
সৌরভ চক্রবর্তীর গল্প ‘বাড়ি ফেরার রাস্তা’
গত বছর বর্ষাকাল পড়ার কিছু আগে, এক রাত্রে বাড়ি ফেরার সময় অতীন বাড়ির রাস্তা ভুলে যায়। ধরা যাক সে-বার খুব গরম পড়েছিল। আমের ফলন ভালো হয়েছিল। বর্ষার আশায় দিন গুনতে গুনতে খানা-খন্দ-পুকুর শুকিয়ে খটখটে হয়ে গিয়েছিল। এরকমই কোনো এক বছরে এই ঘটনা ঘটে। বড় রাস্তা থেকে বা-দিকে সে তার বাড়ির রাস্তায় ঢোকে। কিছুদূর হাঁটে। ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে দেখে অচেনা তল্লাট। দাঁড়িয়ে পড়ে অতীন। ভালো করে আবার চারদিক দেখে। হ্যাঁ, অচেনা। ল্যাম্প পোস্টের আলোর ঔজ্জ্বল্য মাপে। অচেনা তা-ও। তারপর জুতো ঘসে বোঝার চেষ্টা করে রাস্তার বয়স। ঠিক নাগাল পায় না। সবশেষে গাছের বাকল জরিপ করে এবং বাতাসের গন্ধ নেয়। হাতের তালুতে গাছের বাকল শিহরণ তোলে না, আর বাতাসে পরিচিত পিপুল পাতার গন্ধ নেই। অতীন ঘুরে দাঁড়ায়। ফিরে আসে বড়ো রাস্তায়। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। বড়ো রাস্তা যদিও তার অন্য দিনের মতোই চেনা: শিরীষ গাছ, অধরের ঝুপড়ি, লিচু তলা— চেনা সবই। ভাবে অতীন, আর একবার বাড়ির রাস্তায় ঢুকবে কি না। আকাশে তারা দেখা যায়। মেঘ দু’এক টুকরো উড়ে চলে। অন্য কোনো দেশে, যেখানে সন্ধে হচ্ছে, সেখান থেকে আলো এসে এই রাতটার উপর আলতো বিছিয়ে থাকে। কিন্তু, আর একবার ওদের বাড়ির রাস্তা কিংবা যে-রাস্তা ওদের নয়, সে-রাস্তায় ঢুকবে কি না, সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারে না অতীন। এমন সময়, একটি বাইক তার সামনে এসে দাঁড়ায়। নিস্পৃহ দৃষ্টি মেলে অতীন বাইক এবং তার আরোহীর দিকে, কিছু বুঝতে চেষ্টা করে না, কেবল তাকায়। বাইক চালক অপ্রত্যাশিত কণ্ঠে ওকে বাইকে উঠতে বলে এবং বাড়িতে পৌঁছে দেবে এই প্রতিশ্রুতি দেয়। একটু ভেবে, কিংবা না ভেবেই অতীন পেছনে উঠে বসে। দেরি না করে চালক ছেলেটি বাইক ছোটায়। চলন্ত বাইকে হাওয়া লেগে ওর জামার ভেতরে গেঞ্জির ঘাম শুকোতে শুরু করেছে দেখে অতীন জিজ্ঞেস করে, আমরা কোথায় যাচ্ছি? ততক্ষণে বড়ো রাস্তা থেকে বাইক একটা ঝামা পাতানো এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় এসে পড়েছে। অন্ধকার গ্রামের পথ। ঝিঁঝি-ডাকা, নির্জন, ভূত-বেড়ানো গ্রাম। বাইক চালক উত্তর দেয় না। গ্রামের রাস্তায় গোরুর গায়ের গন্ধ ভেসে বেড়ায়। ভেসে বেড়ায় বাদুরের ডানার তীব্র স্যাতসেতে শব্দ। অতীন মনে করার চেষ্টা করে, ছেলেটি তাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে বলেছিল। ফলে আবার বলে, বাড়ি যাচ্ছি তো? বাইকের শব্দ আর আলো, অন্ধকারে আস্ফালন ছড়াতে ছড়াতে এগিয়ে যায়। ছেলেটি এবারেও কোনো উত্তর দেয় না। তখন অতীন ভয় পায়? হয়তো পায়; কিংবা পায় না। দেখা যায়, সে আর কিছুই জিজ্ঞেস করে না ছেলেটিকে, বাইকের পেছনে বসে অনির্দিষ্ট অন্ধকারের দিকে ছুটে চলে। অনেকক্ষণ ছুটে চলে; চলতে চলতে কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে সে। যখন ঘুম ভাঙে, দেখে, সে বড়ো রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। বড়ো রাস্তা, যা কিছুক্ষণ আগেও চেনা ছিল, এখনও একই রকম: চেনা ল্যাম্প পোস্ট, শিরিষ গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে পঞ্চমীর চাঁদ ডুবে-যাওয়া আকাশ এবং রাস্তায় জুতো ঘসে বুঝে নেওয়া যায় রাস্তার বয়স। কিন্তু, তার বাড়ি যাওয়ার রাস্তাটা ঠিক কোথায়! অতীন আবার চিন্তায় পড়ে যায়। শ্বাস নেয়, শ্বাস ছাড়ে। গাছ দেখে, দেখে না। আকাশের বর্ণ ছোঁয়, আবার ছোঁয় না। আচমকাই, কিছু বুঝে ওঠার আগেই এবার বাড়ির রাস্তা দেখতে পায়। বড়ো রাস্তা থেকে বায়ে সোজা চলে গেছে সে রাস্তা। ল্যাম্প পোস্টের আলোর ঔজ্জ্বল্য তার চোখে ধরা পড়ে যায়। সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। বাড়ির দিকে পা বাড়াতে যাবে, তখনই কেউ ডাকে। কে? অতীন চিনতে পারে না। ধপ করে লোডশেডিং হয়। বাতাসে কামিনী ফুলের গন্ধ ভেসে আসে। কোথা থেকে আসে, অতীন বোঝার চেষ্টা করে না। লোকটি বলে, বড্ড একঘেয়ে, তাই না? হ্যাঁ, বলে অতীন, কিছুই তো ঘটছে না! ঘটনাবিহীন গল্প, লোকটি বলে। অতীন নিশ্চুপ। সে-গল্প তো এরকমই হয়, ফের বলে লোকটি। অতীন বলে, বড্ড একঘেয়ে। লোকটি হাসে, তা বটে। কিন্তু বলো তো তা-বলে বাড়ির রাস্তা ভুলে যেতে হয়! চমকে ওঠে অতীন। বলে কী লোকটা! একটু ভাবে সে। বলে, ঘটনাবিহীন গল্প বা ঘটনাযুক্ত গল্প— কোনোটাই আমার পছন্দ না। কিন্তু ভেবে দেখেছ কি, লোকটি হারতে চায় না, জীবনে কখনো কখনো এমন সময় আসে, যখন সব রাস্তা এক রকম মনে হয়? অতীন বিরক্ত। লোকটি থামতে চায় না, এমন সময়ও আসে, যখন বিশেষ তারিখও আলাদা করা যায় না। বলতে বলতে লোকটি এগিয়ে আসতে থাকে। অতীনের কানের পাশে কথাগুলো ঘোরে। হুঁ, তারিখ? জানতে চায় সে। হ্যাঁ, তারিখও, রাস্তারই মতো। লোকটি হাসতে হাসতে বলে। ভ্রুকুঞ্চিত চোখে, বুকের মধ্যে হঠাৎ খেলে যাওয়া ধরফরানি নিয়ে স্পষ্ট তাকায় অতীন। দমকা বাতাস বয়। প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে দরজা বন্ধ করার আওয়াজ ভেসে আসে। ভেসে আসে দূরের ঝোপ থেকে রাতপাখির চিৎকার। কিছুটা চিন্তামুক্ত অতীন; কারণ, সে বাড়ির রাস্তা খুঁজে পেয়েছে। এবার বাড়ির পথ ধরে। কিন্তু মনের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি তার হাঁটার গতি স্লথ করে দেয়। ‘জীবনে কখনো কখনো এমন সময় আসে, যখন সব রাস্তা এক রকম মনে হয়’— বাড়ির রাস্তা খুঁজে পেয়েও কথাটা সে ভুলতে পারে না। মনে হয় লোকটি তার পেছন-পেছন আসছে। সে কিন্তু লোকটির উপস্থিতিকে অস্বীকার করার তাগিদে পেছন ফিরে তাকায় না। হন-হন করে হাঁটে। বলাইদের বাড়ির দেওয়ালের সাদা রং পেরোয়। শ্যামের ঝুপড়ির ভেতর থেকে ছাগলের গন্ধ নাকে পায়। না তাকালেও তখনও লোকটির অস্ত্বিত্ব সে পেছনে অনুভব করে। তারপর যখন রিঙ্কিদের বাড়ির সামনে আসে, সে ওর গায়ের গন্ধ আর মেলে রাখা পোশাক-শুকোনো জলের গন্ধ পায়। একটু বিহ্বল বোধ করে অতীন। পেছনে কে তাকে অনুসরণ করছে সে ভুলে যায়। হাই ওঠে। রাস্তায় পা ফেলছে কি না বুঝতে পারে না। চোখ বুজে আসে। ঘুমিয়ে পড়ে অতীন। তারপর হাওয়া বয়; রাত্তিরও চোখ মোদে। একসময় অতীন নিজেকে আবিষ্কার করে আবার বড়ো রাস্তায়। শিরিষ গাছ, পঞ্চমীর চাঁদ ডোবা আকাশ, কেমন অচঞ্চল; বড়ো রাস্তার বা-দিক থেকে নেমে যাওয়া বাড়ির রাস্তায় ল্যাম্প পোস্টের চেনা ঔজ্জ্বল্য— কিন্তু লোকটিকে অতীন কোথাও দেখতে পায় না। হঠাৎই মৃদু ঠান্ডা লাগে তার। সে লোকটির গলা মনে করার চেষ্টা করে। কণ্ঠস্বরের কম্পন স্মৃতিতে বারংবার চারণ করে। খুব চেনা-চেনা লাগলেও মেলাতে পারে না। অস্বস্তি হয়। মনোযোগ ঘেঁটে যায়। রাস্তায় পা ঘসে রাস্তার বয়স মেলাতে হিমসিম খায়। তখন তার চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছা করে। সব কিছু ভেঙে-চুরে দিতে ইচ্ছা করে। স্মৃতিতে আবছা ভেসে আসে বাইকে চেপে কোনো দূর দেশে পাড়ি দেওয়ার সন্ধ্যা। অদ্ভুত, ভিত্তিহীন কিছু পথ, স্বপ্নের মতো। যে সময় মানুষ লিটল ম্যাগাজিন করে আর রণজিৎ সিংহ-র কবিতা পড়ে বিহ্বল বোধ করে, সেই সময় কবিতাসক্ত মনকেমনের মুহূর্তে এই ধরনের রাস্তার ছায়া মনের মধ্যে গুমরে উঠতে দেখা যায়। অতীন ভাবে অভীকের কথা। ওই খাতাটার কথা— যেখানে প্রতিদিনের অনুভূতির কথা লিপিবদ্ধ করতে হত প্রত্যেককে। সেই খাতাটা এখনো তোর কাছে আছে? এই সেদিনও ছিল, এখন পাচ্ছি না। আরে অভীক, তুই কোথা থেকে এলি? অভীক হাসে, এই তো। হাসে অতীনও। কিন্তু বড্ড একঘেয়ে, তাই না? ঘটনাবিহীন গল্প আমার কোনো দিন ভালো লাগে না। অভীক বলে। সেরকমই একটা গল্প তুই শোনাবি, তাই তো? অভীক হাসি-হাসি মুখ করে থাকে। জীবনে কি কোনো এক সময় এমন-সময় আসে, যখন সব রাস্তা এক রকম মনে হয়? অভীক এই প্রশ্নের উত্তর দেয় না। বিশেষ তারিখও আলাদা করা যায় না! তারিখও নাকি রাস্তার মতো? বোঝা যায় না, অভীক কথাটা শুনতে পেল কি না। বড়ো রাস্তায় পঞ্চমীর চাঁদ ডুবে যাওয়া রাত্তিরে সে দূর অতীতের দিকে, জীবনের উল্লসিত অধ্যায়ের দিকে মুখ করে দাঁড়ায়। অন্ধকারের দিকে তাকায় গল্প বলবে বলে।
অভীকের গল্প
স্ত্রী মারা যাওয়ার পর জনৈক প্রৌঢ় স্মৃতি-দুর্বলতার শিকার হয়েছিলেন। তাঁর একমাত্র ছেলে বিদেশে থাকত। সে বৃদ্ধ বাবাকে বিদেশে নিয়ে আসে। কিন্তু ঘটনাক্রমে সেদিন ছিল ২৯ শে ফেব্রুয়ারি।
বৃদ্ধ তো কিছুতেই বিদেশে যেতে রাজি হচ্ছিলেন না। ছেলে তাঁকে কতরকম ভাবে ভোলাল। তারপর তিনি রাজি হলেন, কিন্তু নিমরাজি। ছেলেকে কথা দিতে হল, পরের বছর ঠিক এই দিনে তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। ছেলে কথা দিল। কথামতো একটা ক্যালেন্ডার দিল বাবাকে।
ওরা বিদেশে চলে গেল। সেখানে বৃদ্ধের কাজ হল সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিন ক্যালেন্ডারে তারিখ দাগানো।
এই করতে করতে সেই বছর শেষ হল। বাবার কথা মতো ছেলে আবার তাঁকে নতুন বছরের ক্যালেন্ডার দিল। বৃদ্ধ তারিখ দাগ দিয়ে চললেন। কিন্তু সেই ক্যালেন্ডারে ২৯ শে ফেব্রুয়ারি তিনি খুঁজে পেলেন না। রেগে গিয়ে ছেলেকে বললেন, তুই ইচ্ছা করে আমাকে ভুল ক্যালেন্ডার দিয়েছিস। ছেলে বলল, না, তুমি নিজেই তবে অন্য ক্যালেন্ডার জোগাড় করো। তিনি তা-ই করলেন। প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে ক্যালেন্ডার চেয়ে আনলেন। না, সেটাতেও ২৯ তারিখ ছিল না। বৃদ্ধ ছেলেকে আর কিছু বললেন না।
এইভাবে পর পর তিন বছর কেটে গেল। ২৯ শে ফেব্রুয়ারি খুঁজে পাওয়া গেল না। বৃদ্ধ হতাশ হয়ে চতুর্থ বছর ক্যালেন্ডারে তারিখ দাগ দেওয়া বন্ধ রাখলেন।
কিন্তু বৃদ্ধ কি দেশের কথা ভুলে গেলেন? হয়তো-বা দেশের জন্য মনখারাপে তাঁর স্মৃতি-দুর্বলতা কিছুটা সহায়ক হয়েছিল।
সে যাই হোক, পুরো এক বছর ক্যালেন্ডারের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছিন্ন মানুষটি ফেব্রুয়ারির ২৯ তারিখ চলে গিয়েছে ভেবে একরাতে আচমকা আঁতকে ওঠেন। আবার যোগাড় করেন সে-বছরের ক্যালেন্ডার, কিন্তু ২৯ শে ফেব্রুয়ারি যথারীতি খুঁজে পান না। আবার তিন বছর ধরে কাঙ্ক্ষিত তারিখ খোঁজা চলে। আবার বৃদ্ধ ক্লান্ত হন; হতাশ হন। এক বছর পর আবার স্বপ্ন দেখেন, আবার আঁতকে ওঠেন; জোগাড় করেন ক্যালেন্ডার।
কিন্তু তিনি সারা জীবন ধরে আর তাঁর প্রিয় দেশ-গাঁয়ে ফেরার তারিখ খুঁজে পান না।
গল্প শেষ হয়। হাসি হাসি মুখ করে বলে অতীন, তুই গল্পকে গল্পের মতো চলতে দিতে শিখলি না আজও। কিন্তু অবাক হয়ে যায় তারপর; অভীককে আশ-পাশে কোথাও দেখতে পায় না। এবার অতীন স্পষ্ট করে ভাবে, সে নিশ্চয় কোনো ধাঁধার চক্করে পড়েছে। অতীনের জল পিপাসা পায়। কিন্তু ওর কাছে জল নেই। ব্যাগের মধ্যে বোতল আছে, জল নেই। অতীন বাড়ির রাস্তার দিকে তাকায়। ল্যাম্প পোস্টে আলো জ্বলছে। তার আবছা মনে হয়, অথবা মনে করার চেষ্টা করে রাস্তা ভুলে গিয়েছিল কি না কোনো সময়। মনে করতে পারে না। রাস্তা দিয়ে মাঝে-মাঝেই মোটর বাইক, অটো এসব চলে যায়। অতীনের কিছুতেই মনে পড়ে না। সে বরং বাড়ির রাস্তার দিকে তাকায়, বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু সালোয়ার পরা একটি মেয়ে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে আসে ওর দিকে। বেলা। তার মুখে হাসি। তুমি! কোথায় গিয়েছিলে? অতীন জিজ্ঞেস করে। বেলা হাসে। করুণ চোখে তাকায়। বাড়ি যাবে তো? অতীন মাথা নাড়ে। চলো; কিছুটা একসঙ্গে যাই। বেলার ঠোঁটে গত শীতের ঠোঁটফাটা লুকিয়ে থাকে। চোখের কোণে কাল্পনিক হাসি ফুটিয়ে বলে, এসো, রাত হয়ে যাচ্ছে। অতীন বেলার সঙ্গে হাঁটতে শুরু করে। বড়ো রাস্তা থেকে ওদের বাড়ির রাস্তায় ঢুকেই একটি লম্বা সেগুন গাছ। তার পাতায় রাতের বয়সের চিহ্ন মানুষকে চমকে দেয়। বড়ো বড়ো পাতায় রাত্রিগুলি খসখস করে। বেলার ওড়নায় সেই খসখস প্রতিধ্বনিত হলে অতীন বেলার দিকে তাকায়। তুমি মোটা হয়ে গেছ। বলে অতীন। অতীনের শ্বাসের গন্ধ বেলার কানের পাশে ঘুরে বেড়ায়। আর তুমি রোগা। বলে বেলা। সেগুন গাছের কাণ্ডে প্রবাহিত বাতাসের অমসৃণ বিস্তার লেগে থাকে। পাতার আড়ালে ঘুমিয়ে পড়া পাখি চোখ বুজেই ওদের পায়ের শব্দ শুনতে পায়; ওরা চোখ খোলে না। বেলার জুতোর তলা থেকে গতজন্মের বনজ গন্ধ ভেসে আসে। অতীনের মনখারাপ লাগে। চালতা গাছের আকাশ-ঢাকা নিঃসঙ্গতার তলা দিয়ে যাওয়ার সময় বেলা পেছন ফিরে তাকায়। কী? বলে অতীন। বেলা বলে, আমরা কিছু ফেলে আসিনি তো? প্রাতিবর্তিক আবেগে অতীনও পেছন ফেরে, বোধহয় কোনো রাস্তা, বলে সে। চালতা গাছের নীচে পিপুলের জঙ্গলে রাত্রি শুয়ে থাকে। একটা ব্যাঙ ওদের দিকে ভাষাহীন চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে। পিপুলের পাতার গন্ধে ব্যাঙের চামড়া স্যাতসেতে সবুজাভ। অতীন ল্যাম্প পোস্টের আলোর রং দেখে। বেলা ফেলে আসা রাস্তার ধুকপুকুনি শুনে কেঁপে ওঠে। তা স্বত্ত্বেও ধীর পায়ে পিপুলের জঙ্গল পার হয়। রাস্তার উপর ঝুঁকে পড়া আম গাছের ডালের দিকে তাকিয়ে, ওর নীচে জড়ো হওয়া অন্ধকারের থেকে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে বেলা বলে, চলো, ওই রাস্তায় ফিরে যাই। অতীন দেখে, সে দু’পা এগিয়ে গিয়েছে। থমকে দাঁড়ায় সে। হঠাৎ মনে পড়ে একদিন বেলা একটা গল্প বলেছিল। অতীন বেলার চুলের দিকে তাকায়। নিষিদ্ধ যৌবন ওর চুলে আজও লেগে আছে দেখে; তার গন্ধ পায়। আবার সেই গল্পটাও মনে পড়ে।
বেলার গল্প
বাবার সঙ্গে মেলা থেকে ফেরার পথে ছেলেটি আবিষ্কার করল সে হারিয়ে গেছে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলা মানুষের ভিড়ে সে কোথাও তার বাবাকে খুঁজে পাচ্ছিল না। সে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল।
এমন সময় একটি লোক ছেলেটিকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল সেখানে। জানল, ছেলেটি তার বাবাকে হারিয়ে ফেলেছে এবং বাড়ির পথ সে চেনে না। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, যেখানে ছেলেটিকে এই ভদ্রলোক আবিষ্কার করেন সেটি ছিল চার রাস্তার মোড়। ফলে, কোন দিকে ওর বাবা গেছে সেটা অনুমান করা সম্ভব নয়। আবার কোন গ্রামে ছেলেটির বাড়ি সেটাও সে বলতে পারছিল না।
লোকটি বলল ছেলেটিকে, পেছনের পথ চলে গেছে মেলার দিকে, যেখান থেকে সে এল। সামনের পথ শেষ হচ্ছে বড়ো বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে। ডানদিকের পথ যাচ্ছে রেলস্টেশনে। আর বা-দিকের পথ চলে গিয়েছে নদী পর্যন্ত।
ছেলেটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
তুমি যেদিক থেকে এসেছ সেদিকে কী ছিল— নদী, বাসস্ট্যান্ড, না ট্রেন?
ছেলেটি বলল, সেদিকে ছিল আমার বাড়ি।
অতএব, লোকটি কোনো ভাবেই ছেলেটি কোন দিক থেকে এসেছে তা জানতে পারল না। ফলে, সে ছেলেটিকে নিয়ে বারবার ডানদিক, বা-দিক আর সামনের রাস্তা বরাবর গেল। এবং একাধিকবার যাওয়া স্বত্ত্বেও ছেলেটির বাবাকে খুঁজে পাওয়া গেল না।
এদিকে ছেলেটির বাবা ছেলেকে হারিয়ে ফেলার পর ফের চলে গিয়েছিল মেলায়। ভেবেছিল, ছেলেও তাকে খুঁজে না পেয়ে মেলাতেই ফিরে আসবে।
কিন্তু ছেলেটি কোনো ভাবেই পেছন দিকে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবেনি।
রাত্রি তখন বেশ গভীর হয়ে এসেছে; আর একটু পরেই খেয়া বন্ধ হয়ে যাবে, এমন সময় লোকটি শুনল, ছেলেটি তাকেই বাবা বলে ডাকছে। লোকটি প্রথমে ভেবেছিল, সে তার বাবাকেই বুঝি খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু, কয়েক মুহূর্ত পর ভুল ভাঙল তার। বুঝল সে, ছেলেটি আসলে তাকেই বাবা বলে ডাকছে।
গল্প শেষ হলে বেলা বলেছিল, ছেলেটি কি কোনো অদ্ভুত ধরনের স্মৃতিভ্রংশ রোগে আক্রান্ত ছিল? অতীন বলেছিল, গল্পের প্রয়োজন ছিল লোকটিরও কোনো সন্তান না থাকা। হ্যাঁ, গল্পের প্রয়োজনেই দরকার ছিল ওদের পেছন দিকে না ফিরে যাওয়া। তখন বেলার চুলের গন্ধে তার খুব কষ্ট হয়। আমগাছের ছায়ার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে সে ফেলে আসা রাস্তার দিকে তাকায়। এবার আর দেরি করে না অতীন— পেছন দিকে ফেরে। আর দেরি করে না— প্রায় দৌড়তে দৌড়তে ওই রাস্তায় ফিরে যায়। সেখানে অনেক দূরের আসর থেকে কীর্তনের সুর ভেসে আসে। কতদিন আগে শোনা ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের নীলাম্বরী রাগের বিস্তারের কাছাকাছি সেই সুর। সেই আবছা সুর শুনে তার ঘুম পায়। আশপাশে তাকায় অতীন; বুঝতে পারে, বেলা তার ফেলে আসা রাস্তায় ফিরে আসতে পারেনি। সে টেনে টেনে নিশ্বাস নেয়। তারপর মিছিমিছি বেলাকে খোঁজে। খোঁজার পদ্ধতিটাও বেশ অদ্ভুত। সে আসলে বেলার জুতোর তলা থেকে যে বনজ গন্ধ ভেসে এসেছিল, সেই গন্ধ খুঁজতে রাস্তার ধারে ঘাসের উপর দাঁড়ায়। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, যতক্ষণ না ঘুগরো পোকাটি তার পায়ের কাছে এসে থামে; যতক্ষণ না ওই গন্ধ সে ঘুগরোর গা থেকে পায়। তারপর রাস্তা থেকে নিচে নেমে পড়ে। অন্ধকার পেরিয়ে ফসলের মাঠের কাছে চলে যায়। অনেক্ষণ হাঁটতে হয়, অথবা সে হাঁটেই না আদৌ। কিন্তু পটল ক্ষেতের ওমের কাছে গিয়ে থামে। গাছের গোড়ায় বিচালির ওমে সে কি বেলার নিষিদ্ধ চুলের গন্ধ পায়? অতীন কি নিস্তব্ধ বীজতলায় সোঁদা গন্ধে পা ডুবিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে? না, সে মনে করতে পারে না। তার চোখ বুজে আসে। খসখসে জীবনে এক মসৃন ঘুম তাকে ডুবিয়ে দেয়। একসময় দেখে সে বড়ো রাস্তায় দাঁড়িয়ে। অতীন কাঁধ থেকে ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে। আকাশমণি গাছের ফুলের গন্ধের নিচে দাঁড়িয়ে এলোমেলো রাত্রিটার দিকে তাকায়। ঘড়ি দেখে। বাড়ি ঢোকার সময় এখনো হয়নি; সময়ের প্রায় আঠাশ মিনিট আগে আজ চলে এসেছে দেখে। অতএব, একটু দূরে টগর ফুলের কুঁড়িগুলি তার চেতনায় বিহ্বলতা আনে। জীবনের কিছু সঞ্চয় এই গাছের পাতায় জমানো আছে অনুভব করে। কিন্তু কী সঞ্চয়— সে মনে করতে পারে না। টগর ফুলের কুঁড়ি দিয়ে সেই বালক বয়সে কী যে করত আবছা আবছা স্বপ্নের মতো মনে পড়তে থাকে তার। পায়ের পাতার নিচে আবছা স্বপ্ন সুড়সুড়ি দেয়। অতীন বিহ্বল বোধ করে। সজনে পাতার গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। দেখে সে, নুন আর ভজন হেঁটে আসছে। অতীন উৎফুল্ল বোধ করে। কারণ, ওরা নিশ্চয় ভুলে যায়নি টগর ফুলের কুঁড়ি দিয়ে কী ম্যাজিক ছোটোবেলায় দেখাত। বোসের আমবাগানে পোড়ো বাড়ির ছবি আঁকতে গিয়ে নুন, ভজন আর অতীন সাপের শঙ্খ লাগা দেখেছিল। সাদা কাগজে জল রঙের মায়া স্বাস্থ্যবান সাপ-সাপিনীর শ্বাসের শব্দে ভরে উঠেছিল। নুনকে দেখে সেই সাপিনীর কথা মনে পড়ে অতীনের। কালো মেয়ে নুনের চোয়ালে তেলতেলে অতীত লেগে ছিল। ভজনের পোশাকে লেগে ছিল সেই অতীতের ধুলো। কিন্তু অতীন অবাক হল, যখন জানতে পারল ওরা কোথায় যাচ্ছে। আজ থেকে ৫০/৬০ বছর আগে নাগ পাড়ায় এক বুড়ি ছিল; যার তিন কুলে কেউ ছিল না। ওরা সেই বুড়ির পরিত্যক্ত বাড়ির খোঁজে যাচ্ছে। কিন্তু, কেন? এই রাত্রে! সে এক গল্প— বলে ওরা। কী গল্প? নুন সুন্দর করে হাসে; তার চোখে সাপিনীর চোখের মায়া। তুই বাড়ি যা, বলে ওরা। কী আছে ওই বুড়ির ভিটেতে? আছে একটা গল্প; স্রেফ একটা গল্প, ভজন বলে। ধুর! হাসে অতীন। বিশ্বাস কর, বলে ওরা, শুধুই একটা গল্প। অতীন নির্বাক হাসে। ওরাও নির্বাক তাকিয়ে থাকে। শুনি গল্পটা, একটু পরে অতীন বলে। রাত্রি নিশ্বাস বন্ধ করে থেমে যায়। আকাশের কোনো অদৃশ্য কোণে চাঁদ ছিল, সে লুকিয়ে পড়ে। বাড়ি যাস। বলে নুন। অতীন মাথা নাড়তে ভুলে যায়। তারপর ওরা গল্পটা বলে।
নুন ও ভজনের গল্প
আজ থেকে ৫০/৬০ বছর আগে নাগ পাড়ায় এক বুড়ি ছিল, যার তিন কুলে কেউ ছিল না। বুড়ি একা একা থাকত আর রাত্রে উঠনে ঘুরে ঘুরে শামুক মারত। রাত্রি বেলা সে ঘুমোত না। তা সত্ত্বেও বুড়ির বয়স যখন ৮২, এক রাতে সে স্বপ্ন দেখে। ঘুমোত না, তবু কী ভাবে স্বপ্ন দেখল? সে-ও এক ঘটনা। সেটা গল্পের শেষে বলা হবে। কী দেখল সে স্বপ্নে? অন্য কারও পক্ষে সেটা জানা সম্ভব ছিল না, যেহেতু বুড়ি নিজেকে ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করত না। কিন্তু শোনা যায় বুড়ি দু’তিন দিন খুব কেঁদেছিল। অনেকে বলে, স্বপ্ন বুড়ির স্মৃতি উসকে দিয়েছিল। যেহেতু বুড়ির কোনো বন্ধু বা সুহৃদ ছিল না, সেহেতু তার অবিরাম কান্না দেখে ঝড়ের দেবতা ঠিক করলেন, বুড়ির হারানো জিনিস প্রতিদিন একটা একটা করে বুড়িকে ফেরত দেবেন। দেবতা হওয়া সত্ত্বেও, তাঁর পক্ষে কাজটা করা যে খুব সহজ ছিল এমন কিন্তু না। তবুও তিনি কোথা থেকে কোথা থেকে বুড়ির জন্য এক এক করে সব উড়িয়ে আনা যায় তার বন্দোবস্ত করলেন এবং পরদিন থেকেই কাজ শুরু করে দিলেন।
সাড়ে চার বছর বয়সে সে একটা পুতুল হারিয়েছিল। এমনিতে বুড়ির অনেক খেলনা ছিল। কিন্তু এই খেলনাটি তার অধিক প্রিয় কারণ, এই পুতুলের একটা হাত খুলে গিয়েছিল। হয়তো-বা সেজন্যই ওর প্রতি বুড়ির অধিক টান। ঝড়ের দেবতা এ-কথা জানতেন। বুড়ি সন্ধে বেলা তুলসীতলায় প্রদীপ দিয়ে ঘরে ওঠার সময় শুনল পেছনের বাগানে ঝুপ করে একটা আওয়াজ। আসলে বাতাস প্রথম যে জিনিসটা তার পেছনের বাগানে ফেলেছিল, সেটা ওই হাত ভাঙা পুতুল— যে পুতুল হারিয়ে বালিকা বুড়ি তিন দিন কিছু খায়নি; শুধু কেঁদেছিল। যদিও বুড়ি সেদিন ওই আওয়াজ গ্রাহ্য করেনি। পেছন ফিরে চায়নি সে।
এইভাবে প্রতিদিন বাতাস একটা করে তার হারানো জিনিস ফেলে যেতে লাগল, কিন্তু বুড়ি ভ্রুক্ষেপ করল না। অবশেষে একদিন এল, যেদিন বাতাস তার শেষ হারানো ধন তার একমাত্র ছেলেকে নিয়ে এল যে ৩২ বছর আগে মারা গেছে। সেদিন শুকতারাকে একখণ্ড মেঘ ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। সন্ধে দিতে নামার সময় বুড়ি সেদিকে তাকায়। কিন্তু ফেরার সময় আর তাকানোর কথা মনে থাকে না, পেছনে ঝুপ করে হওয়া আওয়াজ আবারও উপেক্ষা করে সেদিনও বুড়ি ঘরে ফিরে যায়।
এক-দেড় ঘণ্টা বাদে কেন যে বুড়ির এই প্রথমবার মনে হল যে, এই যে প্রতিদিন আওয়াজ হচ্ছে, একবার গিয়ে দেখা যাক তো কীসের আওয়াজ! আলো নিয়ে উঠোনের পশ্চিম কোণে যাওয়ার ইচ্ছা সে এই প্রথমবার সংবরণ করতে পারল না। গেল সে। এবং অলৌকিক ভাবে সে তার ছেলের মৃত্যুর দৃশ্য নিজের চোখের কোটরের মধ্যে দেখে সংজ্ঞা হারাল।
শোনা যায়, এই ঘটনার পরদিন সন্ধ্যায় বুড়ি মারা যায়।
অতীন বলে, তারপর? ভজন আর নুন হাসে। শেষ হয়ে গেল? আবার বলে অতীন। হ্যাঁ, শেষ। বলে ওরা। তোদের গল্পগুলো বড্ড তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। ওরা তাতেও হাসে। তখন অতীন বলে, কিন্তু ওই বুড়ির বাড়ি খুঁজে কী লাভ? শুনেছি বুড়ির বাড়ি খুঁজে পেলে অসুখ সেরে যায়। অতীন অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ল্যাম্প পোস্টের আলোয়-আবিল রাত্রি পায়ের তলায় শিরশির করে। অর্থহীন কিছু গল্পের অন্ধকার তার কলারের ঘাম থেকে গন্ধ ছড়ায়। নুনের চোয়ালে জীবনের অসুখ লুকিয়ে আছে? কিংবা ভজনের প্যান্টের ঝুলে, নির্জনে? ভাবতে গিয়ে অতীন আশ-পাশের উদবৃত্ত অন্ধকারের দিকে তাকায়। মনে মনে ভাবে, এই ভাবনা থেকে সচেতন হয়ে সামনে চেয়ে দেখলে নিশ্চয় আর নুন ও ভজনকে আর খুঁজে পাবে না, বরং ঘুমিয়ে পড়বে সে। এবং হয়ও তাই। সে ঘুমিয়ে পড়ে। অতীন জানে, একটু পরে ঘুম ভাঙবে তার; দেখবে, সে বড়ো রাস্তায় দাঁড়িয়ে। কয়েক মুহূর্তের জন্য আবিষ্ট বোধ করবে, তারপর কাঁধের পেশীতে অনুভব করবে টানটান ক্লান্তি। আকাশের দিকে তাকিয়ে কিংবা আশপাশের অন্ধকারের দিকে, সে কাঁধ থেকে ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলতে যাবে যে মুহূর্তে, ঠিক তখনই দেখবে ওর পাশে এক অদ্ভুত মানুষ দাঁড়িয়ে। কেমন সেই অদ্ভুত মানুষ, কেন অদ্ভুত, সেটা গল্পের শেষে বলা হবে। আপাতত, একেবারে গা-ঘেঁসা দূরত্বে অচেনা এবং অবশ্যই অদ্ভুত এমন কাউকে দেখলে, যা হওয়ার কথা, ভয় পেয়ে যাবে অতীন। দেখবে, আকাশ থেকে শেষ গ্রীষ্মের ঝিমধরা তাপ নেমে আসছে। সেই তাপের তলায় দাঁড়িয়ে লোকটি অতীনের দিকে চেয়ে কুটকুটে হাসি হাসছে। কী চাই? অতীন না বলে পারে না। সে কাঁধ থেকে নামিয়ে একটা বড়সড় ঝোলা অতীনের সামনে রাখে। কী আছে? অতীন জিজ্ঞেস করে। লোকটি আবার মিটমিট করে হাসে। অতীনের গা গোলায়; খিদে পেয়েছে। মনে পড়ে, ব্যাগের মধ্যে জল শেষ হয়ে যাওয়া খালি বোতল ছাড়া কিচ্ছু নেই। তবুও বের করে, দেখে, আবার রেখে দেয়। বিরক্ত অতীন আবার বলে, কী ওতে? লোকটি কুটকুট করে হেসেই যায়। অতীন বাড়ির রাস্তায় পা দেওয়ার আগে চোখ মেলে তাকায়। তখন বলে লোকটি, পিঠে লাগিয়ে দেব, তারপর যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারবেন। দাম মাত্র দেড় টাকা। সন্দিগ্ধ অতীন ভ্রু কুঁচকে তাকায়: সত্যি! লোকটি একই রকম মিটমিট করে হেসে চলে। অতীন ফিসফিস করে বলে, যে কোনো জায়গায়? মাথা নাড়ে লোকটি। এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, যে এর পর অতীন লোকটির সামনে হাঁটু মুড়ে বসে। এমন ঘটনা ঘটা যে শুধু সময়ের অপেক্ষা লোকটি যেন জানত— এমন ভাবে তাকায় সে। তারপর ব্যাগ খুলতে শুরু করে। একটার পর একটা চেন খুলতে থাকে। খোলার সময় নানা রকম অদ্ভুত আওয়াজ হয়। অতীন শোনে; বোঝে, সময় চলে যাচ্ছে। দেখে রাত্রির রূপ অনেক বার বদলে বদলে গেল। তারপরেও লোকটি ব্যাগ খুলতে থাকে। শিরিষ গাছের বাকলের ফাঁক থেকে কেন্নোর হেঁটে যাওয়ার শব্দ শুনতে পায় অতীন। আকাশমণি ফুলের পরাগে বাতাস লাগে। অতীন অপেক্ষা করে; লোকটি ব্যাগ খুলতে থাকে, এবং যথারীতি ব্যাগ খোলা লোকটির শেষ হয় না। এই ধরনের যাচ্ছেতাই গল্পের কাছে আত্মসমর্পণ করবে না, শেষমেশ এরকম প্রতীতি হলে উঠে দাঁড়ায় সে। ভ্যাবাচেকা লোকটি বলে ওঠে, আর একটু স্যার; এই হয়ে এসেছে। অতীন বলে, থাক; বাড়ি যাব। লোলটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। অতীন পাত্তা দেয় না; বড়ো রাস্তা থেকে বা-দিকে নেমে গেছে যে রাস্তা, সেই সরু রাস্তায় নেমে যায়: বাড়ির রাস্তা কি না, চেনা, না কি অচেনা— খেয়াল থাকে না তার। সে হাঁটতে থাকে। রাত্রি গাছের পাতায় শনশন করে, আর সত্যি বলতে কী, হাঁটতে হাঁটতে আবারও ঘুমিয়ে পড়ে অতীন।