উঁকিঝুঁকি, আয়না ও দু’চারটে দিন  পর্ব-২ <br />  কৃষ্ণালক্ষ্মী সেন

উঁকিঝুঁকি, আয়না ও দু’চারটে দিন পর্ব-২
কৃষ্ণালক্ষ্মী সেন

ট্রেন যখন টামনা স্টেশনে থামল, মোবাইলের ঘড়িতে তখন পাক্কা ছ’টা সাঁইত্রিশ।
সকালের রোদ গ্রাম্য বালিকার সরল আমাপা খিলখিলে হাসির মতো ছড়িয়ে রয়েছে প্ল্যাটফর্মে। চারপাশে সবুজ, মাঠ ছাড়িয়ে মাঠ, হাওয়ার স্রোতে হাওয়া আর তীব্রতম বসন্ত। গাছে গাছে পলাশ, পলাশে পলাশে দোলের রং লাল ছুঁয়ে লাল। ট্রেন থেকে নেমেই অনুভব করলাম একটি আলোকিত রাজ্যপাট পেয়ে যাওয়ার গাঢ় ভালোলাগা আমার সারা শরীরের কোষে কোষে চারিয়ে যাচ্ছে। ঝরঝরে লাগছে। বেশ হালকা লাগছে অনেকদিন পর।
এই এমন স্নিগ্ধ, সুরেলা সকাল একমাত্র বাংলার গ্রামগুলিকেই আজও জড়িয়ে জড়িয়ে আছে। কোথায় আর এমন রূপ! নগরের সাজানো চাকচিক্যে কোন ফাঁকে যে সূর্যটা পুবে পশ্চিমে পাক খেয়ে দিকদিগন্তে চলে যায়, আমরা বুঝতেও পারি না। তারপর জ্বলে ওঠে জোরালো নিয়ন আলো। শহরে রাতের অন্ধকার গভীর নয় বলে সকালের আলোও এত ঝকঝকে লাগে না।
কী মনোরম, সতেজ, ঝলমলে টামনার এই সকালের সৌন্দর্য! বাংলা কী সুন্দরী! মিশরের সেই এক রানি ক্লিওপেট্রার চেয়েও।
আনন্দে থাকার চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে? ভালোলাগা নিয়ে ভালো থাকার চেয়ে সুখ আর কোথায়? কিন্তু শরীরের অনেকগুলি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ একসঙ্গে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠতে চাইলে সেটা যেকোনও ব্যক্তির পক্ষেই খানিকটা বিড়ম্বনার হয়। আমি দেখলাম আমার চোখ, নাক, কান, মুখ নিয়ে আমিও বেশ আতান্তরে পড়েছি। আমি কি চেয়ে চেয়ে এই চোখভরানো বাংলা প্রকৃতির অন্য অনুপম রূপ দেখব! নাকি প্রভাতফেরীতে বেরিয়ে পড়া যত পাখির দলের কুজনে, কিচিরমিচিরে কান পাতব! নাকি হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে আসা বনফুলের গন্ধ নেব শরীর ভরে! এসব দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে মনে হয় আনমনা, হতভম্বের মতো অনেকক্ষণই দাঁড়িয়ে ছিলাম স্টেশনে। হঠাৎ শুনি—
‘মেডাম, কোথায় যাবেন? চলেন, স্টেশনের বাইরে টোটো আছে।‘
‘বিদ্যাসাগর আবাসিক স্কুলে যাব, কিন্তু সে তো এখান থেকে কাছেই!’

‘একটুক দূর বটে।‘
‘একটুক দূর… তাহলে এক কাজ করুন দাদা, আপনি আমার এই ব্যাগদুটো নিয়ে স্কুলের কাছে চলুন, রাস্তাটুকু আমি হেঁটেই যাচ্ছি।
অর্জুনকাকা বলে দিয়েছে স্টেশন থেকে স্কুলে যেতে হেঁটে বড় জোর মিনিট সাত আটেক লাগবে। অতএব হাঁটা শুরু করলাম।
হাঁটতে আমার বেশ লাগে। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার দু’পাশে কত কত ছবি তৈরি হয়, তাতে চোখ পড়ে—বাঁ হাতে ফুটপাতের কোণ ঘেঁষে এক মধ্যবয়সী মহিলা দাঁড়িপাল্লায় কুমড়ো মাপতে ব্যস্ত, সামান্য সবজিপাতি নিয়ে রোজই এইখানটাতেই তার ক্ষুদ্র বাজার। তার পাশে চপের দোকান। মোচার চপ ভাজা হলে, মাছের চপ হবে। লম্বা লাইন সেখানে। রাস্তায় গাড়ির দৌড়, মানুষের হাঁটাহাঁটি। হঠাৎ শেষ বিকেলবেলাটুকু ফুরিয়ে আসে, নাগরিক সব আলো জ্বলে ওঠে। ল্যাম্পপোস্টের নিচে যে বুড়ো মাছওয়ালা বসে, তার ভাঙা রেডিওতে গান চলে। রেডিওটা একটা শ্যাওলা ধরা ইটের গায়ে আধ শোয়ানো ভঙ্গিতে রাখা থাকে। আর একটু এগোলে একটি স্টেশনারি দোকান, মালিক তার দোকান সাজতে যত ব্যস্ত, বিক্রিতে তার সিকিভাগ মনোযোগও নেই। খদ্দের এসে দাঁড়িয়েই আছে। ডানদিকে মাংসের দোকানের ছেলেটা নির্বিকারচিত্তে দায়ের এককোপে একটা মুরগিকে দু’টুকরো করে কেটে দেয়, তারপর কেবল গলগলে রক্ত আর রক্ত। মানুষ মাংস ভালোবাসে, মাংস কেনে। এসব আমি আমার শহুরে জীবনে সন্ধ্যের রাস্তায় আকছার দেখি।
তবে এখানে হাঁটার মধ্যে অন্য ছবি, আলাদা সুখ। চারদিকে খোলা মাঠ, মাঠ পেরিয়ে হু হু করে আসছে মেঠো বসন্ত-হাওয়া, স্টেশনের ধারে ধারে তালগাছের সারি, তাতে উল্টানো কুঁজোর মতো ঝুলছে বাবুইপাখির বাসা। চারপাশে চোখ ফেরালে গাঢ় সবুজের সমারোহ। এ সমারোহে তো কেবল সজীবতা নেই, গানও আছে— সকালবেলার ভৈরবী রাগিণী যেন। এখানে চোখের যেমন সুখ, প্রাণের তেমনই বড় আনন্দ— এখানে মানুষের কথা আর পাখির ডাক ছাপিয়ে অযথা আওয়াজ নেই, একটানা একঘেঁয়ে কোলাহল নেই।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে যে রাস্তাটা সোজা টামনার ভিতরের দিকে চলে গেছে তার একেবারে সামনেই রাস্তার দু’পাশে দুটি দোকান, মিষ্টির, মুখোমুখি। টিনের ছাউনি, ইটের গাঁথনির উপর মাটি লেপে দেওয়াল তোলা, তাও আবার কোথাও কোথাও মাটি ঝরে গিয়ে ইট বেরিয়ে পড়েছে। তবে দেওয়ালের সামনের দিকগুলিতে এক পোচ করে আলকাতরা লাগানো। কোথাও কোনও বাহুল্য নেই। এমনকী মিষ্টিগুলো কাচে ঢাকা যে শো কেসে সাজানো রয়েছে সেটিও নড়বড়ে লড়ঝড়ে গোছের। তার ভিতরে থালায় থালায় করে বেশ কয়েক রকমের মিষ্টি সাজানো আছে। তিলের নাড়ুর মতো কী একটা রয়েছে যেন।

রাস্তার বাঁ দিকের দোকানটায় শো কেসের পাশে উঁচু একটা ধাপের উপর দোকানের মালিক বসে আছেন। বয়স্ক, তবে শরীর স্বাস্থ্য বেশ ভালো, মাথার চুল প্রায় সব সাদা। তাঁর সামনে রাখা আছে বড় একটা কাঠের রেকাবি। তাতে বেনেবউ পাখির গায়ের রঙের মতো হলুদ হলুদ বড় জিলিপি থরে থরে সাজানো। ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো পড়লে কুলুঙ্গিতে থাকা আধুলিটি যেমন ঝকমকিয়ে ওঠে, এই ফুটো ফাটা দোকানে জিলিপিগুলো তেমনই আলোময়ী, রসময়ী।
‘খাবে তো মা, দোকানে এসো দেখি, দ্যাখো ওইখেনে, ওই ড্রামে জল আছে, হাত ধুয়ে নাও।‘
খাব! এই সকাল সাতটার সময় জিলিপি খাব! যে আমি কিনা সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে নেফারতিতি-সুলভ মর্জি মেজাজে এক কাপ সোনালি সোনালি চায়ে এক কণা চিনি বরদাস্ত করে উঠতে পারি না, সেই আমি এই এক জটিল প্যাঁচালো মিষ্টির রূপে রসে মজে গিয়ে নিজেকে হারাব!
হ্যাঁ, হারাব। মাঝে মাঝে নিজেকে জিলিপিতে হারিয়ে মিষ্টত্বে খুঁজে পাওয়া ভালো।
—‘আচ্ছা, দুটো জিলিপি দিন তো। জেঠু, ওইগুলো কি নাড়ু?
-—হ্যাঁ, নাড়ু, তিল আর নারকেল দিয়ে গড়া
—ওটাও দিন দুটো
—তা মা, তুমি কি ঘুরতে এইচো!
—হ্যাঁ, সেইরকমই
জিলিপিতে কামড় বসাতেই মুখের ভিতরটা রসে ভরে উঠল। এমন মুচমুচে অথচ রসালো জিলিপি আমি আগে খাইনি, কিন্তু আমাদের গুপ্তকবি, হ্যাঁ, ঈশ্বর গুপ্তও বোধহয় কখনই খাননি। খেলে নিজের লেখা কবিতার লাইনটি তিনি বদলে দিতেন। লিখতেন,
রসে ভরা রসময় রসের জিলিপি
পরের লাইনটি কী হত সে আমি জানি না, তা তিনি নিজেই জিলিপি খেয়ে ভাবতে পারতেন। তবে এটা বলতে পারি রসের ছাগলের বদলে রসের জিলিপি আমাদের কল্পনায় একটু কম দৌরাত্ম্য করত এবং আমরাও তাঁরই মতো রসময় ছাগলের কারণে পাগল হতাম না।
— বুইলে, এই সময় পলাশের কালে অনেক লোকজন কলকাতা থেকে আসচে। আগে আমরা যখন বড় হচ্ছি, এসব জায়গা কী ফাঁকা! ওই দিকটায় বড় একটা জঙ্গল ছিল, এখন আর তার কিছুই নেই।

— সেই, এখন তো পুরুলিয়া রীতিমতো ট্যুরিস্ট…

হঠাৎই চারপাশের সমস্ত সকালের ধ্রুপদী টুং টাং সরিয়ে একটা জোর আওয়াজ হল। আশেপাশে আমরা যারা ছিলাম, সবাই সবটুকু বুঝে ওঠার আগেই দেখলাম একটি কমবয়সী ছেলে তার মোটর বাইক থেকে জোরে আছড়ে পড়ল রাস্তার উপর। তার বাইক গড়াতে গড়াতে গিয়ে পড়ল জল কাদা ভর্তি পাশের জমিতে। ছেলেটি যেখানে পড়েছে তার খানিকটা কাছেই দেখি রাস্তার উপর চাপ চাপ রক্তের মধ্যে একটা পাতিহাঁস পড়ে আছে। বোঝা যাচ্ছে মরে গেছে। এসবের মাঝেই এক ভদ্রমহিলা পাশেরই কোনও বাড়ি থেকে কোমরে আঁচল গুঁজতে গুঁজতে দৌড়ে এলেন। তার তখন কেবল কান্না আর বিলাপ:
‘হেইমা, হেইমা গো, আমার হাঁসটাকে মেরে দিলে গা। কানা, চোখে কানা সব, দেখতে পায় না বটে!’
হাঁসের মাথাটা বাইকের চাকায় একেবারে থেঁতলে গেছে।
ভদ্রমহিলা মরা হাঁসটিকে কোলে তুলে নিলেন, যেমন করে মা তার শিশু সন্তানকে নেয়।
কেমন না!
পোষ্যরা পায়ে পায়ে ঘুরতে ঘুরতে কখন যে আমাদের এত প্রিয় হয়ে ওঠে! আমাদের খুব ছোট ছোট মুহূর্তগুলোর সঙ্গেও তারা আগাপাশতলা বড় জড়িয়ে যায়।
তাদের মৃত্যুও তারপরে কোনও একদিন স্বজন হারানোর শোকের মতো দারুণ হয়ে ওঠে।
ভদ্রমহিলা, দেখি, হাউ হাউ করে কাঁদছেন।
মানুষের মন আর মানচিত্রে এ পৃথিবী জুড়ে কত বিস্ময়!
বৃহত্তর রাজনৈতিক ম্যাপের এক অংশে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক বিন্দুর মতো লেগে থাকা আমার বাংলার এক প্রান্ত-গ্রাম, গুগল ম্যাপ যার সবটুকু ঠিকানা ঠিক ঠিক দিয়ে উঠতে পারে না, সেখানে এক অশিক্ষিত মহিলা আটপৌরে ছাপা শাড়ি পরে লাল মোরাম ঢালা রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে তার এক মৃত পাতিহাঁসের জন্য আছাড়িপিছাড়ি কাঁদছেন।
অন্যদিকে, এই আমাদের পৃথিবীরই অন্য এক প্রান্তে যেখানে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তে মানুষের মৃত্যু ও চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাওয়া শহরের এক আপাদমস্তক ইতিকথা নিয়ে গাজা শুধু খবরে খবরে এক ধ্বংসস্তুপ মাত্র। সেদিকে তাকিয়ে দেখি অগুনতি বাবা মা তাদের সন্তানের মৃতদেহ দুই হাতে বুকের কাছে চেপে ধরে এক শূন্যের মতো বসে আছেন। আশ্চর্য! তারা কেউ কাঁদছেন না, তাদের চোখে একফোঁটা জল নেই। প্রতিটি শূন্য কেবল শূন্য থেকে শূন্যতর হয়ে উঠছে।
যুদ্ধবাজের দল তাদের মেরে ফেলেছে। এই যুদ্ধবাজদের আমরা ঘৃণা করি। এরা কত নিঃস্ব মানুষ, না! এদের হৃদয়ে গান নেই, শৈশবের স্মৃতি নেই, প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই। কিচ্ছু নেই।

পৃথিবী তাও কী সহনশীল এদেরও প্রতি!

ছেলেটিকে রাস্তা থেকে অনেকে মিলে ধরাধরি করে তোলে। বোঝা যাচ্ছে আঘাত পেয়েছে ভালোই। হাঁটুর কাছে অনেকটা কেটে গেছে, গভীর হয়ে। রক্তে জিন্সের প্যান্ট ভিজে যাচ্ছে। কেউ একজন মিষ্টির দোকান থেকে কাপড়ের টুকরো নিয়ে এনে ওর ক্ষতের ওপরে বেঁধে দিল। এ অনেকটা সমুদ্রের জলে বালির বাঁধ দেওয়ার মতো হল আর কী। ডাক্তারের কাছে না নিয়ে গেলেই নয়।
মহিলা কান্না থামিয়ে এখন ফোঁপাছেন।
মৃতের পক্ষ, আহত পক্ষ এবং আমরা সব তৃতীয় পক্ষ — সকলেই বুঝতে পারছি এ নেহাতই এক দুর্ঘটনা।
এটা দেখে আমার বেশ ভালো লাগল যে এইসব মানুষজন ঘটনাটি নিয়ে অযথা হইহই রইরই বাঁধিয়ে দিলেন না। আসলে অপচয়ের একপ্রান্তে সামান্য একটি পাতিহাঁস ছিল বলেই কি কিছু হল না! তা নয় সম্ভবত। কেননা অতি সামান্য একটি সেফটিপিন নিয়েও আমি বড়সড় বিবাদ হতে দেখেছি।
যন্ত্রণাকাতর মুখ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ছেলেটি পকেট থেকে পয়সার ব্যাগ বের করে। মরা হাঁসের দাম দিতে চায় সে। দুটো নোট। পাঁচশো টাকার।
হাঁসের দাম কত?—আমি জানি না। মরা হাঁসের দাম কত?— হাজার টাকা? আমি জানি না।
ভদ্রমহিলা টাকা নিলেন না। হাঁস কোলে নিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে চলে গেলেন।
ছেলেটিও চলে গেল খোঁড়াতে খোঁড়াতে। দু’তিন জন তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল ডাক্তারের কাছে।
এরই মাঝে কাদামাখা মোটর বাইকটি কেউ জমি থেকে তুলে এনে মিষ্টির দোকানের পাশে রেখে দিয়েছে। ওটাকে কেমন একটা বিকট জন্তুর মতো দেখাচ্ছে।
রাস্তা আবার আগের মতো ফাঁকা ফাঁকা হয়ে আসে।
এখানেই সকালবেলাকার অপ্রত্যাশিত দৃশ্যের যবনিকা পতন হল।

রোদ ধীরে ধীরে চড়া হচ্ছে।

(ক্রমশ)

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes