সেপিয়া রঙের গলি – পঞ্চম পর্ব
‘সূর্য ডোবার পালা…’
অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
ডাকনামে ডাকছে মা। একটা… দুটো… তিনটে… পাখিরা সব ঘরে ফিরছে না ঘর ছাড়ছে বোঝা গেল না। তাদের সমবেত মিছিলশব্দ ভেদ করে উঠে এল মায়ের স্বর। লাল সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আমার লাল টিপ জোড়া পলা মা ডেকেই চলেছে। বেলে পাথরের চওড়া সিঁড়িতে ঘোলাটে আলো মাখা ম্রিয়মান কিছু প্রেমিক-যুগল ঘুরে ঘুরে মা’কে দেখছে। আমি অপ্রস্তুত হই। চোখ দিয়ে থামাতে চেষ্টা করি। মায়ের ভ্রূক্ষেপ নেই। সবেধন নীলমণি একখানা হাতব্যাগ আঁকড়ে ধরে বলে চলেছে… ‘যাস না, যাস না… আর নামিস না। জোয়ার আসছে। উঠে আয়… যাস না। ’
জোয়ার আসছে! তাই তো লাল সিঁড়িগুলি একে একে ছলছল ডুবে যাচ্ছে বেশ। একধাপ… একধাপ আরও নেমে যাই। পায়ের নীচে জল ছাড়িয়ে যতক্ষণ সিঁড়ি পাওয়া যায়, ততক্ষণ নামতে থাকি। সিঁড়িতে মায়ের ডাক আবছা হতে থাকে। ঘুম ছিঁড়ে যায়।
শহরের সমান্তরাল এই নদীর কথা বললে মায়ের কথা বলা হয়।
আমাদের ছিল পাগলের গলি, রাজ্যেশ্বরীতলা, নিভু নিভু জমিদার বাড়ি, কড়ি-বরগা দেওয়া রেশন দোকান আর একটু হাঁটলে বাসরাস্তা। বাসরাস্তার ওপারে ভাগীরথী-হুগলী। মায়ের কাছে গঙ্গা। মায়ের কাছে শিখি গঙ্গাস্নান।
সদ্য গুনতে শেখা দিনে মা বলত ‘বল দেখি ক’টা মন্দির?’ কড় গুনে দেখতাম এদিকে ছ’টা, ওদিকে ছ’টা। বারংবার গুনে গুনে ঠিক হওয়া। ‘বারো… বারোটা। এবার জলে নামি?’
শরীর পোড়ানো রোদে দু’ধারের বারোটি শিব মন্দিরের মাঝ বরাবর জলে নেমে যেত মা। তারপরে ডাকত, ‘আয়!’
আমাকে শক্ত করে ধরে ঘোলাটে বাদামি জলে ডোবায়, ভাসায়। চলে শিশুকন্যার গঙ্গাস্নান। মন্ত্রোচ্চারণ বাড়ে। ভিড়ে শুধু কালো মাথা বোঝা যায়। মা নিজে ডোবে, আমাকে ভাসায়। তারপরে উঠে আসে জল থেকে। ‘শিব শিব… শিব শিব…’ বারোটি শিবমন্দিরে উঠে যায়। আমি দেখি ধূপ-কর্পূরের গন্ধে তার প্রার্থনায় শুধু আমি জুড়ে আছি।
কথিত আছে, গঙ্গার পশ্চিম কূলে হুগলী জেলার কোন্নগর শহরের এই অংশে মূলত ছিল ব্রাহ্মণদের বাস। হাটখোলার দত্ত পরিবারের ধর্মপ্রাণ জমিদার হরসুন্দর দত্ত ১৯২১ সালে কোন্নগরের এই অংশে গঙ্গা সংলগ্ন বারোটি শিবমন্দির ও ঘাট নির্মাণ করেন। আশেপাশের সমস্ত জমি কিনে একটি বাজার বসানো হয়। সেবাইতদের বাসস্থান নির্মিত হয়। আগামীদিনের রক্ষণাবেক্ষণের পরিকল্পনার খসড়া করে যান হরসুন্দর দত্ত।
মায়ের কিনে দেওয়া একটি স্লেট, সেটায় লেখার চেয়ে আঁকতাম বেশি। রাস্তা… গাড়ি… আর শহরের মানুষের দেওয়া ডাকনাম – বারোমন্দির। বারোমন্দির ছিল স্বাধীনতার নাম। যে সীমানা আমাকে পেরোতে দেওয়া হয় না, কখনও কখনও সেই স্বাধীনতা মেলে। স্বাধীনতা শিখিয়ে দেয় পার্থক্য।
যেমন মহালয়ার দিনের স্বাধীনতা আমাকে বাবানদাদার থেকের আলাদা করে দিত। সারাবছর যার সঙ্গে মাঠে, তেমাথার মোড়ে খেলার হুটোপুটি, মহালয়ার দিনে আমার থেকে একটু বড়ো সেই বাবানদাদাই দিব্যি কাজ পেয়ে যেত বারোমন্দিরের চায়ের দোকানে। সে তখন কাপ-প্লেট ভিড় সামলাতে ব্যস্ত, ঘুরেও দেখত না। কী দূরত্ব… কী দূরত্ব! কোন্নগর দ্বাদশ মন্দির ঘাটে দুই বন্ধুর দূরত্ব লঙ্ঘন করা যেত না। তর্পণরত বাবার জুতো পাহারা দিতে যাবার অছিলায় জলে নামবার স্বাধীনতা তেতো হয়ে যেত। বাবানদাদা কেন যে চিনেও ডাকল না!
আমাদের ছিল বারোমন্দিরের চড়কের মেলা। ভয় পাওয়া… ফের দেখতে চাওয়া চড়ক। রোদচশমা, মুখোশ, আর কাগুজে হাওয়াকলের ঘাট। মায়ের ছিল নীল পুজোর বারোমন্দির ঘাট। বাবার ছিল মহালয়ার বারোমন্দির ঘাট। আমারও ছিল লুকোনো প্রার্থনার বারোমন্দির ঘাট।
যোগেশ্বর, রত্নেশ্বর, জটিলেশ্বর, নকুলেশ্বর, নাগেশ্বর, নির্ঝরেশ্বর, যজ্ঞেশ্বর, জলেশ্বর, জগদীশ্বর, নাদেশ্বর, নন্দীশ্বর, ও নরেশ্বর… গঙ্গাতীরে একচালা বঙ্গীয় স্থাপত্যের বারোটি শিব মন্দির হরসুন্দর দত্তের মৃত্যুর সাথে সাথে জরাজীর্ণ হতে থাকে। একসময়ে গঙ্গার ভাঙন ছুঁতে আসে মন্দির। ধনী বিড়লা পরিবারের পঞ্চাশ হাজার টাকার সহায়তায় ১৯৬৭ সালে ফের মন্দির সংস্কার করা হয়। নতুন চাতাল নির্মিত হয়। উন্নয়ন সমিতি গঠিত হয়।
আমি বড়ো হতে থাকি এই বারোমন্দির ঘাট ঘিরে। প্রথম প্রার্থনা, প্রথম পুজো, প্রথম শাড়ি… ধাপে ধাপে নেমে যাওয়া জীবন। লায়েক হওয়ার প্রথম জীবনে প্রথম সিগারেটও। মায়ের সঙ্গে মতভেদের দিনে একা বসে থাকার আশ্রয় বারোমন্দির ঘাট। একটা-দুটো পয়সা জলে ছুঁড়ে কারও ফিরে আসা চাওয়াও বারোমন্দির ঘাট।
লাল-হলুদ রঙের বারোটি শিবমন্দির একটি শহরের ভোল পাল্টানোর সাক্ষী। বারবার সেজে উঠেছে নতুন করে। প্রান্তিক ও শহরের পরিচায়ক হয়ে থাকার নিজস্ব উদাসীনতা নিয়ে থেকে গেছে।
ঘাট একই রয়ে গেল, আমাদের চাওয়া পাল্টে গেল। তিথি মেনে গঙ্গাস্নান বন্ধ হলে জানলাম বড়ো হয়ে গেলাম। ঘাট চিনলাম নতুনভাবে।
একদিন ভোর। মা-মেয়ে ঘাটে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কোথাও যাওয়ার ছিল কি? আজ আর মনে করতে পারি না। সুদৃশ্য লাল মেঝের সিঁড়ি, হলদে থাম, ছাউনি ঘেরা বসার জায়গা ও ঘোলাটে গঙ্গার দিকে চেয়ে থাকা বারোটি শিবমন্দিরের আনাচে কানাচে বিকট নাড়ি উল্টানো বাতাস ভরে গেল। একটু পরে দেখা গেল একটি ছেলের সাদাটে পা বাঁধা হয়েছে জলযানে। মানুষের পচে যাবার গন্ধ ছড়িয়ে যাচ্ছে মন্দিরে মন্দিরে। জলযানে বাঁধা হয়েছে সেই দেহ। জলের ওপরে উঠে রয়েছে শুধু একটি পা। দেহ ওপারে যাচ্ছে।
ভয় পাওয়া অস্বস্তিতে মায়ের কাছে কুঁকড়ে এলে চোখ আড়াল করেছিল মা। সেদিনও হাতব্যাগ আঁকড়ে, আমাকে আঁকড়ে মুষড়ে যাওয়া মা বলেছিল, ‘আহা গো! কার ঘরের ছেলে গেল! কে জানে কোন ঘরে খুঁজছে!’ ভাবলাম, কোথায় এই সাদাটে পায়ের বাড়ি, কোথায় ছিল আস্তানা। খুঁজতে খুঁজতে হন্যে হওয়া কিছু মানুষ হেঁটে বেড়াল মস্তিষ্কে। তৈরি হল এক অতি সামান্য গল্প ‘পারাপার’।
কোন্নগর দ্বাদশ মন্দির ঘাটে প্রতিটি তিথি ফিরে আসে, পুজো হয়, গণবিবাহের আয়োজন চলে, তর্পণের ভিড় আগের মতোই, শিবরাত্রির দিন এযুগের কোনও এক বাবানদাদা প্রচুর কাজ পায়। শুধু আমারই যাবার সময় পাল্টে গেল। চড়কের মেলার আকর্ষণ আমাকে ছেড়ে গেছে। নির্জনতার আকর্ষণ বেড়েছে। মা-মেয়ের সম্পর্ক পাল্টে গেছে। সেই ডোবানো ভাসানো নতুন স্লেটের শিশুকন্যা একটু নির্জনতার খোঁজে এখানে বসে থাকে। মানুষ দ্যাখে।
এই’ই লাইব্রেরী যাওয়ার পথ। লাইব্রেরী যাওয়ার নামে ঘাটে বসে থাকার নিজস্ব মুক্তি। বারবার ছুঁয়ে যাওয়া। বারবার ডেকে যাওয়া। ডাকবার দিন ফুরিয়ে এলে মানুষ যেমন বারবার ডাকে।
সন্ধেয় গঙ্গারতি হয়। মা কোনোদিনও দ্যাখেনি। বরং আমাকে নিয়ে সন্ধেরাতের দিকে মাঝে মাঝে ঘাটে এসে বসে। সামনে কালো জল, দূরে আলোর আভাস। লাল সিঁড়িতে সোডিয়াম ভ্যাপরের আলো বসে থাকা মানুষের মুখ রহস্যময় করে তোলে। মন্দির থেকে ঘন্টার শব্দ আসে। সঞ্জয় পাগল ইতিউতি ঘোরে। মাঝারি লোহার গেটের কাছে জগন্নাথ দেবের নতুন মন্দির তৈরি হয়েছে। সেখানে প্রদীপ জ্বলে। পূজারী বসে থাকেন কার যেন অপেক্ষায়। ফুচকা ও আইসক্রিম বিক্রেতার মুখে রাত বাড়ে। রুদ্রাক্ষ বিক্রেতা বৃদ্ধার মাথাটা এলোমেলো হয়। প্রেমিক-যুগল তাড়াহুড়োয় বাড়ি ফেরার পথ ধরে। মা আর আমি বসে থাকি, দেখি আমাদের শহরে রাতের প্রস্তুতিপর্ব। নদীর হাওয়ায় হাওয়ায় মা আমার শৈশবের কথা ভাসিয়ে দেয়। আমার সময় প্রার্থনা করে।
এরপরে আসে জল। আসে আমার অবাধ্যতা। গঙ্গাজল ভরে আনতে জলে নেমে যাওয়ার বাসনা। একপা… দু’পা নামতেই মায়ের চিৎকার। দিনের যেকোনো সময়েই আমি জলে নামলে বুঝি জোয়ার আসে! আমি হাসি। মা বোঝে না। শুধু ডেকে যায়।
কৃষ্ণফলক, স্লেট পেন্সিল ছেড়ে যাচ্ছি। চড়কের মেলা, রাক্ষুসে মুখোশ ছেড়ে যাচ্ছি। ঘাটের নির্জনতা ছেড়ে যাচ্ছি। শহরের ভাগে পাওয়া নদীটাও। সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছি, জল পেরিয়ে, শহর ছাড়িয়ে আমি সরে যাচ্ছি। ঘাটে দাঁড়িয়ে রয়েছে মা। হাতব্যাগের নামে আমারই শৈশব আঁকড়ে চিৎকার করে ডাকছে … ‘যাস না। যাস না। জোয়ার আসছে। নামিস না। ’
বারোমন্দির ঘাট থেকে একাই ঘরে ফিরবে আমার একলা মা।
ক্রমশ