হিন্দি ভাষার কবি হূবনাথ পান্ডে-র কবিতার অনুবাদ
অনুবাদ ও ভূমিকা > স্বপন নাগ
কবিতায় প্রতিবাদ এবং হিন্দি কবি হূবনাথ পান্ডে
প্রতিবাদী কবিতা কিংবা কবিতায় প্রতিবাদ, এ নিয়ে আলোচনা নতুন কিছু নয়। কবিতার মাধ্যমে প্রতিবাদ বিষয়টিকে বিশুদ্ধবাদীরা দেখেন একরকম ভাবে। তাঁদের মত হল, প্রতিবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে লেখাটি বিবৃতিমূলক হওয়ার দিকেই ঝুঁকতে চায়। নষ্ট করে কবিতার লাবণ্যকে। আবার, কবিতাও বিভিন্ন সময়ে অনেক আন্দোলনকে প্রেরণা জুগিয়েছে, জোরদার করেছে, আন্দোলনকারীদের উদ্বুদ্ধ করেছে, এমন নজিরও খুব কম নেই।
আধুনিক হিন্দি কবিতার জগতে হূবনাথ পান্ডে চর্চিত একটি নাম। বহুচর্চিত তাঁর কবিতা। এই সময়, এই সময়ের বৈষম্য, কুসংস্কার, জাতপাতের সমস্যায় দীর্ণ ভারতীয় সমাজ, রাজনীতিকদের নীতিহীনতা, রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী মনোভাব … এ সবই কবি হূবনাথ পান্ডের কবিতার বিষয়। তাই তাঁর বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর শোনা যায় তেলুগু কবি ভারভারা রাওকে সামনে রেখে লেখা কবিতা ‘এক বুঢ়া’-য়। লেখেন, ‘করোনার ভয়াবহ এই আবহে / ত্রস্ত রাষ্ট্রের এত ভয় ! / এত ভয় একজন জরাগ্রস্ত বুড়োকে ? / তার কবিতাকে ? তার জড়িয়ে-আসা উচ্চারণকে ?’ পরেই তিনি লেখেন, ‘ এ কথা তো সত্যিই — / আলোর ক্ষীণ একটি বিন্দুকে আজও / ভয় পায় জমাট অন্ধকার !’ আমরা জানি, মুক্তির সপক্ষে স্বাধীন কন্ঠ বনাম রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের চিরকালীন বৈরীতার কথা। আমরা স্বাধীন সেই কন্ঠস্বর শুনি হূবনাথের কবিতায়। হূবনাথ পান্ডের আর একটি দীর্ঘ কবিতার কথা উল্লেখ করব। কবিতার নাম ‘মুসলমান’ । কবিতাটি শুরুই হচ্ছে এভাবে — ‘ম্যায় মুসলমান হুঁ / কিঁউকি মেরে আব্বু মুসলমান হ্যায় / অগর ও হিন্দু হোতে / তো ম্যায় ভী হিন্দু হোতা।’ এমনই সহজ সরল ভাষায় লেখা যে, কবিতা তরতর করে শেষ অবধি পড়ে যেতেই হয়। এ কবিতায় তথাকথিত দুই সম্প্রদায়ের মধ্যকার বিদ্বেষ, তা নিয়ে ইন্ধনকারীদের মদতে ঘটা দাঙ্গার বিভৎসতা উঠে এসেছে কবিতার ছত্রে ছত্রে নিতান্তই আটপৌরে শব্দসংকলনে।
কবি হূবনাথ পান্ডের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নাম ‘কৌয়ে’। প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৯ সালে। ঐ বছরই প্রকাশিত হয়েছিল ‘লোয়ার পরেল’ কাব্যগ্রন্থও। দুটি বই-ই প্রকাশ করে মুম্বাইয়ের ‘অনিমেষ প্রকাশন’। ‘মিট্টী’ তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশ কাল ২০১২ ।এটিও প্রকাশিত হয়েছে একই প্রকাশনা সংস্থা থেকে। ১, ২, ৩, করে অনেকগুলি ছোট ছোট আকারে কবিতা সংকলিত করা হয়েছে ‘মিট্টী’ কাব্যগ্রন্থটিতে। তার থেকে একটি মাত্র কবিতা উদ্ধৃত করা যাক — ‘মিট্টী কো ছুয়ো / তো অ্যয়সে / জ্যায়সা ছুতা হ্যায় ফুল / খুশবু কো / জ্যায়সা ছুতী হ্যায় কিরণ / রৌশনী কো / জ্যায়সে ছুতী হ্যায় হাওয়া / শীতলতা কো / ছুতা হ্যায় জল / তরলতা কো / মিট্টী অ্যায়সে হী ছুতী হ্যায় মিট্টী কো’ : মাটিকে সেভাবেই ছোঁও / যেভাবে সৌরভ ছোঁয় ফুল / যেভাবে আলো-কে ছোঁয় কিরণ / শীতলতাকে ছোঁয় হাওয়া / আর তরলতাকে জল। / মাটি / এভাবেই ঠিক ছুঁয়ে থাকে মাটিকে।’ জাতপাতে দীর্ণ এই সমাজে একজন কবি যখন তাঁর ‘বাল্মীকি ‘ কবিতায় প্রশ্ন করেন, ‘ কী জাত তোমার / বাল্মীকি ? / জনতা জানতে চায় !’ আমরা চমকে উঠি আমাদের দীনতায়, হীনতায়। এ কবিতাতেই তাঁর উচ্চারণ : ‘তোমার রাম ছিল মানুষ / একজন মানুষের যেসব দোষত্রুটি থাকে / সেই সব নিয়ে একজন রক্তমাংসের মানুষ। / পরবর্তী ভক্ত কবির দল / রামকে ঈশ্বর বানিয়ে দিয়েছে — / বেজায় দুর্বল আর অসহায় এক ঈশ্বর। / এই ঈশ্বর পাপীদের হাতের খেলনা হয়ে উঠেছে / আর তা নিয়ে খেলা শুরু করেছে ধান্দাবাজ রাজনীতি।’ আবার ‘এক অওর আদিবাসী’ কবিতায় তাঁর স্পর্ধিত উচ্চারণ : ‘তোমাদের সভ্যতার সামনে / আমরা দাঁড়িয়ে থাকব বুক চিতিয়ে / আমাদের অসভ্যতাকেই সঙ্গী করে দেখতে চাই / কত ক্রুর হতে পারে তোমাদের মহান সভ্যতা ! / আর দেখাতে চাই — / মারখাওয়া মানুষেরাই হারে না প্রতিবার, / যারা মারে, তারাও জেতে না সব সময় !’ তাঁর কবিতায় যেমন হাইওয়ের ট্রাকের চাকায় পিষ্ট পরিযায়ী যুবক শ্রমিকের প্রসঙ্গ আছে, তেমনই হাথরসে নৃশংস বলাৎকারের ও হত্যার শিকার সেই মেয়েটিও উঠে আসে কবিতার বিষয় হয়ে। এ সব থেকেই এই সময়ের সঙ্গে কবি হূবনাথ পান্ডের ভাবনার সংপৃক্ততা আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করি।
২০২০ সালের শুরুতে জয়পুরের ‘বোধি প্রকাশন’ থেকে বেরিয়েছে তাঁর সাম্প্রতিক কবিতার বই — ‘অকাল’। এ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলিতেও ধরা আছে এই সময়। সমাজের অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে যেন তীব্র একটি আলোর অস্থির আনাগোনা এই সব কবিতা।
১৯৬৫ সালের ১৩ই এপ্রিল বেনারসে জন্ম কবি হূবনাথ পান্ডের। বর্তমানে তিনি মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দি বিভাগের অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। কবিতা ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে তিনি নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারভিত্তিক রচনাও লিখেছেন। এ যাবৎ প্রকাশিত কবি হূবনাথ পান্ডের রচনাসমূহ :
কাব্যগ্রন্থ :
————-
• কৌয়ে
• লোয়ার পরেল
• মিট্টী
• অকাল
সাক্ষাৎকারভিত্তিক রচনা :
————————————
• বাজা (বালচিত্র সমিতি, ভারত)
• হমারী বেটী (সুরেশ প্রোডাকশন)
নিবন্ধগ্রন্থ :
————–
• ললিত নিবন্ধ : বিনা কী বাত
• ললিত নিবন্ধকার কুবেরনাথ রায়
• সিনেমা সমাজ সাহিত্য
• কথা পটকথা সংবাদ
গবেষণা :
————-
• সমান্তর সিনেমা মে নারী
হূবনাথ পান্ডের একগুচ্ছ কবিতা
চশমা
“”””””””
সেদিন
গান্ধীজী
চশমা খুলে
ছলছলে চোখ
মুছতে মুছতে বলেছিলেন —
হিন্দু আর মুসলমান
দুটো চোখ আমার !
তার পর থেকে
বেঁচে থাকল শুধু চশমা।
তার সেই চোখ দুটি
জানি না, কোথায় যে হারিয়ে গেল !
••
নীরবতা
মরার ঠিক আগে
যদি সে চিৎকার করতে থাকত
বেঁচে যেতে পারত, হয়তো বা।
শুধু বেঁচে থাকার জন্যে
সে জীবনভর চুপ করে ছিল।
••
রাজা
রাজা নির্ভীক
রাজা অমর।
সন্ত্রস্ত প্রজাই
রাজাকে নির্ভীক বানায়,
মরনাপন্ন প্রজা থেকেই
রাজা অমর হয়।
নিজেরই রাজ্যে
ঘোর অরক্ষিত রাজা।
দুর্ভেদ্য সুরক্ষায় বেষ্টিত থেকে
প্রজাদের নির্ভয়ে থাকার
আহ্বান করেন।
মরার সমস্ত লোকতান্ত্রিক অধিকার
প্রজাদের অর্পণ করে
রাজা বলেন —
‘ বাঁচো, খুশিতে বাঁচো।’
প্রজারাও অবুঝ —
বুঝতে পারে না তাদের রাজাকে।
আর এ জন্যেই
রাজা নির্ভীক
রাজা অমর।
••
ভালোমানুষ
বড় ভালোমানুষ সে !
সাফসুতরো থাকা তার খুব পছন্দের।
দিনে দু’বার সে স্নান করে
রোজ, ঠান্ডাতেও।
দাড়িকাটা চাই রোজ
এমনকি পিতৃপক্ষেও।
স্মিত হাসি তার লেগেই আছে মুখে
সকলের সাথে মেশে হাসিমুখে
সব্বার সাথে।
কাউকে কোনো নালিশ করে না,
কারোর নিন্দে-মন্দও না।
এই পৃথিবীতে তার কোনো শত্রু নেই,
সম্ভবত বন্ধুও।
তার কাছে সবকিছু একইরকম।
এক স্ত্রী
পাঁচটি মেয়ে
এক বুড়ি মা
আর একমাত্র সরকারি চাকরি তার।
অফিসে সে কোনদিন ‘লেট’ করেনি
কোনদিন নেয়নি একটিও ছুটি,
অসুখও করেনি তার কোনদিন।
কোনদিন কোন হরতাল কিংবা বনধে
সামিল হয়নি সে ;
হরতাল হলেও কখনো বা
যতক্ষণ না হরতাল শেষ হয়ে যাচ্ছে
ঘরে না গিয়ে অফিসেই থেকে যেত সে।
অফিসফেরৎ প্রতিদিন বিকেলে
নিয়ম করে ঘরে ফেরে সঙ্গে লাউ নিয়ে,
হিং দিয়ে খায় মুগের ডাল
আর খুব ভক্তিভরে
হনুমান চালিসার মত পড়ে খবরের কাগজ।
কোনো সমস্যাই
কোনদিন তাকে হয়রান করেনি।
বৌয়ের অসুখ তাও সে খুশি
মেয়ে পালিয়েছে ঘর ছেড়ে তবুও খুশি
চিনের কাছে হেরেছে ভারত তাও সে খুশি
পন্ডিত নেহরু মারা গেছে তবুও খুশি
রঙ্গা-বিল্লার ফাঁসি হয়েছে তাতেও খুশি …
তার খুশিতে
খুশি হয় না অন্য আর কেউ,
তবু সে সর্বদা খুশিই থাকে।
তার সম্পর্কে সবাই বলে —
বড় ভালোমানুষ সে !
••
কবিতা
কবিতা
কী করে ?
কিছু নয়।
কবিতা
কী করতে পারে ?
কিছুই নয়।
কিন্তু
তুমি পারো।
যতক্ষণ
কবিতার সঙ্গে থাকো
অন্তত
মানুষ হয়ে থাকতে পারো।
কী দেয় কবিতা ?
কিছু নয়।
কী দিতে পারে কবিতা ?
কিছুই তো নয় !
কিন্তু যতক্ষণ
থাকো কবিতার সঙ্গে,
তুমি তোমার
যা কিছুই-নয়-এমন
সবকিছুই
দিতে পারো তাকে।
••
ওরা
হয়তো প্রকাশ্যে
কখনোই মানবে না ওরা,
অথবা চুপ করে থাকবে ;
কিন্তু সত্যি তো এটাই —
ওদের জন্যেই আমাদের জীবন কাটে
হেলায়, নোংরা আবর্জনায়, বনে জঙ্গলে।
অসহায় পালিত পশুর মত
আমাদের ঘরের মেয়েদের ওরা
ডেকে নেয় ঝোপেঝাড়ে,
ওদেরই কব্জায় থেকে যায়
আমাদের ঘরের বাচ্চা বউয়েরা।
আমাদের চিৎকৃত কান্নাকে
গলাকাটা পশুর আর্তনাদ ছাড়া
কিছুই ভাবে না ওরা।
মানুষ হিসেবে
তাদের ভাবনার পরিধির ও বাইরে
আমাদের টিকে-থাকা।
গাঁয়ের দক্ষিণ সীমান্তে আমরা
সবকিছু হারিয়েছি,
লুঠ হয়ে গেছে সব —
চারদিক জুড়ে শুধু হতাশার ছায়া ,
তাদেরই মুখের দিকে তাকিয়ে
দাঁড়িয়ে আছি আমরা।
তাদের রাশি রাশি বই থেকে ভয় পেয়ে,
তাদেরই হিসেব-খাতায় আটকে গিয়ে,
তাদেরই দেখাশোনায় পালিত হয়ে,
তাদেরই বানানো নিয়মে ছটফট করতে করতে
আছাড়ি পিছাড়ি মরছি আমরা।
তবুও চেষ্টা আমাদের —
আমাদেরই কোনো আচরণে যেন
অসুবিধে না হয় ওদের !
আর, আমাদের এই সমর্পণই ওদের শক্তি,
আমাদের সরলতাই ওদের সামর্থ্য,
ওদের আতঙ্ক আর সমস্ত অপরাধের জন্যে
দায়ী আমাদেরই নীরবতা।
যেমনটা আজ ওরা
তেমন হতে দিয়েছি আমরাই ;
আর আমরা আজও রয়ে গেছি সেরকমই।
আমরা ভুলে যাই
মামুলি পঙ্গপালও উজাড় করে দিতে পারে
ফসলের রাশি,
নগণ্য উইও ধ্বসিয়ে দিতে পারে পুরো সাম্রাজ্য,
এই যে ধূ ধূ করে জ্বলছে আজ
আমাজনের জঙ্গল —
একটি মাত্র স্ফুলিঙ্গ থেকেই একদিন
জ্বলে উঠেছিল আগুন :
যে আগুন ঘুমিয়ে আছে নিষ্প্রাণ পাথরে,
শুকনো কাঠে আর ক্ষতবিক্ষত বুকের গভীরে …
আগুন জাগবে যেদিন
সেদিন জেগে উঠবে আমাদের ভাগ্যও।
নইলে ঘুমন্ত আত্মা আর মৃত পশুর মধ্যে
কী-ই বা তফাৎ !
••
ধর্ম
কোনো দুর্বল নিরপরাধের ওপর যদি
ক্রুদ্ধ হতে পারো,
অনায়াসেই হয়ে উঠতে পারো হিংস্র,
পুষে রাখতে পারো যদি ঘৃণা,
অন্যায় দেখেও যদি আলোড়িত না-হয় রক্ত,
হারামের খাওয়া যদি লজ্জার না হয়,
অন্যের মেহনতের ফসল কেড়ে নিতে
যদি হাত না কাঁপে,
অপার দুঃখ দেখেও যদি না জন্মায় করুণা,
নিজের দেহ আর দৈহিক সুখ ব্যতিরেকে
যদি কিছু ভাবতেই না পারো,
তা হলে বিশ্বাস করো —
তথাকথিত ধর্মের এতসব নাটকের পরেও
তোমরা কিন্তু ধর্ম থেকে অনেক অনেক দূরে।
দাড়ি-টিকি রোজা-উপবাস
আজান-আরতি মন্দির-মসজিদ
গীতা-কুরআন …
সব সবই অন্তঃসারশূন্য নিরর্থক শব্দ !
ধর্ম আবরণ নয়, সে আচরণ।
যা দেখা যায়, সে তো আবরণ ;
আর সুগন্ধের মত অনুভব করা যায় যা —
সে-ই তো আচরণ।
ধর্মে থাকে না দুর্গন্ধ
ধর্ম, সে তো মনুষত্বেরই সৌরভ।
••
সত্য
খোঁজ চলছে একটি কাল্পনিক ধারণার।
কাল্পনিক সত্যকেও বোঝা যায় —
যেদিন থেকে এই ভ্রমে ডুবেছিল মানুষ,
বস্তুত সেদিন থেকেই শুরু বোঝার চেষ্টা।
অন্বেষণে অবশেষে
উঠে এলো এমন অনেক মিথ্যে
যাকে এতদিন সত্য বলে মেনে নেওয়া হয়েছে।
যা মেনে নেওয়া যায়
তা-ই সত্য হয়ে যায় নিজে নিজেই
যেমন ঈশ্বর
যেমন স্বর্গ
যেমন নরক
যেমন ধর্ম …
সবই সত্য বলে মেনে নেওয়া হয়েছে।
অতএব , কোনো প্রশ্ন নয়
প্রশ্নের উত্তাপে গ’লে যেতে পারে
মেনে নেওয়া সত্য !
মেনে নেওয়া সত্যকে রক্ষার জন্য তাই
গড়তে হয় গড়,
ফিরি করতে হয় কাহিনীর,
লিখতে হয় পুঁথি …
আর এভাবেই
কাল্পনিক ধারণা একদিন মূর্ত হয়ে ওঠে,
যাকে তুমি
অনায়াস পেয়ে যাও দৃশ্যগন্ধস্পর্শের সীমানায়।
কী আশ্চর্যজনক ভাবেই না
একটি কল্পনাকে পাওয়া যায় যথার্থের রূপে,
তার জন্যে মরতে পারো
মারতেও পারো কোন নিরপরাধকে।
যথার্থের বোধ থেকে
সহস্র যোজন দূরে বাস কল্পনার,
সে কল্পনার আনন্দও এমনই মাদকতাময়
যার আমেজ ফুরোয় না মৃত্যুর পরেও !
বুদ্ধিমানেরা যেমন বলেন —
মৃত্যু জীবনের শেষ, তা কিন্তু নয় ;
মৃত্যু বরং জীবনেরই সত্য !
••
রামরাজ্য
”
রাগে গরগর করতে করতে
সাপের হিসহিস শব্দে
ধর্মরাজ বললেন —
যুগ যুগ ধরে
ধর্ম সামলাতে সামলাতে
তুমি কি পাগল হয়ে গেছো
চিত্রগুপ্ত ?
কতবার বোঝাই বলো তো,
আমার দরবারে
সশরীরে মর্ত্যবাসীর প্রবেশ
কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ !
এক যুধিষ্ঠিরই যা অন্য কথা,
তা বলে রক্তে মাখামাখি
হাত পা ভাঙা
চোয়াল দাঁত থ্যাঁতলানো
খুবলে নেওয়া একটা চোখ
রক্ত ঝরছে সারা শরীর থেকে
আর থেকে থেকেই
হৃদয়বিদারক আর্তনাদ করছে
নগ্ন বিভৎস এই দেহ
এখানে কীভাবে ?
এখানে তো শুধু
আত্মারই বিচার হয় !
হতভম্বিত চিত্রগুপ্ত
তোতলাতে তোতলাতে বলল —
মহারাজ !
এ কোনো দেহ নয়।
মহান ভারতভূমির
রামরাজ্য থেকে এসেছে
বলাৎকারগ্রস্ত এই আত্মা প্রভু !
স্বর্গ মিডিয়ার খবর —
জ্ঞান হারিয়েছেন ধর্মরাজ,
এখনও ফেরেনি !
••
বাঁশ ফুল
ন্যাশনাল পার্কের বাঁশের জঙ্গলে
ফুল ধরেছে —
খবরে পড়লাম।
কাঁচা হলুদের গাঢ় রঙের ফুলে
সেজে উঠেছে বাঁশ।
ঢাক-ঢোল পিটিয়ে
শোভাযাত্রা সহকারে
গায়ে-হলুদ নববধূর মত
সেজেগুজে বসন্ত এসেছে।
বাবা তুলসীদাস বলেছিলেন —
অমৃত বর্ষণ হলেও
ফুল কখনো ফুটবে না বেত বনে।
তুলসীবাবা মিথ্যে হয়ে গেল,
মিথ্যে হল যাবতীয় প্রবচন !
জ্ঞানীরা বলেন
বাঁশের ফুল আসে শতবর্ষ পরে।
আর তিলকধারী পন্ডিতরা তাতেই
সম্ভাবনা দেখেন আসন্ন বিপদের।
এ সবকেই ফুৎকারে উড়িয়ে
ন্যাশনাল পার্কে
ফুলে ফুলে সেজে উঠেছে বাঁশের জঙ্গল।
শাল্মলী শুকিয়ে যাচ্ছে,
ঝলসে যাচ্ছে শিমুল পলাশ গুলমোহর,
কুয়াশার ঝাপটায়
নষ্ট হচ্ছে বাসন্তী ফুল,
মুখ লুকিয়ে নিচ্ছে সবুজ, আর
লজ্জায় মলিন হচ্ছে অমলতাসও।
বসন্তকে আটকে রেখেছে টোলট্যাক্সের লোকেরা,
মিউজিক কোম্পানিগুলো
কিনে নিয়েছে কোকিলের গানের কপিরাইট,
উর্দু শায়েরি থেকে উড়ে গেছে বুলবুল,
আম্রমঞ্জরীর টেন্ডার খোলা হয়নি এখনো,
হলুদের পেটেন্ট এখন আমেরিকার কাছে ….
এমন দিনে
বাঁশের এরকম ফুলবতী হয়ে ওঠা
বড়ই অশ্লীল মনে হয়।
আর, অশ্লীলতার মার্কেট —
সে তো হাজার হাজার কোটি কোটি ডলারের !
তো, কী ভাবছেন ?
যাওয়া যাক, ন্যাশনাল পার্ক !
••
কুপুত্র
গাই আমাদের মা,
আমাদের মানে হিন্দুদের।
সব হিন্দুদেরও নয়
স্রেফ তিলকধারী, ধর্মধ্বজাধারী,
পাপমোচক, শত্রুবিনাশকারী,
শুদ্ধ আর্যরক্তবাহক,
সত্যযুগের সংবাহকদের …
গোবর গোমূত্রে মাখামাখি হয়ে
গোয়ালঘরে জন্ম না নিলেও
জন্মসূত্রে আমরা কিন্তু
গোপুত্র, গোরক্ষক এবং গোভক্ত।
এখনো অব্দি কোনো বাছুর
আপত্তি করেছে, শোনা যায়নি।
আর করবেই বা কেন
সে তো আমাদেরই ভাই।
আমরা ষাঁড়
হাম্বাহুম্বি করে আমরাই ঠিক করব
কোন্ ঘরে, কোন্ বৃদ্ধাশ্রমে অথবা
কোন্ বিধবাশ্রমে থাকবে আমাদের মা।
ঘাস কাগজ কিংবা কোন্ প্লাস্টিক খেয়ে মরবে
কোথায় কোন্ শকুনে ঠুকরে খাবে তার লাশ,
মরবে না পচবে, মর্জি় আমাদের !
আরে বাবা, মা তো আমাদের,
আমরা তারই পুত্র।
কুমাতা হয় যদিও বা, কখনোই নয় কুপুত্র !
••
রাবণ অমর
রাবণ অমর —
মানো অথবা না-ই মানো,
বাজি ধরে বলতে পারি
রাবণ অমর !
প্রতি দশেরায়
তাকে পোড়ায় এক নতুন রাম,
ধূ ধূ করে জ্বলতে থাকে রাবণ
কিন্তু মরে না,
ছোট ছোট কণায় শুধু
ছড়িয়ে পড়ে বাতাবরণে।
বছরভর
আমাদেরই চারপাশে
বহাল তবিয়তে সে বেঁচে থাকে
ভিন্ন ভিন্ন রূপে।
কাগজে রোজ ছাপা হয় তার ছবি,
টিভিতে তো সে ছেয়েই থাকে ;
সে উদ্বোধনের ফিতে কাটে
ইন্টারভিউ দেয়
বিদেশ সফরে যায়
কবিতা পড়ে
সমীক্ষা করে
শেয়ার বেচাকেনা করে
জেলও যায় কখনো সখনো …
চিনতে পারবে না তাকে।
কেননা, এ সবই সে
করে যায় ভিন্ন ভিন্ন রূপে।
যদি চিনতে চাও
ঝুঁকে দেখো তার চোখের দিকে,
যদিও, দেখতে সে দেবে না, তবুও
যখনই শুরু হয় নবরাত্র
তার একটি একটি কণা
জমতে শুরু করে, আর
দেখতে দেখতে দশম দিনে
সে হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ এক রাবণ।
যাকে তুমি পোড়াও
আর ভাবো
রাবণ মরে গেছে !
শুধু আমিই জানি —
রাবণ অমর।
••
উত্তরাধিকার
গান্ধীর মৃত্যুশেষে
অন্ধ জনতা পেলো চশমা,
ইংরেজ ঘড়ি নিয়ে গেছে,
চিতার আগুনে জ্বলে গেছে
তার ধুতি আর নীতি।
গান্ধীর লোকেরা পেলো রাজঘাট,
সংস্থাগুলো পেলো আত্মকথা আর ডান্ডা ;
আর নেতারা
পুরো দেশ হাতিয়ে নিয়ে ঘোষণা করছে :
গান্ধীকে না জানিয়েই আমরা
তাকে ভাগ করে নিয়েছি
নিজেদের মতো করে।
••
শুয়োর
কোনো এক জমানায়
শুয়োরের অবতার
ধারণ করে বিষ্ণু
বাঁচিয়েছিল পৃথিবীকে।
এ নিয়ে আজও
কিছু শুয়োরের খুব গর্ব।
আর এখন
পৃথিবী এদের থেকেই
বেঁচে থাকতে চায় !
••
রামকথা
অনাদি
অনন্ত
শাশ্বত
রামকথা।
নতুন নতুন প্রশ্ন নিয়ে প্রতি যুগই
নিজেদের মত করে রচনা করেছে তাদের রামকথা।
নিজেরই রামকথা নিয়ে বাল্মীকিও
বিষ্ণুর মত অবতরিত হন প্রতি যুগে।
আমি বাল্মীকি নই, তাঁরই অংশ।
রামকথা লেখার দায়িত্ব আমারও আছে,
কিন্তু রামকে রচনা করব সে সামর্থ্য কোথায় !
রাবণের কথাও বলব না।
শূর্পনখাকে অপহরণ না করে নেয় কেউ
তা নিয়ে রাবণের প্রবল দুঃশ্চিন্তা,
ঘোর অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে রাক্ষসকূলের,
মন্দোদরীকে নিয়েও বড় চিন্তা,
সন্তান আর সন্তানের মত প্রজাদের নিয়েও
তার দুঃশ্চিন্তার শেষ নেই।
ঘুমিয়ে কাটালে পুরো লঙ্কাটাই না বিক্রি হয়ে যায়
এই চিন্তায় দুদন্ড ঘুমোতে পারে না কুম্ভকর্ণ।
মেঘনাদের ব্যস্ততা
বিরোধীদের জয় করার জন্য নয়,
তাদের ক্রয় করবার জন্য !
আর রাবণের গগনচুম্বী মূর্তি নির্মাণে
আকন্ঠ ডুবে আছে তার সমর্থকদল।
এ জন্যেই, আমার ‘কথা’-য় রাবণ থাকবে না।
ধোপা, নিষাদ,শবরই শুধু নয়,
আমার রামকথায় থাকবে
রামের সমস্ত প্রজার কথা,
থাকবে, বলাৎকারের শিকার মেয়েটির কথাও,
প্রজারক্ষায় নিযুক্ত যে পুলিশ
ধর্ষিত মেয়েটির দাহ-সংস্কার করেছিল যে পুলিশ
থাকবে তাদের কথাও।
ধর্মের পথ ছাড়ে না যে আদালত
আর সেই ধর্মের আড়ালে থাকে যে মজুতদাররা
যাদের কাছে মনুষত্ব অর্থহীন
সেই ধর্ম আর আদালতের কথাও থাকবে।
সেই প্রথম, যেবার শ্রীরাম অবতার হলেন
তখন থেকেই শুধু মানুষ পরিচয়ের জন্যে
যে অজস্র মানুষের লড়াই জারি আজও —
তাদের কথা থাকবে আমার রামকথায়।
আমার রামকথায় সীতা
একা একা বনে যেতে অস্বীকার করবেন,
শম্বুক মারা যাবেন না বরং পূজিত হবেন,
হতাশ হয়ে যেন সলিল সমাধিস্থ হতে না হয় রামকে
সে চেষ্টাও থাকবে আমার রামকথায়।
আমার চেয়ে কে আর বেশি জানবে
ঈশ্বরের মরে যাওয়ার যন্ত্রণা ?
আমি যে বাল্মীকিরই বংশজ !
••
একটি অসমাপ্ত কবিতা
বালক দেখল —
হাল কাঁধে মাঠে চলেছে পুরুষ।
তৈরি করে নিয়ে নিজেদের
পুরুষেরা বেরিয়ে পড়ছে
অনেক অনেক কাজে,
সে দেখল —
সমাজের সবেতেই পুরুষ।
আর মায়েরা
ঘরে থাকে, দিনভর ম্লান,
করতেই থাকে কিছু না কিছু।
বালকের পৃথিবী ঘরের বাইরে,
বাইরে দেখে না সে মেয়েদের।
যদিও বা দেখে,
দেখে, কেউ কুড়োচ্ছে শুকনো পাতা,
পাতকুয়ো থেকে জল ভরছে কেউ,
কেউ ঘুঁটে দিচ্ছে, ধান রুইছে,
দুধ দুইছে কেউ কিংবা
কেউ ঝুড়ি নিয়ে বসে আছে কিছু বেচার…
এও কোনো কাজ হলো !
বালক মনে মনে ভাবে।
কাজ তো সেগুলোই —
হাল চালানো
ট্রাক্টর, মোটরসাইকেল চালানো,
পড়া পড়ানো, হিসাব-কিতাব,
তর্কবিতর্কে শামিল হওয়া
যা সব —
সবই বীরবিক্রম পুরুষের !
মায়েরা বসে থাকে উনুনের পাশে,
বাসন মাজে, আনাজ কোটে,
বাটনা বাটে, রান্না করে, খেতে দেয়,
পুরুষের কাছ থেকে তুলে নেয় এঁটো বাসন,
হাত ধুয়ে দেয়, টিপে দেয় হাত-পা,
ঘরে থেকেই দিনরাত করে সেবা …
আর বালিকারা
দুর্বল খয়াটে দুঃখী ছিঁচকাঁদুনে
মার খায় কথায় কথায়।
খুব বেশি হলে, যদি জোটে সময়
মনের কথা বলে পুতুলের সঙ্গে।
বালক নিবিড়ভাবে পুরুষকে দেখে
দেখে সে ক্ষমতা, দেখে পৌরুষ,
ধন-দৌলত দেখে, নাম-যশ দেখে
যা কিছু দেখে — সব সবই পুরুষের।
বালিকা কিছুই দেখে না,
তার সময় বড় কম —
তাকে হয়ে উঠতে হবে নারী।
আর এ জন্যেই
ঠিক করে দেখা হয়নি তার কিছুই,
কিছু জানাও হয়নি তার।
এ নিয়ে দরকার নেই চিন্তার
পুরুষই তাকে সব দেখাবে,
শেখাবেও সবকিছু —
একজন মহিলা বলে বালিকাকে,
মহিলার সব কথা মেনেও নেয় বালিকা।
বালককে কেউ কিছু বলেনি কখনও,
বালককে কেউ কিছু বলে না,
শুধু তাকে সমর্থ করে তোলা হয় !
সে যেন খানদান, পুরুষের খানদান
ইজ্জত আর পরম্পরাকে রক্ষা করতে পারে,
সে যেন পালন করতে পারে পরিবারকে,
পরিবারের মেয়েদেরকে।
আর সেই বালিকা
পুরুষেরই সহায়তায় জন্ম দেয় পুরুষদের,
জন্ম দেয় তারই মত মেয়েদের —
যারা এই পুরুষের দুনিয়ায়
কিছুই করে না, কখনো !
শুধু পুরুষের হয়ে বেঁচে থাকে,
বেঁচে থাকে পুরুষের জন্যে
তার শরীর মন আত্মা নিয়ে সারাজীবন !
মনে মনে ভাবে —
আহা ! কতই না ভালো
কিছুই করতে হয় না মেয়েদের
কিছুই সইতে হয় না ;
শুধু পুরুষ-ইচ্ছের নদীতে বয়ে যেতে হয়
নিষ্ক্রিয়, চুপচাপ !
••
বলদ পুজো
বছরে একটা দিনই বলদকে পুজো করা হয়।
ধুইয়ে, স্নান করিয়ে সাধ্যমত সাজানো হয় বলদ,
আরতি করা হয়, খাওয়ানো হয় রান্নাকরা খাবার
সাজিয়ে গুছিয়ে বের করা হয় ঝাঁকি
উৎসবের আমেজে পুরো পরিবার, পাড়াপড়শি
হর্ষোল্লাসে মাতে, বছরভরের মমতা
লুটিয়ে দেওয়া হয় এই একটা দিনে।
বলদও বেশ হতচকিত।
কিছু বুঝে উঠবার আগেই নেমে আসে সন্ধে
তারপর সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে লোকজনও
রাতভর মশগুল থাকে চর্চায় :
ট্রাক্টরের যুগে বলদগুলো আর
কোনো কাজের না হে !
না ঘরকা না ঘাটকা।
তবুও, একটা দিনের জন্যে হলেও
বলদকে পুজো করা হয়।
যাদের বলদ নেই নিজেদের —
পুজো করে তারাও অন্যদের বলদকে।
আর তারপর
গলি মহল্লা রাস্তায় ঘুরে মরে
আওয়ারা নিষ্কর্মা অসহায় হয়ে,
গোবর দুর্গন্ধে ভরা দুষ্কর জীবন নিয়ে
ঘুরে বেড়ায় দলে দলে।
অথচ ভয়েই প্রতিদিন পুজো পায় ষাঁড়
আর বলদ ?
যে ছিল একদিন গাড়ির সাথী,
যার শক্তি ছিল সামর্থ্য ছিল সম্বল ছিল
আজ শুধু সে
বয়ে বেড়ানোর মতো বোঝামাত্র !
কান্নাই যার সম্বল
তাও, বছরের একটিই মাত্র দিন
বাকি দিন ট্রাক্টরের, থ্রেশারের, মেশিনের …
ও সবও আর সবার কাছে কোথায় !
আজও অনেক লোকের কাছে তাই
বলদই সবকিছু,
বলদই বাঁচিয়ে রেখেছে পরম্পরা।
আর পরম্পরা হামেশাই তো বেঁচে থাকে
দুর্বল কাঁধ আর অসহায় হাতের ভরসায় !
তা না হলে কসাইখানায় পশুর ভিড় তো কম নয় !
••
আর এক আদিবাসী
আমাদের কাছে কোনো কাগজ নেই সাহেব।
আমাদের সবকিছুই চলে মুখে মুখে
মৌখিক আমাদের পরম্পরা —
মুখে মুখেই আমাদের বেঁচে-থাকা, বেড়ে-ওঠা।
তোমাদের লেখাপড়া থেকে
আমরা অনেক অনেক দূরে সাহেব !
এ নিয়ে আমাদের দুঃখও নেই কোনো।
তোমাদেরও তো শুরু এই জঙ্গলেই
সভ্য হয়ে তোমরা জঙ্গল ত্যাগ করেছো,
ছেড়ে দাওনি তবু জঙ্গলকে।
আমরা রসদ হয়েছি তোমাদের সভ্যতার
তোমাদের মহল, তোমাদের শিক্ষা,
তোমাদের খেলা, তোমাদের যুদ্ধ —
জঙ্গল নয়, যেন আমাদের শরীর কেটেই
বিকশিত হয়েছে।
আমাদের নৈবেদ্য করেই
গড়ে উঠেছে তোমাদের ভগবান।
তোমাদের ফূর্তি
বড় যন্ত্রণার আমাদের কাছে।
আমাদের বুকের ওপর দিয়েই প্রতিবার
ছুটে গেছে তোমাদের রেলগাড়ি,
যে কাগজের জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরছো
তাও বানিয়েছো জঙ্গলকেই দলে-পিষে।
তোমাদের কাগজ দেখেনি এই জঙ্গলকে,
তাই আজ জঙ্গলে এসেছো কাগজ চাইতে !
ঋষি মুনিরাও তো তোমাদের
আমাদেরই পাতার কুটিরে ছিল তাদের বাস
আমাদের বলিদান দিয়ে
জ্ঞান বিতরণ করেছে শুধু তোমাদের।
যখনই চেষ্টা করেছি প্রতিবাদের
আমাদের রাক্ষস বলেছো তোমরা,
উপেক্ষা করেছো ভাল্লুক বাঁদর বনমানুষ বলে।
তোমাদেরই আদি কবি তো বলেছিল —
আমাদের এক হাতে শাস্ত্র, অন্য হাতে অস্ত্র !
আর এখন,
তোমাদের শাস্ত্রের কাছে অবনত হই
অথবা মুখোমুখি হই তোমাদের অস্ত্রের।
তোমরা যুদ্ধে নিপুণ ছিলে
যুদ্ধই ছিল তোমাদের কারবার।
আমরা তো আজও
গাছের একটি সজীব ডালও কাটি না
পশুহত্যা করব কী করে ?
বুনো জন্তু থেকে বাঁচতে শুধু
হাতে নিয়েছি হাঁসুয়া।
তোমাদের আধুনিক অস্ত্রের কাছে
আমাদের পরাজয় তো অনিবার্য,
কিন্তু তোমাদের শাস্ত্র ?
যে শাস্ত্রে আগ্রহ ছিল না সেদিন,
এমনকি আজও !
যে শাস্ত্র তোমাদের করুণা শেখায় না,
প্রেম দয়া শেখায় না,
তা নিয়ে কী কাজ আমাদের ?
অরণ্য
তোমাদের সমৃদ্ধির উৎস হতে পারে
আমাদের কাছে তা কিন্তু আরাধনার।
আমাদের বেঁচে-থাকার আধার !
শুধু তোমাদের জন্যেই
তছনছ হয়েছে আমাদের সবকিছু।
আর নয়
আর একদমই নয় !
অরণ্য আমাদের —
কোনো প্রমাণ নেই আমাদের কাছে।
এর পরেও
যা-করার তোমাদের, করো।
আমরা এই জঙ্গল ছেড়ে,
জংলিপনা ছেড়ে কোথাও যাব না।
তার মানে এই নয়, হাতে অস্ত্র তুলে নেব
তোমাদের গল্পেই শুধু
আমাদের যাবতীয় হিংস্রতা ;
হিংস্রতা আমাদের জন্মগত নয়।
তবুও আমাদের যাদের হাতে আজ অস্ত্র দেখছো
সে সবই তোমাদের সভ্যতার ফসল !
ওরা তোমাদের খেলাই খেলছে
যে খেলার কোনো শেষ নেই।
তোমাদের সভ্যতার সামনে
আমরা দাঁড়িয়ে থাকব বুক চিতিয়ে,
আমাদের অসভ্যতাকেই সঙ্গী করে দেখতে চাই
কত ক্রুর হতে পারে তোমাদের মহান সভ্যতা !
আর দেখাতে চাই —
মারখাওয়া মানুষেরাই হারে না প্রতিবার,
যারা মারে, তারাও জেতে না সব সময় !
_______________________________
মূল হিন্দি থেকে অনুবাদ : স্বপন নাগ