
শুধুই কিছু কথা | কিছু কথা
শুভদীপ সাহা
শুধুই কিছু কথা উদয়ন বাজপেয়ী অনুবাদ : সন্দীপন চক্রবর্তী প্রচ্ছদশিল্পী : মৃণাল শীল ঋত প্রকাশন মুদ্রিত মূল্য – ২০০/-
“অনুবাদক হলেন শাপগ্রস্ত সেই ক্ষুধাতুর তৃষাতুর ট্যান্টালাসের মতো যার হাত থেকে কেবলই সরে যায় জল, কেবলই খসে যায় ফল। কিংবা তিনি বলতে পারো যেন সিসিফাস। পাহাড়চূড়োয় পৌঁছোবার মুহূর্তেই আবার গড়িয়ে নামে সফলতার সব পাথর।”
শঙ্খ ঘোষ | ছন্দোময় জীবন
অনুবাদের ক্ষেত্রে শঙ্খবাবুর এই কথাগুলো যে কতটা যথার্থ, তা ব্যর্থ অনুবাদক মাত্রই টের পান। অনুবাদের রকমফেরে আক্ষরিক অনুবাদ কাটিয়ে কেউ কেউ ভাবানুবাদে প্রয়াসী হ’ন। উদয়ন বাজপেয়ী হিন্দি ভাষার বিশিষ্ট কবি এবং লেখক। পেশাগতভাবে তিনি ভোপালের গান্ধী মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক। নাটক, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র এবং লোকশিল্প নিয়েও তিনি কাজ করেছেন জীবনের নানা সময়ে।
বইপ্রকাশের সন্ধে পেরিয়ে কলকাতার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তাঁর সাথে আলাপচারিতায় নানা কথা উঠে আসে। উদয়ন জানান, তাঁর মতে অনুবাদককে মূল রচনার সাথে একাত্ম হ’তে হ’বে। শুধু ভাবনায় নয়— ফর্ম্যাটেও। একটি লেখা কেন এই ফর্ম্যাটেই লেখা হ’ল, তা তাঁকে বুঝতে হ’বে— অনুসন্ধান করতে হবে। সর্বোপরি, কবিতার অনুবাদককে একজন কবি হ’তে হ’বে। সেই কবি হ’তে পারে জীবনে একটিও কবিতা লেখেননি, কিন্তু তাঁর জীবনচর্যায় যেন কাব্যময়তা থাকে।
‘শুধুই কিছু কথা’, সন্দীপন চক্রবর্তীর অনুবাদ বইয়ের একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই কাব্যময়তার স্রোত আমরা টের পাই। ১৯৮৬ সালের জানুয়ারী নাগাদ উদয়ন বাজপেয়ীর কলমে উঠে আসে এমন কিছু শব্দের চলাচল, যা লিখতে ব’সে তিনি টের পান ‘এই কবিতাগুলোয় এমন কিছু ঘটে গেছে যে, এর আগের সব কবির সমস্ত কবিতাই বোধহয় কোনো পূর্বযুগের ব্যাপারস্যাপার’। এরপর শুরু হয় অপেক্ষা। উদয়নের ভাষায়, তিনি বানানেওয়ালা কবি নন। অপেক্ষাকারীদের একজন। এই চটজলদির যুগে দাঁড়িয়ে অবাক হ’তে হয়, ১৯৮৬ সালে যে কবিতার স্রোতে ধাক্কা খেয়ে অন্যরকম কবিতা লেখার অপেক্ষায় বসেছিলেন উদয়ন— ২০১৫ -তে এসে টের পান সেই স্রোত শান্ত হয়েছে। ‘কেবল কুছ বাক্য’ প্রায় তিরিশ বছরের ভাবনার ফসল। বলা বাহুল্য, দীর্ঘ তিরিশ বছরের এই চলাচলে, ‘পাওয়া কবিতা’য় জুড়ে গেছে উদয়নের ব্যক্তিগত জীবনদর্শন।
এই ব্যক্তিগত জীবনদর্শনকে সার্বিক ক’রে তোলা, তাও অন্য এক ভাষায়— এটা সহজ কাজ ছিল না। ‘শুধুই কিছু কথা’ পড়তে বসলে টের পাওয়া যায়, এই ব্যক্তিগত অনুভূতি আদতে ছেঁড়া ছেঁড়া ইঙ্গিতবাহী দৃশ্যকল্প যা এক অনির্দিষ্ট ভাবনার স্রোত তৈরি করে। এই স্রোত পরতে পরতে মিশতে থাকে এক সম্ভবনার দিকে। কখনও সেই সম্ভবনা উত্তর পায়, কখনও সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী হয়ে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় পাঠককে। পাঠককে বসতে হয় সেই লেখার পাশে। সন্দীপনের লেখায় সেই জোর আছে যা ভাবনার খোরাক দেয়, শৈল্পিকভাবে।
সন্দীপন বলেছিলেন, উদয়ন আদতে একজন বাঙালি কবি, যিনি হিন্দি ভাষায় লেখেন।
ভুল কিছু বলেননি। অনুবাদে পড়তে গিয়ে কখনও মনে হয়না অন্য ভাষায় লেখা কোনো কবিতা। ভাষার হোঁচট না খাওয়া অনুবাদকের সহজিয়া কৃতিত্ব ব’লে ধ’রে নিলে, ভাবনায় যে স্বাভাবিক চলন তা অনেকটাই উদয়নের ওপর বর্তায়। কিন্তু, এই ‘বাঙালি কবি’র অনুবাদ কি খুবই সহজ ছিল? একটা কবিতা পড়া যাক।
বাবা
টেলিফোনটা ভেঙে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মেঝেতে। তার কালো টুকরোগুলো নিয়ে, একটা ঝুড়িতে, ভরে ভরে রাখছেন বাবা। মা রাঁধুনিকে হরেক নির্দেশ দিতে ব্যস্ত। বাবাকে দেখে, লজ্জায় মা আধখানা ঘোমটা টানে। বারান্দায় খাট পাতা। শুয়ে শুয়ে আমি ভাবছি, অমরিন্দর কৌরের কথা। বারান্দার ঠিক উপরেই একটা ঘর। আমাদের মৃত আত্মীয়স্বজনরা ওখানেই থাকেন। মা রোজ তাঁদের খাবার দিয়ে আসে। তাঁরাই আমার সমস্যার সমাধান করতে পারেন। মা আমায় ওখানে নিয়ে যায় না। আমি আজ চুপিচুপি যাচ্ছি সেখানেই। ‘বাবা, আপনি কি ওকে একটু, উঠিয়ে নিয়ে আসতে পারবেন এখানে, খানিকক্ষণের জন্য? না না, আমি স্রেফ দেখতে চাই ওকে’, সে হাসছে। আমি অমরিন্দর কৌরের দরজায় দাঁড়িয়ে। ‘এই একটু আগেই তো, সাদা দাড়িওয়ালা এক বুড়ো এসে, নিয়ে গেল ওকে।’ ফিরে আসি আমি।
বাড়িতে কেউ নেই। উঠোনের দুধ-সাদা জ্যোৎস্নায় ঝকঝক করছে তার সাদা শরীর।
এক ঘটনাপ্রবাহ। চিত্রকল্প আঁকছেন কবি। একটি দৃশ্য তৈরি করলেন। একটু বিরতি নিলেন। ‘বাড়িতে কেউ নেই।’ শব্দবন্ধে ভাঙলেন তাঁর তৈরি করা চিত্রকল্প। যে অজানা আশঙ্কায় পাঠক এতোক্ষণ পড়ছিলেন কবিতাটা, তাতে যেন মৃদু সম্মতি দিলেন কবি। তারপরের “উঠোনের দুধ-সাদা জ্যোৎস্নায় ঝকঝক করছে তার সাদা শরীর।” দিয়ে সেই ভাবনার স্রোত জিইয়ে রাখলেন।
কোনোভাবেই এই লেখাকে অ-বাংলা লেখা বলে ভাবা যায় না। সন্দীপন প্রশংসনীয় এই কারণেও যে তিনি অনুবাদের জন্য উদয়নের কবিতা বেছেছেন। বা হয়তো, বলা ভালো, উদয়নের কবিতা পড়ে তা অনুবাদে না ক’রে থাকতে পারেননি।
কিন্তু, উদয়ন যে বারবার বলছিলেন, কবিতার রসকে ধরতে হবে। সন্দীপন বাংলা কবিতার জগতে একজন সার্থক কবি এবং সফল অনুবাদক (তাঁর সম্পাদক বা চলচ্চিত্র ভাবনা বা সমালোচক সত্ত্বাকে আপাতভাবে সরিয়ে রাখছি)। কিন্তু, তবুও এই প্রশ্ন উঠে আসে, এই কবিতাগুলোর ভাবনার বীজ কি তাঁর মধ্যে ‘কেবল কুছ বাক্য’ দিয়েই প্রকাশ পেয়েছে? উত্তর খোঁজার আগে পরপর দুটো কবিতার দিকে চোখ রাখি।
সাদা পাতা
বাবার গাড়িটা, এক ইমারতের সামনে দাঁড়িয়ে। বাবার সঙ্গে আমি ভিতরে। হাতে একটা বিস্কুটের প্যাকেট, বাড়ির বাইরেই সেটা আমায় দিয়েছিলেন বাবা আমরা যেখানে এসেছি, সেখানে তাঁর মেয়ের জন্মদিন উদযাপন হচ্ছে। মেয়েটার পোশাক বেশ ঝলমলে আর নতুন। রোজ সকালে, আমায় উঠিয়ে দেয় মা। স্কুল না-যাওয়ার অজস্র অজুহাত ভাবতে-ভাবতে, বিছানা ছেড়ে উঠি। ভেজা কাপড় পরেই, মা এসে বসে পড়ে রামচরিতমানসের সামনে। তার ঠাণ্ডা শরীর থেকে, টুপটুপ ঝরে ঝরে পড়ে চৌপাইগুলো। আমার ওপর বাবার এটুকুও ভরসা নেই যে, মেয়েকে উপহার দেওয়ার সময়ে, আমি একটুও ভুল করব না। বাচ্চাদের ভিড়ে, আমায় এক পলের জন্যও একলা ছাড়েন না তিনি। বাবাকে সেখানে আর আপন লাগে না, অন্য কারো বাবার মতো লাগে।
ধড়মড়িয়ে ঘুম থেকে জেগে ওঠে মা। মানস-এর পাতাগুলোও সেখানে, তার কাছে, ফাঁকা দেখায়।
স্বপ্ন
খাঁ খাঁ দুপুর। বাড়ি ঢুকতেই দেখি মা ফিরে এসেছে। বসে আছে। পাটভাঙা শাড়ি। একটু হাসলো। কথা বলছি না। মা ঘুরে ঘুরে এটা সেটা গোছাচ্ছে, খাবার বানিয়ে দিলো। আমার চোখ দুটো পোষা বেড়ালের মতো আঁচলে আঁচলে ঘুরছে।
হঠাৎ হুড়মুড় করে ঢুকতে গিয়েও, মাকে দেখে, একটু থমকে গেল বাবা। স্বস্তির শ্বাস। ঢুকলো আস্তে আস্তে। থমকে আছে বাড়ি। নিঃঝুম। মা ঘুরে ঘুরে এটা সেটা গোছাচ্ছে। বাবা বললো, ‘আমাকে কি তুমিই…?’ মা হাসলো। আবার নিঃঝুম।
গোছাতে গোছাতেই, মা আস্তে আস্তে বললো, ‘স্কুল না গেলে, ক্ষতিটা কার?’ ক্ষেপে গিয়ে চিৎকার করছি, ‘বেশ করেছি যাবো না। তুমি চলে গেছ কেন? তুমি যদি চলে যাও, আমিও যাবো না। বেশ করবো।’ বাবা বললো, ‘স্কুল থেকে ফোন করেছিলো।’ আমার চিৎকারে গনগন করছে গোটা বাড়ি।
মা আস্তে আস্তেই বললো, ‘বলেছি তো, আমি আর পারছি না। ভালো লাগছে না এই সংসার, এসব বাধ্যতা।’ থমথম করছে গোটা বাড়ি। বাবা অসহায়। চোখে তাকালো এবার।
মা ব্যাগ থেকে বোঞ্জের একটা ছোট্ট সরস্বতী-মূর্তি বার করে হাসলো, ‘এটা তোর জন্য’। চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘তুমি যাবে না। তুমি চলে গেলে আমি কিছু নেবো না।’ শান্ত মুখে মা বললো, ‘না নিলেও যেতে হবে। নিলেও তাই।”
আচমকা ধড়মড় করে ঘুম ভেঙে গেল। মা নেই। কুণ্ডলী পাকিয়ে, পাশে ঘুমোচ্ছে আমার মেয়ে। হাতে বীণা, পায়ে রাজহাঁস।
প্রথম কবিতাটি (‘সাদা পাতা’) আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল দ্বিতীয় কবিতার (‘স্বপ্ন’) দিকে। দ্বিতীয় কবিতাটি সন্দীপন চক্রবর্তীর ‘তর্পণ’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। ২০১৮ সালে যখন ভাষালিপি থেকে প্রকাশ পায় তর্পণ, তখন সন্দীপন উদয়নের নামও শোনেননি— কবিতা পড়া দূরস্ত। ‘শুধুই কিছু কথা’ পড়তে পড়তে আমার মনে হচ্ছিল ‘তর্পণ’এ যে যাত্রা শুরু করেছিলেন সন্দীপন, এই কবিতাগুলো তারই ডালপালা মেলেছে। ‘কেবল কুছ বাক্য’-এর অনুবাদে তাই বোধহয় সন্দীপন ছাড়া অন্য কারোর কাছে এতো প্রগাঢ় ভাবে ফুটে উঠত না।
কবিতা আদতে কিছু মুহূর্ত। শুধুই কিছু কথা আমাদেরকে সেই মুহূর্তের কাছে দাঁড় করিয়ে দেয়। একজন কবির তিরিশ বছরের জীবন এবং যাপন। শুধুই কিছু শব্দ দিয়ে এই মুহূর্তকে ধরার চেষ্টা এবং ব্যক্তিগত সেই অনুভূতিকে সার্বিক ক’রে তোলা। এই দীর্ঘ সময়ে উদয়ন তাঁর নিকট মানুষদের চ’লে যাওয়া দেখেছেন। চ’লে যাওয়া মানুষদের মধ্যে বেঁচেছেন। বিরাট এক শূন্যতা, এক অনুপস্থিতি, সেই অনুপস্থিতির মধ্যে দিয়ে শব্দের কাছে পৌঁছনো, শব্দের মাধ্যমে পৌঁছনো। এই অনুপস্থিতিই চিরসত্য। এই শূন্যতাই একমাত্র জীবন। যাকে যথার্থভাবে ধরেছেন সন্দীপন। ক্ষুধাতুর তৃষাতুর ট্যান্টালাসের মতো যার হাত থেকে কেবলই সরে যায় জল, কেবলই খসে যায় ফল— কবিতার শেষে এই না পাওয়ার রংটুকু বড্ড রঙিন হয়ে লেগে থাকে। না পাওয়ার রংটুকুকে চেনায় শুধুই কিছু কথা।
ধন্যবাদ ঋত প্রকাশন-কে, বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে এমন এক বইকে উপহার হিসেবে তুলে দেওয়ার জন্য।
ধন্যবাদ মৃণাল শীল-কে, এমন সুন্দর প্রচ্ছদের জন্য।
ধন্যবাদ সন্দীপন চক্রবর্তী-কে, এমন বাঙালি কবির সাথে আমাদের আলাপ করানোর জন্য।
লেখাটি যদি ভালো লাগে, আবহমানে নিজের ইচ্ছেমতো ফোন পের মাধ্যমে
অবদান রাখতে পারেন, এই কিউ আর কোড স্ক্যান করে। ফোন পে করুন 9051781537
অথবা স্ক্যান করুন পেমেন্টের লিংক