
অনিন্দ্য সরকারের কবিতা
বুদ্ধজন্মের প্রতি মোহ
(১)
এখনও কান্নায় আমি ভেঙে পড়ি, দুঃখ
আমাকে টলায়
খসে পড়ে ধ্যানের আসন।
চোখ খুলে দেখি আলোকিত
আলোকিত সব
আবার কখনও বদ্ধ এ-ঘরের কোণ।
এখনও সময় হয়নি, তাই
ছুঁতে তো পারিনি ওই তোমার দু-হাত..
যাও, ফিরে যাও মন—
একমনে শুনতে থাকো জাতককাহিনি
কুসুমিত বুদ্ধের চরণ।
(২)
সারা জীবন তোমাকে খুঁজে চলেছি গৌতম
মৃগদাব, মগধ তন্ন তন্ন করে খুঁজে
কোথাও পাই নি তোমায়।
নৈরঞ্জনা নদীস্রোতে
ভেসে গেছে জিজ্ঞাসা
তবুও তোমায় পাই নি।
আমার কোনো বন্ধু নেই
প্রেম নেই, সংসার নেই
পিছুটান নেই
কেবল তোমার ওই বুদ্ধজন্মটুকু-
বুদ্ধজন্মের প্রতি মোহই
আমাকে তোমার কাছে যেতে দেয় না।
(৩)
‘নগ্ন হয়ে দাঁড়ালে তবেই
বুদ্ধকে পাওয়া সম্ভব’
নগরনটীর কীসের ভয়?
ধুলায় লুটায় বস্ত্র
পড়ে থাকে অলংকার
তবুও তো তাকে পাই না!
কেন এমন হয়?
কামনা-বাসনায় ভরেছে শরীর
বস্ত্র আর কতটুকু ঢাকে?
মুছে ফেলো ষড়রিপু
ছিঁড়ে ফেলো বাঁধন
আম্রপালী কাছে পাবে তাকে।
(৪)
পড়ে আছে কর্তিত কেশ, রাজবস্ত্র
এবার চলে যাবে তুমি
আমাদেরও ফিরে যেতে হবে।
ফিরে চলো ছন্দক
ফিরে চলো কন্থক
দেখা হবে না আর কোনোদিন।
মায়ার পাথর, মোহের পলি, স্মৃতির নুড়ি
ফেলে রেখে তুমি এগিয়ে চলেছো
নির্ভার।
কিন্তু আমি এগোতে পারি না
তোমার ফেলে যাওয়া ভার
বুকে পাথর হয়ে চেপে বসেছে।
(৫)
তুমি চলে যাওয়ার পর
একা হাতে সাজিয়েছি সংসার
পিতা শুদ্ধোধন, পুত্র রাহুল
আমি পত্নী যশোধরা,
কেমন করে ফেলে যেতে পারো তুমি মায়াভার
আমি তো পারি না
সব নিজ হাতে গড়া।
তোমার পিতা নেই, পুত্র নেই, নেই মায়া
ফেরাতে পারে না তোমায় কোনো পিছুটানই
সেসব সযত্নে গ্রহণ করেছি আমি
সিদ্ধার্থ, তুমি আজন্ম আমার কাছে ঋণী।
(৬)
মাতৃঋণ মেটানো যায় না
শোধ করা যায় না স্নেহঋণও,
নৈরঞ্জনা তীরে সব চুপচাপ
পাঁচ সঙ্গীও ছেড়ে গিয়েছে তাকে
শুধু একা আসন সাজাচ্ছে তৃণ।
নদী পার হয়ে আসে কোন
অভিসারী মেয়ে,
বৃক্ষের নীচে যেন বনদেবতার সাজ
সুজাতা স্নেহভরে পরমান্ন
রেঁধে খাওয়ায় তাকে
সিদ্ধার্থ, বুদ্ধ হবেন আজ।
(৭)
বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি
গাইতে গাইতে চলেছে ভিক্ষুর দল।
আমিও পিছু পিছু চলি
চারিদিকে খুঁজতে থাকি।
কী অনায়াসে দুহাত পেতে
গ্রহণ করছে ভিক্ষা
আমি পারি না,
শূণ্য পড়ে থাকে ভিক্ষাপাত্র
আমার দুচোখ শুধু তাকেই খোঁজে।
নিজের ভেতরেই যে বুদ্ধের বাস,
বুঝে উঠতে পারি না।
বুদ্ধজন্মের প্রতি মোহ
আমাকে অন্ধ করে রেখেছে।