংগীত, থিয়েটার, যাত্রা, ছায়ানাট্য—সবকিছু সিনেমাটিকভাবে মিশে গেছে। এইভাবে তিনি পশ্চিমের মঁতাজ ও পূর্বের মিথকে একাকার করে ফেলেছিলেন, যা বিশ্বচলচ্চিত্রে এক নতুন ধারা তৈরি করে।
‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ শুধু তাঁর শেষ ছবি নয়, তাঁর শিল্পজীবনের আত্মসমীক্ষা। এখানে তিনি যেন নিজের সঙ্গে বিতর্ক করছেন, নিজের বিশ্বাসকে প্রশ্ন করছেন। নীলকণ্ঠ বলেন, “যত দিন মানুষ আছে, তত দিন প্রশ্ন থাকবে।” এই সংলাপ তাঁর উত্তরাধিকার—এক এমন প্রশ্নবোধ যা ভারতীয় চলচ্চিত্রকে চিরকাল চিন্তা করাবে।
ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রকে যদি কেবল রাজনৈতিক ইতিহাসের ভাষ্য বলা হয়, তবে তা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, কারণ তাঁর সিনেমা একইসঙ্গে বাঙালির আদি পুরাণচেতনা, লোকবিশ্বাস, মিথ ও প্রতীকের এক গূঢ় প্রতিরূপ। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মানুষের ইতিহাস কেবল ঘটনাবলীর ধারাবাহিকতা নয়, বরং এক গভীর সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের স্রোত, যা আদিকাল থেকে বয়ে এসেছে পুরাণ, গান, গাথা, কাহিনি, লোকসংস্কৃতি ও ধর্মীয় প্রতীকের মাধ্যমে। এই উত্তরাধিকারই বাঙালির চেতনার অন্তর্গত প্রাণ। ঋত্বিক ঘটক ছিলেন সেই প্রাণের চলচ্চিত্র-ব্যাখ্যাতা। তিনি চলচ্চিত্রকে ব্যবহার করেছিলেন এক ধরনের “লোকপুরাণীয় ব্যাখ্যার” আধুনিক মাধ্যম হিসেবে, যেখানে বাস্তব ও মিথ, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক, ব্যক্তিগত ও ঐতিহাসিক — সব স্তর একসঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়।
ঋত্বিক ঘটকের পুরাণচেতনা কোনো ধর্মীয় ভক্তি নয়; বরং তা এক সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান। দেশভাগ-পরবর্তী বাংলা ছিল ভগ্ন, ছিন্ন, বাস্তুচ্যুত — মানুষ হারিয়েছিল তাদের ভূমি, ভাষা, স্মৃতি, এবং আস্থা। এই ভয়াবহ বিভাজনের মধ্যে ঋত্বিক খুঁজে পেয়েছিলেন মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের প্রতিধ্বনি, রামায়ণের নির্বাসনের প্রতীক, দুর্গার আশ্রয়প্রার্থনা, সতীর আত্মবিসর্জনের শোক। তাঁর সিনেমায় এসব পুরাণীয় ছায়া শুধু আখ্যানের অলঙ্কার নয়, বরং বাঙালির আত্মিক আঘাতের প্রতীকী ভাষা। তিনি বলতেন, “আমাদের পুরাণই আমাদের ইতিহাস। ওখানেই আমরা নিজেদের হারানো মুখ দেখতে পাই।” এই দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর সিনেমাগুলি এক নতুন মাত্রা পায় — ইতিহাস ও পুরাণের মেলবন্ধন হিসেবে।
‘মেঘে ঢাকা তারা’-তে আমরা দেখি, নীতা নামের এক তরুণী তার পরিবারকে বাঁচাতে নিজের জীবন উৎসর্গ করে। নীতা শুধু এক বাস্তুচ্যুত মেয়ে নয়, সে আসলে দুর্গা, সতী, কিংবা মা-আর্কিটাইপের পুনর্জন্ম। সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নীতার চরিত্রে রয়েছে এক মায়ের ত্যাগ, এক সতীর নীরব যন্ত্রণা, এবং এক দেবীর মানবিক রূপ। সে সংসারের ভার বইছে, সকলের জন্য নিঃশেষ হচ্ছে, অথচ কেউ তার যন্ত্রণা বোঝে না। শেষের সংলাপ “দাদা, আমি বাঁচতে চাই”—এই আর্তি যেন দুর্গার দোলনা থেকে মানবতার মৃত্যুবেদনা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। নীতা যেন সেই চিরন্তন নারী, যিনি ইতিহাসের প্রতিটি পর্বে সমাজের উদ্ধারকর্তা, অথচ নিজেই নিঃশেষ হন। এই ট্র্যাজিক আর্কিটাইপ ঋত্বিকের প্রায় সমস্ত চলচ্চিত্রেই দেখা যায়।
‘সুবর্ণরেখা’-তে সীতা নামের চরিত্রটি এই পুরাণীয় উত্তরাধিকারেরই আরেক প্রতীক। এখানে সীতা মানে কেবল এক মেয়ে নয়, সে রামায়ণের সীতার আধুনিক অবতার—যাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে সমাজের নৈতিকতার নামে। সিনেমায় নদীর নাম “সুবর্ণরেখা”—যেন লক্ষ্মণের আঁকা সীমারেখা, যার ওপারে চলে গেলে ধ্বংস অনিবার্য। কিন্তু ঋত্বিকের সীতা সেই সীমারেখা অতিক্রম করে, কারণ তার ভাগ্যই নির্বাসন। তার আত্মহত্যা একরকম সতীর আত্মবিসর্জন। নদীর তীরে সেই লাল জলের দৃশ্য যেন প্রতীক হয়ে ওঠে সভ্যতার রক্তমাখা বিবেকের। ঋত্বিক এইভাবে পুরাণীয় কাহিনিগুলিকে নতুন অর্থ দেন—তিনি সীতাকে আর দেবী হিসেবে নয়, বরং এক নিঃসহায় মানুষ হিসেবে দেখান, যিনি নিজের শরীর আর আত্মার মাঝখানে বন্দি।
‘কোমল গান্ধার’-এ আমরা পাই অন্য এক পুরাণীয় স্তর—এখানে আর কোনো দেব-দেবী নেই, আছে হারানো মিলনের অনুসন্ধান। ঘটক নাটকের দল ‘আনন্দমঞ্চ’-এর বিভক্তির কাহিনির মাধ্যমে দেখান, কীভাবে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐক্য ভেঙে গেছে। এই ছবিতে বাণী ও বিমলের সম্পর্ক রবীন্দ্রীয় “উত্তর-রাধাকৃষ্ণ” আর্কিটাইপের মতো—তারা একে অন্যের প্রতি আকৃষ্ট, কিন্তু ঐক্য অসম্ভব। শেষ দৃশ্যে বিমল যখন বলে, “চলো, আবার শুরু করি,” সেই উচ্চারণ এক পুরাণীয় পুনর্জন্মের প্রতীক হয়ে ওঠে। ঋত্বিকের কাছে প্রেম কখনো ব্যক্তিগত ছিল না; তা ছিল সৃষ্টির মূলশক্তি, যেমন ব্রহ্মা ও শিবের দ্বৈততা, রাধাকৃষ্ণের মিলন ও বিরহ।
ঋত্বিক ঘটকের পুরাণচেতনা সবচেয়ে গভীরভাবে প্রতিফলিত হয় তাঁর চিত্রভাষায়। তাঁর প্রতিটি ফ্রেম প্রতীকময়—তিনি আকাশ, নদী, ধূলি, বৃক্ষ, ছায়া, শঙ্খ, আগুন, ধোঁয়া ইত্যাদিকে বারবার ব্যবহার করেন পুরাণীয় চিহ্ন হিসেবে। উদাহরণস্বরূপ, ‘মেঘে ঢাকা তারা’-তে মেঘ কেবল প্রাকৃতিক উপাদান নয়, তা আশ্রয়ের প্রতীক এবং একই সঙ্গে ধ্বংসের ছায়া। মেঘ ঢাকা মানে আশার আড়ালে বেদনা। আবার ‘সুবর্ণরেখা’-য় নদী শুধু জলপ্রবাহ নয়, তা সময়ের ধারাপ্রবাহ, যা ইতিহাসের মতোই অচল। তাঁর সিনেমার প্রতিটি দৃশ্যই যেন উপমা ও রূপকের স্তরে নির্মিত।
ঋত্বিক ঘটক লোকসংস্কৃতিকে পুরাণের আধার হিসেবে দেখতেন। তিনি জানতেন যে, বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতিতে যে বাউল, ভাটিয়ালি, কীর্তন, যাত্রা, শ্যামাপূজা, শাক্তসাধনা, কিংবা লোককাহিনি রয়েছে, সেগুলিই আমাদের জীবন্ত পুরাণ। তাই তাঁর ছবিতে এইসব উপাদান নিয়মিত উপস্থিত হয়। ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র প্রেক্ষাপটে যে লোকসংগীতের সুর ভেসে আসে—“আমারে সইদে দে মা, ভাসাইয়া গা”—সেই গান কোনো চরিত্রের নয়, যেন সময়ের কণ্ঠস্বর। ‘কোমল গান্ধার’-এ রবীন্দ্রসংগীত যেমন ঐক্যের প্রতীক, তেমনি ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’-তে শঙ্খধ্বনি, কীর্তন, এবং ব্রতকথার মতো শব্দাবলী পুরাণীয় রীতির প্রতিধ্বনি। ঋত্বিক ঘটকের শব্দভুবন তাই কেবল সংগীত নয়, তা এক সাংস্কৃতিক স্মৃতিলেখ।
তাঁর সিনেমায় নারী চরিত্রগুলি প্রায়শই পুরাণীয় আর্কিটাইপের আধুনিক প্রতিরূপ। নীতা, সীতা, বাণী, দুর্গা—সবাই কোনো না কোনোভাবে দেবীসত্তার প্রতীক। কিন্তু তাঁরা দেবী নন; তাঁরা মানুষের দুর্বলতা, ত্যাগ, প্রেম ও প্রতিবাদের চিত্র। ঋত্বিকের নারীরা শাস্ত্রীয় দেবত্বের বাইরে গিয়ে মানবিক হয়ে ওঠে। নীতা যেমন মায়ের প্রতীক, তেমনি এক শোষিত শ্রেণির প্রতিনিধি। এই দ্বৈততা তাঁর শিল্পের মূল শক্তি। তিনি বলেছিলেন, “আমার নারী চরিত্ররা দেবী নয়, তারা মানুষ, কিন্তু তাদের মধ্যে আছে দেবত্বের সম্ভাবনা।” এই ‘সম্ভাবনা’ই পুরাণকে আধুনিক করে তোলে।
ঋত্বিক ঘটক প্রাচীন মিথকে ব্যবহার করেন সময়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য। তাঁর চলচ্চিত্রে প্রলয়ের ধারণা বারবার ফিরে আসে। ‘সুবর্ণরেখা’-য় বোমার বিস্ফোরণ, ‘মেঘে ঢাকা তারা’-য় ভাঙা পাহাড়ের শব্দ, ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’-তে যুদ্ধের ইঙ্গিত—সবই কালান্তরের প্রতীক। এই প্রলয় তাঁর কাছে ধ্বংস নয়, পুনর্নির্মাণের সূচনা। যেমন পুরাণে প্রতিটি মহাপ্রলয়ের পর সৃষ্টির আরম্ভ হয়, তেমনি তাঁর ছবিতেও ধ্বংসের মধ্যে জন্মের বীজ লুকিয়ে থাকে। এই মিথোপম ভাবনা তাঁকে পশ্চিমের পরিচালক যেমন পাসোলিনি বা বুনুয়েলের সমতুল্য করে তোলে।
ঋত্বিকের সিনেমায় সময়ের গতি সরল নয়, তা চক্রাকার—যেমন পুরাণে কালচক্র। তাঁর মঁতাজ বা সম্পাদনা প্রক্রিয়া সেই চক্রেরই প্রকাশ। এক দৃশ্য থেকে অন্য দৃশ্যে তাঁর হঠাৎ কাট, প্রতিসংযোজন, শব্দের বিস্ফোরণ—সবকিছুই স্মৃতি ও বর্তমানের সংলগ্নতা প্রকাশ করে। যেমন ‘কোমল গান্ধার’-এ নাটকের সংলাপের সঙ্গে রেলগাড়ির শব্দের সংযোজন বা ‘সুবর্ণরেখা’-য় নদীর দৃশ্যের সঙ্গে গুলির আওয়াজ—এইসব সংমিশ্রণ এক আধুনিক মিথ তৈরি করে। তিনি বলতেন, “আমার মঁতাজ হলো সময়ের ব্যাকরণ।”
‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ তাঁর পুরাণবোধের সর্বশেষ ও সর্বাধিক দার্শনিক প্রকাশ। এখানে নীলকণ্ঠ বাগচী চরিত্রটি একাধারে শিব, ঋষি ও মদ্যপ মানুষের রূপ। তাঁর নাম ‘নীলকণ্ঠ’ নিজেই একটি পুরাণীয় প্রতীক—যিনি বিষ পান করেছিলেন মানবতার রক্ষা করতে। ঋত্বিক নিজেই এই চরিত্রে অভিনয় করেন, এবং তাঁর কণ্ঠে শোনা যায়, “আমি বিষ খেয়েছি, কারণ অন্য কেউ খেতে চায়নি।” এই সংলাপ পুরাণ ও রাজনীতির সেতুবন্ধন। ১৯৭০-এর সমাজের দুর্নীতি, নৈরাজ্য, এবং আদর্শের অবক্ষয়—সব কিছুর প্রতিকার হিসেবে নীলকণ্ঠ নিজের শরীরে সেই বিষ ধারণ করে। শেষ দৃশ্যে যখন সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে, তখন আকাশে বাজে শঙ্খধ্বনি—যেন এক নীলকণ্ঠের মৃত্যু ও পুনর্জন্মের প্রতীক।
ঋত্বিক ঘটকের সিনেমায় আর্কিটাইপের ব্যবহার মনস্তাত্ত্বিকও বটে। তিনি কার্ল ইউং-এর “collective unconscious” ধারণার সঙ্গে গভীরভাবে একাত্ম ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রতিটি সমাজের গভীরে এমন কিছু চিত্র বা প্রতীক আছে যা হাজার বছর ধরে মানুষের চেতনায় বাস করছে—দেবী, নদী, মাতৃরূপ, শিব, প্রলয়, পুনর্জন্ম, নির্বাসন ইত্যাদি। এইসব প্রতীককে তিনি চলচ্চিত্রের দৃশ্য, শব্দ, এবং চরিত্রের মাধ্যমে জীবন্ত করে তুলেছেন। ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র পাহাড়, ‘সুবর্ণরেখা’-র নদী, ‘কোমল গান্ধার’-এর মঞ্চ, ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’-র বন—all are archetypal spaces, যা মানুষের মনোজগতের ভেতরের প্রতিচ্ছবি।
ঋত্বিক ঘটকের ভাষা এতটাই প্রতীকময় যে, তাঁর চলচ্চিত্রগুলোকে সরাসরি আখ্যান হিসেবে পড়লে অনেক কিছুই হারিয়ে যায়। তাঁর চলচ্চিত্র এক ধরনের দার্শনিক গীতিকা, যেখানে প্রতিটি উপাদান মানে বহুমাত্রিক। যেমন ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র প্রতিটি ছায়া মানে মানসিক দহন, ‘সুবর্ণরেখা’-র লাল আলো মানে রক্ত ও জীবন, ‘কোমল গান্ধার’-এর ট্রেনের শব্দ মানে ইতিহাসের চলমানতা। এইভাবে তিনি সিনেমাকে এক প্রাচীন মহাকাব্যের মতো গঠন করেন—যেখানে দৃশ্য মানে মন্ত্র, সংলাপ মানে স্তোত্র, আর সঙ্গীত মানে স্মৃতির ধ্বনি।
ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রভাষায় ধর্মীয় প্রতীক কখনো একমুখী নয়। তিনি যেমন শাক্তপুরাণের শক্তির ধারণা ব্যবহার করেন, তেমনি বৌদ্ধ করুণা ও বৈষ্ণব মানবিকতাকেও মিশিয়ে দেন। তাঁর চরিত্ররা কখনো দেবত্বের জন্য নয়, বরং মানবতার জন্য ত্যাগ করে। তিনি বলতেন, “ধর্ম আমার কাছে চেতনার অংশ, কিন্তু আমি তার প্রচারক নই।” তাঁর পুরাণ তাই ধর্মীয় নয়, সাংস্কৃতিক ও মানসিক। এটি বাঙালির ঐতিহাসিক স্মৃতিকে পুনর্নির্মাণের এক প্রচেষ্টা।
ঋত্বিকের এই পুরাণচেতনা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাঁকে অনন্য করে তুলেছে। আইজেনস্টাইন যেমন রুশ বিপ্লবকে মহাকাব্যের স্তরে তুলেছিলেন, ঋত্বিক তেমনই দেশভাগের বেদনা ও বাঙালির অস্তিত্বকে পুরাণীয় রূপ দিয়েছেন। তাঁর সিনেমায় যেমন বাস্তবতা আছে, তেমনি আছে রূপক ও মিথ। এই দ্বৈততার কারণেই তাঁর চলচ্চিত্র একদিকে তীব্র রাজনৈতিক দলিল, অন্যদিকে এক গভীর আধ্যাত্মিক যাত্রা।
তাঁর সিনেমার সংগীত ও শব্দ-নকশাও এই পুরাণীয় ভাষাকে সমর্থন করে। তিনি লোকসঙ্গীতকে ব্যবহার করেছেন দেবোত্তম ভাবনার সঙ্গে যুক্ত করে। ‘সুবর্ণরেখা’-য় বাউলসুর, ‘কোমল গান্ধার’-এ নাট্যসংগীত, ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’-তে কীর্তনের ছায়া—সব একত্রে তৈরি করে এক অদ্ভুত মিথিক আবহ। এই সুরের মধ্যে লুকিয়ে থাকে প্রার্থনা ও প্রতিবাদের মিলন।
ঋত্বিক ঘটকের সিনেমার এই পুরাণবোধ আসলে তাঁর সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের প্রতি গভীর প্রেমের ফল। তিনি মনে করতেন, “আমরা যদি নিজের মিথ ভুলে যাই, তাহলে নিজের অস্তিত্বও হারাব।” তাঁর সিনেমা সেই ভুলে যাওয়া মিথকে পুনরায় উচ্চারণ করে। তাঁর প্রতিটি ফিল্ম এক একটি আধুনিক মহাকাব্য—যেখানে দেবতা ও মানুষ একই আকাশে বাস করে, যেখানে প্রেম, মৃত্যু, নির্বাসন, যুদ্ধ—সব এক বৃহত্তর মানবিক চেতনায় রূপ নেয়।
শেষ জীবনে, ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’-র সময়, তিনি নিজেই এক পুরাণীয় চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন—এক যাযাবর, এক ঋষি, এক নীলকণ্ঠ, যিনি বিষ পান করছেন মানবতার বাঁচানোর আশায়। তাঁর সংলাপে সেই আত্মত্যাগের প্রতিধ্বনি—“আমি জানি, সব শেষ, তবু গান গাই।” এই উচ্চারণ যেন শিবের তাণ্ডব, যেখানে ধ্বংসের ভিতরেই সৃষ্টির সম্ভাবনা।
ঋত্বিক ঘটক তাই শুধু এক পরিচালক নন, তিনি এক মহাকাব্যের রচয়িতা, যিনি বাঙালির পুরাণ, ইতিহাস ও মননের সমবেত সুরে চলচ্চিত্রের নতুন ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন। তাঁর সিনেমা আমাদের শেখায়, আধুনিকতার মানে পশ্চিম অনুকরণ নয়, বরং নিজের মাটির মিথকে নতুনভাবে দেখা। তাঁর প্রতিটি ফ্রেম যেন সেই পুনর্জন্মের ছবি—যেখানে অতীতের ছায়া ও ভবিষ্যতের আলোর মিলনে জন্ম নেয় এক অনন্ত বাঙালি চেতনা।
ঋত্বিক ঘটক ছিলেন এমন এক শিল্পী যিনি সিনেমাকে কেবল বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে নয়, সমাজ ও ইতিহাসের গভীর সঙ্কটের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর সৃষ্টিশীলতার কেন্দ্রে ছিল এক তীব্র রাজনৈতিক আত্মসচেতনতা, যা জন্ম নিয়েছিল ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার, দেশভাগের ক্ষত, শ্রেণিবৈষম্য এবং মানবমুক্তির স্বপ্ন থেকে। তিনি ছিলেন বাঙালির ইতিহাসের এমন এক সময়ের সন্তান, যখন সমাজতন্ত্র, বিপ্লব, ও মার্ক্সীয় দর্শন নতুন করে মানুষের চেতনায় আলোড়ন তুলেছিল। এই আন্দোলনের প্রতিধ্বনি ঋত্বিকের চিন্তা ও সিনেমার ভেতর এমনভাবে গেঁথে আছে যে, তাঁর প্রতিটি ফ্রেমই হয়ে উঠেছে এক রাজনৈতিক ভাষ্য, এক বিপ্লবী ব্যাখ্যা, এক সমাজদর্শনের প্রতিফলন।
ঋত্বিক ঘটক জন্মেছিলেন ১৯২৫ সালে পূর্ববঙ্গের রাজশাহীতে। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে এমন এক সময়ে, যখন ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম চলছিল প্রবলভাবে। বামপন্থী আন্দোলন, কৃষকসভার লড়াই, ছাত্ররাজনীতি—সব কিছুই তরুণ ঋত্বিকের মানসিক গঠনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তাঁর বড় ভাই মনীশ ঘটক ছিলেন একজন মার্ক্সবাদী বুদ্ধিজীবী এবং লেখক, যিনি ঋত্বিককে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দেন। পরে কলকাতায় এসে তিনি যুক্ত হন ইপিটিএ (Indian People’s Theatre Association)-এর সঙ্গে, যা সেই সময় বামপন্থী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ছিল। ইপিটিএ-র অভিজ্ঞতা তাঁর শিল্পজীবনের ভিত্তি গড়ে দেয়—সেখানেই তিনি শেখেন কিভাবে শিল্পকে সমাজের সেবা, মানুষের মুক্তি, ও শ্রেণিসংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রচিন্তা এই ইপিটিএ-পর্ব থেকেই গঠিত হতে শুরু করে। ইপিটিএ-র মূল দর্শন ছিল মার্ক্সবাদী বাস্তববাদ—শিল্প মানে সেই বাস্তবতার ব্যাখ্যা, যা জনগণের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই দর্শন অনুযায়ী, শিল্পীকে কেবল সৌন্দর্য নয়, সামাজিক বৈষম্যের সত্যও প্রকাশ করতে হবে। ঋত্বিক এই ভাবনাকে গভীরভাবে আত্মস্থ করেছিলেন। তাঁর মতে, “শিল্প যদি মানুষের জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখে, তবে তা শূন্য অলঙ্কার।” তাই তাঁর সিনেমায় সৌন্দর্য কখনো উদ্দেশ্য নয়, বরং মাধ্যম—যার ভেতর দিয়ে শ্রেণি, ইতিহাস, ও মানবিক সংগ্রাম ফুটে ওঠে।
দেশভাগের অভিজ্ঞতা ঋত্বিক ঘটকের রাজনীতি ও শিল্পকে একাকার করে দিয়েছিল। ১৯৪৭ সালে সীমান্তরেখা টানার পর কোটি কোটি মানুষ যেমন ঘরছাড়া হয়েছিল, তেমনি তাঁদের স্বপ্ন, স্মৃতি ও মর্যাদাও ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এই বিভাজনের ইতিহাস কোনো পরিসংখ্যান নয়, বরং এক সমষ্টিগত ট্রমা, যা ঋত্বিকের চলচ্চিত্রের মর্মে স্থায়ীভাবে রয়ে গেছে। তিনি দেশভাগকে দেখেছিলেন কেবল ভূখণ্ডের বিভাজন হিসেবে নয়, বরং শ্রেণি-রাজনীতির এক ভয়াবহ ফলাফল হিসেবে—যেখানে বুর্জোয়া রাজনীতি শ্রমজীবী ও প্রান্তিক মানুষকে ঠেলে দিয়েছিল দারিদ্র্য ও নির্বাসনের অন্ধকারে। এই অবস্থাকে তিনি তাঁর সিনেমায় বারবার ব্যাখ্যা করেছেন। ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র নীতা, ‘সুবর্ণরেখা’-র ঈশ্বর ও সীতা, ‘কোমল গান্ধার’-এর বিমল ও বাণী—সবাই আসলে সেই দেশভাগের সন্তান, যাঁদের শরীরে ইতিহাসের ক্ষত লেখা আছে।
ঋত্বিকের দৃষ্টিতে দেশভাগ ছিল ভারতীয় পুঁজিবাদের জন্মলগ্নের পরিণতি। তিনি বিশ্বাস করতেন, ধর্ম বা জাতিগত বিভাজন নয়, বরং অর্থনৈতিক স্বার্থই দেশভাগের মূলে ছিল। তাঁর সিনেমায় তাই ধর্মীয় প্রশ্নের চেয়ে শ্রেণির প্রশ্ন বড় হয়ে ওঠে। তিনি বলতেন, “আমরা যে এক জাতিকে দুই ভাগ করেছি, সেটা আসলে বুর্জোয়া রাজনীতির ষড়যন্ত্র, যা গরিব মানুষের মাথার ওপর দিয়ে ঘটেছে।” এই মার্ক্সীয় বিশ্লেষণই তাঁর শিল্পকে আলাদা করে তোলে সমসাময়িক অন্য পরিচালক যেমন সত্যজিৎ রায় বা মৃণাল সেনের কাছ থেকে। সত্যজিৎ রায় যেখানে মানবতাবাদী দৃষ্টিতে সমাজকে দেখেছেন, ঋত্বিক সেখানে দেখেছেন শ্রেণিসংগ্রামের দৃষ্টিতে।
ঋত্বিক ঘটকের সিনেমায় শ্রেণি-চেতনা এক গভীর নাটকীয় রূপ নেয়। তাঁর চরিত্ররা প্রায়শই প্রান্তিক, বাস্তুচ্যুত, অথবা বঞ্চিত। তাঁদের সংগ্রাম কেবল ব্যক্তিগত নয়, তা সমষ্টিগত। ‘মেঘে ঢাকা তারা’-য় নীতা শ্রমজীবী মধ্যবিত্তের প্রতীক, যার শ্রমে সবাই বাঁচে, কিন্তু যে নিজে নিঃশেষ হয়। এই ট্র্যাজেডি কেবল একটি পরিবারের নয়, বরং পুরো সমাজের প্রতিচ্ছবি, যেখানে শোষণ এক অদৃশ্য নিয়ম। ঋত্বিক এখানে মার্ক্সীয় ভাবনায় বলছেন—পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিকের শরীর ও মানসিক শক্তি উভয়ই নিঃশেষ হয়, আর লাভবান হয় অন্য শ্রেণি। তাঁর সিনেমার প্রতিটি দৃশ্য সেই অসম সমাজ-ব্যবস্থার দৃশ্যমান প্রতিফলন।
‘সুবর্ণরেখা’ এই দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও জটিল ও গভীর করে তোলে। এখানে দেশভাগোত্তর বাস্তুচ্যুত মানুষদের পুনর্বাসনের কাহিনি মূল বিষয়, কিন্তু এর আড়ালে লুকিয়ে আছে বৃহত্তর শ্রেণিসংঘর্ষের প্রতীক। ঈশ্বর নামের চরিত্রটি, যিনি শরণার্থীদের নিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে চান, এক ধরনের সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী মানুষ। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন ধীরে ধীরে পুঁজিবাদী শহরের দমনে ভেঙে পড়ে। তাঁর বোন সীতা দারিদ্র্য ও পতিতাবৃত্তির শিকার হয়—এই ঘটনাগুলি ঋত্বিক ব্যবহার করেছেন সেই সময়কার সমাজের ভণ্ডনৈতিক কাঠামো প্রকাশের জন্য। সুবর্ণরেখা নদীর ধারে তাঁর ক্যামেরা যেন বলে ওঠে—এই নদীই হলো ইতিহাসের রেখা, যা ধনী-গরিব, শাসক-শোষিত, আশা ও মৃত্যুর সীমারেখা।
ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা কখনো সরাসরি রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা নয়, কিন্তু তার প্রতিটি স্তরে রাজনৈতিক ভাবনা নিহিত। তাঁর চলচ্চিত্রে কোনো বক্তৃতা নেই, কিন্তু প্রতিটি চরিত্র, শব্দ ও চিত্র এক গভীর সামাজিক অবস্থান প্রকাশ করে। তিনি বলতেন, “আমি রাজনীতি করি না, কিন্তু রাজনীতি আমার ছবিতে আসে, কারণ আমি মানুষ দেখি।” তাঁর মানবদৃষ্টি ছিল মার্ক্সীয় মানবতাবাদে উদ্বুদ্ধ—অর্থাৎ, মানুষকে কেবল একটি শ্রেণি-অবস্থানের প্রতিনিধি নয়, বরং সম্ভাবনাময় সৃষ্টিশীল সত্তা হিসেবে দেখা। তাঁর চরিত্ররা যতই ভেঙে পড়ুক, তারা কখনো আশাহীন নয়। তাঁদের ভেতরে থাকে প্রতিরোধের আগুন, যা মার্ক্সীয় “মানবমুক্তি”-র ধারণারই শিল্পিত প্রতিরূপ।
ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রে সমাজতান্ত্রিক ভাবনার প্রয়োগ দেখা যায় তাঁর নন্দনতত্ত্বে। তিনি চলচ্চিত্রকে ‘সমষ্টিগত শিল্প’ বলে মনে করতেন—যেখানে পরিচালক, অভিনেতা, সঙ্গীত, সম্পাদনা, আলো—সব মিলে এক ঐক্যবদ্ধ সৃষ্টিরূপ নেয়। এই ধারণা আসলে সমাজতন্ত্রেরই শিল্পরূপ, যেখানে কোনো একক প্রতিভা নয়, বরং সমবেত প্রচেষ্টাই সাফল্যের মূল। তাঁর মতে, “সিনেমা হলো মানুষের সম্মিলিত স্বপ্ন।” এই সম্মিলনের ধারণা তাঁকে পুঁজিবাদী চলচ্চিত্রশিল্প থেকে পৃথক করে, যেখানে বাজারই নির্ধারণ করে শিল্পের মান।
‘কোমল গান্ধার’-এ সমাজতান্ত্রিক নন্দনতত্ত্বের এই প্রয়োগ সবচেয়ে সুস্পষ্ট। এই চলচ্চিত্র মূলত এক নাট্যদলের বিভক্তি ও পুনর্মিলনের কাহিনি, যা প্রতীক হয়ে ওঠে বামপন্থী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সংকটের। ঋত্বিক দেখান, কীভাবে ব্যক্তিগত অহং ও মতভেদের কারণে একটি আদর্শবাদী আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি বিশ্বাস রাখেন ঐক্যে—বিমল ও বাণীর মিলন, গান, মঞ্চ, এবং ট্রেনের চলাচল সবই সমাজতান্ত্রিক এক পুনর্জন্মের রূপক। তিনি এখানে বলেন, “চলো আবার শুরু করি”—এই সংলাপ শুধু নাট্যদলের নয়, গোটা বিপ্লবী সংস্কৃতির পুনরারম্ভের আহ্বান।
ঋত্বিক ঘটকের রাজনৈতিক ভাবনা কখনো স্থির ছিল না; তা ক্রমাগত বিকশিত হয়েছে সময়ের সঙ্গে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তাঁর সিনেমা শ্রেণিসংগ্রাম ও দেশভাগের আঘাতে আবর্তিত, কিন্তু শেষ জীবনে তিনি সেই সংগ্রামকে এক দার্শনিক রূপে উন্নীত করেন। ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’-তে নীলকণ্ঠ বাগচী নামের চরিত্রটি যেন তাঁর নিজেরই প্রতিরূপ—এক মার্ক্সবাদী শিল্পী, যিনি হতাশ সমাজে মানবতার পুনর্জাগরণের স্বপ্ন দেখছেন। এই ছবিতে মার্ক্সীয় দর্শন এক নতুন আধ্যাত্মিকতায় পৌঁছায়। নীলকণ্ঠ বলে, “আমি বিষ খাইনি, সমাজের বিষ খেয়েছি।” এই সংলাপ আসলে সমাজতান্ত্রিক মানবতার গভীরতম প্রকাশ—যেখানে বিপ্লব মানে কেবল ক্ষমতা দখল নয়, বরং আত্মত্যাগ, ত্যাগের মধ্য দিয়ে নতুন মানুষ তৈরি করা।
ঋত্বিক ঘটক মার্ক্সবাদকে কখনো নিছক রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে নেননি। তাঁর কাছে তা ছিল এক জীবন্ত মানবিক দর্শন। তিনি বলতেন, “মার্ক্সবাদের আসল শিক্ষা হলো ভালোবাসা।” এই ভালোবাসা হলো মানুষের প্রতি দায়বোধ, সমাজের প্রতি দায়িত্ব। তাঁর চলচ্চিত্রের নৈতিক বুনন এই দায়বোধের ওপর দাঁড়িয়ে। তিনি কখনো শ্রেণি-শত্রুর ঘৃণায় নয়, বরং শোষিতের প্রতি সহানুভূতির মধ্য দিয়ে বিপ্লবের কথা বলেন। তাঁর চরিত্ররা যেমন নিপীড়িত, তেমনি প্রেম ও করুণায় ভরা। তাঁর সিনেমা তাই একইসঙ্গে রাজনৈতিক ও কবিতাময়—একদিকে ইতিহাসের ভাষ্য, অন্যদিকে আত্মার স্বর।
ঋত্বিকের চলচ্চিত্রভাষা—মঁতাজ, সঙ্গীত, প্রতীক, সংলাপ—সবই মার্ক্সীয় দ্বন্দ্বতত্ত্বের মতো গঠিত। তাঁর সিনেমায় প্রতিটি চিত্র অন্য চিত্রের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, প্রতিটি শব্দ অন্য শব্দের বিপরীতে প্রতিধ্বনি তোলে। এই সংঘর্ষ থেকে জন্ম নেয় অর্থ। তিনি বলতেন, “চলচ্চিত্র মানে সংঘর্ষ—ভাবনার সংঘর্ষ, ছবির সংঘর্ষ, মানুষের সংঘর্ষ।” এই ধারণা সরাসরি এসেছে আইজেনস্টাইনের মঁতাজতত্ত্ব থেকে, যিনি রুশ বিপ্লবের চলচ্চিত্র-রূপকার। কিন্তু ঋত্বিক এই তত্ত্বকে বাঙালির বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত করেছেন, ফলে তাঁর সিনেমা হয়ে উঠেছে দেশজ বিপ্লবের নন্দনতত্ত্ব।
তাঁর চলচ্চিত্রে লোকসংস্কৃতির ব্যবহারও সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তিনি বিশ্বাস করতেন, সংস্কৃতি কেবল শহরের নয়; গ্রামের, শ্রমজীবী মানুষের মধ্যেও আছে জীবন্ত শিল্পচেতনা। তাই তিনি বারবার বাউল, ভাটিয়ালি, লোককথা, কীর্তন, এবং যাত্রার উপাদান ব্যবহার করেছেন। এইসব জনপ্রিয় মাধ্যমকে তিনি গণসংস্কৃতির বিপ্লবী রূপ হিসেবে দেখতেন। তাঁর মতে, “যে সংস্কৃতি মানুষের মুখে মুখে বাঁচে, সেটাই সমাজতান্ত্রিক।” ফলে তাঁর সিনেমায় গান, কণ্ঠ, ও শব্দ হয়ে ওঠে শ্রমজীবী মানুষের আত্মার প্রতিধ্বনি।
ঋত্বিক ঘটকের সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টি সবচেয়ে স্পষ্ট হয় তাঁর মানুষের প্রতি দৃষ্টিতে। তাঁর চলচ্চিত্রে প্রতিটি মানুষ, যতই ছোট বা উপেক্ষিত হোক, এক সম্ভাবনার প্রতীক। রিকশাচালক, বস্তিবাসী, কুলি, শরণার্থী—সবাই তাঁর কাছে ইতিহাসের নায়ক। তাঁর ক্যামেরা তাদের দিকে কখনো নিচু হয়ে তাকায় না; বরং তাদের চোখের উচ্চতায় দাঁড়িয়ে তাদের গৌরবময় সংগ্রামকে দেখায়। এই দৃষ্টিভঙ্গি আসলে মার্ক্সীয় সমতা-বোধের প্রকাশ—মানুষের মধ্যে কোনো শ্রেণিগত উচ্চতা-নিম্নতা নেই, সবার মধ্যে মুক্তির সম্ভাবনা রয়েছে।
ঋত্বিক ঘটকের শেষ জীবনের হতাশা—তাঁর মদ্যপান, মানসিক ভাঙন—সবকিছুই সেই সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ব্যর্থতার বেদনার প্রতিফলন। তিনি দেখেছিলেন, যে সমাজের জন্য তিনি লড়েছিলেন, সেই সমাজই ভোগবাদে, স্বার্থে, আর উদাসীনতায় ডুবে গেছে। কিন্তু তবুও তাঁর অন্তরে ছিল এক অবিনাশী আশা—মানুষ আবার জেগে উঠবে, আবার লড়বে, আবার গাইবে। তাঁর সিনেমা সেই আশার ঘোষণা।
ঋত্বিক ঘটক তাই কেবল এক পরিচালক নন, তিনি ছিলেন এক বিপ্লবী দার্শনিক, যিনি সিনেমাকে সমাজতান্ত্রিক চেতনার অঙ্গনে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর প্রতিটি চলচ্চিত্রই এক সংগ্রামের দলিল—শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, জাতির আত্মসংগ্রাম, শিল্পীর অন্তঃসংগ্রাম। তাঁর মার্ক্সবাদ কোনো শুষ্ক মতবাদ নয়, বরং জীবন্ত নৈতিকতা—যেখানে শিল্প, ভালোবাসা, ও বিপ্লব এক হয়ে যায়।
ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা আমাদের শেখায়, বিপ্লব মানে কেবল বন্দুকের গর্জন নয়; বিপ্লব মানে এক নিঃস্ব মানুষের মুখে উচ্চারিত “আমি বাঁচতে চাই”। সেই উচ্চারণই সমাজতন্ত্রের প্রকৃত রূপ—মানুষের বাঁচার অধিকার, মর্যাদার অধিকার, স্বপ্ন দেখার অধিকার। ঋত্বিক ঘটক তাঁর সিনেমার মাধ্যমে সেই অধিকারকে অমর করে তুলেছিলেন। তাঁর চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যগুলো, তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত সংলাপগুলো আজও মনে করিয়ে দেয়—বিপ্লব মানে আশা, আর আশা মানেই জীবন।
বাংলা সাহিত্য ও সিনেমার ইতিহাসে দুটি নাম এক অদ্ভুত সেতুবন্ধন রচনা করে—অদ্বৈত মল্লবর্মণ ও ঋত্বিক ঘটক। একজন তাঁর উপন্যাসের মাধ্যমে নদীতীরের প্রান্তিক মানুষের আত্মকথনকে ইতিহাসের অন্তর্গত করেন, অন্যজন শহুরে মধ্যবিত্তের ভেতরে জন্ম নেওয়া আত্মপরিচয়ের বিপর্যয়কে সিনেমার ভাষায় রূপ দেন। “তিতাস একটি নদীর নাম” এবং “যুক্তি তক্কো আর গপ্পো”—এই দুটি সৃষ্টি কেবল দুই ভিন্ন মাধ্যমের কাজ নয়, বরং দুই প্রজন্মের ভারতীয় আত্মবীক্ষণ। একদিকে তিতাসের কুলিয়া-মল্লোদের জীবন, তাঁদের বঞ্চনা, শ্রম, নদী ও প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই—এ এক নিম্নবর্গের সামাজিক নৃতত্ত্ব; অন্যদিকে নীলকণ্ঠ বাগচী—এক বিপ্লব-পরবর্তী মধ্যবিত্ত মেধাবী, যে নিজের ভেতরে সভ্যতার ভাঙন ও আদর্শের দাহ অনুভব করে। দুজনেই নিজেদের সময়ের, কিন্তু দুজনেই কথা বলেন এমন এক “অন্যের” হয়ে—যে কণ্ঠ দীর্ঘকাল ধরে ইতিহাসের প্রান্তে ঠেলে দেওয়া ছিল। এক অর্থে, তিতাসের নদী যেমন ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়, তেমনি নীলকণ্ঠের ভেতরের মানবিক নদীও শুকিয়ে যায়—দুজনেই এক সমাজের নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয়ের প্রতীক হয়ে ওঠেন।
অদ্বৈত মল্লবর্মণের উপন্যাস “তিতাস একটি নদীর নাম” ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয়, কিন্তু তার অভ্যন্তরীণ ইতিহাস আরও পুরনো। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদীর তীরে জন্ম নিয়ে অদ্বৈত নিজের সমাজ—কুলিয়া-মল্লোদের—দুর্দশা, বেদনা, উচ্ছেদ ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এই সমাজ ছিল নদী-নির্ভর, মাছ ধরার উপর নির্ভরশীল এক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৃত্ত, যা ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায় নদীর স্রোত ও ঔপনিবেশিক বাজারনীতির পরিবর্তনে। উপন্যাসটি কেবল একটি সমাজের ইতিহাস নয়, বরং একটি হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠের পুনরুদ্ধার। এখানে ‘সাবঅল্টার্ন’ অর্থে আমরা পাই সেইসব মানুষকে, যাদের কোনো লিখিত ইতিহাস নেই, যাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও অভিজ্ঞতা মূলধারার বুদ্ধিজীবী সমাজে অনুপস্থিত। “তিতাস” তাই ইতিহাসের নীচের দিক থেকে বলা এক প্রতিরোধের ভাষা—যেখানে নদী হয়ে ওঠে সময়ের প্রতীক, শ্রেণিবিভাজনের আখ্যান, এবং মর্মান্তিক নিঃস্বতার সাক্ষী।
ঋত্বিক ঘটক তাঁর “যুক্তি তক্কো আর গপ্পো”য় যে নীলকণ্ঠ বাগচীকে সৃষ্টি করেন, তিনি অন্য এক প্রান্তের মানুষ। তিনি একসময়ের বিপ্লবী, সাহিত্যিক, অধ্যাপক—একজন মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী, যিনি সমাজের পতন ও আদর্শের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করে দিশেহারা। তাঁর কণ্ঠস্বর স্নিগ্ধ অথচ বিষণ্ণ, তীব্র অথচ আত্মসমালোচনামূলক। তিনি বলেন, “এই দেশটা আমার নয়… আমার দেশটা কোথায়?” এই সংলাপে ফুটে ওঠে দেশভাগ-উত্তর মানসিক সঙ্কটের মূলে থাকা এক গভীর প্রশ্ন—পরিচয়, স্থান ও ন্যায়ের সন্ধান। ঋত্বিক ঘটক নিজেই দেশভাগের শিকার, পূর্ববঙ্গের সন্তান। তাঁর কাছে চলচ্চিত্র মানে স্মৃতির পুনর্গঠন, এক ভাঙা ইতিহাসের পুনঃস্মরণ। নীলকণ্ঠ বাগচী তাঁর নিজের প্রতিরূপ, যে সমাজতান্ত্রিক স্বপ্নের পতন প্রত্যক্ষ করছে। সুতরাং, “যুক্তি তক্কো আর গপ্পো”-র নীলকণ্ঠ ও “তিতাস”-এর বসন্ত, রাজু, অনন্ত—সবাই একই স্রোতের মানুষ, শুধু ভিন্ন সময় ও ভিন্ন শ্রেণির ভেতর দিয়ে তারা সমাজের বেদনা বহন করছে।
“তিতাস”-এর মূল সুর হলো সংগ্রাম ও বিলুপ্তির বৃত্ত। নদী এখানে শুধু প্রাকৃতিক দৃশ্য নয়, বরং সামাজিক চেতনার শরীর। মল্লো সমাজ নদীর সঙ্গে যুক্ত ছিল এক অস্তিত্বমূলক বন্ধনে। নদীর উচ্ছলতা মানে তাঁদের জীবিকা, নদীর ক্ষয় মানে তাঁদের মৃত্যু। তাই তিতাস একদিকে বাস্তব নদী, অন্যদিকে মিথ ও প্রতীকের স্তর। মল্লো সমাজের গান, আচার, ভাষা, দেহভঙ্গি—সবই লোকস্মৃতির অঙ্গ। অদ্বৈত মল্লবর্মণ সেই সমাজের অভ্যন্তর থেকে লিখেছেন, বাইরের কোনো বুদ্ধিজীবী হিসেবে নয়। তাঁর ভাষা কখনো নদীর ঢেউয়ের মতো—সুরেলা, বেদনাময়; কখনো ঝড়ের মতো—অভিযোগে ভরা। তিনি লিখেছেন, “তিতাসের জল শুকিয়ে গেলে মল্লোদের বুকও শুকিয়ে যায়।” এই বাক্যটি যেন ইতিহাসের প্রতি তাঁর বিলাপ, যা সাবঅল্টার্নদের অস্তিত্ববিনাশের প্রতীক হয়ে ওঠে।
ঋত্বিক ঘটকের সিনেমায়ও নদী একটি পুনরাবৃত্ত প্রতীক। “সুবর্ণরেখা”-য় যেমন নদী মানে দেশভাগের রেখা, তেমনি “যুক্তি তক্কো আর গপ্পো”-তেও নদী মানে জীবনের প্রবাহের বিপরীতধারা। নীলকণ্ঠের চারপাশে পৃথিবী বদলে গেছে—বিপ্লব ভেঙে পড়েছে, ছাত্ররা দিকভ্রান্ত, বুদ্ধিজীবীরা বিক্রীত, সমাজ এক আত্মস্মৃতিহীন যন্ত্রে পরিণত। তাঁর ক্রোধ, হাস্য, বেদনা সবই একত্রে মানুষের বেঁচে থাকার আকুলতা। এই আকুলতা তিতাসের মল্লোদের আর্তি থেকে খুব আলাদা নয়—তারা নদী হারিয়েছে, নীলকণ্ঠ হারিয়েছে মানবতা। দুই ক্ষেত্রেই হারিয়ে যাচ্ছে “সামাজিক সত্তা”—একটি শ্রেণির, একটি মানুষের।
সাবঅল্টার্ন চিন্তার অন্যতম বিষয় হলো—“কে কথা বলবে তাদের হয়ে যাদের কণ্ঠ ইতিহাসে অনুপস্থিত?” অদ্বৈত মল্লবর্মণ এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন নিজের উপন্যাসে, আর ঋত্বিক ঘটক দিয়েছেন সিনেমায়। তিতাসের কুলিয়া-মল্লোরা নিজেদের ভাষায় ইতিহাস লিখতে পারেননি; ঋত্বিকের নীলকণ্ঠের মতোই তাঁরা ইতিহাসের বহিষ্কৃত সন্তান। কিন্তু দুইজনই প্রতিরোধের ভাষা তৈরি করেন—অদ্বৈত করেন ন্যারেটিভের মাধ্যমে, ঋত্বিক করেন চিত্রভাষার মাধ্যমে। নীলকণ্ঠ বাগচীর সংলাপগুলো—“আমি তো তোমাদের মতোই এক ভিখারি”, “তোমরা ইতিহাসের পাণ্ডুলিপি নও, তোমরা ইতিহাস”—এসব সংলাপ যেন তিতাসের চরিত্রদের অব্যক্ত চিৎকারেরই আধুনিক প্রতিধ্বনি।
তিতাসের মল্লো সমাজের অন্তর্গত নারীরাও এই প্রতিধ্বনির অংশ। বসন্ত, রোজিনা, কুসুম—তাঁরা শুধু করুণ চরিত্র নন, বরং প্রতিরোধের প্রতীক। তাঁরা প্রেম করে, হারায়, কিন্তু বেঁচে থাকে নিজেদের স্বপ্নে। ঋত্বিক ঘটকের সিনেমায় যেমন বীণা বা নীলকণ্ঠের স্ত্রী, তাঁরাও প্রতিরোধের স্তব্ধ ভাষা। এই নারীরা সমাজের নৈতিকতা ও পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে নীরব বিপ্লব। নীলকণ্ঠের স্ত্রী যখন বলে, “তুমি সব সময় হারিয়ে যেও, ফিরে এসো না”—সেই সংলাপে যে হতাশা, তা তিতাসের নারীদের নিঃশব্দ কান্নার সমান।
ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা মূলত রাজনৈতিক—কিন্তু রাজনীতির পরিধি তাঁর কাছে কেবল দল বা মতবাদ নয়, বরং মানুষ ও তার ইতিহাসের সম্পর্ক। নীলকণ্ঠ বাগচীর মধ্যবিত্ত বিপন্নতা আসলে একটি বৃহত্তর সামাজিক সংকটের রূপক। ঋত্বিক বুঝতে পেরেছিলেন যে, ভারতের নবস্বাধীন রাষ্ট্রে যে সমাজতান্ত্রিক স্বপ্ন দেখা হয়েছিল, তা মধ্যবিত্তের মধ্যে ভেঙে পড়ছে। এই সমাজ আর কৃষকের কণ্ঠস্বর শুনছে না, শ্রমিকের কান্না অনুভব করছে না। তিতাসে মল্লোরা যেভাবে বিলীন হয়ে যায়, তেমনি শহুরে সমাজেও সেই বিলুপ্তির পুনরাবৃত্তি। ঋত্বিক তাই সাবঅল্টার্ন ও বুদ্ধিজীবীর কণ্ঠস্বরকে এক মহাসংলাপে মিলিয়ে দেন—তাঁর ছবিতে শহর ও গ্রাম, শ্রমিক ও চিন্তক, নারী ও পুরুষ—সবাই মিলে এক বিশাল মানবিক মঞ্চ।
অদ্বৈত মল্লবর্মণ ও ঋত্বিক ঘটক দুজনেই ইতিহাসের সেই অংশকে চিহ্নিত করেন যা “জাতীয় উন্নয়ন” বা “অগ্রগতি”-র প্রচারে বাদ পড়ে যায়। তিতাসের নদী শুকিয়ে যায় কারণ তার স্রোত আটকানো হয়; নীলকণ্ঠের মন শুকিয়ে যায় কারণ সমাজের স্রোত বাধাপ্রাপ্ত। ঋত্বিক বলেছিলেন, “আমি বিশ্বাস করি—মানুষের মধ্যে এক স্রোত আছে, সেটাকে বাঁধা যায় না।” এই কথাটি যেন অদ্বৈতের লেখারও সারাংশ। তাঁদের কাজের মধ্যে তাই মিলে যায় লোকজ আর আধুনিক, সাবঅল্টার্ন আর মধ্যবিত্ত, নদী আর শহর।
তিতাসে আমরা দেখি ইতিহাসের এক নিম্নতম স্তর থেকে উত্থান—যেখানে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে একাকার। যুক্তি তক্কো আর গপ্পো-তে আমরা দেখি ইতিহাসের শীর্ষে থাকা মানুষের পতন—যেখানে মানুষ নিজের মানসিক শূন্যতায় ডুবে যাচ্ছে। এই দুটি বিপরীত প্রক্রিয়া আসলে এক ইতিহাসচক্র। সমাজ যেভাবে নিজের শিকড় ভুলে যায়, সেভাবেই সে নিজের ভবিষ্যৎ হারায়। নীলকণ্ঠের পতন তাই শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং সামষ্টিক। তাঁর অচেতন মনের মধ্যে নদীর মতো বইছে তিতাসেরই প্রতিধ্বনি—এক প্রান্তিক সমাজের ভাঙা স্মৃতি।
ঋত্বিকের ছবিতে লোকগাথা, গান, ঢোল, নাট্যরীতি—সব কিছু মিলেমিশে এক সমষ্টিগত চেতনার ভাষা তৈরি করে। এটি “লোকস্মৃতি”-র পুনরাবিষ্কার, যা তিতাসেও উপস্থিত। অদ্বৈত যেমন লোকগান ও প্রবাদ দিয়ে সমাজের অন্তর্গত জীবনকে ফুটিয়েছেন, তেমনি ঋত্বিক সিনেমার ভেতরে লোকসঙ্গীত ও মঞ্চরীতি ব্যবহার করে বাঙালির লোকচেতনাকে পুনর্জীবিত করেছেন। এই সংমিশ্রণ তাঁদের দুজনকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে অনন্য করে তোলে। ঋত্বিকের সিনেমায় “মিথ” কোনো অলৌকিক ব্যাপার নয়, বরং সামাজিক বাস্তবতার গভীরে থাকা প্রতীক। যেমন তিতাসের নদী সময়ের প্রতীক, তেমনি নীলকণ্ঠের “পাগলামি” এক সভ্যতার পতনের প্রতীক।
সুতরাং, যখন আমরা তিতাস ও নীলকণ্ঠকে পাশাপাশি রাখি, দেখি—একজন নদীর তীর থেকে ইতিহাসের শেষপ্রান্তে কথা বলছেন, আরেকজন শহরের প্রান্ত থেকে সভ্যতার শেষপ্রান্তে। কিন্তু দুজনেরই মুখে এক অভিন্ন বেদনা—মানুষ হারাচ্ছে মানুষকে। ঋত্বিক এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমার চরিত্ররা সবাই হারিয়ে যাচ্ছে—দেশ হারাচ্ছে, মানুষ হারাচ্ছে, ভাষা হারাচ্ছে।” তিতাসেও তাই—বসন্ত হারায় নদী, হারায় ঘর, হারায় সমাজ।
এই দুই সৃষ্টিকর্তার মধ্য দিয়ে আমরা দেখি এক ভারতীয় পুনরাবিষ্কার—যেখানে নদী, শ্রম, চিন্তা, বিপ্লব, বেদনা—সব মিলেমিশে তৈরি হয় এক মানবতাবাদী মহাকাব্য। অদ্বৈত মল্লবর্মণ সাবঅল্টার্নদের কণ্ঠ দেন, ঋত্বিক ঘটক মধ্যবিত্তের মনের মধ্যে সেই কণ্ঠের প্রতিধ্বনি খুঁজে পান। তাই নীলকণ্ঠ বাগচী যখন শেষ দৃশ্যে অন্ধকারের দিকে হাঁটেন, তাঁর ভেতরে যেন বেজে ওঠে তিতাসের নদীর স্রোত—এক দূর অতীতের জলের শব্দ, যা এখনও থামেনি।
ঋত্বিক ঘটক ও অদ্বৈত মল্লবর্মণের এই মিলন আসলে এক নীরব সংলাপ—যেখানে সাহিত্যের সাবঅল্টার্ন কণ্ঠ ও সিনেমার মধ্যবিত্ত আত্মসন্ধান একে অপরকে সম্পূর্ণ করে। এই সংলাপ আমাদের শেখায়—ইতিহাসের প্রকৃত বোধ আসে কেবল তখনই, যখন আমরা নিচের দিকের কণ্ঠকে শুনতে পারি, আর সেই কণ্ঠকে নিজের মধ্যেও অনুভব করি। নীলকণ্ঠ বাগচী সেই শ্রোতা, আর তিতাস সেই ভাষা। দুজনেই পরস্পরের মধ্যে অবিরাম স্রোতের মতো বইছে—একটি নদী, একটি মানুষ, এক ইতিহাস, এক যন্ত্রণার পরম মিলনে।

