
ইয়োকো ওগাওয়া-র গল্প ‘বেঙ্গারু তোরা নো রিনজুউ’
মূল জাপানী থেকে অনুবাদ:পূরবী গঙ্গোপাধ্যায়
অনুবাদ গল্প বাংলার বাঘের অন্তিমক্ষণ। মূল জাপানী থেকে অনুবাদ:পূরবী গঙ্গোপাধ্যায়। মূল গল্প: বেঙ্গারু তোরা নো রিনজুউ লেখক: ইয়োকো ওগাওয়া [মূল গল্প-- ইয়োকো ওগাওয়ার ছোটো গল্প সংকলন “ কামোকুনা শিগাই,। মিদারানা তোমুরাই”(নীরব লাশ, অপ্রকাশিত শোক) –এগারোটি আন্তঃসংযুক্ত ছোটো গল্পের সমষ্টি। এই বই-এর প্রতিটি গল্পেই মানব জীবনের বিভিন্ন বঞ্চনা, দুঃখ ও হতাশার কথা । আর এখানেই এই গল্পগুলির আন্তঃসংযুক্তি। এই গল্পটি ওই সংকলনের নবম গল্প। ]
****
বাইপাস রোড থেকে নেমে, বেড়িবাঁধ বরাবর দক্ষিণে গাড়ি চালিয়ে ব্রিজ পার হবার সময়েও আমি রাস্তা হারিয়ে ফেলছিলাম। আমি যেখান দিয়ে শহরে ঢুকলাম, সেই রাস্তার একেবারে কোণাতেই তার অ্যাপার্টমেন্টটা ছিল।
সেই বিকেলটা ছিল এক অসহনীয় গরম আবহাওয়ার। বাতাস ছিল না, রাস্তার পাশের সমস্ত গাছ গরমে ঝুলে পড়েছিল, এবং রাস্তার পিচ থেকে ধোঁয়া উঠছিল। উল্টো দিক থেকে আসা গাড়ীগুলোর আলোও যেন চোখে ঠিকরে পড়ছিল। গাড়ীর এয়ার-কণ্ডিশনার সর্বোচ্চ থাকা সত্ত্বেও জানালা দিয়ে আসা বাইরের উত্তাপ থেকে বাঁচার উপায় ছিল না। স্টিয়ারিং-এর হ্যাণ্ডেল এতটাই উত্তপ্ত ছিল যে, হাত লাল হয়ে ব্যাথা শুরু হয়েছিল।
যে মুহুর্তে বাড়ী থেকে বেরিয়েছি ঠিক তখন থেকেই আমি নিজের মনে মনে একটা খেলা খেলতে শুরু করেছি। যেমন, যদি সামনের ট্র্যাফিক সিগনালে আটকাই তো ইউ টার্ন নিয়ে নেব। যদি পেছন থেকে কোনো সিলভার স্পোর্টস কার আমাকে পাশ কাটিয়ে বাঁক নেয় তাহলে আমি সোজা এগিয়ে যাব। গতকাল রাস্তায় যেতে যেতে দেখা পেট-শপের স্কচ টেরিয়ারের বাচ্চাটা যদি ইতমধ্যে বিক্রী হয়ে গিয়ে থাকে তো আমি ফিরেই যাব। পরের বাঁ দিকের মোড় ঘুরতেই যে বাস টার্মিনাল, সেখানে তিনটের বেশী বাস থাকলে অবশ্যই আমার ওই মহিলার বাড়ী যাওয়া উচিৎ।
আমি কেন ভাবছিলাম যে, স্পোর্টস কারটি আমাকে পাশ কাটিয়ে কোথাও বাঁক নেবে, কুকুরছানাটি অদৃশ্য হয়ে যাবে, খাঁচাটা খালি থাকবে? আমি যদিও তাকে সামনা সামনি মোকাবিলা করার প্রতিজ্ঞা নিয়েই বেড়িয়েছিলাম তবুও মনের কোণে কোথাও একটা দূর্বলতা ছিল, যেটা আমাকে কোনোও না কোনো অজুহাতে ফিরে যাবার জন্য টানছিল। ব্রিজের কাছে যেতেই হঠাৎ ট্রাফিক জ্যামে আটকে গেলাম। মনে হয় কোনো পথ দূর্ঘটনার জন্য ওয়ান-ওয়ে ট্র্যাফিক করা হয়েছে। আমি রেডিওটা অন করলাম। কিন্তু সিগনাল এতই খারাপ ছিল যে, বন্ধ করে দিলাম। আবার এক ইঞ্চি এগিয়েই ব্রেক কষলাম।
তার সংগে দেখা হলে কি করব? কি বলব? নিজেকে এই প্রশ্নটা অন্তত এক হাজার বার করেছি। যা করেছে বা করছে তার জন্য থাপ্পড় দেব? গালাগালি করব? নাকি আমার স্বামীর জন্য চীৎকার করব? দূ-র, নিজেকে অতটা করুণ করে তুলে ধরার চেয়ে ওইরকম স্বামীকে ছেড়ে দেওয়াই মঙ্গল।
‘হ্যালো’, আমার মেয়ের কিণ্ডারগার্টেনের শিক্ষিকাকে যেমন করতাম সেইরকম অপ্রয়োজনীয় অভিবাদনই হয়ত করে বসব।
আমার স্বামী দিন তিনেক হল এক রেসপিরেটরি সোসাইটির সম্মেলনে যোগ দিতে আমেরিকা গিয়েছেন। তিনি এখানে থাকলে তাঁকে ওখানে গিয়ে দেখতে পাবার ভয়ে ওখানে যেতেই পারতাম না। তাই ওনার চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলাম।
আসলে আমি কিছুতেই ওদের দুজনের একসাথে মুখোমুখি হতে চাইছিলাম না। কারণ সেক্ষেত্রে হয়ত আমি বিস্মিত হতাম না যদি দুজনকেই অত্যন্ত অন্তরঙ্গ আবস্থায় দেখে ফেলতাম ও হাতে নাতে ধরে ফেলতাম। কিন্তু সেটা আমি চাইছিলাম না। আমি ব্যাপারটায় অতটা গভীর পর্যন্ত জানতে চাইছিলাম না যদিও জানতাম যে, তারা বেশির ভাগ সময়েই একান্তে অন্তরঙ্গ অবস্থায় থাকে। তাই আমার স্বামীর অনুপস্থিতিতে তার সংগে দেখা করাটাই সমীচীন মনে করেছিলাম। তাহলে আমরা দুজনে একসাথে বসে মুখোমুখি আলোচনা করতে পারব।
সম্মেলনটার নাম বা শিরোনাম কি ঠিক মনে পড়ছে না । আমার স্বামী রেসপিরেটোরী অসুখের, বিশেষ করে ইওসিনোফিলিয়া সহ পালমোনারি ইনফিলট্রেটস নামক একটি সিন্ড্রোমের চিকিত্সার বিশেষজ্ঞ। যদিও সেটা কি ধরণের অসুখ তা আমি ব্যাখ্যা করতে পারবো না। আমার স্বামীও আমাকে কোনোদিন বিশদে ব্যাখ্যা করেন নি। আর আমার ও কোনোদিন জানার ইচ্ছা হয় নি। কিন্তু ওই মহিলা নিশ্চয় জানেন। উনি বিশ্ববিদ্যলয়ের চিকিৎসাবিদ্যা বিভাগের একজন বিশিষ্ট সেক্রেটারি।
আমি জানি সম্মেলনের নাম জানা বা না জানা নিয়ে হিংসা করাটা হাস্যকর। কিন্তু তাদের ঘনিষ্টতা আমাকে সবসময়েই পীড়া দিয়ে থাকে। আর এই হিংসাটাই আমাকে অকারণ কষ্ট দেয়।
ট্র্যাফিক ধীরে ধীরে এগোতে থাকে। ব্রীজের ঢালের কাছাকাছি বার-বি-কিউতে মেতে থাকা এক পরিবারকে দেখতে পেলাম। তাদের বার-বি-কিউ থেকে ঝলসানো মাংসের গন্ধটা ব্রীজের চারপাশে ছড়িয়ে গিয়ে গরমটাকে যেন আরো অসহনীয় করে তুলছিল। নদীর বালিদণ্ডের স্তম্ভের উপর বসা সীগলরা তাদের ডানা ঝাপটাচ্ছিল। কিছু উইণ্ডসারফার নৌকা আর মাছ ধরার নৌকা নদীতে ভেসে বেড়াচ্ছিল। কোথাও থেকে একটা বিরক্তিকর হর্ন বেজে উঠল, আর সীগালগুলো উড়ে গেল। প্রখর সূর্যের আলোতে কুঁচকে যাওয়া চোখে আমি দূরে সমুদ্র দেখতে পেলাম।
ব্রিজের ওপরে একটা ট্রাক উল্টে পড়ে আছে। মনে হয় অতিরিক্ত স্পীডে যাবার সময়ে রাস্তার ডিভাইডারে ধাক্কা খেয়ে উল্টে গিয়েছে। ড্রাইভারের সীট্-টার অবস্থা সঙ্গীন। আর একটা টায়ার খুলে বেড়িয়ে গার্ডরেলের উল্টো দিকে গিয়ে পড়ে আছে। এম্বুলান্স, ক্রেন, পুলিসের গাড়ী ট্রাকটাকে নিয়ে যাবার জন্য আর রাস্তা খালি করার কাজে তৎপর। চারদিকে লাল আলো জ্বালিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
ড্রাইভার মনে হয় না বেঁচে আছেন। তাঁর হাড়গোড় এবং শরীরের অন্যান্য অংগ প্রত্যঙ্গ হয়ত স্টীয়ারিং হুইলে আটকে গিয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ।
কিন্তু আমার কাছে আরো বেদনাদায়ক হয়েছিল অন্য কিছু। সেটা হচ্ছে যে, রাস্তার একদিকটা টমেটোতে পরিপূর্ণ ।
প্রথমে বুঝতে পারি নি যে, ওগুলো টমেটো । মনে হচ্ছিল কোনো নাম না জানা লাল, লাল ফুল। আমার মনে হল হয়ত বা আমি কোনো বিষাক্ত ফুলের ক্ষেতে ঘুরে বেড়াচ্ছি। অথবা ড্রাইভারের রক্ত ছড়িয়ে রাস্তাটাকে লালে লাল করে দিয়েছে।
কিন্তু আসলে ওগুলো খুব সুন্দর টমেটো। নিখুত, পাকা টমেটো । সূর্যালোকে চকচক করছে। এত পরিমাণে ছড়িয়ে আছে যে রাস্তার পীচ দেখা যাচ্ছে না।
একজন শ্রমিক শ্রেণীর লোক টমেটোগুলো বেলচা দিয়ে একজায়গায় জড় করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু বিশেষ কোনো ফল হচ্ছিল বলে মনে হচ্ছিল না। কিছু মানুষ আসেপাশে ভিড় করে দেখছিল । আর একদল একটা ইলেকট্রিক করাত দিয়ে ড্রাইভারের সীটের দরজাটা ভাঙ্গার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন।
কিছু টমেটো, যেগুলো এদিকের লেনে গড়িয়ে এসেছিল সেগুলো গাড়ীর চাকায় থেঁতলে যাচ্ছিল। আমার গাড়ীর চাকার তলাতেও কিছু টমেটো চলে এলো। নিশ্চয় সেগুলোও থেঁতলে গিয়েছিল। কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। গাড়ী ঠিক ভাবেই এগিয়ে গেল। মনে হল যেন টমেটোগুলো নিজেরাই থেঁতলাবার জন্যই প্রস্তুত ছিল।
রাতের অন্ধকারে টমেটোর লাল রংটাই হয়ত লাল রক্তের মত দেখাবে। অন্যান্য গাড়ীগুলো যতটা সম্ভব টমেটোগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু আমি চেষ্টা করছিলাম যতটা সম্ভব টমেটো চাকায় পিষতে। আবার খেলায় নামলাম। যদি অন্তত দশটাকে চাকায় পিষতে পারি তো এগিয়ে যাব। গাড়ীর রিয়ার ভিউ মিরর দিয়ে একটা লাল রেখা প্রতিফলিত হচ্ছিল। টমেটোদেরও কি মানুষকে পিষে মেরে দিলে যে অনুভূতি হয় সেই রকম অনুভূতিই হয়ে থাকে? এক, দুই,তিন,চার,পাঁচ। আমি গুনতে শুরু করলাম।
তাকে আমি এখনো পর্যন্ত একবার মাত্রই দেখেছি। তাও দূর থেকে। আমার স্বামী একবার তাঁর গবেষণা সংক্রান্ত কিছু দরকারী কাগজ-পত্র বাড়ীতে ফেলেই চলে গিয়েছিলেন। আর সেগুলো আমি পৌঁছতে গিয়ে ওনার ঘরে ঢোকার আগে সেক্রেটারীর ঘরে যখন অপেক্ষা করছিলাম তখন নিজের অজ্ঞাতেই উঁকি দিয়েছিলাম।
ওখানে যিনি বসে ছিলেন তিনিই যে সেই মহিলা তা সংগে সংগেই বুঝতে পেরেছিলাম। যদিও আগে কখনই তাকে আমি চাক্ষুস বা ছবিতে দেখি নি এমনকি সেই সময়ে তার নেমপ্লেটও দেখি নি তবুও দেখেই চিনেছিলাম যে, ইনিই তিনি, যিনি আমার কল্পনায় আসতেন সেই সব রাত্রে যেদিনগুলো আমার স্বামী বাড়ি ফিরতেন না। আমি ওদেরকে কল্পনায় দেখতাম মহিলার আপাটর্মেন্টের কোনো ঘরে, অথবা আমার স্বামীর পছন্দের কোনো রেস্তোঁরায়, অথবা কোনো হাসপাতালের নির্জন বাগানে।
কিন্তু এই মুহুর্তে মুখটা মনে পড়ছিল না। চুলের ফ্যাশন বা সাজগোজের ধরণ-ও ঠিক মনে ছিল না। শুধু মনে আছে সেই সময়ে সে কোনো একটা কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ততার মধ্যে ছিল। কিছুতেই চেয়ারে বসছিল না। বার বার উঠে দাঁড়িয়ে টেবলের কাগজ-পত্র গোছাচ্ছিল। খুব বিরক্ত ভাবে কাগজপত্র ওলটাচ্ছিল, গোছাচ্ছিল, কিছু ছিঁড়ে ফেলছিল, কিছু কিছু কাগজে আবার নোট করে রেখে দিচ্ছিল। মুখের অর্ধেকটা তার ঝাঁকড়া, ঘামে ভেজা চুলে ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল । টেবলের ফোন বেজে যাচ্ছিল। কিন্তু সে সেটা ধরার কোনো চেষ্টাই না করে কাউকে একজনকে জোরে জোরে ডাকছিল। একজন দৌড়ে এসে ফোনটা তুলে নিল।
যখন মনে হল হয়ত বা সব গোছান শেষ হয়ে গিয়েছে তখনই মনে হয় আবার কোনো ভুল চোখে পড়ে আর সে আবার সব ছড়িয়ে কেঁচেগণ্ডুষ করে গোছাতে শুরু করে। সে হঠাৎই মুখে এত বিরক্তিকর একটা শব্দ করে যে, আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখান থেকেও সেই শব্দ শোনা যায়।
কতবার যে সে গুছালো আর ছড়াল তার ঠিক নেই। কিছুতেই তার মনোমত হচ্ছিল না বা ঠিক মত হচ্ছিল । হয়ত প্রতিবার-ই কোনো না কোনো ভূল থেকে যাচ্ছিল। আর যতবার-ই করছিল কাগজ-পত্র সব আরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছিল। অন্য কেউই কিন্তু তাকে এই ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এলো না।
শেষ পর্যন্ত আমিই দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে চলে গেলাম। আমি ওকে অনেক বেশী দক্ষতার সংগে কাজ করতে দেখতে চেয়েছিলাম। উনি যদি নিখুঁত ভাবে আমার স্বামীর রিসার্চ পেপার টাইপ করতেন বা নিপুন দক্ষতায় কাগজ পত্র গোছানর কাজ করতেন তাহলে আমার ওকে হিংসা করার একটা জায়গা থাকত। কিন্তু যে নিজেই এত বিপর্যস্ত তাকে আমি কি করে হিংসে করতে পারি?
**
আমি সিটি হলের পেছনের পার্কিংএ গাড়ীটা দাঁড় করানর জন্যে নিয়ে এলাম। ওখান থেকে সামান্য দূরত্বে ওর বাড়ী । ওই রাস্তাটা হাঁটার পরিকল্পনা করলাম। যদিও আমি গাড়ীটা ওর বাড়ীর সামনেই দাঁড় করাতে পারতাম, কিন্তু যদি নো-পার্কিংএ দাঁড় করিয়ে ফেলি আর তার জন্য বিরাট অংকের ফাইন দিতে হয় তো সেটা বিরক্তিকর হয়ে যাবে, তাই হেঁটে যাওয়াটাই সাব্যস্ত করলাম। আমি ম্যাপে আরো একবার জায়গাটা ঠিক করে দেখে নিলাম।
অ্যাপার্টমেন্ট ৫০৮। আমি বিড়বিড় করলাম পাঁচ শূন্য আট। গাড়ী থেকে নামলাম। সংগে সংগে ঘামতে শুরু করলাম।
সুন্দর করে লাগান পাউডার, মেক-আপ সব আধ মিনিটেই গলতে শুরু করে দিল। হাঁটার পথে কোথাও কোনো ছায়া পেলাম না।
হাঁটতে হাঁটতে আমার প্রত্যাখাত হবার প্রতিটি স্মৃতি মনে পড়ে গেল। আমার স্বামীর ওই মহিলার সাথে পরিচিতির কাল থেকেই আমার জীবনে এই একটা ঘটনা ঘটে চলেছে। আমি স্মৃতিচারণ করে চললাম। সেই ছোটোবেলা থেকে এখনও পর্যন্ত যেখানে যেখানে যখন যখন প্রত্যাখাত হয়েছি বা আঘাত পেয়েছি সব মনে এসে ভিড় জমাল। তাই আমি ভেবে নিলাম শুধু আমার স্বামীই তো নন, আরো বহু মানুষ আমাকে সারা জীবন অকারণ কষ্ট দিয়েছে । আমাকে দূরে সরিয়েছে। তাই এই খারিজ হবার যন্ত্রণাটা আমার সয়ে যাওয়া উচিৎ।
প্রথমে দু-একটা ঘটনাই মনে পড়েছিল। কিন্তু সব ঘটনাই এতটা আন্তঃসংযুক্ত যে, মনে পড়া ঘটনার সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে চলছিল এবং সেই সব ঘটনার বিশদগুলিও মনে সজীব হয়ে উঠছিল। একের পর এক, যে ঘটনাগুলি আমি সম্পূর্ণরূপে ভুলে গিয়েছিলাম সেগুলি আমার কাছে হঠাৎ করেই এক ঝটকায় যেন ফিরে আসছিল।
কিণ্ডারগারটেনে পড়ার সময়ে, যখন আমাদের গেমস্-ক্লাসে জোড়ায় জোড়ায় নাচতে হত তখন কেবল আমি-ই কোনো পার্টনার খুঁজে পেতাম না। সব সময়েই শিক্ষিকা আমার জোড়া হতেন । এটা আমার কাছে খুবই অপমানজনক মনে হত। যে ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যাটাই অযুগ্ম সেখানে কেন জোড়া বেঁধে নাচের জন্য বলতেন আমি জানি না।
আবার স্কুল থেকে শিক্ষামূলক ভ্রমণ, মানে যাকে এক্সকারসন বলা হয় তাতে যাবার সময়ে আমার নামটা বাদ পড়ে গেল হোটেলের রুম অ্যালটমেন্টের সময়ে। যখন লিস্টটা দেখছিলাম তখন প্রথমে ভাবলাম যে, আমার নামটা হয়ত চোখ এড়িয়ে গিয়েছে। তাই আবার দেখলাম। না কোনো ভুল হয় নি। আমার নাম নেই। মনকে বোঝানর চেষ্টা করলাম ওটা স্কুলের ইচ্ছাকৃত নয়। কিন্তু মন কিছুতেই বুঝল না । খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। শেষ পর্যন্ত আমার যাওয়াটাই হল না। না, নাম না থাকার জন্য নয়। হল না কারণ আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। সেদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গলো গলা ব্যাথা আর টনসিলাইটিস নিয়ে।
যখন আমার ১৫ বছর বয়স আমি প্রচুর ঘুমের ওষুধ একসাথে খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করলাম। নিশ্চয় কোনো বিশেষ কারণেই মরতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন সেই কারণটা ঠিকঠাক মনে পড়ে না। মনে হয় সব কিছুতেই একটা বিরক্তি এসে গিয়েছিল তাই। সেই ঘুমের ওষুধ খাবার ফলস্বরূপ ১৮ ঘণ্টা টানা ঘুমালাম। যখন ঘুম থেকে উঠলাম একদম ফ্রেস। আমার শরীর এতই হালকা লাগছিল যে, মনে হল মরে আবার বাঁচলাম নাকি? কিন্তু কেউই, এমনকি বাড়ির লোকজনেরাও খেয়াল করল না যে, আমি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলাম।
কালকেই যখন বিউটি-পার্লারে চুল কাটতে গেলাম, তখন ওখানকার বিউটিশিয়ান এই আজ যেমন দেখা যাচ্ছে সেই রকম জঘন্য করে চুলটা ছেঁটে দিল । আমি তাকে আমার অপছন্দের কথা জানাতেই সে এমন একটা মুখ করল যে, যাতে মনে হল আমি আমার অধিকারের সীমা ছাড়িয়ে ফেলেছি। সে যা করেছে বেশ করেছে। কিন্তু সে বেশ বাচ্ছা একটা মেয়ে হয়ত বা শিক্ষানবিশ।
যখন চিন্তা থেকে বেড়িয়ে এসে তাকালাম, দেখলাম আমি আবার পথ হারিয়েছি। ম্যাপটা আবার ভাল করে দেখলাম। আর সেদিন যখনই কোনো কোণায় ঘুরছি আগে দেখা দৃশ্যর থেকে তা সম্পূর্ণ আলাদা লাগছে। চতুর্দিক গরমে আচ্ছন্ন। পথচারীরা ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে ফুটপাথের দিকে তাকিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। একটা নেড়ি-বিড়াল রাস্তা-পাশের ঝোপের ছায়াতে কুঁকড়ে বসে আছে।
গায়ে গায়ে লাগান দোকানগুলোর মাথা ছাড়িয়ে আমি দূরে একটা ঘড়ির স্তম্ভের আভাস পাচ্ছিলাম। দুটোর ঘণ্টা বাজল। যদিও দিনটা ভীষণ গুমোট ছিল, বাতাস প্রায় ছিলই না তবুও মনে হল ঘড়ির আওয়াজটা যেন একটা পাক খেয়ে আকাশে উঠে গিয়ে নেমে এসে আমার কানে গেল।
যখন ঘড়ির আওয়াজের প্রতিধ্বনি আসতে আসতে মিলিয়ে গেল, একটা সুন্দর মিষ্টি গন্ধ আমার নাকে এলো। গন্ধটা
ভেসে আসছিল। সুবাস বলা না গেলেও মোটেই বিরক্তিকর গন্ধ নয়। আমি সেই গন্ধ লক্ষ্য করে হাঁটতে লাগলাম।
আমি বিড়বিড় করে বললাম – “মনে হয় ফার্ণ”।
একটা পাথরের তৈরী প্রাসাদোপম বাড়ী। বেশ উঁচু লোহার দরজাটা অর্ধেক খোলাই ছিল। একটা বিশাল ওক গাছ ছায়া দিয়ে জায়গাটাকে শীতল করে রেখেছিল। আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে ভেতরে ঢুকে গেলাম। উপরের জানালার দিকে তাকাতে তাকাতে বাড়ীর দিকে এগিয়ে গেলাম। ধীরে ধীরে পশ্চিম দিক দিয়ে বাড়ীর খিড়কির দিকে গেলাম। গন্ধটা ওখান থেকেই আসছিল।
একটা সযত্নে পরিচর্যা করা বাগান দেখা গেল। ঝোপঝাড়গুলি নিখুঁত মাপে ছাঁটা। সেই সব গুল্মগুলি বাগানের রাস্তায় এক অনবদ্য সবুজ সুন্দর সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। কিছু কিছু ফোটা ফুল ও প্রস্ফুটিত গোলাপ এক সাথে পাশাপাশি সারিবদ্ধ। মাঝখানে একটা ফোয়ারা থেকে পরিচ্ছন্ন জল বেড়িয়ে আসছে। ফোয়ারার ঠিক পাশে একটি বড় বাংলার বিখ্যাত বাঘ শুয়ে আছে।
“ কি হয়েছে? আপনি কি করছেন?”
“ আপনি কাছে এসে দেখলে বুঝতে পারবেন”।
আমার দিকে না তাকিয়েও অবাক না হয়ে বাঘটির পাশে বসে থাকা বয়স্ক মানুষটি উত্তর দিলেন।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম-“ বাঘটি কি মারা গিয়েছে?”
“না এখনো সময় আছে”।— বৃদ্ধ মানুষটি আমাকে হাত নেড়ে কাছে ডাকলেন।
আমি যতই ফোয়ারার দিকে এগোতে লাগলাম একটা শান্ত-মৃদু বাতাস অনুভব করতে পারলাম। ছোটো ছোটো পাখিরা ডাকছে, ফোয়ারার জলের ছাঁট এসে লাগল। মনে হল বাইরের উত্তাপ যেন হঠাৎ করেই নেমে গেল।
এক বিশালাকৃতির বাঘ। পাথরের বেসিনকে ঘিরে শুয়ে আছে। পা দুটো নাড়তে পারছে না, মুখটা অর্ধেক খোলা, জোরে জোরে কিন্তু দুর্বল ভাবে নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করছে।
“এটা আসল বাঘ-ই তো”?
“হ্যাঁ, মৃত্যুপথযাত্রী একটা বাঘ”।
বৃদ্ধ মানুষটি বাঘটির পাশে বসে তার থাবাটা হাত দিয়ে ধরে রেখেছিলেন। উনি এতই স্বচ্ছন্দে ও নির্ভয়ে কাজটা করছিলেন যে, আমারো কোনো রকম শঙ্কা হচ্ছিল না। এই প্রখর গ্রীষ্মের দাবদাহের দিনেও উনি একটু বেশীই ফরমাল সাজগোজ করেছিলেন। একটা খুব দামী ও সুন্দর জ্যাকেট পরে, গলায় টাই দিয়ে মুক্তার কাফলিনে সজ্জিত হয়ে বাঘটার পাশে বসেছিলেন। কিন্তু একটুও ঘামছিলেন বলে মনে হচ্ছিল না। তাঁর চুলগুলোও পরিপাটি করে আঁচড়ানো।
আমি ওনার পাশে হাঁটু গেঁড়ে বসলাম। বাঘটাকে ভীষণ ছুঁতে ইচ্ছা করছিল। তাই ওর পিঠে হাত দিলাম। আমি এতক্ষণ যে গন্ধটাকে ফার্ণের গন্ধ ভাবছিলাম সেটা আসলে বাঘটার গা থেকে বার হচ্ছিল।
ওর দেহের উষ্ঞতায় আমি মুগ্ধ হলাম। এটা কোনো মেকি স্টাফ করে রাখা জন্তু নয় বা আমার কল্পনার কোনো পশু নয়। একটা জ্যান্ত বাঘ। ওর শরীরের ধুকপুকানি আমার হাতের তালুর নীচে অনুভব করতে লাগলাম।
‘এটি একটি চমৎকার বাঘ’। — আমি ফিসফিস করে বললাম।
‘ নিঃসন্দেহে চমৎকার’-বৃদ্ধ মানুষটি বাঘটিকে পরিচর্যা করত করতেই বললেন। বাঘটির কালো ও হলুদ লোম গাছের ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যের আলোতে চকচক করছে। মনোহারী ডোরা, বিশালাকায় শরীর সবটাই বাঘটির জন্য খুবই মানানসই। উপুর হয়ে শুয়ে থাকলেও মনে হচ্ছে এক্ষুণি উঠে তাড়া করবে। ওর থাবাগুলি বেশ ভারী দেখাচ্ছে। চোয়ালটা শক্ত, মুখের কোণায় তীব্র ফেনা উঠতে দেখা যাচ্ছে। প্রতিটি কামড়ই মনে হয় মোক্ষম হত। এ নিশ্চয়ই খুব ভাল শিকারী ছিল।
“এটা আপনার?” আমি বৃদ্ধকে জজ্ঞাসা করলাম।
… “হ্যাঁ”। বৃদ্ধ মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলেন। বাঘটির পেটে একটা কাঁপুনি দেখা গেল আর ও কঁকিয়ে উঠল।
“বেচারা”- বলে আমি বলে পিঠে আস্তে আস্তে চাপরাতে লাগলাম। লোমগুলো খুব মোটা কিন্তু নরম। হাত দিতে খুব ভাল লাগছিল। আর যতবার আমি চাপড়াচ্ছিলাম ততবারই ওই সুন্দর গন্ধটা নাকে আসতে লাগল।
এই প্রথমবার বৃদ্ধ মানুষটি আমার দিকে মুখ করে স্মিতহাস্যে বললেন-“ঠিক আছে আতঙ্কিত হবার কিছু নেই”।
বাঘটির কানটা ঝুলে পড়ল। জিভটা মুখের ভেতরে গুটিয়ে গেল। ধুঁকতে লাগল। তার শেষ শক্তিটুকু দিয়ে সে বৃদ্ধ মানুষটির আরো একটু কাছে এগিয়ে গেল।
মানুষটি- “ঠিক আছে ঠিক আছে” বলে বাঘটার গলা জড়িয়ে ধরলেন।
গরম বাতাসে গোলাপগুলো দুলে উঠল। জমিটার ওপর ছোটো ছোটো পতঙ্গ খেলা করতে লাগল।ফোয়ারা থেকে জলের ছিটে আসতে লাগল।
“ আমি বোধহয় আপনাদের বিরক্ত করছি” –আমার মনে হল আমি ওদের দুজনের শেষ জীবনের একান্ত মুহুর্তগুলোতে ভাগ বসাচ্ছি।
একটু তিরস্করের সুরে বৃদ্ধ মানুষটি আমাকে বললেন-“কেন বলছেন এমন কথা? আপানার এখানে উপস্থিতিটা খুব জরুরী”। বলে উনি বাঘটির দিকে তাকালেন। তার চোখে তখন সারা বিশ্বের বেদনা।
বাঘটির নিঃশ্বাস আনিয়মিত হয়ে গেল। গলা থেকে ঘড় ঘড় আওয়াজ বের হতে লাগল। দাঁতগুলো একটা অন্যটার সংগে লেগে শব্দ করতে লাগল যন্ত্রণায়। ওর জিভটা শুকিয়ে গেল। আমি ওর পিঠে হাত বোলাতে লাগলাম। আমার এ ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।
বৃদ্ধ মানুষটি তাঁর গাল পশুটির মাথায় চেপে ধরলেন। বাঘটি একবার চোখ খুলে এক বিষণ্ন কালো চোখ মেলে যেন ওনাকেই খুঁজল। তারপর যখন বুঝল যে, উনি কাছেই আছেন খুব শান্তিতে চোখ বুজল।
তাদের দুজনের দেহ যেন এক দেহ হয়ে গেল। একজনের গাল, অন্যজনের চোয়াল; একজনের ঘাড়, অন্যজনের গলা; একজনের থাবা, অন্যজনের পা; একজনের গলার টাই অন্য জনের ডোরাকাটা ধড় সব মিলেমিশে যেন একাকার হয়ে গেল।
সারা আকাশ কাঁপিয়ে বাঘটি একটি আর্তনাদ করে উঠল। সেই আর্তনাদের রেশ মেলাতে না মেলাতে আমার হাতের তালুর নীচে যে ধুকপুকানি এতক্ষণ বুঝতে পারছিলাম তা বন্ধ হয়ে গেল। দাঁতে দাঁতে ঘর্ষণের আওয়াজ মিলিয়ে গেল। বাঘটির ফুসফুসের শেষ বায়ু বেড়িয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। ধীরে ধীরে আমাদের ওপর যেন এক আশ্চর্য নীরবতার বিস্তার হল।
বৃদ্ধ মানুষটি তখনো বাঘটিকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইলেন। আমি যতটা সম্ভব নিঃশব্দে ধীরেধীরে উঠে চলে গেলাম। ওদেরকে একসাথে একা থাকার সময় করে দিতে।
আমি গাড়ীতে চাবি রেখে কিছুক্ষণ আমার হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। খানিকটা আগে তালু দুটোতে যে অনুভূতি হচ্ছিল তার কথা মনে করতে চেষ্টা করলাম। গাড়ীর চাবি ঘোরালাম।
নদীর ব্রিজ পার হবার সময়ে টোমেটো গুলোকে কোথাও দেখতে পেলাম না। শেষ পর্যন্ত ফিরেই চললাম।
****
লেখক পরিচিতি– শ্রীমতি ইয়োকো ওগাওয়া আধুনিক জাপানী সাহিত্যের একজন জনপ্রিয় লেখিকা। ৩০শে মার্চ ১৯৬২তে জন্ম। ১৯৮৮ থেকে এখনো পর্যন্ত তিনি পঞ্চাশেরও বেশী লেখা প্রকাশ করেছেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম জাপানী সাহিত্যের বিভিন্ন পুরস্কারে এবং শারলে জ্যাকসন ও আমেরিকান বুক অ্যাওয়ার্ড-এর মত আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত। নোবেল জয়ী জাপানী সাহিত্যিক ওয়ে কেনজাবুরোর মতে-“ওগাওয়া ভীষণ দক্ষতার সংগে মানব মনের সবথেকে সুক্ষ অনুভূতিগুলোর প্রকাশ করতে পারেন”।
অনুবাদক ড. পূরবী গঙ্গোপাধ্যায় জাপানী ভাষার প্রশিক্ষক । পশ্চিমবাংলা ও ভারতের অন্যত্র বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বহুজাতিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে জাপানী ভাষার প্রশিক্ষণে যুক্ত প্রায় ৩৭ বছর। এছাড়াও জাপানী থেকে বাংলা ও ইংরেজী এবং বাংলা ও ইংরেজী থেকে জাপানীতে নিয়মিত অনুবাদের কাজেও যুক্ত।