কিঞ্চিৎ পরচর্চা – ২১
বইয়ের জুড়ি মেলা ভার
রূপশ্রী ঘোষ
বই নিয়ে বহুদিন ধরেই নানান মানুষের নানা ভাবনা। ইংরেজি ভাষায় তো কত শব্দই আছে বই সম্পর্কিত। যেমন, Dog’s Ear, এর মানে হল, বই পড়তে পড়তে যদি কোনো কাজে উঠতে হয় তাহলে কেউ কেউ বইয়ের পাতা যে ভাঁজ করে রাখেন, তা। আবার ধরুন যিনি সবধরনের বই পড়েন, তাঁকে বলা হয় Omnilegent। বইয়ের স্প্লিন অথবা প্রচ্ছদে প্রকাশকের লোগোর একটা নাম আছে। তার নাম Colophon। কিছু মানুষ আছে তারা বইকে ভালো চোখে দেখে না। বিশেষ করে তাদের বিরুদ্ধ মতবাদের বই। তারা সেসব বই ছিঁড়ে ফেলে, পুড়িয়ে দেয়, ধ্বংস করে। মানব ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে বই ধ্বংস করার ঘটনা ঘটেছে। এর নাম বিব্লিওক্লাজম। নতুন বইয়ের গন্ধ পেলে মন ভালো হয়ে যায়। এর একটা গালভরা নামও আছে। Delitrium। অনেক সময় আমাদের রিডগ্রেট হয়। রিডগ্রেট কী? একটি বই পড়তে পড়তে ফেলে রাখার পর বহুদিন পর সেই বইটা আবার পড়া শুরু করলে মনে হয় কেন এতদিন পড়িনি। একে বলে রিডগ্রেট। বাংলাতেও আছে বইপোকা, বইচোর, আরও কত কিছু। এই বই নিয়েই আবার আসছে কলকাতা বইমেলা। আরও নানান জায়গায় হচ্ছে নানান বইমেলা। আসছে বিতর্ক এবং সেই ভুলে যাওয়া বছরের পর বছর ধরে আমাদের চেনা অচেনা তর্কগুলো। এত সব তর্ক ঝগড়া বিতর্ক এবং বিষণ্ণতার পরে বই কিন্তু রয়ে গেছে। কোনও ফ্যাসিস্ট হিটলার বই পুড়িয়েও বইকে ধ্বংস করতে পারেনি, কোনও মৌলবাদী মৌলবী বা পুরোহিত বা যাজক পারেনি বইয়ের ইতিহাসকে মুছে দিতে, ভবিষ্যৎকেও ধ্বংস করে দিতে। কারণ বই ধ্বংস হয় না। তার প্রকাশের রূপান্তর হতে পারে শুধু। চলতে থাকে এক বিরাট মিলনের উৎসব। জ্ঞান ও তথ্য পেরিয়ে যার নাম প্রজ্ঞা। বই আসলে সেই প্রজ্ঞার চাবিকাঠি। লিখলেন রূপশ্রী ঘোষ
বইমেলা প্রায় এসেই গেল। হাতে গোনা কয়েকটি দিন মাত্র। এই বই নিয়ে এবার নানান কথাবার্তা কানে আসবে বা খবরের কাগজ, পত্র পত্রিকাতেও লেখা হবে। বিষয় একটাই, বই কি আদৌ পড়ে? পড়লে কারা পড়ে? কী পড়ে ইত্যাদি প্রভৃতি প্রশ্ন। বইমেলা শেষে তার একটা লম্বা হিসেবের তালিকাও দেখা যায় গিল্ডের তরফ থেকে, এ বছর কত টাকার বই বিক্রি হল শিরোনামে। বইমেলাতে খাবারের স্টল দেওয়াটাও কতটা অপরাধ তা নিয়েও নানা মুণির নানা মন্তব্য। বইমেলায় তো আরও নানান বিষয় থাকে, হস্তশিল্পের জিনিস বিক্রি, ছবি আঁকানো, ছবি আঁকা টিশার্ট, গয়না টয়না বিক্রি, কবিতা পাঠ, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য, পথনাটিকা, বাউল গান, ব্যান্ডের গান কী থাকে না সেখানে…। যাঁরা যান তাঁরা সবই জানেন। এত চুলচেরা হিসেব না দিলেও চলে। কিন্তু বক্তব্য হল, বইমেলা একটা মেলা যখন,তখন সেখানে সবকিছু থাকতে অসুবিধাই বা কোথায়? বই কিনতে কিনতে টাকা শেষ হয়ে গেলে এ টি এম থেকে যেমন টাকা তোলার ব্যবস্থা থাকতে পারে (আজকাল ইউপিআই, পে টিএম হয়েছে), বা নিজস্ব ব্যাগ ভরে যাওয়ার পর আবার ব্যাগ কেনার ব্যবস্থা থাকতে পারে তেমনভাবেই সারাদিন ঘুরে ক্লান্ত হয়ে গেলে খাবার, জল, চা, কফি, টয়লেট এসবের ব্যবস্থা থাকতে দোষ কোথায়? নিন্দুকরা তা নিয়ে বড্ড কথা বলেন। আরে বাবা বই বিক্রি হলেই কি সব বই পড়ে সবাই? সেটা কি বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিসংখ্যান নেওয়া হয়েছে কখনও? যত বই বিক্রি হল তত বই পড়া হল কিনা? অনেকের বই কেনার একটা নেশাও থাকে পড়ার থেকে বেশি। আর তাছাড়া সবাই তো সব ধরনের বই পড়েও না। লেখকদের যেমন প্রকারভেদ আছে, পাঠকদেরও তো তেমন প্রকারভেদ আছে। কেউ ভালোবাসে হালকা ফুলকা চালের উপন্যাস, ছোটোগল্প, কেউবা কবিতা, কেউবা আবার ভারি ভারি প্রকৃষ্টরূপে বন্ধন নামে প্রবন্ধ কেউ আবার পুরোপুরি সাহিত্য বাদ দিয়ে দর্শন, বিজ্ঞান, রাজনীতি, সমাজনীতি, ধর্মনীতি আরও যা যা নীতি হয় সেসব ভালোবাসে। মেলার সুবিধা, সমস্ত বইগুলো স্টলে সাজানো থাকে বলে সেগুলো হাতে নিয়ে দেখার সুযোগ থাকে, ক্যাটালগ সংগ্রহ করা যায়, জানা যায় কোথায় কী পাওয়া যায়। সবসময় কলেজ স্ট্রিট গিয়ে তো বই হাতে নিয়ে ঘেঁটে দেখাও যায় না। আর সব দোকান তাদের অন্দরমহলে ঢুকে বই দেখার সুযোগও দেয় না। কে বলতে পারে, দেখতে দেখতেই আপনার মনে হতে পারে, ‘বাঃ এই বইটা দারুণ তো, এটা আমার কাজে লাগবে’ ভেবে কিনে নিলেন। এমন তো অনেকের ক্ষেত্রেই হয়। হয়তো বইটা সম্পর্কে কিছুই জানা ছিল না, মেলায় ঘুরে দেখতে দেখতে হাতে পেয়ে সেটা কিনে নিয়ে কাজে লাগানো গেল। আর যে বই আপনি জানেন, কিনবেন ঠিক করেই রেখেছেন সে তো কলেজ স্ট্রিট থেকে বা অন লাইনে অর্ডার দিয়ে এমনিই কিনবেন। ছাড় বেশি পাওয়া যায় কলেজ স্ট্রিট গেলে আর ঘরে বসে পেতে চাইলে অনলাইন। কিন্তু মেলা কি শুধুই বই কেনা, বই পড়া, বই দেখে আনন্দ পাওয়ার উৎসব? আর কোনো কি লাভ নেই? বইমেলায় ঘুরলে তো ক্লান্তির পাশাপাশি মানসিক আনন্দও হয়। কত চেনা জানা, বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে দেখা হয়। কত নতুন নতুন বিষয়, জিনিস চোখে পড়ে। আর এটা তো সম্পূর্ণই ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনি শপিং মলে গিয়ে আনন্দ পাবেন নাকি বইমেলা গিয়ে? এমন কথাও শোনা যায়, বই যত না পড়ছে লোকে, তার থেকে লেখা হচ্ছে বেশি। পাঠকের থেকে লেখক বেশি। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন লেখকের ভিন্ন ভিন্ন পাঠক হয় বলেই মনে করি। আপনি যেটা লিখছেন সেটা যদি একজনও পড়েন, জানবেন আপনার ওই লেখাটার জন্য একজন পাঠকই যথেষ্ট। আর একটা কথাও শোনা যায়, বই যাঁরা লেখেন তাঁদের সব বই বিক্রি হয় না, ওই তাঁর পরিচিত কয়েকজন আত্মীয়স্বজন বা চেনা পরিচিত বন্ধু-বান্ধবই কেনেন। একদম ভুল কথা। এটা বহু লেখক বলতে পারবেন, তাঁদের কাছে কত অচেনা মানুষের ফোন আসে তাঁর বই পড়ে যদি পাঠকের ভালো লেগে থাকে। আর একটা বিষয় হল ফেসবুক লেখক। এটারও খারাপ দিক কিছু দেখি না। আজকাল তো সবই ডিজিটাল মাধ্যম হয়ে গেছে। কেউ যদি ডিজিটাল মাধ্যমে তাঁর বক্তব্য লেখার মধ্য দিয়ে বহু মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন, তাতে অসুবিধা কোথায়? এ টি এম থেকে ক্যাশ টাকা না তুলে ইউপি আই মাধ্যমে পেমেন্ট দেওয়াটা যদি ঝঞ্ঝাটহীন ব্যাপার বলে মনে হয়, তাহলে ডিজিটাল মাধ্যমে বই বা যেকোনো লেখা পাঠ করাটায় দোষ কোথায়? পিডিএফ, কিন্ডেল ভার্সন, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম যেকোনো মাধ্যমেই যদি পড়াশুনো করা যায় এতে গেল গেল রবের কিছু আছে বলে মনে হয় না। প্রবাসী বাঙালিদের কাছে ডিজিটাল মাধ্যমে পৌঁছোনো সহজ। সবকিছুরই তো পরিবর্তন হচ্ছে। সহজবোধ্য, দৃষ্টিনন্দন করার জন্য আজকাল যেকোনো বিষয়ের লেকচারও তো পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনই চায় বা পছন্দ করে মানুষ। যখন আপনার কাছে সুযোগ সুবিধা থাকছে, তা ভালো কাজে লাগাতে দোষ কোথায়? যাঁরা এখনো ডিজিটাল মাধ্যমে স্বচ্ছন্দ নন তাঁদের কথা বাদ দিন, কিন্তু তাই বলে তাঁরা এই মাধ্যম খারাপ, ক্ষতিকর বলে দাগিয়ে দিয়ে বিরোধিতা করবেন এটাও ঠিক নয়। সব বিষয়েরই কোনো না কোনো নিন্দুক থাকেন কিন্তু প্র্যাগমাটিক হয়ে যাওয়ার মানে দেখি না। আর একটা অসুবিধা হল আমরা সবাই যেমন আরাম পছন্দ করি তেমনি বিনোদনের ক্ষেত্রে বেশি আরাম পেয়ে গেলে মস্তিকের একটা অলস হয়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকে। বই পড়ে যে কল্পনা শক্তি তৈরি হয় সিনেমা ভিডিও মাধ্যম সেটা সরাসরি হাজির করে দেয়। কল্পনা তৈরির জায়গাটাই থাকে না। তাই বাচ্চারা পিডিএফ পড়তে গিয়ে যদি ভিডিও বা রিলস দেখে ফেলে বা গেম খেলে ফেলে, তাতে অ্যাডিক্টেড হয়ে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা থেকে যায়। মনোযোগ ধরে রাখতে অসুবিধা হয়, মন বারেবারেই সহজে আনন্দে পেতে সেদিকেই ধাবিত হয়। তাই বাচ্চাদের নাগালে যাতে এই সহজ আনন্দগুলো যথেচ্ছ বা সহজলভ্য হয়ে না যায় সেদিকেও একটু খেয়াল রাখা প্রয়োজন। পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে না কিন্তু কিছুটা ছাড় দিয়ে একটা সীমারেখা টেনে দেওয়া দরকার। নাহলে মন চঞ্চল হয়ে বারেবারে ওদিকেই যাবে। আমাদের বড়োদেরও তাই হচ্ছে। চারপাশে একটু চোখ খোলা রাখলেই দেখা যায় পরিচারিকা থেকে শিক্ষিকা, ডাক্তার থেকে মোক্তার, – সবার ক্ষেত্রেই রিলস স্থান জাঁকিয়ে বসেছে।
রুচির দিক থেকে সিনেমার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। সেই দিকটায় আমরা যদি একটু তাকাই তাহলে দেখা যায়, কেউ কমেডি, কেউ হরর, কেউ থ্রিলার, কেউ সিরিয়াস, কেউ রূপকথা, কেউবা হালকা চালের বাণিজ্যিক ছবিই দেখতে পছন্দ করেন। দর্শক রুচি অনুযায়ীই নানান ছবির বিভাগ এবং সেই দিকগুলোর খেয়াল রেখেই সিনেমা তৈরি হয়। আর সিনেমাও তো কোনো না কোনো গল্প। অবসর বিনোদনের উপায়। একসময় বইও তাই ছিল। সেজন্য গৃহবধূরা হালকা চালের সানন্দা, রান্নার বই, আরও নানান উপন্যাস, ছোটোগল্পকে দুপুর অবসর করেছেন বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। বই পড়ে বোঝার ব্যাপারটাও আছে, সব বই সবাই যে বুঝবেন তাও তো নয়। বিদগ্ধ পণ্ডিত যে বই বাছবেন, অল্প লেখাপড়া জানা গৃহবধূও সেই বই বাছবেন এমনটা ধরে নেওয়ার কোনো মানে নেই। অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন পাঠক সমাজের মতো ভিন্ন ভিন্ন লেখক এ নিয়ে দ্বন্দ বা মতবিরোধের কিছু নেই। মোদ্দা কথা যে বা যিনি যে ধরনটা পছন্দ করেন তিনি ঠিকই সেই দিকটা বেছে নেন। পেশার ক্ষেত্রেও তো একই কথা সাজে। সবাই কি আমরা একই পেশায় নিযুক্ত? তা তো নয়।
গানের ক্ষেত্রেও, সব ধরনের গান সবাই শোনেন না। লেখক এবং পাঠকের ব্যাপারেও একই কথা। হ্যাঁ, এত মতবিরোধের পরও কি বই লেখা বা বই পড়া থেমে যাচ্ছে? মনে হয় না। যার যেটা দরকার সে সেটা ঠিকই পড়ে নেবে। সিলেক্টিভ তো হতেই হয়। সবেতে গুরুত্ব বা পাত্তা দিতে গেলে এত সময়ই বা কোথায় জীবনে? যারা ছাত্রছাত্রী তাদেরকে সিলেবাসের বই পড়তে হচ্ছে, যারা কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দেবে এখন, তারা সেগুলো নিয়ে ব্যস্ত, যাঁরা ক্লাসে পড়াবেন যে টপিকের উপর পড়াবেন, তাঁরা সে বিষয়টাই পড়বেন, যিনি যে বিষয়ে লেকচার দেবেন তিনি সে বিষয়ের রেফারেন্স পড়বেন, তার বাইরেও কেউ দস্তভয়স্কি, জয়েস, প্রুস্ত, কামু, কাফকা, কার্ল মার্ক্স, হিটলার, চে, ম্যাক্সিম গোর্কি, মুরাকামি, ঝুম্পা লাহিড়ি, হান কাং থেকে শুরু করে আরও নানান বিদেশি সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতির বই বেছে নেবেন, কেউবা বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, তিন বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে আশাপূর্ণা, মহাশ্বেতা, সুচিত্রা, বাণী বসু, সুনীল, শক্তি, জয় পেরিয়ে অমর্ত্য সেন থেকে শুরু করে আরও প্রখ্যাত প্রাবন্ধিকদের বেছে নেবেন বা দেশি বিদেশি সাহিত্য, রাজনীতি, দর্শন ঠিকই বেছে নেবেন বা নেন। যাঁরা এতদিন কী পড়া উচিত জানতেন না, তাঁরাও জেনে নিয়ে (যদি আগ্রহ থাকে) ঠিকই সেসব বই বা বিষয় পড়ে নেবেন। কিন্তু লেখা বা পড়া থেমে থাকে না থেমে নেই। রিলস বেরিয়েছে বলে কি সিনেমা তৈরি বন্ধ হয়ে গেছে? সিরিয়াল, সিরিজ? রিলসেরও নানান ধরন আছে। চটুল বিষয় থেকে সিরিয়াস বিষয়, মোটিভেশনাল সবই। তাই বলে কি সবাই সব রিলস দেখেন? টেস্ট ম্যাচ, ওয়ান ডে, টি টোয়েন্টির ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। ব্যাপারটা হল সময় বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে নয়, বদল হতে হতেই চলেছে। এ নিয়ে তো কোনো সন্দেহ নেই। আগে গুরুগৃহ ছিল, টোল, পাঠশালা ছিল সেখান থেকে পরিবর্তিত হতে হতে বাইজুস, আকাশও গিলে খাচ্ছি আমরা। সময়, সমাজ, পরিস্থিতি, অর্থনীতি, বিশ্ববাজার সব মিলিয়ে যে যে পরিবর্তন যেভাবে আসছে আমরা সবাই তার সঙ্গে কমবেশি নিমরাজি, গররাজি, অখুশি, খুশি সবমিলিয়ে সহবাস করছি। সবকিছু যে বুঝে করছি এমনটাও নয়। কিছুটা জোয়ারে গা ভাসানোর মতো ভাসাতেও হচ্ছে। সময়ের বদল যেমন আমরা দেখতে দেখতে চলেছি তেমনি বদলে যাওয়া সময়ের ইতিহাসও দেখছি। ইতিহাস দেখতে গিয়ে আমার অন্তত একটা কথা মনে হয়েছে, কোনো সময় বা কালটা সেই সময়ের মানুষের কাছে সুন্দর বা সুস্থির বা স্থিতিশীল ছিল না। পৃথিবী শুরুর সময় থেকে যদি নাও দেখা হয় , যতটুকু দেখা যায় অন্তত দুশো তিনশো বছরের ইতিহাসের দিক থেকে শুরু করলে বা সমস্ত আন্দোলনের ইতিহাস ঘাঁটলে ওই একই অস্থির অবস্থা লক্ষ করা যায়। অতএব এ আই যুগ আসছে, ডিজিটাল যুগ আসছে, বই যুগ শেষ হচ্ছে বলে গেল গেল রব না করে ভবিষ্যতের পরিবর্তন নীরবে দেখতে থাকা হোক, আর বই, খবরের কাগজ, হাবিজাবি মিনিংলেস ডকুমেন্টের হার্ডকপির জন্য গাছ নষ্ট করা বন্ধ হোক বলে প্রতিবাদী স্বর তীব্র হলে আরও বেশি বেশি গাছ লাগিয়ে পরিবেশ বাঁচানো হোক। ব্যালান্স করলেই সমস্যা কম হবে। তাহলেই তো মিটে যায়। যত বেশি আধুনিক তত বেশি ধ্বংস তা নিয়েও তো সন্দেহ নেই। স্পেন, ইতালির মতো উন্নত আধুনিক দেশও তো আজ প্রকৃতির করাল গ্রাসে নিশ্চিহ্ন হতে বসেছিল প্রায়। প্রকৃতি রুষ্ট হলে তো কারোর হাতেই কিছু থাকে না। অতএব যতদিন মানুষ আছে, সমাজ আছে, জীবন আছে ততদিন স্বাভাবিক নিয়মেই সব চলুক। খেলাও চলুক, মেলাও চলুক, বই লেখাও হোক, পড়াও হোক। সবই হোক। যে যেমন মাধ্যমে স্বচ্ছন্দ সে তেমন মাধ্যমই বেছে নিক। বই কম কেনা হলে আলমারিও কম লাগবে। চেয়ার টেবিলে না পড়লে, খাটে বসে না পড়লে বা ঘুমোলে এখানেও গাছ বাঁচানো যাবে। বই পড়ে জ্ঞান কার কতটুকু হয় এই বিতর্কে না ঢোকাই ভালো। মনোরঞ্জন হলেই হল। আনন্দ পেলেই হল। হ্যাঁ, লেখকদের নিয়ে কটু কথা, বাঁকা চোখ, নিন্দে, গালমন্দ সবই থাকবে। সেটা সমাজের অন্যান্য মানুষের দিক থেকে যেমন থাকবে একজন লেখকের অন্য লেখকের প্রতিও থাকে বা থাকবে। এ সমস্তকিছু নিয়ে সহবাস করতে হবে বা বাঁচতে হবে। মনে না নিলেও মেনে নিয়েই বাঁচতে হবে। কে অপমান করল, অবহেলা করল, কটুকথা বলল, এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে সময়টা নষ্ট করে লাভ নেই। লেখার মাধ্যমেই সমাজের কাছে সমাজকে হাজির করতে হবে। যার দরকার সে ঠিকই পড়ে নেবে। অতএব ২০২৫-এর আসন্ন বইমেলা আনন্দের হোক। প্রয়োজনের কিনা সময় বিচার করবে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বইয়ের সঙ্গে সেলফিও থাকুক। উৎসর্গ পাতায় লেখকদের অটোগ্রাফও উঠুক ফুটে। বই পড়ছে না, বিক্রি হচ্ছে না ভেবে লেখকরা হতাশ হয়ে লেখা ছেড়ে দিলে পাঠকদের তো আর একেবারেই অস্তিত্ব থাকবে না। তাই প্রকৃত, অপ্রকৃত সমস্ত পাঠকের দিকে তাকিয়ে লিখে চলুন, লেখা থামাবেন না। আপনার মূল্যবান বক্তব্য সবার কাছে মূল্যবান না হলেও কারো না কারো কাছে নিশ্চয়ই মূল্য থাকবে। থাকেও। পাঠক-লেখক সম্পর্কটাই তো একে অপরের পরিপূরক। পাঠক না থাকলে তো লেখকও অস্তিত্বহীন। একজন লেখক তাঁর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে যা প্রকাশ করেন তা কোনো কোনো পাঠকের যেমন গায়ে লাগতে পারে, অপরদিকে কোনো কোনো পাঠকের মনে হতে পারে, ‘এই তো উনি ঠিক আমার মনের কথাটাই বলেছেন, আমি যা বলতে চাই কিন্তু পারি না, তা লেখক বলে দিয়েছেন’। ফলে এখানে লেখক লিখে সার্থক, পাঠক পড়ে। বহু বই লেখা হয়ে গেছে আর লেখার দরকার নেই, মানুষ আগে ওগুলোই পড়ে শেষ করুক। এমনটা বলাও মূর্খামি। কারণ তাহলে এই সময়টাকে কারা তুলে ধরবে? সমসময় বলেও তো একটা ব্যাপার থাকে। সেটাও মানুষ ছাপার অক্ষরে বা ডিজিটাল মাধ্যমে পড়তে চান, পড়েন। অতএব মেলাতে বইয়ের পাশাপাশি টইও থাকুক বহাল তবিয়তে। লেখক, প্রকাশক, আয়োজকদের পাশাপাশি আরও কিছু মানুষও লাভবান হোন সমানভাবে। সময় বয়ে চলুক নিজের গতিতে।