স্রোত পর্ব ১২ <br /> যশোধরা রায়চৌধুরী

স্রোত পর্ব ১২
যশোধরা রায়চৌধুরী

২০১৩-১৪। কলকাতার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছেলেমেয়ে তৈরি করে একটা নতুন প্রবণতা। কয়েকটি মেয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিনকে পোস্টার হিসেবে ব্যবহার করে তোলপাড় তুলে দেয়৷ এরা সব কেমন মেয়ে? কী চাইছে এরা? এই সব নিয়ে ও বাঙালি মধ্যবিত্তের ভুবনায়িত মূল্যবোধ নিয়েই "স্রোত"৷ গ্রন্থাকারে 'স্রোত' নাম দিয়ে একটি অতি সীমিত প্রকাশনা প্রচেষ্টাও হয়েছিল। তবে প্রকাশক সব কপিশুদ্ধু গায়েব হয়ে যাওয়াতে, স্রোতকে পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত আকারে এবার আবহমানের পাঠকদের কাছে ধারাবাহিকভাবে হাজির করার প্রচেষ্টা । "সম্পূর্ণ ভাবে নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা এমন উপন্যাস আমি আগে পড়িনি। নারীবাদী লেখকের লেখা উপন্যাস পড়েছি। কিন্তু তাতে পুরুষের লোলুপতা কে কাঠগড়ায় দাঁড়করানো আর নারীকে শিকার প্রতিপন্ন করার চেষ্টায় প্রায়শই অবজেকট্ভিটি থাকেনি। এই উপন্যাসের শিকড় গেছে নারী জীবন যাপনের নানা স্তরে । এর মধ্যে আছে যে ভাষায় পুরুষতন্ত্র জীবনের ন্যারেটিভ এমনকি সাহিত্য ও রচনা করে , তার ইন্টারপ্রিটেশন। এতে স্পষ্ট কথা আছে, অভিমান আছে, হাস্যরস এবং অসহায়তাও আছে । এবং সর্বোপরি পুরুষকে নিজের জীবনে জড়িয়ে নেওয়ার আকাঙ্খা।..এখনকার ছেলে মেয়ে দের হাতে ই তুলে দেওয়া কাহিনীর ব্যাটন, এদের স্পস্ট করে দেখা, বলতে পারা ও অতীতের বোঝা নামিয়ে রেখে পথ চলার সাহস কে কুর্ণিশ জানিয়েছেন যশোধরা। মুক্তি এরাই আনবে। যৌনতার রহস্যময়তার আবরণ উন্মোচন করে তথ্যের নিরপেক্ষতার মধ্যে উত্তরণ।যশোধরার Clarity of perspective অতি তীক্ষ্ণ। সবমিলিয়ে উপন্যাস টি মনোভংগি ভাষা ও কাহিনী সর্ব অর্থে আধুনিক। একে বারে রিয়েল টাইমে দাঁড়িয়ে লেখা। দেশ কাল সময় ও ব্যক্তি সত্ত্বার বিশাল ব্যাপ্তিকে বিন্দুতে এনে কিভাবে প্রতিবাদের ভাষা নির্মান করেছেন যশোধরা। নির্য্যাস হয়ে মনে রয়ে যায়, পুরুষকে বিযুক্ত করার অভিপ্রায় নয়, তার সংগে আবার প্রথম থেকে পড়া জীবনের পাঠ।" ( অনিতা অগ্নিহোত্রী)

প্রথমার রবীন্দ্রসঙ্গীত

প্রথমা ব্যাঙ্গালোর থেকে শিফট করবে কলকাতায়। কাজের অছিলা। কিন্তু সুস্নাত বুঝতে পেরেছে। বুঝেও উদাসীন।
উদাসীন নয় সুনন্দনা। মেয়ে কষ্টটা পেয়েছে ঠিকই। কিন্তু মাকে যেতে দিতে রাজি। মেয়েই বেশি করে বলেছে। মা, এবার তুমি নিজের কেরিয়ারটা দেখ। দাদুর বাড়িটাও লুকিং আফটারের অভাবে নষ্ট হচ্ছে।

মনে মনে নিজেকে দশ হাজার বার বলে প্রথমাঃ সুস্নাত পর্ব ওভার হয়ে গিয়েছে ।
এক লাইনে লেখা খুব সোজা। আসলে নিজের কাছে নিজেই হেরে যাওয়ার ইতিহাসটা কুড়ি বছরের পুরনো হতে। নিজের কাছে বিষয়টা এখনো সমান দগদগে। সমান ব্যাথাতুর।
তবু বিচ্ছেদ হতই, সেটা গত মাসে একটা কাজের অফারের সঙ্গে সঙ্গে নির্ধারিত হয়ে গেছে। সুনন্দনার অনুমতি নিয়ে, সুনন্দনার বাবা মা আলাদা থাকবে, ঠিক হয়ে গেছে। সম্মতি দিয়েছে মেয়ে। কী অদ্ভুত। এই জিনিশও জীবনে হতে পারে, কোনদিন ধারণার মধ্যে আনা যেত দশ বছর আগেও? বাইশ বছরের মেয়ের অনুমতি নিয়ে আলাদা হয়ে যাচ্ছে পঞ্চান্ন আর সাতান্ন বছরের বাবা মা?

সুনন্দনা নিজের ঘরেই আজকাল সারাদিন থাকে। খুব মন খারাপ করেই থাকে। তবে টুঁ শব্দটি করেনা। মায়ের চলে যাওয়ায় ওর ভেতরের রক্তক্ষরণের কথা মাকে বা বাবাকে জানতে দেয় না।

নিজেই বলেছে, নিজের খাবার তৈরি করে নিতে পারে সুনন্দনা এখন। কিচেনে কোন তাকে কী থাকে ওর নখদর্পণে। আগে শখে বেকিং করত কেক, কুকিজ, এটা ওটা সেটা। এখন ভাত ডাল ও শিখে নেবে। দাঁতে দাঁত চেপে মেয়ে ইউটিউব থেকে ডাউনলোড করছে রান্নার রেসিপি।

কুড়ি একুশ বছরের একটি মেয়েকে আজকাল আর মায়েদের দরকার হয়না। বরং মা যদি নিজের দিকটা নিজে দেখে, তাতে সবাই নাকি মোর কমফর্টেবল থাকবে। এরকম একটা কথা মেয়ে বলেছে, মাকে।

না, দেশটা ত আমেরিকা হয়ে যায়নি। বিলেত হয়ে যায়নি। যে ছেলেমেয়েরা আঠারো হলেই অন্যত্র চলে যাবে। আলাদা বাড়িতে থাকবে। বাবা মায়ের সঙ্গে থাকা আউট অফ ফ্যাশন নয় এখনো এ দেশে। আর মেয়ে সন্তান, তাকে ত একদা মনে করা হত বোঝা। এখন বোঝা ভাবেনা কেউ। তবু , সুনন্দনাকে ছেড়ে বদলি নিয়ে প্রথমার চলে যাওয়া… খুব হৃদয়বিদারক। অন্তত প্রথমার কাছে।

যাবার আগের দিন, প্রথমা গত এতগুলো বছরের মধ্যে এই প্রথম বার বার মাঝরাত্তিরে জেগে উঠেছে, কষ্টে। বুকের মধ্যেটা ভেঙেচুরে গেছে তার।

তারপর নিজেকে বুঝিয়েছে। এর আগেও ত কত কত রাত সে নিজের একলা ঘরের বালিশ আঁকড়ে কেঁদেছে, বলেছে, সামবডি হেল্প মি। আমাকে কেউ আদর দাও। তারপর চোখ মুছে ঘুমিয়ে পড়েছে। কেননা, পাশ থেকে আদর করার লোক নেই। আর , সে তো স্বঘোষিত স্বাধীন মহিলা। আর তার স্বামী উদাসীন।

স্বাধীন মহিলা হবার দাম দেদার বিভ্রান্তি আর অনেকটা দমবন্ধকরা একাকীত্ব। এটুকু বুঝেছে। বার বার নিজেকে বুঝিয়েছে, আজ সুস্নাতর বন্ধুরা লাইন দিয়ে এসে ওদের বিবাহের বিফলতা নিয়ে টীকা টিপ্পণী কাটলেও, গত কুড়ি বছরই আসলে প্রথমা ছিল একা। তবে হ্যাঁ, জীবনে তথাকথিত সফল সুস্নাতর বাড়ি ঘরদোরের কমফোর্ট জোনের লোভেই সে ছেড়ে যেতে পারছে না এই সংসার, অথবা সুনন্দনা বড় হওয়া অব্দি অপেক্ষা করতে হয়েছে। যে কারণেই হোক, গত এতদিন ও নিজেকে ক্ষমা করতে পারেনি, এতদিন ও নিজেকে দুষেছে।
এখন নিজের মাথার ওপর থেকে উঠে গেছে অপরাধবোধের বিশাল বোঝা। অন্যরা এখন তাকে দুষুক যতখুশি। তার নিজের বিবেক পরিষ্কার।

প্রথমা দ্রুত নিজের জিনিশ গোছাচ্ছে, আর প্রতিমুহূর্তে মাথার ভেতর কাজ করে চলেছে এই সব যুক্তি, প্রতিযুক্তি। কথা, কথার বিপরীতে আবার কত কথা। বারান্দার গাছ ছেড়ে যাবার কষ্ট, নিজের অর্ধেক জামাকাপড় যা এতদিন ধরে জমা হয়েছে আলমারিতে, এগুলো ছেড়ে চলে যাবার কষ্ট, এগুলোও কম কষ্ট নয়, নিজের সম্পর্কগুলোকে ছেড়ে চলে যাবার কষ্টের থেকে। স্মৃতি, হ্যাঁ স্মৃতিগুলোকে ছেড়ে যাওয়াও কষ্ট খুব।
ও দু তিনটে স্যুটকেস গোছাচ্ছে। আর ঘরে টিভি চলছে।
টিভিতে পৃথিবীর নানা দেশের খবর দেখাচ্ছে। আল জাজিরা, বিবিসি দেখাচ্ছে, নাইজেরিয়ার ৩০০ টা মেয়েকে ইস্কুল যাওয়ার অপরাধে বোকো হারাম কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়ে হোস্টেজ করে রেখেছে। দেখাচ্ছে, ইউক্রেনের সবকটা শহরে রাশিয়া পন্থী আর ইউক্রেন পন্থীদের মধ্যে মারামারি হচ্ছে। আগুন, ধোঁওয়া, কিছু সাদা মানুষের লাশ। আচ্ছা, ওরা প্রথম বিশ্বের মত সাদা চামড়া, অথচ দ্বিতীয় বিশ্ব। এতদিন লৌহ কপাটের আড়ালে ছিল। এখন স্বাধীন , কিন্তু অর্থনৈতিক অবস্থা তৃতীয় বিশ্বেরই কাছাকাছি।
কী সুন্দর দেখতে ওরা।
কোনদিন সুন্দর দেখতে ছেলেদের সঙ্গে প্রেম করা হল না। মা খুব কড়া ছিল।
কিন্তু সুস্নাত যখন জীবনে এল, তখন মায়ের থেকে দূরে, অনেকটাই দূরে প্রথমা।
সুস্নাত সুদর্শন না হতে পারে, খুব শান্ত মিষ্টি আর মাটির মানুষ। চোখের রঙ কেমন? আগে বাদামি ছিল। অনেকদিন ঠান্ডা কুঁজোর জল খাওয়া হয়নি। এরকম এক তৃষ্ণা জাগত তখন ওর মনে।
দার্জিলিং এ প্রথম যখন আলাপ, তখন যেদিন সুস্নাত ফিরে যায়, আর প্রথমা থেকে যায়, সেই দিন ও মনে মনে একটা গান গেয়েছিল। মোহরদির গলায় শোনা সেই গান । তুমি যেও না এখনই, এখনো রয়েছে রজনী।
ফিরে এসে, কলকাতায় বার বার দেখা হয়েছে। একটা বৃষ্টিভেজা বিকেলে দেখা হয়েছিল ওদের কফি হাউজে। সারা গা থেকে টপটপ জল ঝরছিল সুস্নাতের। প্রথমারও। ওরা মুখোমুখি বসে কফি নয়, ইনফিউশন খেয়েছিল। সেদিন নিজেদের পছন্দ, অপছন্দ, ভাল লাগা, মন্দ লাগা, কাজের প্রেফারেন্স অনেক কিছু বলেছিল।
শুধু একটা জিনিশ বলতে ভুলে গেছিল প্রথমা। রবীন্দ্রসঙ্গীত । মনে মনে শুধু গান হচ্ছিল। এমনও দিনে তারে বলা যায়। এমন ঘনঘোর বরষায়।
একটা বিকেলে , প্রথম চুমু খাওয়ার দিন , সল্ট লেকের বনবিতানের কুঞ্জে। কুঞ্জটায় ঢুকে সুস্নাত বলেছিল, এখানে চুমু না খাওয়াটাই অশ্লীল।
সেদিন ওরা কেউ ফিরে যেতে চায়নি। কিন্তু আলটিমেটলি বাড়ি ফিরতে হয়েছিল। যার যার বাড়ি। ওরা ভেবেছিল, আর না, এবার পরস্পরকে ছেড়ে থাকব না আর। এবার বিয়ে করে নেব।
না, সেদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত ভাবেনি প্রথমা। শুধু সুস্নাত, সুস্নাতর শরীর ভেবেছিল। আকুল হয়েছিল, আর ভেবেছিল, এখন তো ফিজিকাল রিলেশন করাই যায়। কিন্তু মা, মা-টা! আর ফেরার পথে ও ও ভেবেছিল , মাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার একটা জাস্টিফিকেশন হিসেবেই সুস্নাতকে আঁকড়ে ধরছে না তো?
মা কী বলবে, ভেবে একটু ব্যথা। অল্প। চিনচিন। জানত না তখনো, সামনে হিন্দি ছবির মত সিমেন্টের বিশাল দেওয়াল ভাঙার কাজ। কোন রবীন্দ্রসঙ্গীত যুঝতে পারে না যার সঙ্গে।
মা, মা-ও কি বুঝেছিল? তাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছে প্রথমা? তাই এত রেজিস্টেন্স? এভিডেন্স ছিল? ওর চাউনিতে, ওর ব্যবহারে? ওর অফিস থেকে ফিরেই বিস্কুট কিনে না আনতে চাওয়ায়? ময়দা ফুরিয়ে গেছে শুনে ঝাঁঝিয়ে ওঠায়? রোজকার থাকায়?
তারপর একদিন প্রথমার বাড়িতে সুস্নাত যায়, ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলতে। মায়ের মুখ কঠিন হয়ে যায়। তখনো ঐ ঘ্যাম চাকরি পায়নি সুস্নাত। তবে পাওয়ার জুতো পরে। ওর সঙ্গে সুস্নাতর কোন এক বারে গিয়ে বিয়ার খাওয়ার ছবি মাকে ইতিমধ্যেই এক মাসতুতো দাদা দেখিয়েছিল।
প্রথমা এবার বিদ্রোহ করেছিল। ওর জীবনে বিদ্রোহের ওটা শুরুও না, শেষও না। সারাজীবনটাই বিদ্রোহের সঙ্গে ঘর করতে হবে, জানত না নিজের বিধির নির্দেশ, প্রথমা।
বিদ্রোহের অব্যবহিত ফল, মায়ের চোখের ওপর দিয়ে সুস্নাতকে নিজের সংরক্ষিত অঞ্চল, বাড়ির চিলেকোঠার ঘরটায় তুলে আনা। প্রথমবার শরীরী মিলন। কিন্তু শরীরী মিলনের দিন কোন আনন্দ পায়নি সুস্নাত। প্রথমাও। বড্ড তাড়াহুড়ো ছিল। আর ভুল করে প্রথমা বলেছিল, মা তোমার সম্বন্ধে কয়েকটা কথা জানতে চেয়েছে। তুমি রেগুলার ড্রিংক কর কিনা। ইয়ে, আমি জানতে চাইনি কিন্তু।
সুস্নাত গুম হয়ে গেছিল। বড্ড শান্ত আর ঠান্ডা আর মিষ্টি ছেলে ও। তাই আর কিছু বলেনি। শুধু উঠে, প্যান্ট পরে জিপ টেনে , শার্ট গায়ে গলাতে গলাতে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিল। পথ আটকেছিল প্রথমা। প্লিজ , যেও না, প্লিজ। তোমাকে বলতে হবে না উত্তরটা। মাকে আমি বকে দেব। ম্যানেজ করে নেব। প্লিজ।
আমি মদ খাই গাঁজা খাই ব্রাউন সুগার নিই। আমি অনেক মেয়ের সঙ্গে প্রেম করেছি, শুয়েওছি। আজ আমার শোয়া দেখে বুঝতে পারলে না? মাকে বলে দিও।
সুস্নাত এরকমই । ঠোঁটকাটা, দুর্জনে বলে সৎ।
কিন্তু প্রথমাও তো নিজে এরকম। আর চেয়েওছিল এরকমই কারুকে।
কেঁদে ফেলেছিল। প্রথমা নিজের গরম অশ্রু চাটতে চাটতে, বলেছিল, যেও না।
রবীন্দ্রসঙ্গীত মাথায় বেজেছিল। তুমি যেও না এখনই।
আর একদিন বলেছিল প্রথমা। আমি কোনদিন তোমাকে ঠকাব না সুস্নাত, আমি কোনদিন তোমাকে ভাল না বাসলে বলে দেব আর ভাল বাসি না। কিন্তু এবারও সুস্নাত চলে যেতে চেয়েছিল। রেগে। ‘মামদোবাজি! আমি তোমার ব্যাপারে পোজেসিভ, জেনে রেখো। অন্য কোন ছেলে সিনে ঢুকলে কিন্তু খুন করে দেব। যতই আমি ঠান্ডা আর মিষ্টি হই না তোমার কাছে। এই একটা ব্যাপারে আমাকে তুমি এখনো চেনোনি।‘ আবার উঠে যাচ্ছে, আবার প্রথমা রাস্তা আটকেছিল। “যেও না”।
ব্যাগ কাঁধে সারা কলকাতা চষে চষে প্রেম করে ক্লান্ত হয়ে বিয়ে করেছিল ওরা। এই কয়েক বছরে দুজনেই দুজনের সঙ্গে মান অভিমান করেছে। কিন্তু অল্প। প্রথমার ভাল্লাগতো, “তোমাকে কিন্তু যে কোন সময়ে ছেড়ে চলে যেতেই পারি “ এটাই বলতে। আর শুনলেই রেগে উঠে যেত সুস্নাত।
কিন্তু বিয়ের পর থেকে ব্যাপারটা উলটে গেল।
প্রেম করতে করতে হাঁই হাঁই করে হাঁপাতে হাঁপাতে সুস্নাত বলত, তোমাকে সব দিতে পারি, সব দিয়ে দেব। কিন্তু আলটিমেটলি কিছুই দিতে চাইল না, মানে দিলেও, সেটা অন্যদের, নিজের বন্ধুদের, বাবা মাকে সবাইকে ভাগ করে দেবার পর যেটুকু উদবৃত্ত সেটুকুই। কীভাবে যে বিয়ের পর সব উলটে যায়!
ঝগড়া শুরু হল । প্রথমা দেখল, সুস্নাত মোটেই পোজেসিভনেসটাকে দ্বিপাক্ষিক করতে চায়না।
শুরুর দিকে যে কটা ঘটনা ওদের দাম্পত্যকে প্রচন্ড টেনশনে ফেলে দিয়েছে তার ভেতরে একটা ঘটেছিল বিয়ের কয়েকবছরের মধ্যে। সেই প্রথম বুঝেছিল, সুস্নাত সন্দেহ করে।
তার থেকেও হাড় হিম করা সত্যটা এটাই ছিল, প্রথমা বুঝেছিল, বিবাহ বা দাম্পত্যসম্পর্ক দাবিই করে যে স্বামী স্ত্রী পরস্পরকে সন্দেহ করবে।
সন্দেহ করল কেন সুস্নাত?
কত তুচ্ছ কারণ সেটা। সলিড কোন কথা নয়। অবান্তর ব্যাপার। এখনো প্রথমা ভাবে আর অবাক হয়। অবিশ্বাস্য লাগে। সুস্নাত যে ওকে এতদিন চিনত, চিনেছে, হঠাৎ ভুলতে বসেছিল। অচেনা লাগতে শুরু করেছিল সুস্নাতকে, মনে হয়েছিল, এটা কি ওর মানসিক বিকার?
বিসমিল। ছেলেটা ওদের সংসারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। প্রথম সংসারে ঢুকে নানা কাজে এদের ভূমিকা ছিল। এরা ওর ম্যান ফ্রাইডে। গ্যাস ফুরোলে বিসমিল, হঠাৎ ওষুধ বিশুধের দরকারেও। কার্পেন্টার বা প্লাম্বার ধরে কাজ করিয়ে দিতেও।
আসলে সুস্নাত যা যা এড়িয়ে যেত কাজের চাপের দোহাই দিয়ে সবই।
সেই বিসমিলকে ও রাখী বাঁধবে বলেছিল। বিসমিল ওকে বা-জী বলত। মানে দিদি। আর সুস্নাতকে জিজাজি। আসলে সম্পর্কটা কেন দাদা বৌদি না, কেন দিদি জামাইবাবু, এই জায়গাটায় বোধ হয় আঁতে ঘা লেগে গেছিল সুস্নাতর।
চিবিয়ে চিবিয়ে ওকে বলেছিল, আমার যে একটা ব্রাদার ইন ল আছে আগে জানতাম না ত! আর রাখীটা বাঁধবে এটা আমাকে বলার প্রয়োজন নেই বুঝি? আমাকে কাজের লোকের মুখে শুনতে হল এটা। গোপনে রাখী বাঁধছ আজ, কাল কী করবে ছেলেটাকে? আর এস এস –এ জয়েন করে নেব ভাবছি। প্রথম বের করে দেব বাড়ি থেকে এই মুসলমানটাকেই।
কাজের লোক সুমতি, যে ওর ব্যাপারে ওর শাশুড়ির কাছে স্পাইগিরি করে সব খবর দিত, সেই দাদাবাবুর কানও ভারি করেছে।
এত নোংরা কথা জন্মেও শোনেনি প্রথমা। আর ও যে একনিষ্ঠ সুস্নাতর প্রতি, সেই সত্যটাকে ও এতটাই স্বতঃসিদ্ধ মনে করত, যে, এরকম একটা সন্দেহ যে কোনদিন নোংরা শ্বাপদের মত সুস্নাতর চোখ থেকে ঝরে পড়বে ভাবেইনি কোনদিন।
স্তম্ভিত হয়ে গেছিল।
নিজের বড় হয়ে ওঠার গভীর লিবারাল, ধর্ম নিরপেক্ষতার, পরিশীলনের স্টিলের বলয়ে আঁচড় কাটতে পারেনি সুস্নাত। ও স্থির ছিল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিল, আমার সম্পর্কগুলো নিয়ে তোমার মাথা না ঘামালেও চলবে।
অথচ এখনো সুযোগ পেলেই সুস্নাতর, ওর ফোন খুলে মেসেজ পড়ার অভ্যেস গেল না। কতবার বলেছে প্রথমা , ব্যক্তিগত অধিকারের সীমানা লঙ্ঘন কর না। তারপর ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়েছে।
তারপর থেকেই বোধ হয় সুস্নাতর ব্যাপারে প্রথমা কিছুতেই পোজেসিভনেস দেখাতে পারল না।
তারপর পনেরো বছর কেটে গেছে। মিথ্যে কথা বলা খুব ভাল, খুব প্রয়োজনীয় দাম্পত্য জীবনে, কিন্তু তাও মিথ্যে কথা বলতে শেখেনি প্রথমা।
কিন্তু মিথ্যে বলতে তো শিখতেই হয়। পনেরো কুড়ি বছরটাও তো কম নয়।

কিন্তু তবু, প্রথমা, পনেরো বছরের দাম্পত্যে একবারও সুস্নাতকে ছেড়ে চলে গেল না। প্রথমদিকে রক্ত গরম ছিল বলে, বলত যাবে। যেতেও চেষ্টা করত, কিন্তু সুস্নাত জেনে গেছিল এগুলো ওর ফাঁকা আওয়াজ । তাই আর আটকাত না। রাখাল ছেলের বাঘ বাঘ চীৎকারের মত। তাই মান ভাঙাতও না। ক্লান্তভাবে বসে থাকত, প্রথমা রেগে “ছেড়ে চলে যাবার” ভাণ করত।
তারপর ও নিজেই তিনটে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়ে আবার ফিরে আসত, তারপর সুস্নাতর গলা জড়িয়ে হু হু করে কাঁদত।
তখন কোন বাড়িতে থাকা হবে তা নিয়ে তুমুল খন্ডযুদ্ধ চলছিল, ওদের ভেতরে , তখন বহুবার প্রথমা খাটের প্রতিটি মশারির রড খুলে ফেলে দিয়েছে, আলমারির জামাকাপড় বার করে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। সুস্নাত গুম হয়ে বসে থেকেছে।
প্রথমা ওর শ্বশুর শাশুড়ির ইন্টারফিয়ারেন্স সহ্য করতে পারেনি, তাই ও বেরিয়ে যেতে চেয়েছে। বিবাহিত জীবনের কনস্ট্যান্ট নজরদারি, সবাইকে বলে বাড়ি থেকে বেরও, এমনকি বর তার প্রতি গতিবিধির খুঁটিনাটি জানতে চাইবে…এসব তার অসহ্য লাগত। প্রথমার আসলে কোন ধৈর্য নেই, সবার সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা। তাই ও পারত না।

উল্টোদিকে, সেই ইগোটা প্রথমা দেখাতে পারেনি। যখন উঠে চলে যেতে চেয়েছে সুস্নাত। প্রথমা তখন , প্রতিবার দরজা আটকেছে। প্রতিবার ঝগড়া থামিয়েছে। প্রতিবার ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে, বলেছে , যেমন ইতিহাসের নারীরা বলে, তোমার পায়ে পড়ি, রাগ কোর না! সব ঠিক করে দেব আমি, সব।
তুমি! তুমি, কী করতে পার প্রথমা। কী তোমার ক্ষমতা! কী তোমার এলাকা? এতটা কনফিডেন্স কোত্থেকে পাও যে সবকিছু তুমি ঠিক করে দিতে পার? কিচ্ছু পার না ঠিক করতে তুমি, বরং সব খারাপ করে দিচ্ছ প্রথমা, সব , সব খারাপ করে দিচ্ছ।

একটা সময়ে সুস্নাত আর প্রথমা দুজনেরই বয়স হয়ে যায়। ততদিনে গোধরা হয়ে গেছে, গুজরাত দাঙ্গা হয়ে গেছে। একটা সময় সুস্নাতর বি পি হয়েছে, প্রথমার সুগার। ততদিনে পশ্চিমবঙ্গে চৌত্রিশ বছরের রাজনৈতিক ফ্রন্টটির পরিবর্তন হয়ে গেছে।

জীবনে এসে গেছে স্মার্ট ফোন। আর, ধীরে ধীরে সুস্নাতর সঙ্গে ওর সম্পর্কটাও নিভে গেছে। পাকাপাকিভাবে মেনে নিয়েছে ওরা দুজনেই। একদিন হঠাৎ দুজনে দ্বিপাক্ষিকভাবে মেনে নিয়েছে এই নেগেটিভিটি ভাল নয়। এই ছটফটানি ভাল নয়। এভাবে পরস্পরের জীবনকে ক্ষতবিক্ষত করা ভাল নয়।
আরো নেগেটিভিটির জন্ম দেবার আগেই সুনন্দনাকে সাক্ষী রেখে ওরা আলাদা হয়ে যায়। ওদের ঝগড়া দেখলে আগে সুনন্দনা কেঁদে ফেলতে, ছোট্ট সুনন্দনা।
এখন আর কাঁদেনি।
মাকে বলেছে, মা, তোমার যদি মনে হয় ইউ আর কমপ্রোমাইজিং উইথ বাবা, তাহলে তুমি নিজের মত থাকো। আমার কোন আপত্তি নেই। তবে আমাকে তো এখন পাঁচ বছর ব্যাঙ্গালোরেই থাকতে হবে। লেট মি লুক আফটার বাবা। তুমি যাও।
কী শক্ত আমার মেয়েটা। প্রথমা আশ্চর্য হয়ে গেছে। আনন্দে বুক ফুলে উঠেছে। কষ্টে বুক ফেটেও গেছে।

সব স্মৃতিকে, ভুলভাল ওই সম্পর্কটার সব পিছুটানকে দূরে সরাতে সরাতে, কষ্ট পেতে পেতেও, কলকাতায় ফিরে এল প্রথমা। মায়ের বাড়িতে গিয়ে দেখল বাড়িটা মায়ের মৃত্যুর পর কীভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। খুব কষ্ট হল, ভীষণ কষ্ট। তারপর আবার মানিয়ে নিল নিজেকে। টুকটাক রিপেয়ার করে থাকাও শুরু হয়ে গেল ওখানেই।
নিজের চেতনার আনন্দ যতটা পারা যায় খুঁড়ে তুলল। ঝড়ঝাপটার এই পর্ব একদিন কেটে যাবেই।
ভেবে দাঁতে দাঁত চেপে আবার নিজেকে স্থিতু করল, কলকাতার পুরনো পরিচিতিগুলোকে জাগিয়ে তুলল।
আবার গেল যাদবপুর। নিজের পড়াশুনোর আলমা মাতের, স্মৃতিমধুর আশ্রমের মত সেই জায়গাটায়। ফিরে গেল, কিন্তু এই গত কয়েকবছরে সব কিছু পালটে গেছে। তার যাদবপুরও গেছে । প্রথমার মনে হল অন্যরকম হয়ে গেছে আবহ। আর, এতদিন ব্যাঙ্গালোরে সুস্নাতর দামি চাকরি বিশাল ফ্ল্যাট, ওর নিজের এন জি ওর অন্যধরণের কাজ কর্ম করে ওর কলকাতার বাজারে খুঁটে খাওয়ার ক্ষমতা চলে গেছে।
যা পাওয়া যায় তাই সই, বলে ও মানবী বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের ডকুমেন্টেশনের কাজে ঢুকে পড়ল। ধাঁ করে।
টালমাটাল তরণী ধীরে ধীরে ঠিক হবে। মৃদু বাতাস বইবে আবার। সেই আশা, আস্থা নিজেকে দিতে চাইল।
রাত্রিবেলা সুনন্দনার সঙ্গে স্কাইপে আড্ডা দেয়। আর সকালটা লেখালেখি করে। দুপুরে অফিস যায়।

যে কোন গাড়িঘোড়ায় ,ওয়াশিংটন ডিসি থেকে কলকাতা, লন্ডন মেট্রো থেকে হাওড়া হাবড়া লোকালে, পরিপার্শ্ব ভুলতে আজকাল স্মার্টফোণ বার করে ইয়ারফোন কানে ঠুশে, বসে পড়ে সবাই। যাদবপুর যাবে বলে, অটোতে উঠেই, কানে গান গুঁজে অফিসের পথে অটোতে উঠে প্রথমা হঠাৎ খেয়াল করল, ও আবার রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা শুরু করেছে।
রবীন্দ্রসঙ্গীত ও স্টুডেন্ট লাইফে শুনত। বিয়ের পর থেকে ওর রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা বন্ধ হয়ে গেছিল পুরোপুরি। তারপর থেকে আজ অব্দি কখনো শোনেইনি গানগুলো।
কী যে হয়েছে প্রথমার, ও এখন রাশি রাশি এম পি থ্রি লোড করছে ফোনে, আর শুনছে।
হঠাৎ খেয়াল করল, ঠিক পনেরো থেকে কুড়ি বছর ও রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনেনা। হ্যাঁ সুস্নাতর সঙ্গে তো ওর কুড়ি বছরেরই আলাপ। সেই যে, দার্জিলিং এর ম্যালে আলাপ।
সুস্নাত, শান্ত , শিষ্ট, নরম ছেলে। ম্যাচো নয়, বড্ড ঠান্ডা ঠান্ডা ও। শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত ভালবাসত না , ক্ল্যাসিকাল হিন্দুস্তানি বেশি ভাল বোঝে বলেই, ওর জানত, রবীন্দ্রসঙ্গীতের পুরোটাই লিরিক, কোন গানই না ওটা, কোন সুরই নেই ওতে। ন্যাকামি করে চিবিয়ে চিবিয়ে গানগুলো শোনে কী করে লোকে!
তারপর থেকেই প্রথমাও তো হাসত, রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনলে ওরও তো হাই উঠত। আজ আবার শুনছে। এই রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা ফিরে এল সুস্নাত জীবন থেকে বেরিয়ে চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই।
ও ভুলেই গেছিল, রবীন্দ্রসঙ্গীত ভালবাসে ও।

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes