
ললিথাম্বিকা অন্থর্জনম -এর গল্প অনুবাদ- শম্পা রায়
মালয়লম ভাষা ও সাহিত্যের সুবিখ্যাত লেখক ললিথাম্বিকা অন্থর্জনম (১৯০৯-১৯৮৭) কবিতা, গল্প, উপন্যাস---সৃষ্টির প্রায় প্রতিটি শাখাতেই অনায়াস দক্ষতার ছাপ রেখেছেন।‘অগ্নিসাক্ষী’ তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা। এই উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সালে তিনি সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কারে সম্মানিত হন। এছাড়াও ওয়লার অওয়ার্ড, ওডক্কুষল অওয়ার্ড, কেন্দ্র-সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কারও তিনি অর্জন করেছেন। ললিথাম্বিকার কলমে জীবনের অতলস্পর্শী অনুভব বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে।
ধীরেন্দু মজুমদারের মা
আমায় চেনো তোমরা? আমি শান্তি মজুমদার। নব্বই বছর বয়স। আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা — সবই পূর্ববঙ্গের এক গাঁয়ে। ন’টা সন্তানের জননী। সাত ছেলে, এক মেয়ে। এদেশের জন্য পাঁচ সন্তানকে বলি দিয়েছি। আর চারটেকে দিলাম পাকিস্তানের জন্য। শেষে নবীন প্রজন্মের সব ছেলেমেয়েকে দত্তক নিই — তারাই আমার পুত্র-কন্যা-নাতি-নাতনি। চেয়েছিলাম, ওই গাঁয়েই… যে মাটিতে আমার পূর্বপুরুষদের জন্ম-মৃত্যু… সেখানে আমারও মরণ হোক। সেদিন মুক্তিফৌজের সেপাইরা যদি আমায় জোর করে কাঁধে তুলে না পালাতো, তাহলে এই শান্তিদিদিমাও যুদ্ধে সগর্বে প্রাণ দিয়ে কবেই মুক্তি পেত!
কী বলছ? আমি সাহসী! তা অকারণে ভয় পাব-ই বা কেন? শান্তির কোনো সন্তান কক্ষনো ভয় পায়নি। ভারত আমার আপন দেশ। আমার পাঁচ সন্তানের রক্তমাংস এই মাটিতে মিশে আছে। কিন্তু একজন শরণার্থী, একজন বিদেশির মতো এখানে পড়ে থাকা শান্তি দিদিমার মোটেই পছন্দ নয়। বাছারা, তোমরা বোধহয় বুঝেছ,ভারত মানে আমার কাছে শুধু একমুঠো মাটি নয়। সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা স্বর্ণমাতৃকা আমাদের। তাঁর হাতের ঝকঝকে ধারালো তলোয়ারের ধ্যান-ভজনা করে নিজের ছেলেমেয়েদের বড় করেছি আমরা। তাঁর মুক্তির জন্য আপন সন্তানদের উৎসর্গ করেছি। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথমদিকের সেই নিঃস্বার্থ সাহসী শহীদদের গল্প কি তোমরা শুনেছ, বা তোমাদের ইতিহাসে কি এধরনের কোনো ঘটনার উল্লেখ রয়েছে?
স্মৃতিগুলো একে একে স্পষ্ট হচ্ছে। রোমাঞ্চকর সব স্মৃতি ! বিশেষ কোনো মানুষ বা পরিবারের নয়, একটা গোটা দেশের করুণ কাহিনি! শান্তি মজুমদারের কথায় বিস্তারিত জানতে পারবে।
শোনো তবে। আজ যাকে তোমরা পূর্বপাকিস্তান বলো, আমাদের ভিটে ছিল সেই দেশের মাঝামাঝি। যে পথ ধরে পদ্মা নদী পূবে সাগরের দিকে বয়ে গেছে, তার বাঁপাশে ছিল আমাদের জমিদারি। ওই এলাকায় মাঝেমধ্যে বান ডাকত। সারা গাঁয়ের লোকজন তখন দুর্গামন্দিরের ওপারের পাকঘরে উঠে যেত। শুধু মজুমদারবাড়ির বউরা প্রাসাদের মতো বাড়ির ঘের-বারান্দায় বসে বসে পদ্মার জলের সংহারতাণ্ডব দেখত। তারা কখনও অন্ত:পুরের বাইরে পা ফেলেনি। কোনোদিন কোনো পরপুরুষের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি। একবার ছোটকর্তা অবনী মজুমদারের সোহাগের গিন্নি প্রসবযন্ত্রণায় কাতরাতে শুরু করলে তিনি জেদ করে শহর থেকে ডাক্তার আনতে চেয়েছিলেন। লোকে যাকে ‘রাজাসাহেব’ বলত, সেই বড় মজুমদার, নিষেধ করেন। মহিলাদের রোগভোগ হলে মরণ ছাড়া আর কেউ সেই মজুমদার বংশের অন্দরমহলে ঢুকতে পারে না। সেখানকার রীতিই এই।
লাল রেশমি কাপড়ে, মাথাভরা সিঁদুরে বিয়ের সাজে সেজে বন্ধ পালককিতে চড়ে ওই বাড়িতে যখন প্রথম পা দিই, তখন আমি মাত্র ন’বছরের মেয়ে। পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত কখনো ওই বাড়ি থেকে বেরোইনি। বড় ছেলে ধীর কলেজে পড়াকালে ওর এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য সদর দরজায় দাঁড়াতে কত মিনতি করেছিল। একবার সস্ত্রীক মহামান্য রাজ্যপাল এসেছিলেন। তাঁকে অভ্যর্থনার জন্য বেরিয়ে আসতে স্বামী শত অনুরোধ জানিয়েছেন। তাতেও রাজি হইনি। সত্যি বলতে, উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে জন্ম-নেওয়া এক মেয়েমানুষের এমন আচরণ, ভাবাই যায় না। আমিও নিয়ম ভাঙতে ভয় পেতাম, কিন্তু পেটের সন্তানই যদি সমস্ত বিধিরীতি গুঁড়িয়ে দিতে চায়, তাহলে কী করব বলো? এক দিকে স্বামী, অন্যদিকে সন্তান! এমন ধর্মসঙ্কটে মা কার পক্ষ নেবে, কাকে সাহায্য করবে? কর্তব্যের ভয়ঙ্কর টানাপোড়েন! এ তোমরা বুঝবে না, বাছারা, কক্ষনো বুঝতে পারবে না।
মজুমদাররা অতিমাত্রায় রাজভক্ত পরিবার। নানা জায়গায় ছড়ানো তাদের জমিদারি, ভূসম্পত্তি। পঞ্চায়েতপ্রধানও তারাই। আমার স্বামী রায়বাহাদুর এবং বিশিষ্ট বিচারপতি। আবার মাননীয় ব্রিটিশ সরকারের পরামর্শদাতা সমিতির সদস্যও বটে। রাজ্যপাল তথা ভাইসরয় কালে-অকালে অতিথি হয়ে আসতেন। ভেবেছিলাম, বি এ পাস করলেই বড় ছেলে ধীরেন্দুকে আই সি এস পড়তে বিদেশে পাঠিয়ে দেব। কর্তা বলতেন, “রায়বাহাদুর তো একটা ফাঁপা খেতাব, কিন্তু আই সি এস… অর্থবিত্ত আর ক্ষমতা দুই-ই এনে দেবে।”
ধীর,অবশ্য এসব কথার কিচ্ছুটি না জেনেই বাড়ি থেকে কলকাতা আর কলকাতা থেকে বাড়ি,দরকার মতো আসা-যাওয়া করত। সে লেখাপড়ায় যেমন তুখোড়;তেমন সুন্দর চেহারা আর মিষ্টিভাষী। তবে সবচেয়ে বড় যেটা, সক্কলের মুখে মুখে ধীরেন্দু মজুমদারের দয়া, মায়ার সুখ্যাতি। সবসময় একদল সাধু ওর সঙ্গী। তাদের কারোর জন্য সদরবাড়িতে, কাউকে বা অন্ধকার গুদামঘরে থাকার ব্যবস্থা করত। বাড়ির রান্নাঘর থেকে খাবার পৌঁছে দিত। এইসব লোকজনের জন্য আমার থেকে কত পয়সা যে সে নিয়েছে! লোকের মুখে বাবু ধীরেন্দ্রর প্রশংসা শুনে তৃপ্তিতে আমার দু’কান ভরে থাকত।
এক রাতে ঘোমটা-ঢাকা এক মেয়েকে নিয়ে সে ভেতরবাড়িতে এলো; “মা! ইনি ভৈরব মার্গের যোগিনী। কারোর সঙ্গে কথা বলা,মেলামেশা বা দেখাসাক্ষাৎ করবেন না। তোমার ঘরের কাছাকাছি কোনো ছোট ঘরে ওনাকে থাকতে দাও। খাবারও তুমি নিজেই এনে দিও।” আমি ভারী খুশি হয়েছিলাম। এ যুগে, বেশিরভাগ ছেলেপুলে বারস্ত্রীদের পিছনে দৌড়ায়, আর এ সন্ন্যাসীদের আদর-আপ্যায়নে ব্যস্ত!
অন্ধকার ঘরে বসে সন্ন্যাসিনী দিন-রাত লেখাপড়া করতেন। লিখতে লিখতে কাগজের স্তূপ জমলে ধীর এসে সেসব নিয়ে যেত। মন্ত্র জপ করার মতো ওরা দুজনে নিজেদের মধ্যে কী ফিসফিস করত, কিন্তু আমি খাবার নিয়ে গেলে সেই মহিলা ঘোমটা টেনে ঘরের কোণে সরে দাঁড়াতেন; হয়তো আমি তাঁর শিষ্যা নই বলেই। তুমুল বৃষ্টিভেজা এক গভীর রাতে ধীর আমাকে সেই আঁধার ঘরে নিয়ে আসে। “মা, যোগিনী-মা আজ ফিরে যাচ্ছেন। এখন উনি তোমার সঙ্গে দেখা করে কিছু উপদেশ দিতে চান। এসো।” বলে সে সন্ন্যাসিনীর মুখের গেরুয়া কাপড়ের ঘোমটা সরিয়ে দিল। আমি স্তব্ধ ! এ তো একজন পুরুষ … যুবক। যেন ধীরের দাদা। “মা, আমায় ক্ষমা করুন, আমি সূর্য সেন।” জোড়হাতে সে বলতে থাকে, “সবাই আমায় ‘মাস্টারদা’ ডাকে। মহাকালী রূপে আমরা মাতৃভূমির আরাধনা করি। শত হস্তে তরবারি, শত হস্তে চক্র ! শত্রুর রক্তে রাঙা মাথা, নাড়িভুড়ি শোভিতা। কিন্তু আজ প্রথমবার দেবীর অন্নপূর্ণেশ্বরী রূপ, করুণা মূর্তি দেখলাম। আশীর্বাদ করুন, এই রূপ যেন চিরদিন আমার হৃদয়ে উজ্জ্বল থাকে।” আমার পায়ের ধুলো নিয়ে ‘মাস্টারদা’ কাঁদছিল। সঙ্গে আমিও। এই কি সেই বিখ্যাত বিপ্লবী সূর্য সেন, উগ্রপন্থী! দেশদ্রোহী! এর মাথার জন্যই পুলিসের লোক ছুটে মরছে? তাঁর নতশিরে হাত ছুঁইয়ে মনে হল আমার হৃৎপিণ্ডটাই ধরে আছি। “সূর্য সেন! মাস্টারদা! আমার দিদিই তোমার গর্ভধারিণী নন তো?”
সময় দ্রুত ফুরায়। একটা নৌকা পদ্মায় নোঙর করা ছিল। উথালপাতাল ঢেউয়ের মধ্যে দিয়ে সেই নৌকার হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি নিশ্চল হয়ে দেখতে থাকি। ততক্ষণে শান্তি মজুমদার নামের ঘরোয়া গৃহবধূটির মৃত্যু হয়েছে। এর পরিবর্তে জন্ম নিয়েছে এক নতুন নারী — বঙ্গমাতা। এমন ঘটনার সবটুকু জেনেও কিছুই না জানার ভান করি। একই সময়ে স্বতন্ত্র দুটো মানুষ হয়ে দিন কাটাই।
দিন যায়। পুলিস সূর্য সেনকে ধরেছে, তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হবে — খবরটা শুনে ধীরের বাবা বলেন, “বেশ হয়েছে। ওর মতো দেশদ্রোহীর এই শাস্তিই দরকার। কে জানে কী সব অশান্তি বাঁধিয়েছে। মহামহিম রাজ্যপাল কালও বলছিলেন, মজুমদার সাহেব! আপনার বড়ছেলে বেশ সাহসী। ওকে পুলিসে নেব বলে ভেবেছি।” শুনে কান্না চাপার চেষ্টা করলেও আমি চোখের জলে ভেসে যাই। সূর্য সেনের মৃত্যুর খবরে নাকি যে ছেলে ভবিষ্যতে পুলিশ কর্মচারী হবে তার কথা ভেবে এমন হল, কে জানে। … যাক! সে সব বাদ দাও।
মাস্টারদার মৃত্যুর পরেও ধীর বিভিন্ন মানুষজন নিয়ে এসেছে। কয়েকজনকে আশ্রয়ও দিতে হয়েছে আমায়। তারপর হঠাৎ একদিন সেই বোমাটা ফাটল…ধীরের বাবা রায়বাহাদুর নীহারেন্দু মজুমদার পুলিসের বড়কর্তার থেকে শুনলেন, তার ছেলের ওপর সরকারের শ্যেনদৃষ্টি রয়েছে। “না না, আমার এরকম কোনো ছেলে নেই। আমার বড়ছেলে মরে গেছে।” অন্দরমহলে এসে তিনি ফেটে পড়েন। আমায় হুকুম দিলেন, ‘‘ওই পাজিটা যদি আবার এখানে এলে, ওকে জলটুকুও দেবে না। সোজা পুলিসের হাতে তুলে দেবে। স্বামীর আদেশ সত্ত্বেও পতিব্রতা ধর্মপত্নী এই মা সেই সন্তানকে বহুবার আশ্রয় দিয়েছে। অতিসামান্য কিন্তু প্রয়োজনীয় রসদও যুগিয়েছে। কেঁদেকেটে তাকে বলেছি, “বাপ আমার! তুই কোনো গোলমালে যাস না। কথা দে, এসব থেকে দূরে থাকবি।” চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে পরার আগে সে বলেছিল, “মা জানো, আগে য়ুনান মায়েরা নিজের প্রথম ছেলেকে যুদ্ধদেবতার জন্য বলি দিত। জন্মভূমির হিতার্থে প্রাণদান মানে স্বর্গে যাওয়া, তাই না? আমার মা তো দেবী। মাতৃভূমির জন্য তুমি বড়ছেলেকে উৎসর্গ করো মা। তোমার আরও আটটি সন্তান তো রইল।”
“বাবা, দেশের চেয়েও মা কিন্তু বড়।” আমি আকুলভাবে কাঁদতে থাকি, “মায়ের মন বলে একটা বস্তু আছে। তার বুক ফেটে যায়। দেশ তো শুধু মাটি আর কাঁকড়।” ধীর আমার কপালে চুমু দেয়। “ না মা, না, তোমার মতো কোটি কোটি মায়ের হৃদয় দিয়ে দেশটি গড়া। তাঁদের কষ্ট, বেদনা, অশ্রু…সবই আছে। এই দুখিনী মাতৃভূমির মুক্তির জন্য আমার মৃত্যু হলে, হাসিমুখে তোমার ‘বন্দেমাতরম’ গাওয়া উচিত, মা। বলো তুমি হাসবে তো?” কথার শেষে আমায় প্রণাম সে দ্রুত চলে গিয়েছিল। তারপর চিটাগাঙ অস্ত্রাগার লুন্ঠনের সময় ডিনামাইট বিস্ফোরণে ছেলের মৃত্যুসংবাদ শুনে ক্ষোভে দুঃখে অসহায় আমি তার বাবার সামনেই ‘বন্দে মাতরম্’ গাইতে থাকি। হেসে…কেঁদে…পাগলের মতো চিৎকার করে গেয়ে যাই —“কোটি কোটি করধৃত করাল করবাল।”
আহ! আমার এত তেষ্টা পাচ্ছে কেন! বাছারা, আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, একটু জল দাও। ঠাণ্ডা জল…।
এবার শেষ করি। জানি, এখন এসব কথা বলার নয় … এই মানুষগুলোকে মনে করাও অন্যায়। শরণার্থী হয়ে তোমাদের কৃপাভিক্ষা করে আমি এখন এক বিদেশি। ধীরেন্দু মজুমদারকে লোকে কবেই ভুলে গেছে। তাহলে এই মায়ের কথা কে মনে রাখবে?
ধীরের দেশসেবার ভূত, ওর ছোট ভাইদেরও ঘাড়ে চেপে বসেছিল। শরদিন্দু লন্ডনে ব্যরিস্টারি পড়তে গিয়ে, ইন্ডিয়া অফিসের সামনে এক সাহেবকে গুলি করে মেরে আত্মহত্যা করে। নিত্যেন্দু আর সত্যেন্দু কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। ওদের বাবা পক্ষাঘাতে শয্যা নিলেন। পারিবারিক সমস্ত সম্পত্তি বাজে – য়াপ্ত হল। তবুও মজুমদার ভবনের কীর্তি আজও গগনস্পর্শী। বাছারা, দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামীদের গোপন আশ্রয় ছিল ওটা। সেই বাড়ির পাতালঘর থেকে তারকেশ্বর গ্রেপ্তার হয়। গণেশ ঘোষ, সাবিত্রী, কল্পনার মতো কত মানুষ ওখানে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছেন। তোমরা প্রীতিলতা ওয়াদেদারের সম্পর্কে শুনেছ? আমার মেয়ে মিনতির প্রিয় বান্ধবী ছিল। বেচারী…বিপ্লব করার জন্য তার জন্ম হয়নি। রক্ত দেখলে ওর মাথা ঘুরত। কাউকে কাঁদতে দেখলে নিজেও ফুঁপিয়ে উঠত। এমন কিশোরীও শহরতলীর ইউরোপীয়ান ক্লাবে বোমা ছুঁড়ে শেষে পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মারা যায়। এই ঘটনা কি তোমাদের বিশ্বাস হবে?
এমন মানুষদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা তোমরা আজ ভোগ করছ। কিন্তু এদিনটা দেখার জন্য নিত্যেন্দু, সত্যেন্দু, মিনতিরা আর থাকল না। তারপর দেশে কংগ্রেস এল। গান্ধিজি এলেন। গোপীনাথকে কিছুতেই ক্ষমা না করার যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ তিনি দিলে, আমি বললাম, “বাপুজি, ইতিহাস আপনাকে ক্ষমা করবে না। ধৈর্যশীল হওয়া কোনো অপরাধ নয়। দেশের জন্য মরে আর মেরে এই বাঙালী যুবকেরা অমর হয়ে গেছে।” অবশেষে জাতি এবং ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হল… ত্রৈলোক্য চক্রবর্তী নেহরুকে বললেন, “কার পরামর্শে আপনি বাংলার মাথা কাটলেন, কার বুদ্ধিতে আপনি আমাদের আলাদা করে দিলেন? এখানে হিন্দু-মুসলমান নেই। বাঙালিরা সবাই এক, সবসময় একজোট ছিল…আছে…থাকবে। ধড় আর মাথা আলাদা করে দিলে এই রাহু-কেতুর খেলা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। চাঁদ-সূর্যে গ্রহণ লাগবে। সাবধানে থাকবেন।’
হ্যাঁ, গ্রহণই লাগল বটে। এবার সবাইকে গিলতে গিলতে সে এল। দেশভাগের সময় আমরাও ভারতে চলে আসার কথা ভেবেছিলাম। পরে মনে হল, যেখানেই থাকি…ওখানে বা এখানে, সব জায়গার একই পরিস্থিতি। যে জায়গাতেই হোক, ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের সেবা করলেই সব ভালো হবে। আমি আবার নতুন রাষ্ট্রের কাজে মন দিই। মজুমদার ভবনের ভাঙাচোরা চৌচালার নিচে মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য আবার লোকে ভিড় জমায়। গান্ধিজির সঙ্গে নোয়াখালিতে গেলাম। চিটাগাঙে সেবাশ্রম, ঢাকায় সৌহার্দ্য সমিতি প্রতিষ্ঠা করি। কখনো নিয়ম-বিরুদ্ধ কিছু করিনি। তবুও সরকারি আধিকারিকরা আমায় সন্দেহের চোখে দেখত। শুভেন্দু ঢাকায় অধ্যাপনা করত। সেই চাকরি থেকে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। সমরেন্দুকে ডাক্তারি করার ছাড়পত্র দেয়নি। যোগেন্দু বন্যাত্রাণে গিয়ে মারা যায়। সোনা গো, বাঙালীদের বরাবরই এমন ললাটলিখন। এখানকার প্রকৃতিও অশান্ত। সমুদ্র প্রায়ই উপকূলের জনপদকে ডুবিয়ে দেয়। অহরহ প্রবল ঝড়ঝঞ্ঝা। পদ্মায় জোয়ার আসে। মহামারী, দারিদ্র্য ক্রমাগত ছড়ায়। জাতি-ধর্ম আঁকড়ে তো এসব প্রতিরোধ করা যায় না। আমার ছোটমেয়ে লয়লা এক মুসলমানকে বিয়ে করেছে। সবাই একসঙ্গে থাকতাম। এককালে তিনবছরের নাতনি নসিমাকে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গান ‘সোনার বাংলা’ গাইয়ে খুব আনন্দ পেয়েছি। ওহ! আমাদের থেকে
সেই শিশুকে ছিনিয়ে, রাস্তায় আছড়ে মেরে ফেলেছে সৈন্যরা।
সব শেষ হয়ে গেল। বাছা রে, সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেল। তবু আমার আরও একটা সম্পদ ছিল — পূর্ববঙ্গের সেই মাটি, যা আমার মা আর মেয়ে — দুই-ই। আমার জন্মভূমি, আমার বাংলাদেশ, সেখানকার সদা চঞ্চল নদনদী, ঝিল, মানুষজন। স…ব এখন নষ্ট হয়ে গেছে।
মুজিবর সায়েব বলতেন, “শান্তি দেবী, আপনি আমাদের বাংলাদেশের প্রতীক। আপনিই মা, আপনিই মাতামহী, আপনার আশীর্বাদে বাংলা আবার স্বাধীন হবে।” আমার শরীরে মোটে রক্ত ছিল না। তাও নিজের তর্জনী কেটে তাঁকে তিলক পরাই। “বাবা, জয়ী হও। বাংলাকে মুক্ত করার সৌভাগ্য হোক তোমার।” পরে তাঁর নাতি এবং মুক্তিফৌজের সৈনিকরা শান্তি দিদিমাকে নিয়ে, ওদেশ থেকে ভারতে পালিয়ে যায় আসে। শরণার্থিনী ভিখারিনী বিদেশিনী—এখানে এই ছিল ওঁর পরিচয়।
“বলো ইন্দিরা, বলো, শান্তি মজুমদার কি এখানে শরণার্থিনী হয়ে এসেছে? ধীর, সমর, সত্য, নিত্যর মা কি এখানে বিদেশি? রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, সি আর দাস, নেতাজির পুণ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে জানতে চাই, শান্তি মজুমদার ভারতীয় না বিদেশি? যদি বলো এ আমার দেশ নয়, তাহলে আমি এখানে মরব না। ওহ! … আমার চোখ ফেটে জল আসছে। মাথাটা কেমন ঘোরাচ্ছে।
কিন্তু না, আমি কাঁদব না। ধীরেন্দু মজুমদারের মা কাঁদবে না। বরং এসো, আমরা সবাই মিলে আগের মতো সেই গান গাই —
“কোটি কোটি করধৃত করাল করবাল।
সুফলা…সুজলাং শস্য শ্যামলাং মাতরম
বন্দে মাতরম্।”
অনুবাদঃ
শম্পা রায়
পেশা শিক্ষকতা
মৌলিক গ্রন্থ: বিস্মৃত মণির সন্ধানে (প্রবন্ধ সংকলন)
সম্পাদিত গ্রন্থ: অসীমান্তিক শ্যামল (সাহিত্যিক শ্যামল ভট্টাচার্য সম্মাননা প্রবন্ধ সংকলন)
অনুবাদিত গ্রন্থ: দর্জ কিজিয়ে নাম কূলভূষণ (হিন্দি থেকে বাংলায় অনূদিত / লেখক অলকা সরাওগি)
এছাড়াও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ লিখেছেন I

