
একগুচ্ছ কবিতা। কৃষ্ণপ্রিয় ভট্টাচার্য
পাখিবিষা
মেটেলি পাহাড় থেকে যে শুদ্ধ পাইন
লাসা হয়ে
একা হেঁটে গেল চীনের ইউনান
সে পাখিবিষা, বিষধর পাখিদের গ্রাম–
রবিবার শুধু রাতে খোলা থাকে।
বুড়িমাসি চলে গেলে
পানের ডাবর বেচে মা একদিন একা
‘পাখিবিষা যাই’ বলে সেই যে গেলেন,
সেই যে ‘রবিবার রাতে খোলা থাকে’–
হয়ত পাখি হয়ে গেলেন।
কত যে সকাল হয়
কত যে কাক ডাকে
গাছ কেটে, মাটি কেটে রাস্তা হয়
কত দারোয়ান বুকের ওপর দিয়ে হাঁটে–
কত স্কুল উঁচু হয়, ডাকঘর দীর্ঘ হতে থাকে,
ট্রাম বিদ্যুৎ আলোর অফিস উঁকি দেয়–
শীত আসে হেমন্ত আসে…
মা সেই ‘পাখিবিষা যাই’ বলে চলে গেল
যে গ্রাম শুধু রাতে খোলা থাকে।
……………
আদমশুমারির বিকেল
আদমশুমারির অপরাহ্নে এসে
শেষ লোকটিকে যখন প্রশ্ন শুরু করি
সকালের শুক্রা নাগেশিয়া ছুঁটে আসে, বলে–
আমার প্রেমিকার নাম-ঠিকানা নিলেন না তো!
আমার ভাষার নাম, দেবতাদের নাম নিলেন না তো!
ভ্যালাকোবা-রংধামালির দিকে গেলে
দেবী চৌধুরানীও আমাকে আজকাল বলেন
আমি নাকি ম্যাজিস্ট্রেটের চোখ দিয়ে
নারীদের দেখি…!
ফাটাপুকুর পেরিয়ে যত মন্থনির দিকে যাই
যতই পাখিদের আশ্চর্য গ্রামের দিকে যাই
এমন আরও কত অনিবার্য মিষ্টি সব প্রশ্নেরা
আমার পথ আটকায়…
প্রশ্নের আত্মারা পাশা খেলে, লুডু খেলে
আমি ধ্যানমগ্ন হই আদমশুমারির আশায়।
একদিন সালুগাড়ার তিব্বতি ওষুধের দেশের
পুলিশের কাছে শুনলাম–,
যেকোনো ইভ যেকোনো আদমশুমারিতেই
প্রেমিক-প্রেমিকাদের ডেটা আগে নিতে হয়।
স্মার্ট-নীল ভলভো বাস ড্রাইভারকেও দেখলাম
নিরীহ যাত্রিদের বলছেন–
জজ-ম্যাজিস্ট্রেটদের চোখ দিয়ে
দেবী-দর্শন একদম ভুল…!
……………..
আবার ভাদু সিং
বেঙ্গাইজোত নামে একটি গ্রাম আছে
সেই গ্রামে ভাদু সিং ভাস্কর্যপুরুষ।
ভাদুর বাড়িতে গেলে আমি কোলে করে
কতকিছু নিয়ে যাই– পায়রা, ফুলঝাড়ু, হাঁস…
কিছুটা বাসে করে, কিছুটা ভ্যানরিকশায়
কিছুটা গোড়ালি-ভেজা জল, কিছু ফল…
খেমচি নদী পার হয়ে
আমাকে পৌঁছুতে হয় ভাদুভবন।
‘বিষুবরেখা থেকে এতদূরে, খেমচি নদীতীরে
মনোরম এই রাজধানী কেন বানালেন…?’
বোকা প্রশ্নের উত্তর আর কী হবে?
নদী পাখি ধানক্ষেত, আদি নকশালবাড়ির আকাশ
চুপ করে থাকে।
খুরপি হাতে নিয়ে লাফাক্ষেত নিড়ায় ভাদু সিং
মাঁচার লালপুই, ঝিঙাবালিকারা অপেক্ষায়…
কখন ভাদুবুড়ো আমাদের পাশে এসে শোবে!
আমার পেছনে আরেকটি ভ্যানরিকশায়
আমেরিকা থেকে এক দীর্ঘ চিঠি আসে
ভাদুকে ইংরেজিতে লেখা চিঠি–
সেই দীর্ঘ চিঠি আমাকে পাঠ করতে হয়
বুড়োকে শোনাতে হয় তার ইঙ্গিত।
দই-চিড়া খেতে খেতে,
মাটিচাপা গুয়াপানতাম্বুল খেতে খেতে
গোটা শনিবারজুড়ে
আমাকে পড়তে হয় জীবনের প্রথম
আমেরিকার টাইপ করা চিঠি।
সন্ধ্যা গড়ায়,
উঁকি দেয় রাতের বেঙ্গাইজোত।
কুঁপির আলোয় আলোকিত ভাদুর রাজধানী, বেঙ্গাই
ওয়াশিংটন ডি সি হতে থাক…
আরও অসংখ্য কত ভ্যানরিকশা
অসংখ্য কত রাতের মশাল
অসংখ্য নদীপাখিদের ব্রিগেড
এইবার চিৎকার করে বলে–
একালের কোন কবি
ভাদু সিং-কে বানালেন
এমন বিলিয়নিয়ার অফ সলিচিউড!
……..
অনন্তকথা
তুলসীপাতার কাছে প্রতিদিন কী এত চাও জোড়হাতে?
সিঁড়ি যেমন জলের কাছে আনে,
দোতলায়, তিনতলায় জানালার আলো টানে–
তেমন ট্রাপিজ চাও করের রেখায়?
যা চাও মায়ের কাছে, তা কি তুমি নিজের কাছে চাও?
যা তোমাকে পানের ডাবরের কাছে নিয়ে যায়,
যজ্ঞডুমুরের যে ছাল ঘরে রস আনে–
তার কাছে কী বর চাও আজকাল?
পতাকার কাছে যাহা চাও, তাহা কি তুমি
যুদ্ধের কাছে চাও?
এইসব কষ্টকর কাটাকুটির মধ্য দিয়েই একদিন
বৃষ্টি এসেছিল। সেই বৃষ্টিতে ভিজেছি সবাই।
হলুদবাগানের সেই মেঘ জেগে আছে।
কিন্তু এখানে আজ এত পাথরের ভিড় কেন?
মানুষের কাছে ওরা কী চাইতে এসেছে?
ফুলবেলপাতা দিয়ে ঝাড়ো পাপ?
পাথরেরও পাপ আছে! ঠাকুর ঠাকুর!
এসব কথা আমি বলছি আমার নিজের সাথে
তুলসীপাতা, জলসিঁড়ি ডাবর ও ডুমুর,
এই যে পতাকার উল্লেখ, যুদ্ধের উল্লেখ,
পাথরের বৃষ্টিপাত, আমাদের আত্মনিবেদন
সে তো আমি আমার অনন্তকেই দিয়েছিলাম।
………….
অশ্বদর্শন
একটি ঘোড়া থেকে প্রথমে
সাদা, পরে দ্বিগুণ কালোঘোড়া বেরিয়ে এল
তারপর, সাদাঘোড়ারা সবাই হয়ে গেল কালো
কালোগুলো হয়ে গেল সাদা।
সাদা মানে, গোরুর দুধের মতো সাদা
অঙ্ক খাতার মতো, মায়া ও শান্তির সাদা।
এবার গোটা পর্দা সাদা
ভাবলাম বিজ্ঞাপনের বিরতি। না।
পুনরায় কালো হয়ে এল পর্দাসুন্দরী
ভাবলাম কেবল বিভ্রাট। না।
কেউ ছিল না কোথাও। কেউ না।
ঘোড়ার পেছনে কেউ থাকে না কোনোদিন
পর্দার সামনে যেমন
আমরাই আগুন বানাই, আমরাই জল
সবই ওই ভাষার ডার্করুম
ঘুম প্রয়োজন আমাদের।
………..
শূন্যসারস
শূন্য আমাকে চায়…
পুণ্য আমাকে চায়…
আকাশ কাকে চায়, বৌঠান!
ঘাসে ঘাসে সহবাসে যত কার্তুজ, যত অশালীন
সব অক্ষর ফিরিয়ে দিল ম্যাকফার্লিন চার্চ
অথচ আবার শুনি, শূন্য আমারে চায়, আহা!
শূন্য তুমি নারী না বৈঠকখানার মাছুয়ার কেউ হও
এত রাতে গান গাইছ ফার্নেসে!
এ তো প্রজাপতি আসছে ঘরে, প্লাবন অকস্মাৎ!
এসব কথা কবে ভাসবে চরাচরে, ম্যাকফার্লিন!
দাদুর জামার পকেট ছিল জওয়ান বুটের চেয়েও ভারী
সেই সনাতন বুক থেকে আমি
দলসিংপাড়ার পাথর কুড়িয়েছি, বারবার…
শ্রেণিহীন, বর্ণহীন, গন্ধহীন পাথর কুড়িয়েছি
কত মানুষের প্রেম জ্বলে যাচ্ছিল
পুড়ে যাচ্ছিল কত হাতে আঁকা বিদ্রোহ, হুল
ডম্বর চক্ থেকে, উঁচু কালেবুঙ থেকে শেষমেশ
গড়িয়ে দিয়েছি সে পাথর পৃথিবীর দিক…
আজ পোখ্রেবুঙে আছি, ধাপে ধাপে শূন্যতা
পাঁচ হাজার ফুট নীচের সাগরেও সে আছে
নারী হোক বা না হোক, সে কিন্তু আছেই বহাল
এখন টেরাস থেকে নদী নামবে ঘিস্
নদী নামবে লিস্, সেই জলে ভেসে আজ
আমাদের প্রেসিডেন্ট নামবেন…
এসো শূন্য, এসো বুকে ; বুক রহস্যময়।
………….
ভ্যানগখ
জলস্তর থেকে যতই উঁচুতে উঠতে থাকে চিল
ততই শূন্যের নিকটস্থ হয় কবি।
পুরুষ বা নারীদের মতোই সে শারিরীক হয়।
ঋতুপরিবর্তনেও ঘনিষ্ঠতা বাড়ে-কমে কবি ও কবিতার।
এ অনেকটা ইস্কুল বা খরবায়ুবেলার জল ও পাথরভাসান–
পাথর চলে যায় দূরে
ঢেউ, শব্দ করে আসে পাশে পায়ের পাতায় ;
এ অনেকটা আকাশে জল ঢালো ওড়াও…
পৌঁছুতে না পেরে সে দেহে ফিরে আসে।
এরকমও হয়–
কোনোদিন কাছে আসছে না কোনো কবি
কবিতা এল অন্য কোনো ছদ্মবেশে…
এমন চঞ্চল উদাসীন অস্থির মধ্যান্হে একদিন ধরা যাক
নদীর ওপার থেকে, মহাশূন্যাকাশ থেকে
সুচরিতা ও কৌশিকের কাছে ভ্যানগখ এলেন
একটি কবিতা যেন হঠাৎই
টুকরো হয়ে উড়ে গেল দু-জনের কাছে
অপার বিস্ময়ে দু-জনেই ভুলে গেল
কে নারী কেই-বা পুরুষ
পাথরে নয় হৃদয়ে নয় কবিতা সৃষ্টি হল
মানুষের সরল বিশ্বাসে
কবির ঠিকানা থেকে বহুদূর সরে গেল আকাশ
কৌশিক পৌঁছুলেন সুচরিতার কাছে,
সুচরিতা কৌশিকে…
…………