
নীলোৎপল গুপ্ত -এর কবিতাগুচ্ছ
পাঁচটি কবিতা
বিচূর্ণ আত্মকথা
কে বলে স্পর্শ অগ্নি, কে বলে গো দেহ-ভস্মাধার
কে বলে উড়ন্ত ছাই, তন্মধ্যে তাপ ধিকিধিকি
এটুকু প্রাপ্তি শুধু, এইটুকু মুঠি-সম্বল
বাকি সব অপঠিত, কুয়াশায় ঢাকা শিলালিপি।
তবুও উল্লাস বাজে, ঝরে ফুল সচিত্র বাগানে
পখি সব করে রব, কাল ধায় সপ্তনদীপার
বালিকার হাসি নিয়ে কখনো বা বসন্ত উধাও
মধ্যরাতে বায়ুপথে ফিরে আসে বিশুদ্ধ নাবিক।
এ-নাট্য প্রহসন, এ-কাহিনি বিরহবিধুর
আমরাই দর্শক আমরাই শান্ত কুশীলব
আহ্লাদে কাঁদি-হাসি, শেষদৃশ্যে মৃত সৈনিক
বিচূর্ণ আত্মকথা বিন্দু বিন্দু বাতাসে ছড়াই।
শান্তিকল্যাণ
অবয়বসর্বস্ব-দেহ মৃত মন ভূতের কুঠুরি
ঘোরেফেরে ছায়াসম রাজপথে কাফেটেরিয়ায়
হাড়ে ঘুন জিভে লালা মস্তিস্কে বিচিত্র ছত্রাক
এরাই নকল রাজা অথবা রাজার অনুচর
শাসন পাঠায় রাত্রে দণ্ডবিধান তদুপরি
ন্যায়ের সংজ্ঞা লেখে এঁকে দেয় নীতির পরিধি
বিপরীত বলো যদি তন্মাত্র সমূলে বিনাশ
অতঃপর বায়ু বয়, শান্তি ছড়ায় দিকে দিকে।
এমন সুখের রাজ্যে কে গো তুমি বিধর্মী পথিক !
অযথা প্রশ্ন তোলো আনুগত্যে তুমুল অনীহা
অগ্রাহ্য পরিণাম, কথা বলো চোখে চোখ রেখে
আমরা অতীব শিষ্ট তবু আছে সহ্যের সীমা
একান্ত নাচার হলে বাধ্য হই দিতে ক্রমপাঠ
নাহলে আমরা কিন্তু স্বভাবত খুবই মানবিক।
এবং সেটা মন্ত্র হয়ে বাজতে থাকে
চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে জলের আয়না
ডাইনে-বাঁয়ে ভাসছে হাজার মুখচ্ছবি
ছেঁড়া-কথার গল্প ভাসছে বাতাসজুড়ে
প্রতিটা ক্ষণ পল-অনুপল আর্তনাদের।
বিম্বে-প্রতিবিম্বে শুধু গোলকধাঁধা
আয়না ভেঙে ছড়িয়ে যাচ্ছে মুখচ্ছবি
একটা মুখই দখল নিচ্ছে হাজার মুখে
মিথ্যে ভয়ের মুখোশগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে।
ভয়ের থেকে বেরিয়ে এসে সামনে দাঁড়াই
অন্ধকারেও প্রশ্ন ছুঁড়ি জনস্রোতে
‘মৃত্যু’ নামক শব্দটিতে দু’হাত রাখি
এবং সেটা মন্ত্র হয়ে বাজতে থাকে।
প্রেক্ষাপটে আদি মহাকাল
ইতিউতি মেঘ ধায়, চূড়ান্ত সীমায় আলো-ঢেউ
নিম্নগামী পাখিপুঞ্জে কুজনের সহাস্য বিলাস
এ-হেন দৃশ্য ছেড়ে কে গো তুমি বে-আব্রু পথিক
পত্রপুটে ধ্বংস লিখে চিরকুট বাতসে ভাসাও!
এ নাও সম্মতিলিপি, দূর কুহকের তর্জমা
দাঁড়াও সায়াহ্নকালে নিসর্গ-অক্ষরের নিচে
বলো মাটি, বলো জল, বলো আদি সৃষ্টি-প্ররোচণা
অতঃপর নিশ্বাসে শতছিন্ন হৃদয় পোড়াও।
সমার্থক প্রেম মৃত্যু, থাকা না-থাকার ভেদরেখা
জীবন মহার্ঘবস্তু, প্রতিক্ষণ পূর্ণ জায়মান
ছড়ায় আখ্যানকথা, দিকচক্রে আঁধার ঘনায়
খণ্ড খণ্ড উন্মোচন প্রেক্ষাপটে আদি মহাকাল।
এক্ষণে খুলে ধরো মুঠি
ভূর্জপত্র মহাকাশ, উড়ে-যাওয়া আলুথালু গান
গানের ভেতরে কান্না, গানের ভেতরে জলরব
দিগন্তে ঝুলন্ত নৌকো, আর শূন্যের ভেতরে ভাঙা-ছায়া
জাগে স্মৃতি সরীসৃপ, গহ্বরে গাঢ় অন্ধকার।
তবুও মানুষ বাঁচে, গ্রাম জাগে গ্রামের ভেতর
ওষ্ঠে পোড়া চুম্বন, ভালোবাসা জন্ম-অভিশাপ।
এই তো সুবর্ণ আলো, এক্ষণে খুলে ধরো মুঠি
দেখি হস্তরেখা দেখি কতখানি দীর্ঘ আয়ুপথ
কোন্ নদী কোন্ সেতু, দুঃখের পারে কোন্ দেশ
কত মৃত্যু হলে বলো এ-জীবন মহার্ঘ হবে !