
আলোকের সাধনা (টমাস আলভা এডিসনের জীবন-কাহিনি) হোমেন বরগোহাঞি মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস
৯
বেশি করে ঘুমোনো জীবনের অপচয় মাত্র
চাকরি যাবার পরে টমাস কানাডা থেকে আমেরিকায় ফিরে এল।বিবেকের নির্দেশে সে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে এল যদিও তার চাকরির প্রয়োজন ছিল, কারণ সে কাজ না করে বসে খেতে পারার মতো ধনী মানুষ ছিল না। সে পুনরায় চাকরি খুঁজতে লাগল। কিছুদিন চাকরি খোঁজার পরে সে অবশেষে চিনচিনাটি নামের শহরে পুনরায় টেলিগ্রাফ অপারেটরের একটা চাকরি পেল। বাধ্য হয়ে চাকরি নিল যদিও তার মনে সুখ ছিল না। তার বেতন ছিল খুবই কম। তার গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় বই এবং সাজ সরঞ্জাম কেনার জন্য সে টাকা সঞ্চয় করতে পারছিল না। কিন্তু চাকরি করে কোনো মতে পেটে ভাতে খেয়ে থাকাটা তো তার জীবনের লক্ষ্য ছিল না বা কেবল তার জন্যই তার জন্ম হয়নি। তার জীবনের লক্ষ্য ছিল নানা বিষয়ে জ্ঞান আহরণ করা, গবেষণা করা, আধুনিক বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিবিদ্যার সাহায্য নিয়ে মানুষের ব্যবহারের জন্য নানা ধরনের উন্নত সরঞ্জাম উদ্ভাবন করা। কিন্তু একটা সময় সে বুঝতে পারল যে টেলিগ্রাফ অপারেটরের চাকরি করতে থাকলে কোনো মতে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকা ছাড়া তার জীবনে অন্য কোনো বড়ো কাজ করা সম্ভব হবে না।
চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে টমাস একদিন ভাগ্যের সন্ধানে নিরুদ্দেশ যাত্রা আরম্ভ করল।
টমাসের এই অস্থির অবস্থা প্রায় পাঁচ বছর ধরে চলল। সে যে চাকরিবিহীন ছিল তা নয়। একের পরে এক সে কয়েকটি চাকরি পেয়েছিল , কিন্তু কোনো একটি চাকরিতেই সে বেশিদিন টিকে থাকতে পারছিল না। এক জায়গায় কিছুদিন থাকার পরে তার বিরক্তি লাগতে শুরু করেছিল; ফলে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে সে অন্য একটি জায়গায় যাত্রা করেছিল। সে যে বেশি বেতন পাওয়া ভালো চাকরির সন্ধানে এভাবে অস্থির হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল তা নয়। সে আসলে নিজের জন্য জীবনের একটি লক্ষ্য ঠিক করে নিয়েছিল, আর চাকরি করে অর্থ উপার্জন করার চেয়ে সেই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার ওপরে সে বেশি জোর দিয়েছিল। ফলে চাকরি করে থাকার সময়ও সে বেশি করে সময় খরচ করত গবেষণার কাজে। গবেষণার জন্য দিনে কম সময় পাওয়া যায়, কারণ দিনে চাকরি করতে হয়। সেই জন্য সে রাতে মাত্র চার ঘন্টা ঘুমোত। বাকি সময় জেগে থেকে গবেষণার কাজ করত। তার মুখে প্রায়ই একটি কথা শোনা যেত যে বেশি করে ঘুমানোটা জীবনের অপচয় মাত্র। সে যাই হোক না কেন, চাকরি করে থাকার সময়ও নিজের গবেষণার কাজে বেশি সময় দেওয়ার জন্যও তাকে কয়েকটি চাকরি হারাতে হয়েছিল।
একুশ বছর বয়সে পদার্পণ করে টমাস উপলব্ধি করল যে এই অস্থির অবস্থার অবসান ঘটিয়ে এক জায়গায় স্থায়ী হওয়ার সময় এসেছে। এই সময় একজন বন্ধু তাকে বোস্টনে যাবার উপদেশ দিল। বন্ধু নয়–যেন স্বয়ং ভাগ্য বন্ধুর মাধ্যমে টমাসকে বোস্টনে যাওয়ার নির্দেশ দিল।বোস্টনে সে এরকম কিছু গবেষণার কাজ করার সুযোগ পেল –যে সমস্ত গবেষণার ফল তার মনে প্রবল আত্মবিশ্বাস এনে দিল এবং তার মনে অনেক নতুন নতুন চিন্তার বীজ অংকুরিত হল।
বোস্টনে সে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন টেলিগ্রাফ নামে কোম্পানির অফিসে টেলিগ্রাফিস্টের চাকরি পেল। তাকে রাতের বেলা কাজ করতে দেওয়া হয়েছিল; ফলে দিনের বেলা সে গবেষণার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিল।
তার মধ্যে সময় বের করে সে মাত্র চার ঘন্টা ঘুমোত।একজন একুশ বছরের যুবক ছেলের মনে আমোদ-প্রমোদের কোনো চিন্তাই আসত না; তার কাছে প্রতিটি মুহূর্তই ছিল কাজের সময়। কাজ করে সে আনন্দ লাভ করত, কাজের মধ্যেই সে খুঁজে পেয়েছিল জীবনের চরম সার্থকতা। কাজের মধ্যে যে মানুষ এত আনন্দ লাভ করতে পারে, তার জন্য অন্য কোনো আমোদ প্রমোদের প্রয়োজন হয় না।
টেলিগ্রাফ হল মূলত একটি বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, অর্থাৎ একে বিদ্যুৎ শক্তির সাহায্যে চালানো হয়। তাই বিদ্যুৎ বিজ্ঞানের বিষয়ে ভালো জ্ঞান থাকা মানুষের পক্ষে ভালো টেলিগ্রাফিস্ট হওয়া বেশি সহজ হয়। অতি অল্প বয়স থেকেই টমাস নিজের গবেষণাগারে নানা বৈদ্যুতিক গবেষণা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সেই বিষয়ে অত্যন্ত দক্ষ হয়ে উঠেছিল। এখন সেই বিদ্যা তার কাজে লাগল। বোস্টনে টেলিগ্রাফিস্ট হিসেবে চাকরিতে যোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার অসাধারণ কর্ম নৈপুণ্য সবার চোখে পড়ল। তার ওপরওয়ালা এবং সহকর্মী প্রত্যেকেই পঞ্চমুখে তার প্রশংসা করতে লাগল। তার নিয়োগকর্তা এমনকি তার বেতন বাড়িয়ে দিল।
কিন্তু দক্ষ ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে টমাসের যে কাজ সবচেয়ে বেশি প্রশংসা পেয়েছিল তার সঙ্গে টেলিগ্রাফের কোনো সম্পর্ক ছিল না।
পৃথিবীতে এরকম কোনো মানুষ থাকতে পারে না যে আরশোলার উৎপাতের সঙ্গে পরিচিত নয়। দিনের বেলা নর্দমা বা সেরকম অন্য কোনো অন্ধকার নোংরা জায়গায় লুকিয়ে থাকা আরশোলা রাত হলেই দলে দলে খাদ্যের সন্ধানে বেরিয়ে এসে মানুষের ঘরে তৃষ্ণার্তের মতো ঘুরে বেড়ায়। ওরা রোগের বীজানু বহন করে নিয়ে বেড়ায় তাই মানুষ তাদের ঘৃণা করে এবং ওদের মেরে ফেলার চেষ্টা করে। শুধুমাত্র আরশোলা মারার জন্যই যে বাজারে কত ঔষুধ বেরিয়েছে তার কোনো সীমা সংখ্যা নেই। কিন্তু রক্তবীজের বংশধরের মতো আরশোলাকে মেরে শেষ করাটা সহজ কথা নয়। প্রায় পঁয়ত্রিশ কোটি বছরের চেয়ে বেশি সময় ধরে তারা এই পৃথিবীতে আছে। প্রাণিবিজ্ঞানীদের মতে ওরাই বোধ হয় পৃথিবীর প্রথম উড়ন্ত প্রাণী। এই পঁয়ত্রিশ কোটি বছরের ভেতরে বিভিন্ন প্রজাতির অনেক প্রাণী পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, কিন্তু আরশোলা আজও বেঁচে আছে।
টমাস কাজ করার টেলিগ্রাফ অফিসটাতে অসংখ্য আরশোলা ছিল। একদিন একটি আরশোলা টমাসের একজন সহকর্মীর কোটের পকেটে আশ্রয় নিয়েছিল। গডউইন নামের সেই মানুষটি পকেটে হাত ঢুকিয়েই হঠাৎ বিকটভাবে চিৎকার করে উঠল, কারণ কিছু একটা তার আঙ্গুলে কামড়ে দিয়েছে বলে সে অনুভব করল। তার চিৎকার শুনে ঘরে থাকা প্রতিটি সহকর্মী তার কাছে দৌড়ে এল। মানুষটি কোটের পকেটে দ্বিতীয়বার হাত ঢোকাতে সাহস করছে না দেখে টমাস তার কোটটি গা থেকে খুলে নিয়ে ঝেড়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লাফিয়ে পড়ল একটি আরশোলা।
আরশোলার অবিরাম উৎপাতে বিরক্ত হয়ে সহকর্মীরা এবার টমাসকে ঘিরে ধরে বলল–’ তুমি তো বুদ্ধির প্রকাণ্ড একটি ভান্ডার। নাকে চিমটি কাটলেই তোমার বুদ্ধি বের হয়। আরশোলা মারার জন্য কিছু একটা বুদ্ধি বের করতে পার না কি ?’
টমাস কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল–’ দেখা যাক কী করতে পারি। আশা করি যে কাল থেকে তোমরা এখানে আর আরশোলা দেখতে পাবে না।’
পরের দিন রাতে কাজে আসার সময় টমাস একটি টিনের টুকরো সঙ্গে নিয়ে এল। টিনের টুকরোটি ছোটো এবং লম্বায় দুই ভাগ করে সে টেবিলের ওপরে সমান্তরালভাবে সাজিয়ে রাখল। তারপরে সে একটা শক্তিশালী ব্যাটারির দুটো প্রান্তের সঙ্গে টিনের টুকরো দুটি সংযুক্ত করে দিল। টেবিলের ওপরে রাখা হল কিছু খাবার জিনিস।
যথাসময়ে টেবিলের উপরে আরশোলার প্রবেশ ঘটল।আরশোলাটি একটা টিনের টুকরো বেয়ে অন্য একটিতে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৈদ্যুতিক সার্কিট সম্পূর্ণ হল এবং বিদ্যুতের আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে আরশোলার প্রাণ বায়ু উড়ে গেল। এভাবে একের পর এক অনেক আরশোলা টমাসের বৈদ্যুতিক মরণ ফাঁদে ধরা দিল। টমাসের ভেলকিবাজি দেখে তার সহকর্মীদের মুখে কোনো কথা যোগাল না।
অবশ্য বেশি বুদ্ধির পরিচয় দিতে গিয়ে টমাসকে একদিন চাকরিটা হারাতে হল।
টমাস রাতে টেলিগ্রাফ অফিসে কাজ করে, দিনে ঘরে নানা বিষয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করে।ঘুমানোর সময় খুব কম পাবার জন্য রাতে কাজ করে থাকার সময় সে কখনো ঘুমে ঢলে পড়ে। তার সহকর্মীরা নিশ্চয় বৈজ্ঞানিক গবেষণা করে না, কিন্তু রাতে কর্তব্যরত অবস্থায় তাদেরও কখনও ঘুমে চোখ জুড়িয়ে আসে। কোম্পানির মালিকরা প্রায়ই এই কথাটায় সন্দেহ করছিল। সেই জন্য কর্মচারীরা সারা রাত ঠিক মতো কাজ করে কিনা জানার জন্য তাঁরা একটি বুদ্ধি বের করল। তাঁরা কর্মচারীদের এই বলে নির্দেশ দিল যে রাতে অপারেটররা সারারাত এক ঘন্টা পরে পরে টেলিগ্রাফ করে সদর কার্যালয়ে একটি সাংকেতিক বার্তা পাঠাতে হবে। কোনো কর্মচারী সেই বার্তা না পাঠালে বুঝতে হবে যে সে নিদ্রায় অভিভূত হয়ে পড়েছে।
টেলিগ্রাফ অফিসে রাতে সাধারণত বেশি কাজ থাকে না, তাই কাজ না করার সময়টুকুতে কিছু সময় শুয়ে নিলে সেটা কোনো সাংঘাতিক দোষের কথা নয়। অথচ কাজ থাকুক বা না থাকুক এখন থেকে সারারাত জেগে থাকতে হবে। টমাস সেই কথা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না— এ রকম একটি কৌশল করার জন্য সে মনস্ত করল। কোম্পানির মালিকদের নির্দেশ ছিল যে রাতে অপারেটরদের ইংরেজি ছয় শব্দটি মোর্স সংকেতের মাধ্যমে টেলিগ্রাফ করে পাঠাতে হবে। টমাস বুদ্ধি খাটিয়ে এরকম একটি যন্ত্র আবিষ্কার করল– যে যন্ত্র মানুষের হাতের সাহায্য ছাড়াই নিজে নিজে ‘ছয়’ শব্দটি টেলিগ্রাফে পাঠাতে পারে। যন্ত্রটিকে একটি ঘড়ির সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়ার ফলে সে এক ঘন্টা পরে পরে সংকেত পাঠাতে সক্ষম হল। এরপরে খুশি মতো নিদ্রা সুখ উপভোগ করায় টমাসের কোনো অসুবিধা হল না।
কিন্তু কোম্পানির মালিকরাও একেবারে বোকা ছিল না। তাদের একজনের মনে কিছুদিন ধরে সন্দেহের উদ্রেক হতে লাগল। মনের অশান্তি দূর করার জন্য একদিন তিনি টমাসের কাছ থেকে বার্তা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে টেলিগ্রাফের মাধ্যমে ডেকে পাঠালেন। কয়েকবার ডেকে ডেকে তিনি যখন টমাসের কোনো সাড়া পেলেন না তখন তার মনের সন্দেহ আগের চেয়ে বেশি ঘনীভূত হল। গাড়িতে উঠে সেই মুহূর্তে তিনি টমাসের কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। সেখানে গিয়ে তিনি দেখলেন যে তার অনুমানই সত্য। টমাস নিদ্রায় অভিভূত। তার হয়ে টেলিগ্রাফ বার্তা পাঠিয়েছে একটি যন্ত্র।
পরের দিনই টমাস কে চাকরি থেকে বিতাড়িত করা হল।
লেখক পরিচিতি-১৯৩২ সনে লক্ষ্মীমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’,‘বিভিন্ন নরক’,‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোট গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। ১২ মে ২০২১ সনে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।
অনুবাদক পরিচিতি- ১৯৫৮ সনে অসমের নগাঁও জেলার যমুনামুখে বাসুদেব দাসের জন্ম হয়।১৯৮২ সনে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও ভাষাতত্ত্বে এম এ করেন। আজ পর্যন্ত অসমিয়া অনূদিত গল্পের সংখ্যা পাঁচশত কুড়িটির ও বেশি।সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে নিয়মিত ভাবে অসমিয়া গল্প,কবিতা,প্রবন্ধ এবং উপন্যাস অনুবাদ করে চলেছেন।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপরিচিত সংস্থা NEINADএর পক্ষ থেকে অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য Distinguished Life Membership এর দ্বারা সম্মানিত করা হয়।প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা চুয়াল্লিশটি।হোমেন বরগোহাঞির অসমিয়া উপন্যাস ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’(সওদাগরের পুত্র নৌকা বেয়ে যায়) বাংলা অনুবাদের জন্য ২০২৪ সনের সাহিত্য আকাদেমি অনুবাদ পুরস্কারে সম্মানিত হন।

