শেষ কাহিনি <br />  শুভদীপ নায়ক

শেষ কাহিনি
শুভদীপ নায়ক

দুপুরে বারান্দায় বসে লেখার প্রুফ দেখছিলাম, এমন সময় ভিতরের ঘরে টেলিফোনটা বেজে উঠল । জ্বলন্ত সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে ঠুসে উঠে গিয়ে ফোনটা ধরলাম ।
‘গোপালনগর থানা থেকে বলছি—’
—হ্যাঁ, কী ব্যাপার বলুন ।
‘আপনি শেখর ব্যানার্জী কথা বলছেন ?’
—বলছি ।
‘আমি থানার বড়বাবু কথা বলছি । আপনার মাসতুতো ভাই রঞ্জিত গত পরশুদিন লরির ধাক্কায় মারা গেছে । ডেডবডি পোস্টমর্টেমে পাঠানো হয়েছিল, গতকাল রিপোর্ট এসেছে । ড্রিঙ্ক করে রাস্তা পার হওয়ার সময় লরিতে ধাক্কা মারে । স্পট ডেড । ওঁর বাড়িতে পুলিশ পাঠানো হয়েছিল, খবর শুনে বাড়ির লোকেরা মৃতদেহ নিতে অস্বীকার করেছে । অতি কষ্টে ওদের সঙ্গে কথা বলে আমরা অাপনার নম্বরটা জোগাড় করলাম । ওরা বলল, আপনি নাকি ওদের আত্মীয় হন । যদি একবার এসে বডিটা রিসিভ করেন, খুব ভাল হয় ।’
বললাম, ‘আমি তো কলকাতায় থাকি । পৌঁছতে দেরি হবে ।’
—কতক্ষণ লাগবে তাও ?
‘ঘন্টা তিনেক তো বটেই ।’
—আচ্ছা, আসুন । বেশি দেরি করবেন না । পুলিশের আরও অন্যান্য কাজ থাকে ।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমাকে কি থানায় যেতে হবে ?’
—থানায় কেন আসবেন ? বডি বনগাঁ হাসপাতালের মর্গে আছে । ওখান থেকে তুলে নিন । পরে থানায় এসে রিপোর্টটা নিয়ে যাবেন । পুলিশ কেস হয়েছে তো মশাই ।
‘আচ্ছা বেশ ।’
—একটা কথা জিজ্ঞেস করব ?
বললাম, ‘হ্যাঁ, করুন ।’
—এলাকার অনেকেই বলল, ভদ্রলোকের বিয়ে হয়েছিল । কিন্তু বৌ নাকি সঙ্গে থাকে না । ডিভোর্স হয়ে গেছে কি না সে ব্যাপারে কেউ কিছু বলতে পারল না । শুনলাম, উনি আপনার মাসতুতো ভাই হন । আপনি কিছু জানেন ওঁর স্ত্রী কোথায় থাকেন ?
‘বিয়ে হয়েছিল জানি । তবে যতদূর জানি ওদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে । ডিভোর্সের ব্যাপারে জানি না । ওঁর স্ত্রী থাকত লেকটাউনে । এখন কোথায় থাকে জানি না ।’
দারোগা বিরক্তকর সুরে বলল, ‘অ, একবার আসার পথে খোঁজ নিয়ে দেখবেন যদি পারেন । যাক গে, সময় নষ্ট না করে যত তাড়াতাড়ি পারেন আসুন ।’
আমি রিসিভার নামিয়ে রেখে ভাবলাম, মাসির বাড়ির কেউ বোধহয় আমার এখনকার মোবাইল নম্বরটা জানে না, তাই ল্যাণ্ডলাইনের নম্বরটাই দিয়েছে ।
অনেকদিন অফিস ছুটি নিয়ে বাড়ি বসে লেখালিখির কাজ করছিলাম । বাইরে পা দেওয়া হয়নি অসুস্থতার কারণে । গালে চাপ দাড়ি হয়ে গেছে । চুল বেড়েছে । আয়নায় দেখলাম নিজেকে অপরিষ্কার দেখাচ্ছে । কিন্তু এখন আর দাড়ি কাটার মতো সময় হাতে নেই । আলমারি থেকে একটা কালো ফুলহাতা শার্ট বের করে পরলাম । তৈরি হয়ে বেরতে যাব এমন সময় বইয়ের টেবিলে রাখা একটা পুরনো ফোটোফ্রেমে চোখ আটকে গেল । আমি আর রঞ্জিত পাশাপাশি দাড়িয়ে আছি একটা ছবিতে, ঐ একই ফ্রেমে আটকে রাখা আরেকটি ছবিতে একা তাকিয়ে আছে কেয়া, রঞ্জিতের স্ত্রী । কেয়ার চোখ দুটো এখনও আমার ঘর আলো করে আছে । কুড়ি বছর হয়ে গেল আমি ঐ চোখ দুটোকে ভুলতে পারিনি, অথচ ভুলতে চেয়েছি আমার সমস্ত অতীতকে ।
রঞ্জিতের মৃত্যুসংবাদটা শুনে খারাপ লাগল, কিন্তু শান্তি পেলাম এইভেবে ওকে আর ভুগতে হল না এই পৃথিবীতে । রোজকার অন্ন ধ্বংস করে প্রতিদিন এই যে মানুষের বেঁচে থাকা, এ যে কত কষ্টের সেটা বলে বোঝানো যাবে না । হঠাৎ, খেয়াল হল দারোগা রঞ্জিতের স্ত্রী’র একটা খোঁজ নিতে বলেছেন । কিন্তু কেয়া কি এখন ওর বাপের বাড়িতে থাকে ? তা ছাড়া কোথায় থাকবে ! কিন্তু কুড়ি বছর পর গেলে আমায় ও কি চিনতে পারবে ? সঙ্কোচ হচ্ছিল । তবু, একটা ট্যাক্সি ধরে লেকটাউনে গেলাম । জয়া সিনেমা হলের কাছে নেমে পাশের সরু রাস্তায় ঢুকে হিসেব করে তিনটে বাড়ি ছেড়ে গিয়ে দেখি চতুর্থ বাড়িটা, মানে কেয়াদের বাড়িটা এখন আর নেই । সেখানে চারতলা বিল্ডিং উঠে গিয়েছে ।
নিচে সিকিউরিটি গার্ডকে কেয়ার কথা বলে জিজ্ঞেস করলাম থাকে কি না । লোকটা খৈনি ডলতে ডলতে জবাব দিল ও-নামে কেউ থাকে না । তবে বলল, ‘চক্রবর্তী’ পদবীর একজন থাকে তিনতলায় । দেখতে পারেন গিয়ে ।
উপরে উঠলাম সিঁড়ি বেয়ে । ডোরবেল বাজাতেই একজন বিবাহিতা যুবতী বাচ্চা কোলে দরজা খুলল ।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেয়া এখানে থাকে ?’
বলল, ‘আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না ।’
আমার পরিচয় দেওয়ার আগেই কেয়ার ভাই এসে পড়ল । চিনতে পেরে বলল, ‘আরে শেখরদা, দিদি তো এখানে থাকে না ।’
বললাম, ‘কোথায় থাকে ?’
বলল, ‘দিদি বারাসাতে কালীকৃষ্ণ গার্লস হাইস্কুলে পড়ায় ।’
বললাম, ‘তোমাদের বাড়িটা প্রোমোটিং হয়েছে জানতামই না ।’
ও বলল, ‘ভিতরে এসো । বাইরে দাঁড়িয়ে কেন ? বাড়ি তো অনেক বছর আগে ভাঙা পড়েছে ।’
উল্টোদিকের বন্ধ ফ্ল্যাটটা দেখিয়ে বলল, ‘ওটা দিদির ফ্ল্যাট । বন্ধই পড়ে থাকে । আমরা দেখাশুনো করি ।’
‘আর তোমাদের বাবা-মা ?’
বাবা তো সেই কবেই মারা গিয়েছিল সেরিব্রালে । মা এই সেদিন গেলেন ।’
বাচ্চাটাকে ভিতরে রেখে ওঁর স্ত্রী এসে বললেন, ‘বাইরে কেন, আসুন না ভিতরে ।’
বললাম, ‘না, একটু তাড়া আছে । এদিক থেকে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম দেখা করে যাই । তোমাদের বিব্রত করলাম ।’
মিথ্যেটা বলতে হল । আমি মিথ্যে কথা বলা পছন্দ করি না । কিন্তু দু’একটা পরিস্থিতি আমাকে দিয়ে মিথ্যে বলতে বাধ্য করায় ।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার দিদি এখন আর শ্বশুরবাড়ি থাকেন না ?’
কেয়ার ভাই বলল, ‘না, দিদির সঙ্গে জামাইবাবুর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে । ও-বাড়ির কেউ দিদিকে ভাল চোখে নেয় না ।’
বলেই বলল, ‘কিছু মনে কোরো না ওঁরা আবার তোমার আত্মীয় হন । কিন্তু আমাদের দিকটাও তো একবার ভেবে দেখতে হবে ।’
বললাম, ‘থাক ওসব পুরনো কথা । চলি ।’
নেমে এসে অটো নিয়ে বেলগাছিয়া মেট্রো-স্টেশনে গিয়ে মেট্রো ধরে দমদম এলাম । সেখান থেকে বনগাঁ লোকালে উঠলাম । পড়ন্ত বিকেলের ট্রেন ফাঁকাই ছিল । কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল, রঞ্জিতকে শেষবারের মতো একা দেখতে যাওয়াটা অন্যায় হবে, যতক্ষণ ধর্মমতে তার স্ত্রী বেঁচে রয়েছে ।
অনেক দ্বিধা নিয়ে বারাসাতে ট্রেনটা ছেড়ে দিলাম । কালীকৃষ্ণ স্কুলের গেটে পৌঁছে দেখি স্কুল তখনও ছুটি হয়নি । দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম কেয়ার নাম দিয়ে । দারোয়ান ভিতর থেকে খোঁজ নিয়ে এসে বলল, ‘দিদিমণি ক্লাসে ।’
আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম । ছুটির ঘন্টা বাজতেই নানা বয়সি ভিন্ন ভিন্ন ক্লাসের ছাত্রীরা বেরিয়ে আসতে লাগল । একজন রোগা ছিপছিপে ছাত্রী, শাড়ি পরা, এসে হঠাৎ আমায় প্রণাম করে বলল, ‘আপনি তো লেখক শেখর বন্দোপাধ্যায়, তাই না ?’
বললাম, ‘তাই তো মনে হচ্ছে ।’
‘আমি আপনার সব বই পড়ি । নতুন উপন্যাস ‘আতসকাচের ঘর’-ও পড়েছি । ‘চতুর্দশীর কবিতাগুচ্ছ’-ও খুব ভাল ।’
বললাম, ‘এগুলো তো সব বড়দের লেখা । তুমি কোন্ ক্লাসে পড়ো ?’
‘টুয়েলভ্, মেয়েরা এসব লেখাই পড়তে ভালবাসে ।’
মেয়েটা হাসল । বললাম, ‘তোমার সামনে বোর্ডের পরীক্ষা । মন দিয়ে পাঠ্যবই পড়ো ।’
ঘাড়ে নেড়ে চেলে গেল মেয়েটা ।
কিছুক্ষণ পরে দেখি কেয়া স্কুলের দু’তিনটে দিদিমণির সঙ্গে বেরল । আমাকে দেখতে পেয়ে থ হয়ে গেল, তারপর এগিয়ে এল । ওর সঙ্গে আরও একজন দিদিমণি এগিয়ে এসে বলল, ‘কী সৌভাগ্য, আপনি এখানে ?’
আমি জবাব না দিয়ে মৃদু হাসলাম ।
ঐ ভদ্রমহিলা কেয়ার কাঁধে চাপড় মেরে বলল, ‘বলিসনি তো, এরকম একজনের সঙ্গে তোর পরিচয় আছে ।’
কেয়াও মৃদু হাসল । তবে, হাসিটা সৌজন্যের, না কি লজ্জার, বুঝলাম না । ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আপনারা কথা বলুন আমাদের ট্রেন ধরতে হবে, আমরা চলি । বলে, আরও দু’জন শিক্ষিকা যারা অদূরে দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের দলের সঙ্গে উনি গিয়ে যোগ দিলেন ।
ওরা চলে যেতেই কেয়া আমার দিকে চেয়ে বলল, ‘পরিবর্তন কিছুই হয়নি, শুধু শরীরে অভিজ্ঞতার ছাপ এসেছে ।’
বললাম, ‘তুমিও আগের মতোই আছ ।’
সে বলল, ‘রোগা আমি বরাবরই ছিলাম, এখন ওপরে আড়াল টাঙিয়েছি ।’
আমরা হাঁটতে লাগলাম । কেয়া একটু দাঁড়িয়ে ওর মোবাইলটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল । বলল, ‘এত বছর পর, তাও আমার স্কুলে, চাকরির জায়গায় দেখা করতে আসলেন । বাজ পড়েছে ? না কি মড়ক লেগেছে ?’
বললাম, ‘দরকার আছে ।’
ও বলল, ‘সে আমি বুঝেছি । নইলে অপ্রয়োজনে বিখ্যাত মানুষেরা আসে না ।’
‘কেন ? কোনও মানুষ আপনা থেকে আসে না তোমার সঙ্গে দেখা করতে ?’
ও হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেল । বলল, ‘ বললাম তো, আসে না । আর এতেই আমি অভ্যস্ত ।’
বললাম, ‘তোমাকে একটা কথা বলার ছিল কেয়া ।’
‘বলে ফেলুন !’
—এভাবে ? কোথাও গেলে হত না ?
‘আমি এখানে একজনের বাড়িতে পেয়িংগেস্ট হিসাবে থাকি । সেখানে আপনাকে নিয়ে যাওয়া যাবে না । আমি এখন লেকটাউনে থাকি না ।’
—জানি । গিয়েছিলাম সেখানে ।
আশ্চর্য হল কেয়া ।
বলল, ‘এতবছর পর আপনাকে আমার কাছে কে পাঠাল ? আপনার ভাই ?’
—সে পাঠায়নি । কিন্তু আমি তার জন্যেই এসেছি ।
‘এসে থাকলে খুব ভুল করেছেন । আমি ওকে মন থেকে মুছে ফেলেছি ।’
আমি অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলাম । বললাম, ‘এসব কথা কোথাও বসে বললে হত না ?’
‘এটা কলকাতা নয়, এসব জায়গায় অত কফিশপ, রেস্তরাঁ নেই । আর চায়ের দোকানে যাওয়ার অভ্যেস আমার নেই ।’
একথা বলেই সে বলল, ‘শুনুন, পুরনো বিষয়ে আমি আর আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই না । নতুন কথা থাকলে বলতে পারেন । অ্যাই রিক্সা, চাঁপাডালি যাবে ?’
বললাম, ‘তুমি চলে যাচ্ছ কেন ?’
‘কারণ, নতুন কথা আপনার নেই তাই ।’
রিক্সায় উঠে বসল কেয়া । বললাম, ‘তোমার মোবাইল নম্বরটা অন্তত দাও ।’
নম্বরটা দিল না কেয়া । উল্টে আমারটা চেয়ে নিল । তারপর চলে গেল ।
আমি অপমানিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ ।

। ২ ।

দুপুর রোদে রঞ্জিতের মৃত্যুর খবরটা পেয়েই বেরিয়ে পড়েছিলাম । মাথা ধরেছে দেখে একটা চায়ের দোকানে ঢুকে চা খেলাম । আসলে এতবছর পর কেয়ার অবজ্ঞাটা মন থেকে সরাতে পারছিলাম না । চা খেয়ে সবেমাত্র সিগারেটটা ধরিয়েছি, অচেনা নম্বর থেকে ফোন এল ।
‘হ্যালো ।’
—কেয়া বলছি । ওখানেই দাঁড়িয়ে আছেন এখনও ?
‘হ্যাঁ, কী করে জানলে ?’
—স্বভাবটা চিনি তাই । দরকারটা বলে দিয়ে বাড়ি যান ।
বুকে পাথর চেপে বললাম, ‘রঞ্জিত আর নেই । দু’দিন আগে মারা গেছে ।’
‘ও, রাখছি ।’
ফোন কেটে দিল কেয়া । কেয়াকে আমার ভীষণ নির্দয় মনে হল । কুড়ি বছর আগে সে এরকম ছিল না । তখন ওর মুখে একটা চাপা হাসি ছিল । কিন্তু সেই হাসি প্রকাশ করত না ওর মনের গোপনীয়তা । চোখের দীপ্তিতেই ও জ্বলে উঠত । ওর দৃষ্টি বলে দিত, ইন্ধন জোগাচ্ছে ওর ভিতরের তরঙ্গগুলো । আমরা, মানে আমি আর আমার বাবা-মা একবার দার্জিলিংয়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম । আমাদের সঙ্গে রঞ্জিত গিয়েছিল । দার্জিলিং মেলে আমাদের উল্টোদিকের বার্থে কেয়াদের সিট পড়েছিল । কেয়ারাও সপরিবারে দার্জিলিং যাচ্ছে, কিন্তু সেখানে ওরা থাকবে মাত্র তিনদিন । বাকিটা লাভা লোলেগাঁওতে কাটাবে ।
শিয়ালদা স্টেশন থেকে রাত্রে ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ পরেই ধীরে ধীরে কামরার লাইট বন্ধ হতে শুরু হল । শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরায় রেল কোম্পানীর দেওয়া সাদা চাদর পেতে বালিশ ও কম্বল পাতিয়ে আমরা বিছানা তৈরি করে উঠে পড়লাম । সবচেয়ে উঁচু বার্থে শুয়ে আমি বুকের ওপরে মেলে ধরলাম ভার্জিনিয়া উলফের ‘দ্য ওয়েভস্’ উপন্যাসটি । আমার নিচের বার্থে শুয়ে পড়ল রঞ্জিত । একেবারে নিচের বার্থে আমার মা । আমার মায়ের মুখোমুখি বার্থে যে ভদ্রমহিলা শুয়ে ছিলেন, তার ঠিক ওপরের বার্থে রঞ্জিতের উল্টোদিকে শুয়ে ছিল কেয়া । দু’একবার লক্ষ করলাম মেয়েটাও সঙ্গে করে বই এনেছে, কিন্তু বন্ধ করে রেখে দিয়েছে, পড়ছে না । আমি বই পড়ায় মন দিলাম । ইতিমধ্যে ট্রেন বর্ধমান পেরিয়ে বোলপুরগামী । রঞ্জিত আমাকে হাত বাড়িয়ে ইশারায় জানাল, ‘কথা বললে হয় না একবার মেয়েটার সঙ্গে ?’ আমি তাকে বারণ করে বললাম, ‘না ।’
দেখলাম, কম্বলের তলায় অস্বস্তি হচ্ছে মেয়েটার । একবার উঠে বসে সে চুল ঠিক করল । উঠে বসতেই কম্বলটা সরে গেল বুক থেকে । নজর পড়ল, ভরাট বুক নিয়ে গড়ে উঠেছে তার বছর তেইশের ছিপছিপে শরীর । পুনরায় কম্বল টেনে নিয়ে শোওয়ার সময় আমাকে দেখে ঈষৎ হাসল ।
আমি সেদিন বইটা বেশিদূর পড়তে পারিনি । ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । সকালে উঠে দেখি ট্রেন কুমেদপুর পার করে ছুটে চলেছে । উঠে দেখি নিচের ভদ্রমহিলা আমার মায়ের সঙ্গে গল্প করছে । মেয়েটার বাবা, আমার বাবা একসঙ্গে বসে চা খাচ্ছে । কিন্তু বাকি দুটো বার্থ খালি । রঞ্জিতও নেই, মেয়েটাও নেই ।
আমি ব্রাশ করতে গিয়ে দেখি ট্রেনের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রঞ্জিত মেয়েটার সঙ্গে কথা বলছে । মেয়েটা হাসছে সেসব কথা শুনে । ওর পাতলা চুল বাইরের হাওয়ায় উড়ে এসে মুখে লাগছে । আমাকে দেখেই হাসি থামিয়ে চেহারায় ফিরিয়ে আনল অদ্ভুত গাম্ভীর্য ।
রঞ্জিত মেয়েটাকে বলল, ‘আলাপ করিয়ে দিই । এ হচ্ছে আমার মাসতুতো দাদা, শেখর । সাহিত্যিক হতে চায়, কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ছে ।’
তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, ‘আর ও হচ্ছে কেয়া, বাংলা নিয়ে এমএ-তে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে ।’
আমি ব্রাশ করে চলে এলাম, ওরা দাঁড়িয়ে গল্প করতে লাগল । ট্রেন যখন নিউজলপাইগুড়ি স্টেশনে ঢুকবে, রঞ্জিত ফিরে এসে বলল, ‘ওর কাল ঘুম আসছিল না, তাই দু’জনে জেগে গল্প করলাম ।’
বললাম, ‘সে তো দেখতেই পাচ্ছি ।’
—কোথায় আর দেখলি ? কাল রাতে দু’জনে একসঙ্গে ট্রেনের দরজা থেকে ফারাক্কার লকগেট দেখলাম ।
রঞ্জিতের এসব কথায় সেদিন আমি গুরুত্ব দিইনি । কারণ, জানি স্টেশনে পৌঁছলে মেয়েটা আমাদের থেকে আলাদা হয়ে যাবে ।
গেলও তাই । ওরা আলাদা গাড়ি নিল, আমরা আলাদা গাড়ি । কেয়ার ভাই এসে আমাদেরকে শেষবারের মতো সৌজন্য দেখিয়ে বিদায় জানিয়ে গেল ।
হোটেলে উঠলাম । সামনেই মিনিট পাঁচেক দূরে ম্যাল । পরদিন সকালে আমরা ব্রেকফার্স্ট করতে গ্লেনারিজে গিয়েছি, হঠাৎ সেখানে দেখা হয়ে গেল কেয়াদের সঙ্গে । কেয়া একটা ব্লু জিনসের ওপর লাল উলের হাইনেক গেঞ্জি পরে ছিল, মাথায় একটা উলের সাদা টুপি । তবে, দ্বিতীয়বার দেখা হয়েও ওর সঙ্গে আমার বিশেষ কথা হল না । তৃতীয়বার কেয়াদের সঙ্গে দেখা হল ঘুম মনেস্ট্রিতে । আমরা যখন প্যাগোডাতে ঢুকছি, ওরা তখন দেখে বেরচ্ছে । সেই আলাপটা বেশ দীর্ঘক্ষণ হয়েছিল ওদের সঙ্গে আমাদের পরিবারের । আমরা দুই পরিবার একসঙ্গে মনেস্ট্রির বাইরে একটা দোকান থেকে মোমো খেয়েছিলাম । তখন মোবাইল ছিল না । একটা পকেট ডায়েরির পাতা ছিঁড়ে কেয়া ওদের ল্যাণ্ডলাইনের নম্বরটা লিখে দিয়েছিল রঞ্জিতকে, আর রঞ্জিতদের বাড়ির ফোন নম্বরটা টুকে নিয়েছিল ঐ ডায়েরির পাতায় । রঞ্জিতকে বলে গিয়েছিল, সে যেন অবশ্যই ফোন করে তাকে । ভদ্রতা দেখিয়ে আমাকেও বলেছিল, আপনিও করবেন ।
পরদিন ওরা লাভা লোলেগাঁওতে চলে গিয়েছিল । সেবারে আর ওদের সঙ্গে দেখা হয়নি । ফিরে এসে আমি প্রায় অনেকদিনই মাসির বাড়ি যাইনি । মাসিদের একান্নবর্তী পরিবার । তবে শরিকে শরিকে অশান্তি আছে । রঞ্জিতের বাবারা তিনভাই । বড়জনা মারা গেছে, তার বিধবা স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে আছে । মেজ জনা বিয়ে করেনি । আর রঞ্জিতের বাবা হল ছোটভাই । রঞ্জিত আইন নিয়ে পড়াশুনো করছে কল্যাণী থেকে । একদিন কী মনে করে দু’দিনের ছুটিতে গিয়ে হাজির হলাম মাসির বাড়িতে । গিয়ে শুনলাম, কেয়ার সঙ্গে রঞ্জিতের বেশ গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে । কেয়ারা নাকি মাসির বাড়িতে এসে ঘুরেও গেছে একবার । রঞ্জিত ছুটিতে বাড়ি এসেছিল ।
বলল, ‘ল তে মাস্টার্স শেষ হতে আর ছ-মাস বাকি ! শেষ হলেই প্র্যাকটিস শুরু করব । তারপর কেয়া-রানিকে বিয়ে করছি ।’
বললাম, ‘শুনেছি, আগে না কি বড় উকিলের সঙ্গে দু-চার বছর কাজ শিখে নিতে হয়, অভিজ্ঞতা হলে তবে নিজে প্র্যাকটিস করা যায় ।’
রঞ্জিত বলল, ‘ওসব অভিজ্ঞতার ব্যাপার ক্রিমিনাল কেসে লাগে । আমি সিভিল কেস ধরব । জমিজমার কেলেঙ্কারি, পয়সার কারচুপি, বাড়িঘরের অংশ নিয়ে ঝুটঝামেলা, বিয়ে ভাঙা, —এই সব কেস ! থানা পুলিশের ঝক্কি নেই, বসে মাল্লু আসবে ।’
‘কেয়ার বাড়ি থেকে বিয়েতে রাজি ?’—জিজ্ঞেস করলাম ।
—রাজি বলেই তো অপেক্ষা করতে পারছি না । কেয়ার ইচ্ছেই ওর বাবা-মায়ের ইচ্ছে ।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘মাসি কী বলছে ?’
—কী আবার বলবে ? কেয়াকে দেখতে দেখেছিস ? আমাদের এলাকায় দুশো বছরেও ওরকম সুন্দরী মেয়ে জন্মাবে না । আশা পারেখের ভঙ্গিতে জিনাৎ আমনের কম্বিনেশান । মা দেখেই মত দিয়ে দিয়েছে ওদের ।’
অদ্ভুতভাবে, পাশ করার পর একটা ছোট চেম্বার খুলে ওকালতি শুরু করেছিল রঞ্জিত । আমি পাশ করে বেরিয়ে তখনও চাকরি পাইনি । আমি চাকরি পেলাম ওদের বিয়ের অনেক পরে । রঞ্জিত এক বছরে পয়সা জমিয়ে ফেলেছিল । কোনও নেশাভাঙ করত না তখনও অবধি । বর্ষাকালের এক বৃষ্টিহীন সন্ধেতে রঞ্জিতের সঙ্গে কেয়ার বিয়ে হয়ে গেল ।

। ৩ ।

হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনে এসে দেখি, গেটে ঢোকার মুখে কেয়া দাঁড়িয়ে আছে । যে শাড়িটা স্কুলে পরে এসেছিল, সেটাই পরে আছে । তার মানে, বাড়ি যায়নি ।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাড়ি যাওনি ?
বলল, ‘স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়ে কেউ বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম করে না । রিক্সাটা স্টেশন রোডের দিকে ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম । চলুন, টিকিট কাটতে হবে ।’
বললাম, ‘আমার বনগাঁ অবধি টিকিট কাটা আছে । তোমারটা কেটে আনি ।’
আমাকে থামিয়ে সে নিজেই গিয়ে নিজের টিকিট কেটে আনল । দেখলাম, নতুন করে বৈধব্য তাকে স্পর্শ করেনি । সে আগে থাকতেই বিধবার জীবনযাপন করে । সারাদেহে বিয়ের কোনও চিহ্ন নেই ।
প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে দেখি সন্ধে নেমে গেছে । লাইনের ওপর হলুদ আলো ফেলে বনগাঁ লোকাল ঢুকছে ।
ট্রেনে ভিড় ছিল না, তবে বসার জায়গা নেই । দু’জনে উঠে দরজা থেকে একটু ভিতরে ঢুকে পাশাপাশি দাঁড়ালাম । কেয়া বাইরের দিকে তাকিয়ে, আর আমি তাকিয়ে ওর কুড়ি বছর পরবর্তী তেতাল্লিশের মুখের দিকে ।
সেইবার ওদের বিয়ের পর একদিন গিয়েছিলাম মাসির বাড়িতে । কেয়া তখন নতুন বৌ । যেহেতু আমাদের আগে থাকতে পরিচয় ছিল,—আমি, রঞ্জিত আর কেয়া একসঙ্গে বসে সারাদিন আড্ডা দিয়েছিলাম । ছবি তুলেছিলাম । আমার বইয়ের টেবিলে রাখা ছবিটা সেই সময়েই তোলা । আমি কেয়ার জন্য অরুণ কুমার সরকারের কবিতার বই নিয়ে গিয়েছিলাম । বইটা হাতে পেয়ে কেয়া বলেছিল, ‘কবিতা ? কবিতা তো একইসঙ্গে মানুষকে জুড়ে দেয়, আবার তাকে তছনছ করে ।’
আমি বলেছিলাম, ‘তাই তো ঘটে জীবনে । ধ্বংসের মধ্যেই বেঁচে থাকে সৃষ্টির চিরকালীন সত্য ।’
হঠাৎ ও বলেছিল, ‘আপনার ভাইকে বোঝান সেটা ! সারাক্ষণ বলে, আইনই সব । জীবন নাকি নীতি ছাড়া চলে না । আর কথায় কথায় সেকশান, আণ্ডার সেকশান, ক্লজ, —এইসব বলবে ।’
শুনে হেসেছিলাম । বলেছিলাম, ‘ওসব আদালতের বুলি ।’
জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কলকাতা ছেড়ে এসে এখানে কেমন লাগছে ?’
ম্লান হেসে কেয়া জবাব দিয়েছিল, ‘খারাপ না ।’
তারপর চাকরি পাওয়ায় তিনবছর যেতে পারিনি ওদের বাড়িতে । একদিন দুপুরে খেতে বসেছি, মাসির বাড়ি থেকে টেলিফোন এল রঞ্জিতের পেটে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে, বনগাঁ হাসপাতালে ভর্তি । ট্রেন ধরে গেলাম । গিয়ে দেখি হাসপাতালে ওর বৌ কেয়া আর ওর জেঠতুতো দাদা সমীর দাঁড়িয়ে আছে । সঙ্গে ওর বন্ধু জয় রয়েছে ।
জয়কেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে রঞ্জিতের ?’
‘লিভারে আলসার ধরা পড়েছে দাদা ।’
—সে কী ? হঠাৎ !
‘ হবে না ? আজ দু-বছর ধরে রেগুলার মদ খাচ্ছে ।’
—কেন ? যদ্দূর জানি, ও তো নেশাভাঙ কিছুই করত না ।
জয় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল ।
আমি বললাম, ‘জয়, কী হয়েছে খুলে বলো । আমি ওর দাদা হই ।’
জয় বলল, ‘কী আর বলব দাদা, ওদের বাড়িতে তো শরিকের অশান্তি লেগেই আছে । তার সঙ্গে রঞ্জিতের বৌয়ের বাচ্চা হচ্ছে না বলে অশান্তি হচ্ছে বাড়িতে ।’
আমি লজ্জায় চোখ ফেরালাম অন্যদিকে । জয় বলল, ‘তোমার মাসি, মানে রঞ্জিতের মা উঠতে বসতে খোঁটা দেয় বৌদিকে । রঞ্জিত কখনও বৌয়ের হয়ে মা-কে গালমন্দ করে, কখনও মায়ের হয়ে বৌ-কে ।’
রঞ্জিত সে যাত্রায় রক্ষা পেয়ে গেল । কিন্তু আমি কেয়াকে ও-বাড়িতে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার গায়ে হাত তুলেছে রঞ্জিত ?’
সে বলল, ‘না, কিন্তু তুললেও আশ্চর্য হব না ।’
বললাম, ‘এভাবে কেন বলছ ?’
—কেন নয় ? আমি তো পাপী ! আমি এদের বাড়িতে বংশধর এনে দিতে পারছি না ।’
‘বংশটাই কি সব ? মানুষটার মূল্য নেই ?’
—এদের কাছে নেই । আপনার কাছে থাকতে পারে ।
একটা ক্ষীণ সত্য কেয়ার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল । আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম, আমি কি ঠিক শুনছি ?
পুজোর ছুটির পর মেসোমশাই মারা গেলন । মাসির বাড়ি গিয়ে শুনি রঞ্জিতের বৌ আলাদা থাকে খায়, কেউ ওর সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না । শুধু রঞ্জিত মাঝেমধ্যে কথা কাটাকাটি করে । কেয়াকে ওরা আলাদা করে দিয়েছে, সে এখন একতলার একটা ঘরে থাকে । স্থানীয় একটা বাচ্চাদের স্কুলে পড়ায় ।
কেয়াকে বললাম, ‘একবার ডাক্তার দেখিয়ে নিলে বিষয়টার নিষ্পত্তি হয়ে যায় তো ! কলকাতায় নাম করা সব গাইনি আছে ।’
কেয়া বলল, ‘কলকাতার ডাক্তারকেই দেখিয়েছি । আমার কোনও সমস্যা নেই । যার আছে, তার সেটা মানতে পুরুষত্বে লাগে ।’
—সে কী ! রঞ্জিত তো এমন ছিল না, ও কেন ডাক্তার দেখাচ্ছে না ?’
‘সেটা আপনার ভাইকে জিজ্ঞেস করুন ।’
রঞ্জিতের কোনও খোঁজ পাচ্ছিলাম না দেখে জয়কে ধরলাম । জয় বলল, ‘সে এখন একটা নতুন মেয়েছেলেকে নিয়ে পড়ে থাকে বাংলাদেশ বর্ডারের কাছে ।’
বললাম, ‘তুমি নিয়ে যাবে আমাকে ওর কাছে ?’
জয় বলল, ‘জায়গাটা ভাল নয় দাদা, ওপার বাংলা থেকে যারা এসেছিল, তাদেরই কলোনি ওটা । রঞ্জিত ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে । পাড়াটা খারাপ, এলাকায় খুনখারাপি হয় ।’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘টাকা পায় কোথায় ? এখনও প্র্যাকটিস করে ? কোর্টে যায় ?’
‘সব লাটে উঠেছে দাদা, কী আর বলব ! রাস্তার ধারে চেম্বারটাও জলের দরে বেচে দিল । জমানো টাকা ছিল এককালে, সেসব মদ খেয়ে উড়িয়েছে । এখন বাড়ি গিয়ে টাকার জন্যে অশান্তি করে । ওর বৌ তো বাচ্চাদের স্কুলে চাকরি পেয়েছে । বৌয়ের কাছে টাকা চাইতে যায় যখন, সেসময় বাড়িতে অশান্তি হয় । আমার কাছেও টাকা চেয়েছিল । প্রথম প্রথম দিয়েছি, এখন দিতে পারি না বলে আমার সঙ্গেও আর সম্পর্ক রাখে না । তবে, তোমার ওপরে ওর খুব রাগ দাদা । বলে, তোমার জন্যেই নাকি ওর সংসারটা ভেসে গেছে ।’
আকাশ থেকে পড়েছিলাম জয়ের কথা শুনে । ওর সংসারে আমি তো কখনও বাধা হয়ে দাঁড়াইনি । তাও এত বড় বদনাম দিল রঞ্জিত আমায় !
জয় আমাকে ওর মোটরবাইকে চাপিয়ে বর্ডারের কাছে পাড়াটার সম্মুখে নামিয়ে দিল । বলল, ‘ফেরার সময় অটো পেয়ে যাবেন ।’
পাড়াটায় ঢুকে অল্প খোঁজাখুঁজির পর একটা অর্ধেক ভাঙা বাড়ি দেখতে পেলাম । একজন বলল, ‘রঞ্জিতবাবু ওটাতেই থাকে ।’ দরজা দিয়ে ঢুকে উঠোন পেরিয়ে ঘরে ঢুকতেই দেখি রঞ্জিত একটা বিছানায় গামছা পরে শুয়ে আছে, আর ওর বুকের ওপর একটা শ্যামবর্ণ মেয়ে উদোম ন্যাংটো হয়ে বসে শীৎকার করছে । আমাকে দেখে মেয়েটা গায়ে কাপড় জড়িয়ে ব্লাউজটা হাতে নিয়ে তড়িঘড়ি বেরিয়ে গেল ঘর থেকে ।
রঞ্জিত গামছাটা শক্ত করে এঁটে বলল, ‘আরে তুই ? আসার আর সময় পেলি না ! টগর কী সুন্দর ফুটে উঠেছিল, ঝরে গেল শালা ।’
বিছানার এক কোণে বসে বললাম, ‘মেসোমশাই মারা গেছে খবর দিসনি কেন ?’
—কী খবর দেব ? বাবা দিনরাত চেয়ারে বসে সংসারের ঝগড়া দেখত, একদিন চেয়ারেই ঢলে পড়ে গেল ।
জানা সত্ত্বেও জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোর বৌ এখন আলাদা থাকে ?’
—ইয়েস ! চাকরি করে তাই ফুটানি বেড়েছে ।
‘মুখ সামলে কথা বল রঞ্জিত । তোর লজ্জা করে না কেয়াকে অপমান করতে ?’
—ওসব লজ্জা তোমাদের ভদ্রলোকেদের আছে । আমি ছোটলোক, আমার নেই ।
যে মেয়েটা গায়ে কাপড় জড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, সে কাপড়চোপড় পরে এসে দরজায় দাঁড়াতেই রঞ্জিত পকেট থেকে টাকা বের করে বলল, ‘টগর, এই বাবু আমার দাদা হয় । বোতল নিয়ে এসো, মাংস আনো, দেদার ফুর্তি হবে আজ ।’
আমি ধমক দিলাম, ‘না, ওসব কিছুই আনতে হবে না । তুমি যাও ।’
মেয়েটা চলে গেল । আমি বললাম, ‘বাড়ি চল । আমি তোকে নিয়ে যেতে এসেছি ।’
রঞ্জিত বলল, ‘কেয়া যতদিন ঐ বাড়িতে আছে, আমি যাব না । শালা, রস খাবে তোমরা । আর আমি আঁটি হয়ে পড়ে থাকব ?’
—মানে ? কী বলছিস কি তুই ?
‘ঠিক বলেছি কাকা । তুমি হলে সুপুরুষ, তোমাকে দেখে আমার নাকি শেখা উচিত ! আমি তো জন্তু শালা, বৌ-কে পেট করার মুরোদ নেই, শুধু শুধু আর কদ্দিন দেবে বিছানা গরম করতে ?’
—এসব কে বলেছে তোকে ? কেয়া ?
‘তবে, আর বলছি কী ভাই ! তোমার দেওয়া কবিতার বই সে বুকের ওপরে রেখে ঘুময় দুপুরবেলা ।’
বুঝলাম, রঞ্জিত মদ খেয়ে আছে । আমি উঠে আসলাম । বেরিয়ে আসার সময় টগরের সঙ্গে আবার দেখা হল । ঘরের ভিতর থেকে রঞ্জিত চিৎকার করে বলছিল, ‘চলে যাচ্ছিস কেন ? আমাদের বংশে একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে যা কেয়ার পেটে ।’
মাসির বাড়িতে ঢুকে কেয়ার ঘরে গেলাম । সে স্নান সেরে ঘরে বসে বই পড়ছিল । গিয়ে বললাম, ‘কী বলেছ তুমি রঞ্জিতকে আমার সম্পর্কে ?’
কেয়া বইয়ের পাতার থেকে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকাল, কিন্তু জবাব দিল না । বললাম, ‘আমি আর কোনওদিন এ বাড়িতে আসব না ।’
কথাটা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম । কেয়া পিছন থেকে ডাকল, ‘দাঁড়ান । অন্যায়টা কী বলেছি ?’
আমি ফিরে তাকালাম । ও বই বন্ধ করে বিছানা থেকে উঠে এসে বলল, ‘আপনি আমাকে প্রথম যেদিন ট্রেনে দেখেছিলেন, মনে মনে আমাকে সেদিন চাননি ? আপনার ভাইকে বিয়ে করেছি শুনে আপনি নিজেকে সরিয়ে নিলেন । আপনার ভাই যখন আমাকে অপমান করে, আপনার তখন সেটা গায়ে লাগে না ? আমার শরীরের সঙ্গে আপনার ভাইয়ের শরীরকে আপনি কল্পনা করে কষ্ট পান না ? বলুন মিথ্যে ?’
আমি নিরুত্তর ভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম । কেয়া বলল, ‘আপনি চলে যেতে চাইলে চলে যেতে পারেন, আপনাকে কেউ আটকাবে না ।’ এই বলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ।

। ৪ ।

বনগাঁয় পোঁছে হাসপাতাল থেকে রঞ্জিতের দেহ নিয়ে খয়রামারি শ্মশানে দাহ করতে রাত আটটা বেজে গেল । থানায় যেতে হয়নি । দারোগা নিজে হাসপাতালে এসে রিপোর্টগুলো দিয়ে গেছে । কেয়া বলল, ‘আমি একবার ও-বাড়িতে যাব । আপনি যাবেন ?’
বললাম, ‘না, আমি সঙ্গে গেলে তোমাকে অনেক কথা শুনতে হতে পারে ।’
‘তা হলে আপনি এখন কোথায় যাবেন ?’—কেয়া জিজ্ঞেস করল । দেখলাম স্বামীর মৃত্যুতে ওর চোখ দুটো নির্বিকার, কিন্তু গলাটা ধরে এসেছে ।
‘আমার এক অফিস কলিগের বাড়ি আছে মতিগঞ্জে, নদীর ওপারে । আমি ট্রেনে থাকতে ফোনে কথা বলেছি । আজ রাতে ওখানেই থাকব, কাল সকালে ফিরে যাব ।’
শুনে কেয়া চলে গেল ।
আমি কলিগের বাড়ি এসে ডোরবেল বাজাতেই কলিগের স্ত্রী দরজা খুলে আনন্দিত হল । ওদের বাড়ি স্নান সারলাম, চা খেলাম । সারাদিনের ক্লান্তির পর শরীরটা ফ্রেশ লাগছিল । অফিস কলিগ রুদ্র বলল, ‘আমার স্ত্রী তোমার লেখার খুব ভক্ত । সব বই পড়ে । সম্প্রতি দেশে তোমার ধারাবাহিক লেখাটা নিয়ে ভীষণ প্রশংসা করেছে । লেখাটা নাকি ওর জীবনের সঙ্গে খেটে গিয়েছে ।’
তারপর ওর স্ত্রী শুনে বলল, ‘হ্যাঁ দাদা, কী করে যে এমন লেখেন ! কতবার ওকে বলেছি, দাদা যখন তোমার অফিসে কাজ করে, একদিন ওঁকে নিয়ে এসো আমাদের বাড়িতে ।’
রুদ্র বলল, ‘আমি তো কবেই বলেছি, শেখরদা আসতেই চায় না । আর আজ নিজে থেকে ফোন করে জানাল যে, আসবে ।’
আমি বললাম, ‘আসলে সময় পাই না । এদিকে একটা ব্যক্তিগত কাজে এসেছিলাম, তাই—’
ঠিক ঐ মুহূর্তে আমার এসব প্রশংসার কথা শুনতে ভাল লাগছিল না । আমি কেয়ার কথা ভাবছিলাম । দীর্ঘ কুড়ি বছর পর ওরা কি কেয়াকে মেনে নেবে ? ছেলেই যেখানে রইল না, ছেলের বৌ-কে এত বছর পর দেখে ওরা নিশ্চয়ই খুশি হবে না । কেয়াকে এখন হয়তো অনেক অপমান পেতে হচ্ছে । আমি কেন আনলাম ওকে এখানে ? নিজেই তো দাহ করে দিতে পারতাম ভাইয়ের দেহ । শুধু কি কর্তব্যরক্ষার খাতিরে ওকে আনলাম ? না কি আমার পক্ষে ওকে ছেড়ে বেঁচে থাক সম্ভব হচ্ছে না বলেই রঞ্জিতের মৃত্যুর খবরটা আমি সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করলাম । জীবনের চেহারা কতটা নিষ্ঠুর হয়, সেটা কাহিনি না থাকলে বোঝা যায় না ।
ওদের বারান্দায় এসে একটা সিগারেট ধরালাম, তখনই মোবাইলটা বেজে উঠল । কেয়ার ফোন দেখে ধরলাম ।
‘আপনি কি আজ রাতে এখানেই থাকবেন ?’
কেয়া জিজ্ঞেস করল ।
বললাম, ‘হ্যাঁ, তাই তো ঠিক হয়েছে ।’
সে বলল, ‘আমি আজ রাতের ট্রেনেই ফিরব । আপনি চাইলে যেতে পারেন ।’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘ও-বাড়িতে থাকলে না ? কী বলল ওরা ?’
‘কী আর বলবে ? ওদের বলার মতো মুখ নেই, পরিস্থিতিও নেই । শুধু অপমান করে ছেড়ে দিল । আমি নাকি আপনার ভাইয়ের জীবন নষ্ট করেছি । যাক গে, আপনি থাকুন আজকে । আমি চলে যাচ্ছি ।’
বললাম, ‘একা যেও না । স্টেশনে অপেক্ষা করো, আমি আসছি ।’
কাজের অজুহাত দেখিয়ে রুদ্রদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম । স্টেশানে পৌঁছে রাতের গাড়ি ধরলাম আমরা । রাত সাড়ে দশটার ট্রেন ফাঁকা, তবু জানলার ধারে আমরা মুখোমুখি বসলাম না । বসলাম পাশাপাশি । হঠাৎ খেয়াল করলাম কেয়া আমার কাঁধে মাথা রেখেছে । ওকে ছুঁতেই ও ককিয়ে কেঁদে উঠল । আমি ওকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে ?’
ও বলল, ‘কুড়ি বছর ধরে সমস্ত গল্প-উপন্যাসে, অসংখ্য চরিত্রের মধ্যে দিয়ে আমার শরীর মন নিয়ে খেলা করেছেন আপনি । তবু আমায় ভালবাসতে পারেননি একটুও । সব পড়েছি আমি । আপনি খুব স্বার্থপর, শুধু নিজের কথা ভাবেন !’
আমি নিশ্চুপ থাকলাম । বারাসাত এলে কেয়া ট্রেন থেকে নেমে জানলার কাছে এল । বলল, ‘পৌঁছে ফোন করবেন । আর সাহস থাকলে বাড়ি গিয়ে নতুন উপন্যাসে আমাদের সত্যিটা লিখবেন । পড়ার অপেক্ষায় থাকব ।’

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes