
শুভ রায়চৌধুরী-র গল্প
তোর অস্তিত্ব অথবা আমি
আমি এবার শব্দের মিছিলে লুকিয়ে রাখতে চাই তোকে। তোর অস্তিত্ব ও প্রেমে আমি এখন অমোঘ প্রশ্নচিহ্ন রাখব, তারপর ক্রমশ টুকরো-টুকরো করব সমস্ত যতিচিহ্নে। শুধু তা-ই নয়, আমার শরীরের সমস্ত সময়ের পালক ছিঁড়ে ফেলব এক-এক করে। মুছে দেব আমাদের ইতিহাস, কারণ আমার শরীরের ভেতরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ও সমস্ত অস্থিমজ্জায় অজস্র স্মৃতির প্রতিফলন আমাকে বেঁধে ফেলছে এক শূন্য পরিণতিতে। অনেকে বলেন, সময় সবকিছু ঠিক করে দেয়। কিন্তু সময়টাই যদি রোগ হয়ে ওঠে, তবে?
তাই, আমার এই লেখা, তোকে বিদায় জানানোর অন্তিম চিঠি!
তোর নিশ্চয়ই মনে আছে, চাকরি পাওয়ার পর আমাদের পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার কথা। বাবা-মা’কে ছাড়া সেই প্রথম আমরা দু’জনে মিলে অনেক দূরে বেড়াতে গেছিলাম। আমরা দু’জনেই চাইনি, আমাদের মাঝে কোনও তৃতীয় অস্তিত্ব থাকুক। অনাবিল আনন্দে আমরা ভেসে যেতে চেয়েছিলাম ওই ক’টা দিন। বুঝতে চেয়েছিলাম পরস্পরকে। আমাদের আত্মিক যোগাযোগের পথে আঁধার আবৃত স্থানটিকে ভাস্বর করতে চেয়েছিলাম।
সে-দিনের কথা ভুলি কী করে! লাভা থেকে রিশপ যেতে, পথের ধারে এক নেপালি চা-এর দোকানে ধোঁয়া-ওঠা গরম চা-এ চুমুক দেওয়ার সময়, কখন যেন মেঘ ঢেকে ফেলেছিল পাশের পাইন জঙ্গলটাকে। বৃষ্টি নামার ঠিক আগেই, আমরা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে, মাটির ওপরে বিস্তৃত গাছেদের শিকড়ে-শিকড়ে সাবধানে পা ফেলে অনেকটা উপরে উঠে গিয়েছিলাম। মেঘ আর উঁচু পাইন গাছের ঘন পাতার প্রাকৃতিক ছাদ শুষে নিয়েছিল প্রায় সবটুকু আলো। সেই আলো-আঁধারির মাঝে, গাছের বাকলে জমে থাকা শ্যাওলা তখন প্রতিপ্রভ সবুজ আর মায়াবী। মায়াবী তখন তুইও। অচিরেই এক মায়াবাস্তবতা আমাদের টেনে নিয়েছিল অরণ্যানীর আরও, আরও গভীরে। তারপর এক চিলতে পাহাড়ি পাথুরে পথ ধরে হেঁটেছিলাম প্রায় অনন্ত সময় ধরে, যেন নতুন একটা ম্যাপের সন্ধান করছিলাম আমরা। আমি চাইনি সময়টা তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাক। অনেক কথা বলার ছিল তোকে। আমাদের কাছে কোনও ছাতা ছিল না। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে অরণ্যবৃষ্টির ফোঁটা এসে ভিজিয়ে দিচ্ছিল আমাদের। আর আমরা উষ্ণতার স্বাদ নিচ্ছিলাম একে-অপরের হাত ধরে। তারপর কখন যেন ফার্ন, ব্যাঙের ছাতা, ঘাসের স্পর্শে পায়ে-পায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম নির্জন একটা জায়গায়। সেখানে শুধুই বৃষ্টি পড়ার শব্দ; আর কোনও শব্দ ছিল না। আকাশের দিকে মুখ তুলে বৃষ্টির আদর মুখে মেখে নিয়েছিলাম। ঠান্ডায় কাঁপছিলাম দু’জনেই। আমি তোর হাত নিয়ে আমার দু’হাতের মাঝে রেখে ঘষছিলাম। বাজ পড়ার শব্দে ভয় পেয়েছিলাম। শুনেছিলাম সেই প্রচণ্ড শব্দের অনুরণন এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়তে। তিন-চারটি সিগারেট বিনিময় হয়ে ছুঁয়েছিল একবার তোর ঠোঁট, একবার আমার।
আজও তোর গালে, চুলে ও ঠোঁটে আমার আঙুলের স্পর্শের অনুভূতির সবটুকু অনুভব করতে পারি। হিমশীতল বৃষ্টি তখন তোর গাল থেকে চেটে নিচ্ছিল লবণের স্বাদ। আর আমি হাওয়ায় দুই হাত ছড়িয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলাম। নিতান্তই ছেলেমানুষি! তোর আঙুলে ও ঠোঁটে তখনও আগের রাতের নিকোটিনের হলদে আস্তরণ, এলোমেলো বিন্যস্ত চুলে কে যেন জলরঙে এঁকে দিয়েছিল তিস্তার পান্না-সবুজ প্রবাহ! মাঝে-মাঝে মেঘের ফাঁক দিয়ে বৃষ্টির সঙ্গে ঝরে পড়া অভ্রকণার মতো আলোর কুচি তোর মুখটিকে দীপ্ত করে তুলছিল। জানি-না-কেন, হঠাৎ কোন এক মনখারাপে শ্যাওলার আস্তরণ গাছের শরীর থেকে খুঁটে-খুঁটে তুলছিলি তুই! যা-কিছু আমার বলার ছিল তোকে, বলতে পারিনি সেদিন। চাইনি আমাদের মধ্যেকার ওই সুন্দর মুহূর্তটা নষ্ট হয়ে যাক ভাষার অকারণ জটিলতায়।
এরপর বিকেল গড়িয়ে এলে, আমরা হাত ধরাধরি করে পাকদণ্ডী বেয়ে উঠতে উঠতে উঠতে উঠতে হোমস্টে-তে ফিরে এসেছিলাম। অতটা পাহাড়ি পথ হেঁটে আসার জন্য আমি হাঁপিয়ে গেছিলাম। একটু জিরিয়ে, আমরা ব্যালকনিতে গিয়ে বসলাম। গরম থুকপায় শরীরের নিভু উষ্ণতা জাগিয়ে, তুই গুনগুন করে গেয়ে উঠেছিলি এক চেনা সুর। সুরটা যেন অনেক, অনেক আগে থেকে আমাদের সঙ্গে ছিল। আমাদের জন্মের আগে থেকেই দু’জনকে বেঁধে রেখেছিল। ওখানে তখন, আমার শরীরে শিহরন জাগাচ্ছিল বৃষ্টিভেজা জামায় পাহাড়ি উন্মাদ বাতাসের ছোঁয়া আর তোর সুর।
এই তো, কিছু দিন আগেও সব জায়গায় প্রতি মুহূর্তে তোর অস্তিত্ব অনুভব করতাম। জানি, কেউ বিশ্বাস করবে না আমার এই অদ্ভুত অনুভূতির কথা! প্রতিদিন সকালে বিছানায় জেগে ওঠার পর যখনই চোখ খুলতাম, তোর শরীরও আমার পাশেই জেগে উঠত। ছোটবেলায় যেমন আমরা একসঙ্গে ঘুমতাম, জেগে উঠতাম, ঠিক তেমন। চেনা গায়ের গন্ধ, চেনা স্পর্শ জড়িয়ে নিত আমাকে। কী এক আবেশে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলতাম! তারপর সামান্য আড়মোড়া ভাঙতেই, তোর শরীর টুকরো-টুকরো হয়ে গিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যেত। আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়তাম। উদ্ভ্রান্তের মতো ঘরের প্রতিটা কোনায় খুঁজতাম তোকে। তখন আমার নিজের হাত পা-ও যেন ছায়া হয়ে যেত। খণ্ড খণ্ড ছায়া ফেটে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ত এদিক-সেদিক। নিজেকে বলতাম—না, আমি কিছুতেই ছায়া হব না। ভয় লাগত আমার। নিজেকে বোঝাতাম, এ-কোনও স্বপ্ন নয়। আমি হ্যালুসিনেশনের মধ্যে নেই। তারপর আমার চোখের পাতায় নতুন ধুলোকণা জমা হতো। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠত। সূর্যের তাপ বুঝিয়ে দিত কোনটা বাস্তব আর কোনটা আমার কল্পনার রেশ। একরাশ মন খারাপ জমা হতো মনের মধ্যে।
এই যন্ত্রণা বয়ে চলতে পারছি না আর—তোকে এবার সত্যিই বিদায় জানাতে চাই।
লেখার এই মুহূর্তে, তোকে আরও একবার মনে করিয়ে দিই, আমাদের কাটানো সেই পাহাড়ি গ্রামের বিকেলের কথা। তোর গুনগুন সুর এক সময় সমস্ত শিহরন হ্রাস করে, আমাকে অস্থির করে তুলেছিল। চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে তিন-চার পা এগিয়ে গিয়ে ব্যালকনির রেলিঙের ধারটায় দাঁড়িয়েছিলাম। ঠান্ডা রেলিঙের লোহার খাঁজ আর শ্বাদন্তের মতো ফলাগুলোকে আঙুলের স্পর্শে অনুভব করার চেষ্টা করছিলাম। রেলিঙের গায়ে জমা বিন্দু বিন্দু জলকণায় আমার আঙুল ভিজে গিয়েছিল। তারপর পাহাড় আর উঁচু গাছেদের মাথার ওপর থেকে ভাসা-মেঘ এসে সামনের দৃশ্যপটকে বার বার অদৃশ্য করে তুলছিল। যেন কোনও শিল্পী ক্যানভাসে বেখেয়ালে তুলি দিয়ে ধূসর রঙের আঁচড় কাটছিলেন। আবার পর-মুহূর্তে সে-রঙ মুছে গিয়ে ফিরে আসছিল আবছায়া সবুজ উপত্যকা আর দূরের সেই ছোট্ট বাড়িটা। বাড়িটার চিমনি দিয়ে নির্গত ধোঁয়ার কুণ্ডলী ক্রমাগত চেষ্টা করছিল আকাশ ছুঁয়ে ফেলতে। সকালে আমাদের দেখা পাহাড়ি নদীটির গর্জন তোর সুরকে ছিন্নভিন্ন করতে চাইলেও, তা আবহ হয়ে উঠেছিল। লক্ষ করেছিলাম, নদীটার মাঝে একটা বড় পাথরে বসে জলে পা ডুবিয়ে, আনমনে এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলি ছোট-ছোট পাথরের বিছানার ওপর বয়ে চলা প্রবাহের দিকে। ভেঙে যাচ্ছিল স্রোত। কোন এক ভাবনায় তোর চোখে একরাশ ক্লান্তি ফুটে উঠেছিল তখন!
আমি ওই ক্লান্তি এখন অনুভব করতে পারি।
এরপর যখন পুরোপুরি অন্ধকার নেমে এসেছিল উপত্যকা জুড়ে, আমি হিসেব করতে থাকলাম কোন কোন জিনিস আমাদের এক সূত্রে বেঁধে রেখেছে, বা আমাদের আলাদা সত্তা তৈরি করেছে। আমাদের এই শরীরটাকে কি এই হিসেবের মধ্যে ধরতে পারি?
ভেবে দেখেছিলাম কয়েকটি ব্যাপার আমাদের জুড়ে রেখেছে: একটি জঠর (পৃথিবীর প্রথম সুর আমি ওখানেই শুনেছিলাম, তোর হৃৎপিণ্ডের লাব-ডাব লাব-ডাব…) ও প্লাসেন্টা (যদিও অ্যাম্বিলিক্যাল কর্ড প্লাসেন্টা থেকে দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছিল), আমাদের যৌনতা ও প্রেম, এবং একটি নিরাপদ আশ্রয় (আমাদের মায়ের কোল)।
একদিন আমি ঘরের আয়না ভেঙে ফেলেছিলাম রাগ ও বিভ্রান্তিতে, কারণ আয়নাতে নিজেকে খুঁজে পেতাম না কখনওই। অন্য একদিন, নিজের অস্তিত্বের এই সংকটে আমার যাবতীয় শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকলাপ ও রক্ত সঞ্চালন বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা শুধুমাত্র নিশ্চিত করতে পারত আমার মৃত্যু! ‘পিয়ের লো ফ্যু’-এর কথা মনে আছে? ফার্দিনান্দের মতন নিজেকে লাল-হলুদ ডিনামাইটে ধ্বংস করার ইচ্ছে কোনওদিনই হয়নি আমার। ভার্জিনিয়াও নই আমি। আবার স্নানের সময় মাথা নিচু করে একভাবে তাকিয়ে দেখতাম জলের ধারার সঙ্গে সাবান-শ্যাম্পুর ফেনা, ঝরে পড়া মাথার চুল ও গায়ের মাটি কেমন করে নর্দমার খোলামুখে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আসলে আমি তোর অস্তিত্বকে ধুয়ে ফেলতে চাইতাম। আমি দেখেছি নর্দমার মুখের ছাঁকনিতে আমাদের চুল দলা পাকিয়ে থাকতে। আর-একদিন ছোটবেলায় তোলা আমাদের একটা ফটোগ্রাফ দেখছিলাম। সম্ভবত বাবা তুলেছিল ছবিটি, যে-বার আমরা মাধ্যমিকের পর আন্দামান গিয়েছিলাম। অযত্নে ফটো অ্যালবামে পড়ে থেকে সেপিয়ার প্রলেপ পড়েছিল তাতে। সেই ফটোটায় আমি তোর মুখটাকে কালিতে ঢেকে দিয়েছি!
খণ্ড খণ্ড স্মৃতির ইমেজ সব বিক্ষিপ্ত করে তুলছে। আসলে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছি না লেখাটাকে। এত দিন তো নিজেকে অনেক সামলে চলেছি!
যা-ই হোক, এরপর ভাবতে থাকলাম কোন কোন জিনিস আমাদের দু’জনকে, এই দুই সত্তাকে আলাদা করে রেখেছে: আমাদের নাম, জীবনযাপন, চাওয়া-পাওয়া আর নিয়তি। তুই তোর শরীরে বিষাদের কালচে-নীল নকশায় ধারণ করেছিলি মহাবিশ্বের যন্ত্রণার মানচিত্র, আর আমি শুধুমাত্র তার ছাপ আমার মধ্যে রেখেছিলাম। সে-মানচিত্রের শ্বাদন্ত আমার শরীরের মাংস কামড়ে ধরে রেখেছিল, আমাকে গ্রাস করে নিতে চেয়েছিল সময়ের বিবরে। তুই জানতিস না, জানার কথাও নয়। কামড়ানোর ক্ষতচিহ্নগুলো ঢেকে ফেলার জন্য আমি কখনও-সখনও রঙ মেখে নিতাম এক নিঃশ্বাসে। তারপর অপেক্ষা করতাম নিষুপ্ত পূর্ণিমার আলোয় সব অন্ধকার মুছে যাওয়ার। আমি দেখেছি আমার শরীরে কোনও রঙই স্থায়ী হতো না। আর তখনই তোর স্মৃতি আবার আচ্ছন্ন করে ফেলত আমাকে।
কবে আমি নিজের মতো করে একা থাকতে পেরেছি?
এখন, তোর প্রেমিক, সেই ছেলেটির বাড়ি সবসময় এক বিষণ্ণতার কুয়াশায় মোড়া থাকে। দমবন্ধ করা অন্ধকারের মাঝে এক চিলতে বৈদ্যুতিক বাতির আলো সন্ধ্যা নামলে জানালা দিয়ে দেখা যায়। যেন সেটা বোঝাতে চায়, এই বাড়িতে এখনও একটি প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে। মাসের-পর-মাস ধরে জমতে থাকা কত চিঠি, কাগজপত্র ও বিল জমা হয়ে ডাকবাক্সের খোলা মুখ দিয়ে উপচে পড়ে। ওর ইচ্ছেই নেই সেগুলোকে একবার খুলে দেখবার।
এই তো সেদিন, আমি ওর দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। দরজা খুলে এমনভাবে দাঁড়াল সে সে, যেন আমারই আসবার অপেক্ষা করছিল। তখন ভোর পাঁচটা হবে বোধহয়। ঘড়ি দেখিনি। তবে ওকে দেখে মনে হল, সারা রাত ঘুমায়নি। হাঁটা-চলাতে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিল কতটা ক্লান্তি ঘিরে রয়েছে। ঠোঁটের কোণে ঝোলানো আধ-পোড়া সিগারেটের ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছিল রাতজাগা চোখের তলায় জমাট-বাঁধা বৃত্তাকার কালির দাগ। আমি ঘরে ঢুকতেই আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল, আমার হাতটাকে নিজের মুঠোয় রেখেছিল সযত্নে, যেন এই হাতের স্পর্শ ওর ভীষণ চেনা, খুব কাছের! ও তো আমাদেরকে দু’টি আলাদা সত্তা হিসেবে চেনেনি কখনও—আসলে বোঝেনি বা বুঝতে চায়নি যে আমরা যমজ হলেও একই মানুষ নই। যদিও আমাদের দুটি শরীর আজন্ম একটাই আত্মাকে শরীর-কাঠামোর ভেতরে ধারণ করে রেখেছিল।
ছেলেটি আমাকে ডেকেছিল তোর নামেই। ভুল না-ধরিয়ে দিয়ে পিছু-পিছু নিঃশর্তে ওকে অনুসরণ করেছিলাম বাড়িটার প্রতিটা ঘরে, রান্নাঘরে আর বারান্দায়, যেখানে যেখানে তোর স্পর্শ লেগেছিল, সে-সব জায়গা ছুঁয়ে যাচ্ছিলাম। বারান্দাটা খুব পছন্দ হয়েছিল আমার। আমি সে-কথা জানাতে ছেলেটি বলেছিল, সে নাকি এখন বারান্দায় গিয়ে একবারও বসে না। আড়ালে থাকতে চায়। কেন এই বিচ্ছিন্নতা? আমি এর উত্তর পাইনি আজও। আমি ওর পড়ার ঘরে, টেবিলটার পাশের চেয়ারে বসেছিলাম। একটা বেতের চেয়ারে ছেলেটিও আমার মুখোমুখি বসেছিল। আমার মনে আছে, ডুয়ার্স ঘুরে ফেরার সময় তুই এই চেয়ারটা উপহার হিসেবে নিয়ে এসেছিলি ওর জন্য। ঘরময় বই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিল। দেয়ালে সাঁটানো রয়েছে অজস্র খবরের কাগজের কাটিং। মনের মধ্যে জমে থাকা দ্বিধাবোধ আমাকে ফালা-ফালা করে দিচ্ছিল। আমি চেয়ারের হাতলটা শক্ত করে ধরে, হেলান দিয়ে বসেছিলাম, যাতে উত্তেজনার আগুনে গলে গেলেও নিজের পরিসীমার মধ্যে থাকতে পারি।
তখন মনে পড়ল, জন্মদিনে আমি তোকে কোনওদিন ফুল ছাড়া অন্য কিছু উপহার দিইনি। বরং তুই আমাকে কত কী উপহার দিয়েছিস, যেমন, একবার গ্রীক পুরাণের ভিত্তিতে লেখা অনুবাদ করা গল্পের বই। বইটা থেকে একটা গল্প পড়েছিলাম। প্লেটোর সিম্পোজ়িয়াম-এর ওপর। সেখানে লেখক একটা পৌরাণিক উপাখ্যানকে গল্পের আকার দিয়েছিলেন। বলা যায়, বাস্তবতার নিরিখে বিষয়কে আগুনে পুড়িয়ে ছিলেন। অনেক আগে মানুষের শরীরে দুটো মাথা, চারটে হাত ও চারটে পা ছিল। আমরা জানি, শিশুরা আয়নায় নিজেকে না-দেখলে স্বীয়-সত্তা আলাদা করে চিনতে ও বুঝতে পারে না, তাই সে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে না। গল্পটায় জ়িউস মানুষের শরীর বিচ্ছিন্ন করে সঙ্গী-সঙ্গীনী সৃষ্টি করেছিলেন। সেই থেকে তারা একে-অপরকে ভিন্ন নামে চিনত এবং জানত। আচ্ছা, যদি আমি তোকে আমার নামে ডাকি, তবে কি তুই আমাকে তোর নাম ধরে ডাকবি? কী অদ্ভুত না! আমরা যেন পরস্পরের আয়না। আমরা কি আবার এক হয়ে যাব যদি তোর প্রেমিক আমাকে তোর নামে ডাকে? এ তো সত্যি, আমরা দু’জনে একটা শরীর থেকেই দু’টুকরো হয়েছিলাম।
ছেলেটি একের-পর-এক সিগারেট ধরিয়ে অ্যাশ্-ট্রে’তে ছাই জমা করছিল। কয়েক মুহূর্ত আমার মনে হয়েছিল, ও চাইছে আমার মাথাটাকেই অ্যাশ্-ট্রে হিসেবে ব্যবহার করতে; আর চেষ্টা করছিল গলা, ল্যারিংস, ট্র্যাকিয়া, ব্রঙ্কাই দিয়ে যতটা সম্ভব নিকোটিন ফুসফুসে ঢেলে নিতে। আমি নিশ্চিত ছিলাম, এই ক’বছরে নিকোটিন ওর ফুসফুসের দেয়ালের রঙ গাঢ় কালচে-বাদামি করে তুলেছে। অ্যাসিডে পোড়ালেও সেই দাগ মুছবে না।
“এ-ভাবে দিনের-পর-দিন। চলা। সম্ভব। না।”—ছেলেটি বলেছিল। শেষ তিনটি শব্দের উচ্চারণ করেছিল সামান্য সময় নিয়ে, ভেঙে-ভেঙে। মুখ থেকে নির্গত ধোঁয়া ওর ঠোঁটে ভেঙে যাচ্ছিল, বার বার। ও চাইছিল স্মৃতির জালের সুতো একটা-একটা করে কেটে ফেলতে। অথচ এই জাল আমি সেই কবে থেকে একটু-একটু করে বুনেছিলাম। প্রতিটি সুতো বাঁধা রয়েছে আমার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও মনের সঙ্গে। ওর এই কথায় যেন আমার প্রতিটি শিরা-উপশিরা ফুলে উঠল রক্ত জমাট বেঁধে। তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছিলাম না, উন্মত্ততায় দরজা ঠেলে রাস্তায় বেরিয়ে আসতে চাইছিলাম… ফিরে যেতে চাইছিলাম সেই জঠরে, যেখানে নাড়ি-কাটার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা দু’জনে একসঙ্গে ছিলাম। আমাদের আলাদা শরীর, অস্তিত্ব আর সত্তা—কোনও কিছু ছিল না।
নাহ্, আমি ওর কাছ থেকে পালাতে পারিনি। তারপর যেদিন সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সরিয়ে তার বাড়ির জানালা ভেঙে রোদ ঢুকে সব ঘর আলোকিত হয়ে উঠেছিল, ও আমাকে সিক্ত করেছিল গভীর চুম্বনে। তুই আর আমি, দু’জনেই একই মাংসের দলায় এই শরীর দুটোর আকার পেয়েছিলাম। তাই হয়তো ও আমাকে স্পর্শ করে পেতে চেয়েছিল তোকে, তোর শরীরটাকে… পাগলের মতো চুম্বন করেছিল আমার শরীর জুড়ে, আমার বন্ধ চোখে। তারপর একটা সময় আমার মনে হয়েছিল, ও যেন চুম্বন করছিল একজন মৃত মানুষকে অন্তিম বিদায় জানাতে। তবে ওই প্রথমবার জীবনে খুশি হয়েছিলাম আমি। বুঝতে পেরেছিলাম তোর সেই মন খারাপ আর ক্লান্তির কারণগুলো।
***
এখন আমি ফিরে এসেছি পাহাড়ের সেই গ্রামটায়। তোকে খুঁজে পাইনি কোথাও। এই না-পাওয়াটার মধ্যে একই সঙ্গে রয়েছে আনন্দ আর বিষাদ। আগের মতোই ঠান্ডা হাওয়া কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে। অথচ রোদের আলো উপত্যকা ভাসিয়ে দূরের পাহাড়ি বাড়িটার উনুনের ধোঁয়ার সঙ্গে আদিম খেলায় মেতেছে। অতীতে ফেরার সব রাস্তা একে-একে চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তুই-ই তো, যে, আমার জীবনের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে রেখেছিলি? তোর শরীর আমার অস্তিত্বকে টেনে ধরে রেখেছিল, যেমন করে— ভেজা মাটি আটকে রাখে ধুলোকণা। শুরুতেই কেন নিজেকে আলাদা করে অন্য হাওয়ায় ভাসালি না?
এই তো সেদিন, নাকি কয়েক মাস, বা কয়েক বছর… কতটা সময় এখন হিসেব করতে চাই না আর… তুই হেঁটে চলে গেলি পার্থিব সীমানা ছাড়িয়ে, দূরে, অনেক দূরে। পাদচ্ছেদ তোর শরীরের পোস্ট-মর্টেম করেছে, বিস্ময়সূচক চিহ্ন তোকে করে তুলেছে নির্বাক এবং পূর্ণচ্ছেদ সব স্মৃতিকে ঝাপসা করে দিয়েছে। ডোম আমাকে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল চিতা-ভস্মের ঘট। একটুখানি ছাই মেখে নিয়েছিলাম আমার আঙুলে। ওই মুহূর্তে তুই যেন আমার স্পর্শ এড়িয়ে যেতে চাইলি। তবু, শেষবারের জন্য, আমি স্মৃতি দিয়ে গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম তোর শরীর, আর ধোঁয়ার কুণ্ডলী থেকে তোর চুল।
এখন, রাস্তায় পড়ে রয়েছে বিষণ্ণ ছায়ারা। ওরা গুনগুন করছে আমাদের ভাঙাপথের কাব্য। একটু পরে সন্ধ্যা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে নামলেই, পাহাড়ি নদীটির স্রোতের গর্জন হয়ে উঠবে একদল মানুষের কোরাস—ভেঙে দেবে নিঃসঙ্গতার অবয়ব। লিখতে বসে মনে হচ্ছে, তোর অস্তিত্ব মোটেও আমার হ্যালুসিনেশন অথবা ফ্যান্টাসি নয়, বরং মাধ্যাকর্ষণের মতোই এক শাশ্বত টান।
উত্তর দিতে পারবি, তোর অস্তিত্ব ছাড়া এই বিদায় আমি জানাব কীভাবে?