
অমিতাভ মুখোপাধ্যায় -এর একগুচ্ছ কবিতা
দুপুরের ভয় ভয় ধ্বনি ও গন্ধেরা
১.
দূরের রাস্তা থেকে গান উঠছে, হর্ন ফেটে
মাইকের চোঙা থেকে, মদের দোকানের ঠেলাঠেলি থেকে
ঝিঁঝিঁর একটানা গোঙানি, একটা চুপচাপ
দাঁড়িয়ে থাকা সেতার,
একটা দেশলাই জ্বালানোর শব্দ, একটা কুকুরের হঠাৎ
জেগে ওঠা থেকে
এক পাথুরে নীরব থেকে গান উঠছে…
২.
এই একটা রাস্তার দিকে সারাদিন চেয়ে থাকা
ভীতু ভীতু মনে শব্দের গাড়ি হর্ন মেরে
ফের মিলিয়ে যাচ্ছে, না থাকার ভিতর
কুয়োতলা জুড়ে যেমনটা এঁটো বাসনের ঘিন ঘিন
পিচুটির ভিতর চোখের অংশ লেগে ছিল যেমন
মৃত্যুর ভিতর সরোদের তার ছিঁড়ে বেতাল বেসুর
বেজে উঠেছো যেমন দুঃখের আস্তরণ ফেটে
একটি বালিকার ব্যাগের গোলাপি বেরিয়ে এলো
ভিড় থেকে, টিউশন থেকে
রাস্তা ও নদী এখানে ভীষণ কষ্টের, এখানে তুমি
অন্যভাবে বলো
এখানে তুমি কম্পাসের বাক্সখানি রৌদ্রে রৌদ্রে
বিছিয়ে রাখো
৩.
ভাষা থেকে বেরিয়ে কোথায় যাও !
তুমিই অবসাদ, এগিয়ে চলেছ যেন খুব তাড়া নেই
টবগুলোতে জল দিলেও হয়, ঝাঁঝরির ফুটো দিয়ে
গলে বেরিয়ে আসছে তরল, কে বলেছে অবয়ব নেই!
কে দেখেছে তার রং বেদনানীল দূর সৈকতে
পরিত্রাণের বাঁশি বাজিয়ে চলেছ ভর দুপুরবেলা
চৌকাঠ জুড়ে নিহত ফুলের পড়ে থাকা
জন্ম জুড়ে অবান্তর কিছু প্রশ্ন আর শিস দেওয়া পাখি
অত্যন্ত সরু ডাল বেয়ে কাঠবিড়ালিটির চলন
মন্দ লাগছে না, এই অপেক্ষা অপেক্ষা ভাব
দেবদারু গাছের হাওয়া, বাগানে বাগানে ঘোরে
মানুষের শোকের ধারণা, কলম চুঁয়ে নামা
তরল রেখায় ফোটে কবিতা, গল্প, নাকি
সাদা পাতা, শেষের পৃথিবী !
৪.
যে দ্যাখেনি, তারও মহিমা ফুটে আছে মেঘলায়
দুপুর মানে, তোমার সুর ছুঁয়ে যাওয়া
মানে, একটা ব্যস্ততার ভাব কাঁটাঝোপে চলকে
ফেলে দেওয়া
ভয় এসে নিশ্চিন্তভাবে যে সোফায় বসে আছে
তার কুশনগুলিকে অবিরত চৌকো ও গোল করে দেখা
ক্যালিডোস্কোপের কাচে কেন যে মাত্রা কম !
জানাজানি হবার আগে কাচা পাজামায়
এঁটো হাত মোছা, আরেকটু দূরে তাকালেই
কলকাতার বাস ছুটে যাচ্ছে ঘন ধূসরে
মনে হয়, এখানেই কথা পাড়া যাক
এই দেয়ালে, এই লুকোছুপির মধ্যে, ম্যাজিকবাক্সের মধ্যে
ছড়িয়ে যাক অবাধ্যতা, আর তুমি যাবতীয় মন খুলে
ফের নগ্ন হও…
৫.
পতনের এ’ দীর্ঘ মুহূর্তখানি গল্পের পক্ষপাতী নয়
নামার সময় এই মন শিরশির করে ওঠা
এই হালকা হয়ে থাকা দেহ ফের ভয় দেখাবে
শেষ মুহূর্তের সংঘর্ষের ভয়, আঘাত ও কষ্টের ভয়
নিজের দেহের ভিতর শুনে ফেলা জলতরঙ্গের শেষে
ফোঁপানো সমুদ্রের গুমগুম, আরেকটু পরে
মাটি ছুঁয়ে ফেললেই আমি নষ্ট হয়ে যাবো
মানুষেরা আমাকে ঘিরে গুঞ্জন করবে, যেহেতু পড়ে গেলেই
প্রতিটা চলন ও সম্ভাবনা মৃত
আমার ফুল ও ফলের গুণাগুণ বিশ্বাস দিয়ে চেখে দেখবে
লিখে রাখতে চাইবে সব নশ্বর তাদের জাবেদা খাতায়
টুকে রাখবে স্মৃতি ও সঞ্চয়, যা আমি প্রত্যাখ্যান করে
এই নেমে চলার অবাধে ডুবে যাচ্ছি
৬.
তুলে আনলাম মদ
ঠেক থেকে জানলায়, যাতে এই ম্যাদামারা দুপুর
মসৃণ হয়ে ওঠে, পর্দার ওপারে ঝলসে ওঠে
মানুষের ছোটখাটো সাফল্য, আচারের বয়াম,জাদুবাস্তবে
কামরাঙ্গার সবুজ আর লালমরিচের স্বপ্ন ঘন হয়ে ওঠে
দোতারার সুরে পাক ধরে…
নতুন গুড়ের মখমল রাস্তায়
কারা দলবেঁধে গান গাইতে গাইতে
সংক্রান্তির দিকে চলে যায়,
ক্ষয়ে আসা টুসুর মিছিল, হলুদ জরির সাজ…
নদীটির সাঁকো জুড়ে কেবল
আলোছায়ার বাস্তবিক খেলা …
এসবের বাইরে এক প্রশ্নের মতো মদের গেলাসে
আমি বসে আছি চাটের থালায় আর পৌষালীর মা
আধভেজা শীত শুকিয়ে নিচ্ছেন টানা করিডোরে
রোদ টেনে নিচ্ছেন নিজের দিকে, ভূমিকার দিকে
পরবর্তী বিকেলগুলি ঢলে পড়বে যথারীতি জেনে
বিড়ালের চোখ ঢুকে পড়বে গেরস্ত পাঁচিল টপকে
প্রিয় দুঃখ কালো জামা পরে
এইসব ভয়, ছবি, ভালোবাসা ও উপেক্ষায় আছি
চৌকো ঠান্ডা গরাদে নাক গুঁজে
চোখ ঠেরে বেঁচে আছি শিহরণ আশা করে করে