
পর্ণশবরীর কথকতা ৯
প্রাপ্তি চক্রবর্তী
ঘুমের অন্ধকার থেকে প্রতি সকালে, প্রতি অসময়ের ঘুমে কিছু টুকরো গল্প উঠে আসে। অন্ধকার আর নৈঃশব্দের মাঝে ছড়ানো থাকে আধ-ভাঙা নানান রূপকথার অপূর্ণ আখ্যান৷ অসময়ের ঘুম আমায় নিয়ে যায় ভেঙে যাওয়া জাপানি চা-পাত্রের মতো ভঙ্গুর গল্পের টুকরোদের কাছে। নানা রূপ তাদের, গড়ন ভিন্ন। আমি আঁচল বিছিয়ে যত্ন করে এক-একটা টুকরো তুলে নিতে থাকি। জাপানি ঐতিহ্যের মতো সোনা রঙ দিয়ে জুড়ে নিতে চাই তাদের। আমার রূপকথারা পূর্ণতার গড়ন পাবে সোনা রঙে…
কিন্তু চোখ আমার অযোগ্য, সোনা রঙের খোঁজ পায়নি সে। কালো চটচটে স্থবির জন্তুর মতো আঁধারবেলা আমার সমস্ত ঘুমের গোপনীয়তাকে গ্রাস করে রাখে। গল্পের টুকরোগুলো সামঞ্জস্যতা খুঁজে না পেয়ে হেলায় ছড়িয়ে থাকে সেই স্থবির অন্ধকারের ভিতর৷ অন্ধের মতো বেমানান সব টুকরোগুলো গেঁথে গেঁথে জন্ম দিতে থাকি এক আদিম বণ্য অসুন্দরের।
সোনা রঙের খোঁজ পায়নি আমার চোখ। অন্ধ আমি। জাপানি বুদ্ধভক্তের কাছে দীক্ষা নেওয়া হয়নি আমার ধৈর্যের, দীক্ষা নেওয়া হয়নি কীভাবে সোনা রং খুঁজে তাকে গলিয়ে জোড়া লাগাতে হয় ভঙ্গুর বেয়াদব টুকরো গুলোর মুখে।
আমি অদীক্ষিত। অসম্পূর্ণ কথামালারা আমার হাতের সস্তা বাঁধুনি খসে ছড়িয়ে পড়ে বারেবারে, ঘুমের অন্ধকার থেকে তাদের ভেঙে যাওয়ার ঝনঝন শব্দ শোনে আমার আতঙ্কিত চির-আত্মা। গল্প গাঁথা হয় না আমার। গল্প বলা হয় না আর। রূপকথারা ঘুমের জান্তব অন্ধকারে পিছিয়ে যেতে থাকে ক্রমশ… আর আমি… ডুবে যেতে থাকি এক অপার্থিব নৈঃশব্দের অন্ধকারে।
আলো বাতাসের অগম্য সেই অন্ধকারে কানে আসে বুদ্ধভক্তের শীতল ধ্যানমন্ত্রের সূক্ষ্ম অনুরণন,
“বুদ্ধং বন্দামি,
ধম্মং বন্দামি,
সঙ্ঘং বন্দামি,
অহং সব্বদা।
দুতিযম্পি, ততিযম্পি…”
আমি ক্রমাগত অন্ধকারের ভেতর থেকে সোনার খোঁজের দিকে এগিয়ে যাই, গল্প বোনার ধৈর্য নিয়ে এগিয়ে যাই…বুদ্ধং বন্দামি, ধম্মং বন্দামি… বুদ্ধং বন্দামি, ধম্মং বন্দামি….।
সব গল্প বোনা হয় না আমার, সব আখ্যান তুলে আনতে পারিনি গভীর অন্ধ জলাশয়ের তল থেকে; সোনা রঙের খোঁজে শুধু দীর্ঘ পথ হেঁটে চলি ঘুম থেকে জাগরণে, জাগরণ থেকে ঘুমে…. আবর্তমান পথে আলো আসে বুদ্ধভক্তের প্রাচীন ধীর মন্ত্রোচ্চারণ থেকে৷ আমি শিখতে থাকি কীভাবে ঘুম আর জাগরণের পথ পেরিয়ে সোনা রঙকে খুঁজে বের করতে হয়, দীক্ষা নিতে থাকি সেই তরল সোনা দিয়ে আধভাঙা টুকরোগুলো জুড়ে রাখার স্থৈর্যের। ধ্যান শেষে একদিন সব কটা গল্প স্থির বিশ্বাসে বলে যেতে পারব; বুদ্ধের শীতল মন্ত্র আমার অন্ধ চোখকে শিখিয়ে চলেছে এইসব নিস্তব্ধ কথকতা৷