
সঞ্চিতা বসুর কবিতাগুচ্ছ
মধ্যরাত্রের দরবারি
১
ঈদের শশীকলা তর্জনীর টানে
মোষের শিং যেন
যেভাবে ঢাকীদল সজোর ফুৎকারে
নিশান ছিঁড়ে দেয়।
নিভছে কররেখা।
ঝাপসা জলঝারি সটান মুছে ফেলে
চড়কে বঁটিঝাঁপ।
তখন পাখোয়াজ কোমল, খরশান তীক্ষ্ণ চোখ বাজ
পাখিকে ধরে দেয়।
পাঁজিতে লেখা নেই কীভাবে কোন ক্ষণে শত্রু বধ হবে।
অযথা মনে হয়।
কবি ও কথাকার কাব্যসংসার এর’চে স্পষ্টত
নিদান দিয়েছেন। শূন্যে তুলেছেন
নেভানো পেনদানি। কোন্ এক লেখকের
শেষ অভিজ্ঞান।
কড়ি ও কোমলেতে, বিভাস ও পূরবীতে
জগৎ মিলে গেলে
আমরা ঘরে ফিরি।
গীতবিতান ঘেরা অসম ঘরবাড়ি,
মধ্যরাত্রের দরবারির জয়।
২
আমার এক একটা সাদা চুল
এক এক অপেক্ষার সমান।
————————————
৩
আলো আর আড়ালের মাঝে কোনো সাঁকো থাকবে না।
কাঁঠালপাতার ঘেরে খসখসে স্খলিত আওয়াজ,
মৃদু মর্মরধ্বনি খুব বেশি শূন্য মানে না।
নোয়ার নৌকায় যারা স্থান পেল অথবা পেল না,
পৃথিবী তাদের নিয়ে নিরহংকারী।
আপাত উদাসীনতা কতটা সংস্থান পেলে
প্রসন্নময় সন্ন্যাসী তাকে ফেলে
একা হেঁটে পার হন সাঁকো —
তোমার মতন ঘোর সুসংসারী সেকথা বোঝে না।
৪
স্বপ্নে ফিরে আসে পুরোনো ফ্ল্যাটবাড়ি, দখিনা অলিন্দ
অথবা পুবদিক রোদের আলোছায়া, ভেজা কাপড় মেলা।
নিচে জলের ট্যাংক, তারও সুগভীরে, কালো রহস্যেরা।
শিশুরা খেলা করে, টেনিস বল শুধু বাইরে পড়ে যায়।
জানলা পশ্চিম, তেতলা বাড়িদের
পেছনে সূর্যের অস্ত যাওয়া রোজ
উজল হলুদ আলো লাল মেঝের গালে কেবলই পিছলোয়।
চৈত্রে ফেরিওয়ালা তীক্ষ্ণ চিৎকারে পাড়া নিঝুম করে দুপুর এনে দিল।
দুপুরে জানলারা — কাঠের খড়খড়ি,
বায়োস্কোপে রোদ ধরে ও ছেড়ে দেয়!
পাখিরা উড়ে গেলে জানলা রোদ-ছবি যেভাবে তরলিত,
সেভাবে স্বপ্নেরা জাগে ও ডুবে যায়,
কখনো ভেসে থাকে। বহতা শৈশব।
অথচ বাড়ি ঠিক বন্দী করে রাখে
মধ্যবয়সের স্বপ্নপ্রতিশোধ।
৫
অল্প ঝড় উঠে হাওয়ারা এলোমেলো
ধুলোরা পাক খেলে, ধুনোর গন্ধরা তবুও থেকে যায়
চৈত্র শেষ রাত। গাজন সন্ন্যাসী হাতে ত্রিশূলইধারী
গায়ের চন্দন প্রলেপে দেয় ধার।
অসম বিন্যাসে ঢাকে ও কর্তালে
বাজনা বেজে ওঠে। ভস্ম মাখা হাত
দোমনা পিঞ্জরে কেবল খুঁজে চলে —
অক্ষমালা গাঁথা ন্যুব্জ মহাদেব
পাশের গৌরীকে মলিন বেনারসী
অচেনা মনে হয়। চড়কে চারদিন
চন্দ্রাতপ ঢাকা নকল গড় খালি
নিয়ত শান দেওয়া অস্ত্রমঞ্জরী
নকল পোশাকের মগ্ন বহুরূপ।
৬
বৃষ্টি পড়ছে না৷ ঝোড়ো হাওয়ারা শুধু
অল্প প্রবাহিত, ঝরা ফুলের পাশে
গভীর রাত্তিরে রেবেকা সুলতানা
আলো জ্বালিয়ে একা পড়ছে মন দিয়ে,
অথচ আশা দিয়ে বৃষ্টি ফিরে গেল
বৈশাখের দিন খামোখা এলোমেলো।
রেবেকা সুলতানা পড়তে বসে গেল।
বাংলা ভাষাকে সে আজকে ছাড়বে না।
বৃষ্টি ছেড়ে গেল।
৭
আকাশ নয় শুধু, মনকে ছেয়েছিল
ভিজছে কবুতর ভেজা ধুলোর ছোপ
কেবল্ তার থেকে জলেরা নিয়মিত
নিয়ন্ত্রিত তালে ঝরছে সারাদিন
হাতঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে নিতে পারো
কত সেকেন্ড হল।
চোখেতে জল নেই। ঘুপচি ঘর খোলা।
রাগ ও অভিমান বেড়াতে গেছে যেন
ধূপের গন্ধের ছোঁয়াটা পড়ে আছে।
মন খারাপ নয়।
৮
গর্জনের শেষে দোমনা অভিলাষে
যেভাবে নদীজল তীর ছোঁবার ছল
এড়িয়ে ঘরে ফেরে। যেভাবে একটেরে
নুয়ে পড়েছে গাছ, ফেরার নীল মাছ
আকাশে লাফ দেয়। সেভাবে সাড়া নেয়
আমার দরজারা, পুরোনো কড়ানাড়া
ফিরিয়ে ঝঙ্কার। আচার মাখা জার
চেনা হাতের খোঁজ জারি রেখেছে রোজ।
পর্দা উড়ে গেলে, একটু একটেরে
ভাবনা অগোছালো ধূসর-জমকালো
যেভাবে ধরা দেয়, নিংড়ে মুছে নেয়
আমার দরজার রং ওঠা ছোপ-দাগ —
একশো বছরের চেনা এ শহরের
সব আঙুল ছাপ।
৯
কেল্লার মতো বাড়ি আর তাতে নকল উপনিবেশের নকশা
জলের পাইপ, পাশ দিয়ে ওঠা বটবৃক্ষরা, ঘুম কবুতর
ছাদের ওপরে মস্ত আকাশে ছেঁড়া তার, ঘুড়ি, পায়রার জাল
বারান্দা করে অপেক্ষা কার? নাকি আক্ষেপ? জানে ঈশ্বর।
পুরোনো বাড়ির ছবি ওঠে ভালো — ফটোগ্রাফার দিব্য তা বোঝে
বাসের জানলা চিনিয়ে দিচ্ছে আমার ভবিষ্যতের চেহারা।
১০
লালবাজারের সামনের ফুটে যে লোকটি রোজ ঝুরিভাজা বেচে
যে উনুনে আঁচ দিচ্ছে কেবল তার দিকে কেউ তাকিয়ে দেখে না
ব্যস্ত রাস্তা, ঠিক এগারোটা, বাস থেকে চোখ গিলছে যেমন
যেন সবকিছু ফ্রেমে ধরা আছে স্টিল ছবি হলে দারুণ মানাবে
আধখোলা দ্বার, সিঁড়ি বেঁকে গেছে যেন সিলুয়েটে সুচিত্রা সেন
শুধু উত্তম সেলুন খুঁজছে আনকোরা চোখ আমার মতন
জ্যামে আটকালে বেশ মজা লাগে আরো কিছু ফ্রেম আলগোছে জুড়ি
দ্রুত পায়ে কেউ অফিস যাচ্ছে, আমি বাড়িমুখো, অবিশ্বাস্য!
ময়দান এলে দিল খুশ হয়, কিছু একা লোক, একলা বৃক্ষ
ভাগ্য বেজায় ভালো থাকলে তো একফালি ট্রাম টুং টাং দিন
শরৎকালের আকাশ আসল ট্রাম্পকার্ড ফেলে, সাদা তুলো, নীল
আর তার নীচে আমার মতোই একা ক্ষুর ঠোকে মহীনের ঘোড়া।


জোরালো ইম্যাজেরি,অনুভূতিপ্রসূত লেখা, কিছু প্রয়োগ একদম নতুন। অতিক্ষুদ্র কবিতাটি বিশেষ ভাল লাগল। রেবেকা সুলতানার গল্পও ভাল লেগেছে। কিছু শব্দ ব্যবহার অসাধারণ, যেমন ‘মধ্যবয়সের স্বপ্নপ্রতিশোধ’,’নিয়ত শান দেওয়া অস্ত্রমঞ্জরী’,’আমার মতোই একা ক্ষুর ঠোকে মহীনের ঘোড়া’। কিছু জায়গা দুরূহ ঠেকল, বিশেষ করে ছন্দ। আবার কোনো শব্দ দেখে সন্দেহ হচ্ছে টাইপো নয় তো? সব মিলিয়ে বলব, কয়েকবার করে পড়লে আরো রস পাওয়া যাবে। বহু শুভেচ্ছা রইল।