একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ডাকঘর পাঠের অভিজ্ঞতা <br />   ধৃতিরূপা দাস

একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ডাকঘর পাঠের অভিজ্ঞতা
ধৃতিরূপা দাস

‘ডাকঘর’ শব্দটা উইকিঅভিধানানুসারে — “যে গৃহে সরকারি ব্যবস্থায় চিঠিপত্র এনে প্রেরণ ও বিলি করা হয়।”

অমরকোশ অনুযায়ী — “যে সরকরি দপ্তর থেকে লোকে চিঠি-পত্র ইত্যাদি পাঠায়”

সংসদ বলছে — “পোস্ট অফিস”। ইংরেজি এই শব্দবন্ধের অর্থ —

“the public department or corporation responsible for postal services and (in some countries) telecommunications.”

এখানে ‘সরকারি’ এবং ‘পাবলিক’ এই শব্দদুটোকে মাথায় রেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’কে স্মরণ করা যাক। তাহলে প্রথমেই যেটা হবে ঔপনিষদিক পরমেশ্বরের তত্ত্ব-কাঠামো থেকে বেরিয়ে এসে নাটকটি ১৯১১-১৯১২ সালে লিখবার উদ্দেশ্য আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। বিংশ শতাব্দীর ভারতবর্ষ। তখন এদেশে হিউম্যানিজমের উষা লগ্ন। অথচ বিশ্ব-প্রেক্ষাপটে হিউম্যানিজমের শাখা কমিউনিজম, লিবেরালিজম, এবং ফ্যাসিজমের মধ্যে পার্থক্য তৈরি হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ প্রস্তুতি। শতাব্দীর পথনির্দেশক হয়ে ওঠার লড়াই। বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষিতে ব্রিটেনকে সমর্থন করা প্রয়োজন। কিন্তু দেশে হিউম্যানিজমের পরিপন্থী হয়ে উঠছে ন্যাশনালিজম। ন্যাশনালিস্ট আন্দোলনগুলো অথচ জরুরি ব্রিটিশ ভারতে। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু বারবার একটা ভারসাম্যে আসতে চেয়েছিলেন। কেননা তিনি লিবেরাল হিউম্যানিজমপন্থী ছিলেন — আমরা সকলেই জানি। কেননা তিনি বিশ্বমানব হতে চেয়েছিলেন। কেননা তাঁর পাঠক যে কেউ এ বিশ্বের দেশ-কালের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে — এমনটাই চান একজন কবি। সরলীকরণ করলে যা দাঁড়ায় — কবি তার মানে একটা খোলা ও সচল বাজার চান যেখানে তিনিই একমাত্র প্রভাব বিস্তারকারী। একদম তাই। ইকোনমিক্যালি এবং সাইকোঅ্যানালিটিক্যালি ঠিক তাই। কবিতা সে অর্থে একরকম পুঁজিই বলা চলে। সারাজীবনের সঞ্চয়গুলো ফেলে রেখে কবি মরে যান। সেগুলো আবর্তিত হয়। বাজার তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। বাজারটা কে নিয়ন্ত্রণ করে? হয়তো রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’ই ! এখন অবিশ্বাস করতে গেলে তো বিশ্বকবি বলবেন —
‘চুপ করো অবিশ্বাসী’। তাই বিশ্বাসই অগত্যা। ‘রাজা’ আমাদেরই বিশ্বাস। ‘ডাকঘর’ লিবেরালিজমের টোটেম। মানুষের পূজা-অর্চনা-প্রার্থনা-জিন্দাবাদ। যখন গোটা দেশ — দেশেরই স্বাধীনতা কাঙ্ক্ষায় উত্তাল তখন রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রশ্নে এলেন। কেননা দ্বন্দ্ব আছে। সাহিত্য লিখে যিনি প্রতিষ্ঠিত তিনি তো অবশ্যই দ্বন্দ্বটাকেই ধরিয়ে দেন। একটি দেশের জাতীয় সংগীতের লেখক তিনি — সেই চূড়ান্ত খ্যাতির মুহূর্তে — নোবেল পুরস্কার পাবেন তারপর পরই — সুদূরের ডাক এল কবির কাছে। বেরিয়ে পড়তে হবে। তিনি চির পথিক। এই ভাবনায় ব্যক্তিগত স্বার্থের দিকটা যে আছে — সেটা খুব যুক্তিযুক্ত বলেই আমরা স্বীকার করে নিয়েছি। অস্তিত্ব নিজেকে নিজেরই দায়িত্বে টিকিয়ে রাখতে চায় — এই চাওয়ার মধ্যে কিন্তু কোত্থাও দ্বন্দ্ব নেই। এবং ডাকঘরের ‘গ্রন্থপরিচয়’ ঘাঁটলে দেখব মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা চিঠিতে —

“ডাকঘর যখন লিখি তখন হঠাৎ আমার অন্তরের মধ্যে আবেগের তরঙ্গ জেগে উঠেছিল। প্রবল একটা আবেগ এসেছিল ভিতরে। চল চল বাইরে, যাবার আগে তোমাকে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে হবে — সেখানকার মানুষের সুখদুঃখের উচ্ছ্বাসের পরিচয় পেতে হবে। সে সময় বিদ্যালয়ের কাজে বেশ ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ কি হল। রাত দুটো-তিনটের সময় অন্ধকার ছাদে এসে মনটা পাখা বিস্তার করল। …আমার মনে হচ্ছিল একটা কিছু ঘটবে, হয়তো মৃত্যু। স্টেশনে যেন তাড়াতাড়ি লাফিয়ে উঠতে হবে সেই রকমের একটা আনন্দ আমার মনে জাগছিল। যেন এখান হতে যাচ্ছি। বেঁচে গেলুম। এমন করে যখন ডাকছেন তখন আমার দায় নেই। কোথাও যাবার ডাক ও মৃত্যুর কথা… ‘ডাকঘরে’ …প্রকাশ করলুম। …মনের মধ্যে যা অব্যক্ত অথচ চঞ্চল তাকে কোনো রূপ দিতে পারলে শাস্তি আসে। …এর মধ্যে গল্প নেই। এ গদ্য-লিরিক। …আমার মনের মধ্যে বিচ্ছেদের বেদনা ততটা ছিল না। চলে যাওয়ার মধ্যে যে বিচিত্র আনন্দ তা আমাকে ডাক দিয়েছিল।”

এই আনন্দ নিখাদ মহাসৃষ্টির সঙ্গে মিলিত হতে চাওয়ার — এমনকি এ উত্তেজনা মৃত্যুর সঙ্গে তুল্য — “হে সুদূর, বিপুল সুদূর…” -এর সুরে যে টানটা — বাসনাহীন একটা ভারশূন্য অবস্থার ইঙ্গিত — বেরিয়ে পড়তে হবে — এই রোমাঞ্চে উন্মুখ। নিতান্ত আস্তিক ও মানবিক এই আনন্দটুকুকেই তো প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ আত্মপ্রতিষ্ঠিত হয়ে। পেরেওছিলেন। গোটা বিংশ শতাব্দীকে পথ দেখিয়েছে ইউনিভার্সালিজম এবং ইন্ডিভিজুয়ালিজ, পথ দেখিয়েছে গণতন্ত্র এবং মুক্ত বাজার, পথ দেখিয়েছে লিবেরালিজম। কমিউনিজম এবং ফ্যাসিজমকে পেছনে ফেলে মানুষের বেঁচে থাকাকে সহজ করতে পেরেছে। রবীন্দ্রনাথের পক্ষপাতিত্বে ভুল ছিল না। তাছাড়া নিজে অর্থনৈতিকভাবে ফিউডালিজমের উত্তরসূরী হয়েও ক্যাপিটালিজমের পক্ষটুকু নেবার ক্ষমতা রবীন্দ্রনাথের ছিল। তিনি স্বচ্ছতার সঙ্গে সেটা নিয়েছিলেন। মনে রাখতে হবে দেশজ শিল্পের প্রতি তাঁর মতো মমত্ব এদেশের যেকোনও প্রাণীর চেয়ে বেশি। ‘ব্যক্তি’ বলতে তিনি ঠিক কতদূর বুঝতেন, ‘আত্ম’ বলতেই বা কতদূর — একজন কবির বিশদ যে কতদূর বিস্তৃত হতে পারে — রবীন্দ্রসংগীতের বিপুল ভাণ্ডারের দিকে তাকালেই আমরা অনুমান করতে পারি। মাঝে মাঝে মনে হয় এই যে বেমালুম আমাদের ছোটবেলা জুড়ে রবীন্দ্রনাথকে ‘ঠাকুর’ হয়ে যেতে দেখলাম পাড়ার রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যায়, আহ্নিকে — ব্যাপারটার জন্য রবীন্দ্র সাহিত্যের বিপুল কলেবরটাই দায়ী। আমাদের তো টুলাইনার পেলেই দিন কেটে যায়। ফলত ইয়া মস্ত মস্ত রচনাবলী ‘নমো করে তুলে রাখা’ই শ্রেয়। আমাদের এই আচরণে কিন্তু সেই বিপুলতাকে অস্বীকার করাটা নেই বরং স্বীকৃতিই আছে। ফলত কোনোভাবে প্যাক দিয়েই খাটো করা যায় না তাঁকে। বিশ্বকবি ফিরে আসেন রদ্দুর রায়ের গানে, বিপ্লবেও। সমান্তরালে তিনি উপনিষদের পরম পুরুষটির মতো বাংলা সাহিত্যজগতে প্রণম্য। ঠাকুর আছেন। যদিও একবিংশে দাঁড়িয়ে লিবেরালিজম তথ্য-মুক্তির চাপে কিছুটা ব্যাকফুটে। রবীন্দ্রনাথকে কথায় কথায় টেনে আনা বাঙালি বদলেছে। তবু আমি ব্যক্তি-পাঠক আজও রবীন্দ্রনাথ পাঠের আনন্দ আস্বাদনে সক্ষম। শতাব্দীর একেবারে শুরুতে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা কতদূর — এখুনি সে সিদ্ধান্ত নেয়া অসম্ভব। হারারির ভাষায় It’s too early to make any decision যে এ শতাব্দীর মূল চালিকাশক্তি তত্ত্বটি কী। তবু ঠাকুর একশো বছর পেরিয়েও আছেন। বাংলা কবিতা লিখতে আসা একবিংশের নালকের কাছেই হোক কিংবা পাঠকের কাছে — রবীন্দ্রনাথ এখনও তর্কের বিষয়, গসিপেরও বিষয় রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখালিখির দরুন। জেন জি বা জেন আলফার কাছে তিনি হয়তো উদাসীন স্পর্শ পাচ্ছেন — কিন্তু নামটুকু হলেও ছুঁচ্ছে, ছুঁতে বাধ্য হচ্ছে সকলেই। বাল্মীকির আগে অনন্ত। তাতে অবশ্য গোটা ভারতবর্ষের ছবিটা স্পষ্ট হয় না। কেননা বাল্মীকির আবেদন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে উজ্জ্বল। কেননা তিনি জাতীয়তাবাদের হাতিয়ার। আবারও জাতীয়তাবাদ ফিরেছে। ছদ্মবেশে। তলে তলে ডেটাইজম এবং টেকনো হিউম্যানিজম ক্যাপিটালকে, ডেটাকে এক এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত করছে। ফেসবুক, ইনস্টা আমাদের ব্যক্তিগত তথ্যগুলোকে নিয়ে কী করবে শেষপর্যন্ত কেউ জানে না। এআই। রবীন্দ্রনাথের মতন কবিতা লিখতে আর কত বছর সময় নেবে এআই ? কতবছর টিকে থাকবে কবির প্রয়োজন? মানুষ প্রজাতিটা? শতাব্দীর শুরুতে বহু প্রশ্নের চাপ এসে পড়েছে আমাদের প্রশ্নপত্রে। শতাব্দী জুড়ে তার উত্তরগুলো রচনা করতে হবে। রবীন্দ্রনাথের গুরুত্ব সেখানে থেকেই যায় মানবিকতাকে রক্ষার্থে। অনেকেই বিশ্বাস করেন কিছু লেখাকে বোমা মারলেও মরবে না। কিন্তু সাইবার অ্যাটাক? তথ্যকে নিয়ন্ত্রণ করছে, এমনকি জীবকে নিয়ন্ত্রণ করছে যে অ্যালগোরিদম — তাকে তো আপাতত কিছু মানুষই নিয়ন্ত্রণ করছে। রবীন্দ্রনাথের রাজা কি তবে আজকের পৃথিবীতে সিলিকন ভ্যালির জাদুকরেরাই ? এও তো মানবিকতারই জয় — আমরা যদি ভাবতে বসি! ‘মানবিকতা’ শেষপর্যন্ত তো গুটিকয়েকের। আমি বা আপনি সেই বৃত্তে ঢুকে পড়তে পেরেছি কি? ‘আমরা’ বলে তো আর কিছু নেই। প্রতিটি অস্তিত্বের নিজের লড়াই। গল্পগুলোতে এত বৈচিত্র্য আমাদের যে আমরা একজোট হতেই পারছি না। কারণ ‘আলাদা’ হওয়াটাই ট্রেন্ড। এই ট্রেন্ড কার হাতে? স্বাধীনতা একটা অলৌকিক কল্পনা যে পৃথিবীতে, যে পৃথিবীতে স্পিনোজার দর্শন there is no freedom of choice — আমাদের ভালো করে জানা হতে না হতেই স্বাধীনতার মৃতদেহ রচিত হয়েছে — যে গতিতে রোজ রচিত হচ্ছি আমরা নতুন করে, যে ব্যাপক তথ্যের সোকল্ড ‘মুক্তি’ ঘটছে রোজ — তাঁদের খাঁচাটা কোথায় কেউ জানে না! তাই আজও বেরিয়ে পড়তে হয় মানুষের মানবিকসীমায় গণ্ডীবদ্ধ যাত্রাগুলোতে। আজও অমল আছে। কেননা অবিশ্বাসীর গতি এযুগে আরও ভয়ংকর। স্রেফ পাগল হয়ে যেতে হবে। পাগলেরও অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে। পাগল খাইয়ে বেঁচে আছে কত এন.জি.ও। অন্ধ ভিক্ষুক তো সে তুলনায় ধনী। তো আপনি কখনোই খেলার বাইরের কেউ নন। ফলত শরতের রোদ্দুরের উস্কানি এখনও আমাদের উৎসব-প্রবণ করে। বুঝতে পারি না আমাদের প্রবণতাগুলো, আমাদের মনযোগগুলোও অলক্ষ্যে সম্পাদিত হচ্ছে। সম্পাদিত হচ্ছে দৈনন্দিন চর্যাও। সহজেই উৎসবে ডুবিয়ে দিতে পারছে অন্যপক্ষ। আমাদের সারাবছরের সঞ্চয় নিয়ে পুজোর অপেক্ষায় আমরা। বাজারে নামব। অথচ পেটে শিক্ষা নেই যে কীভাবে টাকা খরচ করতে হয়। নিজস্ব সম্পাদনা নেই। Go with the flow — এই নীতি। এই ভাবনার বিরুদ্ধে কেউ থাকলে তাকেও স্বাগত।

#
ডাকঘরের প্রতিটি চরিত্র, চরিত্রের ভূমিকা আমাদের অধীত। কেননা যে কোনও ভূমিকায় লড়তে অভ্যস্ত আমরা। একরকম কাজ করে সারাজীবন খাওয়ায় দিন শেষ। বহু কাজ আমাদের। বৈচিত্র্য জিন্দাবাদ। ‘ব্যাকুল বাঁশরি’ শুনতে চাওয়াটাও তাই ঘনঘন ঘটে। Trip to infinity ঘটে, Voyage -এ বেরিয়ে পড়া হয় না কিংবা বেরিয়ে পড়াও তো একটা উপায় প্রচারিত হবার। ফলত অনেকেই বেরিয়ে পড়েছেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে যোগাযোগ যতটা ভার্চুয়াল ততটা গভীর, জলজ্যান্ত বাস্তব নয়। তাছাড়া প্রকৃতির টানে, মহাসৃষ্টির টানে বেরিয়ে পড়ার চেয়েও আগে প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলোর প্রতিরোধ জরুরি। ফলত আপনাকে আমাকে জড়িয়ে পড়েই যা করার করতে হয়। এসব তর্কের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথকে সত্যিই ঠাকুর মনে হয়। উপরে থাকেন। মাঝে মাঝে আমরা টেনে নামালেও তিনি কিছু মনে করেন না। ঠাকুরদাদার মতোই স্নেহময় তিনি। শোনা যায় এই চরিত্রেই অভিনয় করেছিলেন। সমস্ত মতকেই স্বাগত জানান, তারপর নিজেকে রোপণ করেন কৌশলে। স্নেহে ভুলিয়ে দেন। বুদ্ধদেব বসু তো গুরুদেবের রচনার এই প্রতারক দিকটি ধরিয়ে দিয়েছিলেন গত শতাব্দীতেই। ফলত সব জেনেই রবীন্দ্রনাথ পাঠযাত্রা আজ আমাদের। গল্পে বা গদ্যে বিস্মিত করা সহজ নয় আমাদের‌। আমাদের সবই চেনা। চেনা দুঃখ চেনা সুখ। এমনকি চেনা আপোশ। তবু অচেনার সন্ধান তো থেমে থাকে না মানুষের। তখন একই কথা অন্যভাবে পুনরাবৃত্ত হয় আমাদেরই মাধ্যমে। এই প্রস্তাবে তাই রবীন্দ্রনাথও পুনরাবৃত্ত।

#
রবীন্দ্রনাথ একটা প্রতিষ্ঠান। বিবেকানন্দের আদর্শে, গান্ধীর আদর্শে যখন গোটা দেশে বৈরাগ্যের ঢল — সংসারের বুকে বসে ফকিরি শিখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর প্রতিটি কাজই একটা পাঠ। তাঁর জীবনচর্যাও। বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় লিখছেন —

“একদা আমাদের দেশের দার্শনিকেরা একটা মারাত্মক ভুল করেছিলেন মানুষের দেহের দিকটাকে অবহেলা করতে গিয়ে। …সংসার মায়া, জীবন অনিত্য, জগৎ নোংরা, এই যখন সত্য হয়ে দেখা দিল, বৈরাগ্যের আদর্শ যখন সর্বগ্রাসী হয়ে উঠলো তখন আমাদের দেশেও ঘনিয়ে এল বিষাদের কালোছায়া। মঠের আধিপত্য চলতে লাগল দিকে দিকে। আনন্দ করতে লোকে ভুলে গেল। আনন্দ যখন দেশ থেকে চলে যায় তখন জাতির জীবন তার গতিবেগ হারিয়ে ফেলে। সহস্র সহস্র মানুষের জীবন হয়ে গেল কুণ্ঠিত, অবগুণ্ঠিত। ফল হল সর্বনেশে। …আধ্যাত্মিকতার মুখোশ পরে এই যে সর্বনাশ এল, দিকে দিকে এই সর্বনেশে বৈরাগ্য-চর্চার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের বিদ্রোহ। তিনি এসে জীবনের পায়ে তাঁর গানের অর্থ নিবেদন করলেন। “বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়” — এই কবিতায় জীবনের অভিযান। “ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করি যোগাসন সে নহে আমার” _ দেহের আনন্দকে অবহেলা করার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অভিযান শুরু করলেন। “জয়ী প্রাণ, চিরপ্রাণ” বলে তিনি ক্ষান্ত থাকলেন না। প্রাণের বন্দনা করে তিনি গাইলেন “জয়ীরে আনন্দগান।” বৈরাগ্যের আদর্শ এসে আনন্দের আদর্শকে দেশ-ছাড়া করেছিল। রবীন্দ্রনাথ দেশবাসীর কানে দিলেন আনন্দের মন্ত্র। তিন বললেন এই জগৎ একেবারেই মায়া নয়। রূপের মধ্যে দিয়ে যিনি অরূপ তিনি আপনাকে ক্রমাগত প্রকাশ করে চলেছেন। যিনি অসীম তিনি সীমার মধ্যে কেবলই ধরা দিচ্ছেন।”
(রবীন্দ্রনাথ, রবিতীর্থে, বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়)

সংসারের বারমুখো ছেলেখেপানো ঠাকুরদা যখন ‘ডাকঘর’ নাটকে ‘ফকির’ সেজে আসে — আমি, পাঠক তো সে ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ ব্যতীত অন্য কাউকে দেখতে পাই না। এবং তাঁর এই ব্যক্তিত্ব নিঃসন্দেহে গড়ে উঠেছে তাঁর ছোটবেলার অভিজ্ঞতাগুলোয় জারিত হয়েই। সুধীর চক্রবর্তী লিখছেন ‘পথিক রবীন্দ্রনাথ : ভ্রমণ ও মাধুকরী’ প্রবন্ধে —

“সারাজীবন ধরে বাইরের নিসর্গ, দূরের অজানা দেশ আর অজ্ঞাত সব মানুষের টান এত যে প্রবল হয়েছিল তাঁর মনে, তার কারণ ছোটবেলা থেকে তাঁকে পেতে হয়েছিল এক সুদৃঢ় অন্দর। জোড়াসাঁকো বাড়ির আঁটসাঁট বন্ধন, ভৃত্যরাজকতন্ত্রের নিশ্ছিদ্র দেখনদারি আর বাবা-মায়ের নিকট সান্নিধ্যের বাইরে এক নিঃসঙ্গ পরিপার্শ্ব তাঁকে সুদূরের পিয়াসী করে তুলেছিল। সংকীর্ণ বাতায়নের ফাঁকফোকর দিয়ে কৃপণ দৃষ্টিতে চেখে নেওয়া প্রাচীন বটের শোভা কিংবা শীর্ণ পুকুরে স্নানার্থীর মুক্তি তাঁকে ব্যাকুল করেছে রৌদ্রমাখানো অলসবেলার আভাসে। তাতে তাঁর কাব্যলোক স্ফুরিত হয়েছে, জেগে উঠেছে গানের সুর, কিন্তু ভ্রমণপিপাসু দেহমনের আড় ভাঙেনি। জীবনের নানা অভিজ্ঞতা অর্জিত হলেও রবীন্দ্রনাথের কাছে বেরিয়ে পড়ার স্বাধীনতা ছিল না বলে, কৈশোরের নিরুপায় বদ্ধজীবনের ভবিতব্য না মেনে, যেন তার শোধ তুলতেই তাঁর উত্তরজীবনের সদা ভ্রাম্যমাণতা। বয়সের প্রৌঢ়ি পর্বে পৌঁছে তিনি কবুল করেছিলেন : ‘কেবলমাত্র এই চলবার আনন্দটুকুই পাব ব’লে আমি বার হয়েছি। অনেকদিন থেকে এই চলবার, এই বার হয়ে পড়বার একটা বেগ আমাকে উতলা করে তুলেছিল।’ …ইংল্যান্ড-আমেরিকা-দক্ষিণ আমেরিকা-জাভা-জাপান-রাশিয়া, যত জায়গায় রবীন্দ্রনাথ গিয়েছেন, তাঁর প্রধান ঝোঁক ছিল কেবল অভ্যস্ত পরিবেষ্টনী থেকে বের হয়ে পড়া নয়, মনুষ্যত্বের সার্বভৌম বিকাশকে ঘনিষ্ঠভাবে জানা।”

কিন্তু এই মুক্তিতে বাঁধনও আছে। বৃত্তটার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় মানব ও তার বিশ্ব। ‘The religion of Man’ গ্রন্থটির প্রথম প্রবন্ধ ‘Man’s Universe’ — নামকরণটিতেই স্পষ্ট যে মানুষের পক্ষ থেকে দেখাটাই মূল রবীন্দ্র-দর্শনে। আমরা জানি আইনস্টাইনের সঙ্গে তাঁর তাত্ত্বিক তর্কের কথা। শঙ্খ ঘোষের ‘দেখার দৃষ্টি’ প্রবন্ধটিও এক্ষেত্রে স্মরণীয়। অবশ্যই স্মরণীয় যে বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় ব্রাউনিং-এর আস্তিকতার সঙ্গে কবিগুরুর দর্শনের তুলনা করে লিখছেন —

“মানুষের জীবন একটা অর্থহীন প্রলাপ নয়- মানুষকে ঈশ্বরের প্রয়োজন আছে বলেই আমাকে তিনি সৃষ্টি করেছেন।”

অর্থাৎ, ‘মানুষের গরিমা’। কিন্তু মানুষের যে জৈবিকভাবে বা কোয়ান্টাম ক্ষেত্রেও আদৌ কোনও গরিমাই নেই — হারারির মতো দার্শনিক এবং বিজ্ঞানের বিপুল তথ্যভাণ্ডারের কল্যাণে আমরা জেনে গেছি। আমাদের রক্তে বিপন্ন বিস্ময়ের মুগ্ধতাও ধাতস্থ হয়েছে। আমরা জানি এ বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড উদ্দেশ্যহীন। ঘটনাপ্রবাহে আমরা ঘটে গেছি। কয়েকটি বিন্দু বা রেখা বা সংখ্যা। বা তাও নয়। দেবদাস আচার্যের একটি কবিতা বইয়ের নাম ‘বিন্দু নয় রেখা নয়’। মানুষকে নিজের প্রাকৃতিক জৈবিক ক্ষমতা দখলের জন্য বহু মানুষকে একজায়গায় করে একটা single processing unit গঠনের জন্য নানা রকম গল্প ফাঁদতে হয়েছে, জীবনের ‘অর্থ’ নির্ধারণ করতে হয়েছে। এভাবে মানুষের তথাকথিত উন্নতির জন্য তাদের সামাজিক বুদ্ধিই মূল। কিন্তু মানুষ তো এক শতাব্দী বাবদ ব্যক্তি স্বাধীনতা চর্চায় মনোযোগী ছিল। ফলে গোষ্ঠীতন্ত্রের গুরুত্ব নিয়ে আবার প্রশ্ন উঠছে। যেমনটা এ আলোচনার শুরুতেই বলছিলাম যে লিবেরাল চিন্তা একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে কিছুটা ব্যাকফুটে। ছোটবেলার রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা এখন কোথাও পুনরাবৃত্ত হলে বিরক্ত হই। যতটা দেখানো হয় ততটা যে পড়া হয় না রবীন্দ্রনাথ তার কারণটাও এই। রবীন্দ্রনাথ বুড়ো হয়েছেন। শতাব্দী জুড়ে পুজো পাওয়া বুড়ো বট-ছায়া। তাঁর দর্শন নিভৃতে ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক-যাত্রায় মিশে গেছে কত মানুষের! আসলে অমল তো আদৌ মরেনি ‘ডাকঘর’ নাটকে। রবীন্দ্র রচনাবলীর গ্রন্থপরিচয় অনুযায়ী —

“রবীন্দ্রনাথ ১৭.২.১৯৩৯ তারিখের একখানি চিঠিতে পরিহাসচ্ছলে লেখেন, ‘ডাকঘরের অমল মরেছে বলে সন্দেহ যারা করে তারা অবিশ্বাসী — রাজবৈদ্যের হাতে কেউ মরে না — কবিরাজটা ওকে মারতে বসেছিল বটে।”

অমল মরেনি তার আরও একটা কারণ এই যে সুধা তাকে ভোলেনি। কিচ্ছু বিশেষ নেই মানুষের। বাকি পাঁচটা স্তন্যপায়ী যেভাবে স্নেহ ধর্ম পালন করে মানুষ কেবল সেটাকেই তার গল্পের সুধা করে তুলেছে। বেঁধে বেঁধে থাকবার মধ্যে যে ওম, স্মৃতির ভেতরে যে ওম — গায়ে ঘেঁষে বসবার ভেতরে যে মায়া — সবই নিতান্ত মানবিক প্রবণতা তবু তার চেয়ে বেশি বাস্তব আর কী থাকে একজন মানুষের কাছে দিনান্তে। ফলত সুধাকে যেন কিছুটা জোর করেই ফিরিয়ে আনেন রবীন্দ্রনাথ নাটকের একেবারে শেষে। কেননা কোমল স্বভাবগুলো মানুষের জৈবিক তাগিদেই জরুরি। ফলত এক নির্ধারিত মায়া রয়ে যায় মানব জন্মের প্রতি আমাদের। এবং এই জড়িয়ে পড়াটা আপাতত ভালোভাবে বজায় রাখতে হবে যদি টিকে থাকতেই হয় নিতান্ত জৈবিকভাবেই। পিঁপড়ে হয়ে আর জন্মাতে চায় ক’জন আস্তিক! ফলত রবীন্দ্রনাথ-চর্চা ব্যর্থ হবে না। কথার পিঠে কথার ওম এসে লাগবে। লাগুক। রবীন্দ্রনাথ মানুষের গানবুড়ো। তিনি যতটুকু আছেন আমাদের মধ্যে ততটুকুই তিনি। বাকি আভরণ খসে যাক।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes