চিরশ্রী দেবনাথের গল্প– ধানের খেতে একটি ভুল

চিরশ্রী দেবনাথের গল্প– ধানের খেতে একটি ভুল

সকালবেলা ঘুম ভাঙা চোখে প্রথম যার ফোন এলো, সে হলো তৃষার প্রিয় বন্ধু আঁখি এবং যে কথাটি শোনার পর তৃষার ঘুমটুম সব হোয়াটস অ্যাপের ‘ডিলিট মেসেজ ‘ এই প্রিয় অপশনটির মতো জাস্ট উড়ে গেলো, তা হলো আঁখির বিবাহ সংবাদ। ‘ জানিস তৃষা, কাল সন্ধ্যায় আমি অংশুমালীকে বিয়ে করেছি ‘ তোকে জানিয়ে রাখলাম। ব্যস্ এতটুকুই।

তৃষার মনে হলো, আঁখি যেন বলল, জানিস কাল সন্ধ্যায় আমি পিৎজা খেয়েছি।

আঁখি যে কাউকে ভালোবাসছে একথাটাই তো এতোদিন জানতে পারেনি তৃষা। ওকে তো ঘুনাক্ষরেও আঁখি জানতে দেয়নি এমন সিরিয়াস ঘটনা, আজ সে তার বিয়ের খবর দিচ্ছে। কলেজ থার্ড ইয়ার মাত্র শেষ হলো । পেনডেমিকের কারণে অনলাইনে ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে। তাই পরীক্ষা নিয়ে যাবতীয় টেনশন এখন তৃষার মাথা থেকে বের হয়ে গেছে, যদিও কলেজের লাস্ট বছরটা খুব খারাপ গেলো, কোনো বেড়ানো নেই, হুল্লোড় নেই, শুধু আলতুফালতু মানসিক চাপ।

কিন্তু এখন আঁখি কোথায় আছে? ওর বর অংশুমালী এটা জানা গেলো। অংশুমালী কে? এই লোকটির নাম তো কখনো তৃষা আঁখির কাছে শোনেনি। তিনি কি বড়ো চাকরি করেন? না এখনো স্টুডেন্ট। আশ্চর্য তো, আঁখি যে এমন ভেলকি দেখাবে তা তৃষা আন্দাজও করতে পারেনি। আঁখি কি এখন ওর নতুন বরের সঙ্গে শ্বশুরবাড়িতে

আছে? না নিজের বাড়িতেই আছে, কাউকে না বলে, রেজিস্ট্রি করে রেখেছে শুধু ? আর কেউ জেনেছে তৃষা ছাড়া?

এইরকম অসংখ্য চিন্তা নিয়ে তৃষা বাথরুমে ঢুকল। নাহ হোয়াটস অ্যাপে এখনো আঁখির বিয়ে সংক্রান্ত কোনো মেসেজ বন্ধুরা করেনি। তারপর দাঁত মাজতে মাজতে, মুখে জল দিতে দিতে, তৃষার মনে চিন্তার ঢেউ, এই অনন্ত বিষাদের সময়ে কার সঙ্গে উড়ে গেল আঁখি।

বাথরুম থেকে বেরিয়েই দেখে, মা দাঁড়িয়ে আছে, উদ্বিগ্ন মুখ। তৃষাকে বললেন, আঁখির বাবা এসেছেন, খুব টেনশনে আছেন তিনি, আঁখি নাকি কাল বিকেলে কোথাও বেরিয়েছিল, তারপর আর বাড়ি ফেরেনি। আজ সকালে থানায় ডাইরি করেছেন, এখন তোর সঙ্গে কথা বলতে এসেছেন। তৃষা নিজের মনকে খুব শান্ত করে নিলো, তারপর আঁখির বাবার সামনে গিয়ে বসলো, উনি কিছু বলার আগেই তৃষা বলল, আজ সকালে আমার হোয়াটস এপে একটি মেসেজ এসেছে আঁখির, সেখানে ও বলেছে, অংশুমালী নামে একটি ছেলেকে আঁখি কাল বিয়ে করেছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন মেসোমশাই আমি কোনোদিন আঁখির মুখে এই ছেলেটির নাম শুনিনি, এমনকি সে যে কাউকে ভালোবাসতো, তাই আমরা কোনো বন্ধুরা জানি না। তৃষা হোয়াটস এপ খুলে মেসেজটি দেখাল আঁখির বাবাকে। আঁখির বাবার মুখে কিন্তু তখন সেই ভয় ভাবটি একটু কমে গেলো । তিনি হয়তো ভেবেছিলেন আঁখি কি ধর্ষিতা হলো বা কিডন্যাপড। তার জায়গায় বিয়ে, বিয়ে মানে যদিও সবটাই, তবুও মৃত্যু তো নয়, কিন্তু অনেক সমস্যার ইঙ্গিতবাহী।

এবার আঁখির বাবা অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে করুণভাবে তৃষার মা’র দিকে তাকিয়ে বললেন, একটি অনুরোধ, আপনি তৃষাকে একটু খাইয়ে দিন, আমি ওকে নিয়ে ওদের বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে একটু খোঁজ খবর নিতে চাই, ফোন করে নয়, ফোনে মনে হয় সবটা বলা হয়ে ওঠে না। একটু চেষ্টা করা আর কী, যদি কেউ কিছু জানে।

ঘটনার আকস্মিকতায় তৃষার মাও হতবাক। তাই তিনি বললেন, অবশ্যই।

বন্ধুবান্ধবদের বাড়ি ঘোরা হলো। ছেলে বন্ধু এবং মেয়ে বন্ধু দু’রকমই। কিন্তু সবাই শুনে স্তম্ভিত এবং নিন্দামুখর । আঁখির এই বিয়ে যেন তাদের কাছে বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো। এখন এমনিতেও লকডাউনের ফলে বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে যাওয়া আসা হচ্ছে না, তাই বহুদিনের মধ্যে আঁখি বা তৃষা কেউ তাদের বন্ধু পরিমণ্ডলে জমিয়ে আড্ডা দেয়নি, তবুও ঘনিষ্ঠজনদের বাড়ি যাওয়া হলো সামান্যতম ক্লু’য়ের আশায়।

দুপুর একটা বাজে, থানা থেকে এখনো কোনো ফোন আসেনি। আঁখির বাবার মুখ শুকিয়ে আছে, তিনি তৃষাকে বাড়ি পৌঁছে দিলেন, তারপর বললেন, কাল আবার একটু খোঁজাখুঁজি করবো, তুমি সঙ্গে থাকবে তো মা? আসলে আঁখির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু তুমিই, তাই তো আমরা বাড়ির লোক জানতাম, কিন্তু আজ আঁখিকে আমি ক্ষমা করতে পারছি না, এই দুঃসময়ে সে আমাদেরকে এভাবে আঘাত দিয়ে চলে গেলো।

তৃষাও ভাবছে আঁখি আসলে খুব স্বার্থপর, সে শুধু নিজের কথাই ভেবেছে, বাবা মায়ের সম্মানের কথা ভাবেনি।

তৃষার ভেতরটা একদম বিস্বাদ হয়ে আছে। কিছুই ভালো লাগছে না। আর একটিও মেসেজ নেই আঁখির তরফ থেকে, প্রায় দেড়দিন ধরে দেখাচ্ছ ও হোয়াটসএপে অ্যাকটিভ নয়।

থানা থেকেও এখনো জানাতে পারেনি কিছু । তৃষা শুয়ে শুয়ে ভাবছে, অংশুমালী মানে হচ্ছে সূর্য। আঁখি তাহলে সূর্যের মতো একটা লোককে বিয়ে করেছে, যদি নাম এবং চেহারা একে অপরের পরিপূরক হয় । আঁখির চেহারা সুন্দর, গায়ের রং খুব ফর্সা নয়, ফর্সার ওপর যেন নরম এক পোঁচ মেঘ, কিন্তু ভেতর থেকে গোধূলির আলো বের হয়, চুলগুলো কিছুদিন হলো স্ট্রেট করেছে, তাতে আঁখির গ্ল্যামার আরো বেড়েছে। পরদিন আবার বেরোতে হলো আঁখির বাবার সঙ্গে, ভদ্রলোক আর কারোর ওপর ভরসা করতে পারছেন না, কাউকে জড়াতেও চাইছেন না, যেন ভীষণ লজ্জার কোনো ব্যাপার ঘটে গেছে, আজকে তিনি ওদের কলেজের পাশটায় যেতে চাইছেন, ওখানে যে ছোটখাটো দোকান আছে চা টিফিনের, সেখানে কেউ কখনো আঁখিকে কারো সঙ্গে দেখেছে কীনা এসব জানতে। তৃষা ভাবছিল অন্য কথা, একজন মেয়ে বা ছেলে কেনো মা বাবার মনে কষ্টের পাহাড় ঢেলে এরকম কাজ করে, বিয়ে অথবা ভালোবাসা কী এতোটাই ইম্পপরট্যান্ট, ছোট থেকে যে মা বাবা এতো আদর করে বড় করে তুলল, তাদের কথা একবারও মনে পড়ে না। আঁখির জন্য আজ ওর বাবার দুচোখের নিচে ঘন কালি পড়ে গেছে দুদিনে। চুল উস্কোখুস্কো। চোখ তুলে কথা বলতে পারছেন না। যেন সমস্ত দোষ একমাত্র পিতামাতার। পাড়া পড়শিদের খোঁচা দেওয়া কথাবার্তা, আত্মীয় স্বজনদের নকল শোক, সবকিছু মিলিয়ে অসহ্য হয়ে যাচ্ছে সময়গুলো, তিনি কিছু বলছেন না, আঁখির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগও করছেন না , শুধু মাঝে মাঝে বলছেন, জানো তৃষা, আমি শুধু একবার জানতে চাই আঁখি কোথায় গেছে , কী এমন সুখের সন্ধানে আঁখি পালিয়ে গেলো, বলতে পারো তুমি? আমাকে একবারটি বললে, ভাবতাম, হয়তো ওখানেই বিয়ে দিতাম। ভেবেছিলাম আঁখি পি এইচ ডি করবে, নেট দেবে, প্রফেসর হবে, একটি সুন্দর জীবন ওকে গড়ে দেবো আমি, আমাকে একদম ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিলো আঁখি। তাই না ? সমাজের কাছে কেমন করে মুখ দেখাই?

এগুলো প্রশ্ন অথবা প্রশ্ন নয়, কিন্তু এসবের কোনো উত্তর নেই তৃষার কাছে।

কলেজের গেট খোলা। স্টুডেন্ট নেই, কিন্তু অফিশিয়াল কাজকর্ম হয়তো চলছে ভেতরে, সামনে কয়েকটি দোকান , এখনো ডে কার্ফু শুরু হয়নি। কোভিড পরিস্থিতিতে, কার্ফুর সময় পরিবর্তিত হচ্ছে যখন তখন। কয়েকদিন হলো বিকেল চারটা পর্যন্ত খোলা, তারপর কার্ফু স্টার্ট হয়ে যাচ্ছে। এখন সকাল এগারোটা বাজে। আঁখির বাবা খুব শান্তভাবে প্রথম দোকানে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কি অংশুমালী নামে কাউকে চেনেন? তৃষা জানত এসব থেকে কোনো উত্তর আসবে না। দোকানদার মাথা নাড়ল। কিন্তু সেই দোকানে বসে চা খাচ্ছিল একটি ছেলে, চোখে কালো চশমা, তাই দৃষ্টিটা বোঝা না গেলেও তৃষার সিক্সথ সেন্স বলল, ছেলেটা ওদের দিকে তাকাচ্ছিল। সবগুলো দোকান ঘোরা হলো, জেরক্স সেন্টার এবং একটি স্টেশনারি দোকানও। কোভিড পরিস্থিতিতে দোকানগুলো টিমটিম করছে এমনিতেই, মানুষগুলোর মুখ ভাঙাচোরা, দৃষ্টিতে শূন্যতা মাখানো, তারমধ্যে অনেকের চেহারাও বোঝা যাচ্ছে না, মাস্কের জন্য।

কোনো দোকানের কর্মচারী বা মালিকই

অংশুমালী নামক লোকটির ব্যাপারে ক্লু দিতে পারলেন না।

আঁখির বাবা আশাহত হলেন খুব। এবার কোথায় যাই বলতো মা। আমার আর কিছু চাই না, শুধু মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করবো, সে কেন এমন করলো। আমি তো সেই মুহূর্তেই মরে গেছি, যখন তোর কাছে সেদিন সকালবেলা শুনেছিলাম।

ত়ৃষা বুক থেকে সব শক্তি সংগ্রহ করে গলায় উৎসাহ নিয়ে বলল, কাকু এরকম বলবেন না, হয়তো অংশুমালী খুব ভালো ছেলে। আঁখিকে সুখে রাখবে, আঁখি শুধু লজ্জায় বলতে পারেনি আপনাদের।

আঁখির বাবা, হাসলেন। একজন ব্যর্থ বাবার হাসি।

টমটম নিয়ে নেই কেমন, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবো, তৃষার কেমন যেন লাগছিল ভদ্রলোককে দেখে, হার্ট অ্যাটাক না করে বসেন।

টমটমে উঠতে যাবে ওরা, সেসময় ওদের দিকে এগিয়ে এলো চায়ের দোকানের সেই ছেলেটি, মুখে এখন মাস্কটা সেঁটে রেখেছে।

বলল, অংশুমালীকে আমি চিনি, ওর বাড়িও । আপনারা কি অংশুমালীর বাড়িতে যেতে চান?

কয়েক মুহূর্তের জন্য তৃষা ও আঁখির বাবা দুজনেই অবাক হয়ে চুপ করে রইল।

হ্যাঁ যেতে চাই, তৃষা বলল। আপনি নিয়ে যেতে পারবেন?

না, আমি নিয়ে যেতে পারব না। আপনাদের ঠিকানা বলে দিচ্ছি, ফোন নাম্বারও আছে। নিজেরা যান। আপনার মেয়ের সঙ্গে আমি ওকে যেতে দেখেছি সেদিন।

এমন একজন জলজ্যান্ত সাক্ষী পেয়ে যাবে ওরা, এ যে কল্পনারও অতীত।

কিন্তু আপনাকে তো আমি একদমই চিনলাম না, তৃষা বলল। আঁখিকে চেনেন আপনি?

হ্যাঁ। চিনি একবছর ধরে, ও অংশুমালীর সঙ্গে ঘুরে বেড়াত সবাইকে লুকিয়ে। অংশুমালী খারাপ নয়, তবে আপনাদের স্ট্যান্ডার্ডের নয় হয়তো ।

আর কিছু বলব না। ছেলেটি চলে গেলো।

তৃষা আঁখির বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,

কাকু ফোন করব?

না, আমি যেতে চাই এখনি ওখানে।

ঠিকানা দেখে টমটমের ছেলেটি বলল, আপনারা অটো নিন। বেশ দূরে আছে এই গ্রামটি । এতোদূর টমটম যাবে না।

ঠিকানায় লেখা, ‘ লক্ষ্মীপুর ‘, নাম শুনেছেন আঁখির বাবা, কোনোদিন যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি, আজীবন শহরের স্কুলে চাকরি করেছেন, এখন সেই স্কুলেরই প্রধানশিক্ষক, আর দুবছর পর রিটায়ারম্যান্ট। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে যান, শহরের একজন গন্যমান্য সজ্জন পরিচিত মানুষ তিনি।

ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, উত্তেজনায় কাঁপছেন, কপাল লাল হয়ে উঠেছে। তৃষা একবার ভাবল আরো কাউকে সঙ্গে নেওয়া হোক । কিন্তু আঁখির বাবা আর এক মুহূর্ত দেরি করতে রাজি নন।

একটি অটো আসছিল। হাত তুলে দাঁড় করালেন, যা টাকা চাও দেবো, আমরা দুজন যাবো এবং আসবো লক্ষ্মীপুর, রাজি?

অটোওয়ালা রাজি হলো।

ঝলমলে রোদে ভেসে যাচ্ছে চারদিক। কে বলবে পৃথিবীতে এখন অদৃশ্য ভাইরাসের আক্রমণ।

চারদিকে ধানখেত, মাঝে কয়েকটি বড়ো বড়ো গোডাউন, সিমেন্টের, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ঔষধের, একটি হিমঘর, এসব পেরিয়ে তারা গ্রামে ঢুকল। প্রথমেই বাজার।

গ্রামের দিকে কার্ফু ঢিলেঢালা। দোকান খোলা, কাঠের বেঞ্চিতে দুজন লোক বসে আছে এবং সকলের সঙ্গেই মাস্ক রয়েছে, যদিও তা থুতনিতে ঝোলানো।

অংশুমালীদের বাড়ি চেনেন আপনারা কেউ?

আঁখির বাবা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

অটো থেকে নামা অব্দি সকলেই ওদের দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকাচ্ছিল, নিচু গলায় মৃদু হেসে বলাবলিও করছিল।

প্রবীণ যে লোকটি ক্যাশে বসেছিলেন, তিনি বললেন রাস্তাটি দিয়ে সোজা যেতে হবে প্রায় দু আড়াই মাইল, একটি বটগাছ, সেখান থেকে বাঁদিকে আরো একটি মাটির রাস্তা গেছে, ওখানে কয়েকটি পুকুর পাবেন, মাছ চাষ হয়, সেখানেই অংশুমালীদের বাড়ি। আপনাদের সঙ্গে তো অটো রয়েছে, কোনো অসুবিধে নেই, তিনি আরো কিছু বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু খুব সম্ভবত তার ছেলে জিনিসপত্র দিচ্ছিল লোকজনকে, ঈশারা করে না করলো। আঁখির বাবার মুখ তখন অসম্ভব থমথমে হয়ে উঠেছে। তিনি তৃষার দিকে তাকিয়ে বললেন, চলো মা, আজ শুধু একটি দিনই, আর ডিস্টার্ব করবো না তোমাকে।

এটা কী বলছেন কাকু, চলুন আপনি, আমি তো আছিই ।

লক্ষ্মীপুর বেশ সমৃদ্ধ গ্রামই মনে হচ্ছে। লোকজনের বাড়ির উঠোনে ধান শুকোনো হচ্ছে, গরু ছাগল, হাঁস, মুরগি, শাকসব্জি, একদম পাঠ্যবইয়ে পড়া আদর্শ গ্রামের মতো।

আঁখির বিয়ের ব্যাপারটা না থাকলে, আজ তৃষা এই দৃশ্যটা উপভোগ করতো। বেড়ানো বা ফেসবুকে সেলফি দেওয়ার জন্য বেশ ভালো, কিন্তু থাকার কথা ভাবলেই তৃষার গা গুলোচ্ছে। কত ভেতরে যাচ্ছে তারা, আস্তে আস্তে বাংলাদেশ সীমান্ত কাছে এসে যাচ্ছে, মাঝে মাঝেই কাঁটাতারের বেড়া দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। বটগাছের গোড়ায় এসে অটোওয়ালা বলল, এটাই বোধহয় সেই গাছ?

বাঁদিকে মাটির রাস্তা, আর চারপাশে শুধু ধানখেত ও সব্জিখেত । মাটির রাস্তা দিয়ে অটো যেতে পারবে, কিন্তু লোকটি বলল, আমি এখানে আছি আপনারা ঘুরে আসুন তাড়াতাড়ি, ভেতরে গেলে অটো ঘোরাতে অসুবিধে হবে।

খুব রোদ, আর ভীষণ টায়ার্ডও লাগছে তৃষার, কিন্তু আঁখির বাবা বলল, ঠিক আছে, দাঁড়ান আপনি।

অতএব হাঁটা শুরু হলো। বেশি দূর যেতে হলো না, পুকুরওয়ালা একটি গ্রামের বাড়ি দেখা গেলো। এই পুকুরগুলো মাছ চাষের জন্য কাটা হয়।

আঁখির বাবা বললেন এটাই হবে আমি নিশ্চিত। দুপাশে দুটো পুকুর, বড় বড় বাঁশ গাঁথা আছে জলে, মাঝখানে রাস্তা, সেই রাস্তা দিয়ে তিনি তৃষাকে নিয়ে একদম বাড়িটির উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালেন। জোরে জোরে ডাকলেন, আঁখি আঁখি !

উঠোনে কয়েকটি বাচ্চা খেলছিল, টিনের চাল দেওয়া মাটির দাওয়ায় একজন বুড়ো বসে বসে চা মুড়ি খাচ্ছেন । দু তিনজন বউ ঝি ঘোমটা টেনে কাজকর্ম করছে, পায়রা ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে ওখানে।

একজন যুবক বেরিয়ে এলো, শ্যামলা রঙ, চুল তেল দিয়ে আঁচড়ানো, পেটানো স্বাস্থ্য, লম্বা ।

আঁখির বাবাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল, বলল আমি অংশুমালী, গ্র্যাজুয়েট, চাষবাস করি, সোজা কথায় কৃষক বলতে পারেন । চাকরির কোনো চেষ্টা কখনো করিনি, করবোও না, আপনাকে চিনি আমি শহরের একজন স্বনামধন্য শিক্ষক হিসেবে , আঁখিকে আচমকাই দেখেছিলাম আপনার সঙ্গে একদিন, খুব ভালো লাগল ওকে, ভাবতাম আমি যা ভাবছি তা অসম্ভব, তবুও লুকিয়ে প্রপোজ করলাম, জানতাম উত্তর আসবে

‘না ‘, পরিচয়ে অবশ্য একজন আধুনিক কৃষক একথাও লিখেছিলাম।

কিন্তু খুব আশ্চর্য হলাম যখন আঁখি আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইল। সবই বলেছি সেদিন ওকে। ও শুধু বলেছে আমার বাবা কৃষকদের খুব পছন্দ করে, সবসময় বলে কৃষক হলো আমাদের অন্নদাতা, সব সরকার তাদেরকে শোষন করেছে শুধু, তিনি দিল্লিতে কৃষক আন্দোলনকে খুব সমর্থন করতেন।

তাই মজা করে বলেছিলাম, আমাকে বিয়ে করতে পারবে এই মুহূর্তে? তোমার বাবা কি রাজি হবেন?

আঁখি বলল হয়তো রাজি হবেন না, তবে আমি সত্যিই তোমাকে বিয়ে করবো। এই ঘটনাটি পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্যজনক ঘটনা আমার মনে হয়েছে। আমি আঁখিকে এক বিন্দু জোর করিনি, এমনকি সে এখনও ইচ্ছে করলে আপনার সঙ্গে চলে যেতে পারে, আনুষ্ঠানিক কোনো বিয়ে হয়নি আমাদের, শুধু সিঁদুর পরিয়েছি মন্দিরে গিয়ে।

আঁখিকে ডেকে দিচ্ছি আমি।

কোনোরকম ভনিতা না করে একশ্বাসে এতোগুলো কথা বলে অংশুমালী মাথা একটু নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

আঁখির বাবা অংশুমালীর দিকে তাকিয়ে আছেন, কিন্তু তাকে দেখছেন না, শূন্য দৃষ্টি।

আঁখিকে আর ডাকতে হলো না, বারান্দায় এসে দাঁড়ালো সে , সুতির শাড়ি পরা, কপালে সিঁদুর জ্বলজ্বল করছে, চোখে জল, এই জল কীসের, ভালোবাসার না মা বাবাকে কষ্ট দিয়ে এভাবে পালিয়ে আসার জন্য, তৃষা ঠিক বুঝতে পারলো না।

আঁখির বাবা, আঁখির দিকে তাকিয়ে বললেন, চলে এসো, যেমন আছো তেমনই, অটো দাঁড়িয়ে আছে সামনের রাস্তায়, এখনো কিছু হয়নি।

বাবা আমি অংশুকে ভালোবেসেছি।

আমরা কি তোমাকে কম ভালোবাসি আঁখি? ভদ্রলোকের কথায় তীরভাঙা আকুলতা। কত উজ্জ্বল জীবন তোমার, এই অজগ্রামে একজন চাষার সঙ্গে তুমি জীবন কাটাবে? একমাত্র মেয়ে তুমি আমাদের, তুমি যা করছো তা হলো চরম ভুল, অল্প বয়সে এরকম মনে হয়, দুদিন পর পস্তাবে, তখন আর সহজে ফিরতে পারবে না, আটকে যাবে সংসারে। মাস্টার্সের জন্য ভালো ভালো ইউনিভার্সিটিতে এপ্লাই করবো আমরা, পি এইচ ডি করবে, চাকরি করবে, ছিঃ আঁখি এটা কিসের মধ্যে এসে ঢুকেছো, এই অন্ধকার গুহায়।

তুমি না বলো কৃষকরা দেশের ভবিষ্যত, সবসময় কৃষকদের আন্দোলনকে

সাপোর্ট করো! আমি ওর সঙ্গে থেকে কৃষিকাজে যুক্ত হতে চাই বাবা।

আঁখির বাবা স্তম্ভিত হয়ে রইলেন।

আর কোনোদিন তুমি ফিরে আসবে না আমার বাড়িতে, দশ মিনিট দাঁড়াবো আমি। ডিসিশন নাও।

আঁখি ঠায় দাঁড়িয়ে রইল, চারপাশের বারান্দায় বাড়িটির অন্যান্য সদস্যরা দাঁড়িয়ে আছে, কেউ একটি শব্দও করছে না,

হঠাৎ ভেতরে কোথাও ঝনঝন করে বাসন পরল, আস্তে আস্তে একটু গুঞ্জন শুরু হয়েছে বাড়ির মেয়েদের মধ্যে।

আঁখির বাবা সেসব কিছুই শুনছেন না, তার চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে, আগুনঝরা চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন শুধু।

দশ মিনিটকে মনে হলো একযুগ।

আঁখি মাথা নিচু করলো এবার।

চলো তৃষা, আঁখির বাবা একটিবারও আর পেছন ফিরে তাকালেন না।

অটোর স্পিড এখন খুব বেশি। তৃষার মনে হচ্ছিল, আঁখির সজল মুখখানি। এ কী করলো আঁখি, দ্যাট্ ফার্মার, ওহ্ মাই গড। তৃষা বিশ্বাস করতে পারছে না। আঁখির বাবা কাঁদছেন। এই তিনদিনের মাথায় ভদ্রলোকের এটাই হয়তো প্রথম কান্না। কাঁদুক উনি। ভেতরটা হালকা হবে। তৃষার মনে হলো আঁখি

একটি চরম ভুল করেছে, যা আসলে বিভীষিকা ছাড়া কিছু নয় তৃষার কাছে।

ওর মতো একটি স্মার্ট শহুরে মেয়ে এরকম ডিসিশন নিলো কী করে?

বিষণ্ণমুখে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে তৃষা।

ভরা বর্ষায় সবুজ হয়ে আছে ধানের খেতগুলো, অল্প বাতাসে দোল খাচ্ছে আহ্লাদে, একটু মেঘ করা আকাশের অভিমানী মুখ নেমে এসেছে ধানের শিষের ওপর, যেন কাঁদবে, কিন্তু কাঁদতে পারছে না,

ভারী অপমান হয়েছে তার কোথাও?

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes