
রিমঝিম আহমেদ-এর কবিতা
আড়াল
তোমাকে লুকোচ্ছি প্রাণপণ– আমার ভেতরে
যেন কেউ না দেখে, আলোয় কিংবা অন্ধকারে
তোমাকে লুকোচ্ছি– যেন-বা পাশের বাড়ি থেকে
চুরি করে আনা পাখি। বুকে ডানার দাপট রেখে
উড়ে যেতে পার! খেতে দিই আলোর জোনাকি
তুমি চুরি করা প্রিয় বই– নেড়েচেড়ে দেখি
পড়ি, চুপ করি– বশীভূত নৈঃশব্দ্য আভায়
লুকোই তোমাকে, শরীরের শিরায় শাখায়
গূঢ় অন্তঃপুরে যেন নামল চকিত খড়খড়ি
যেন মিথ্যে ভয়, আদিরক্ত লুকোচ্ছে কিশোরী
প্রত্যাশা
চেয়েছি রাতের চেয়ে গাঢ় কোনো অন্ধকার
যেখানে নিজেকে ছোট ছোট ভাঁজ করে রাখা যায়!
পায়ের তলায় থাকা মাটি ধীরে সরে গেলে
কার কাছে যাই? তুমি কিংবা আমি! গাছেরাও?
যে পাখিটা উড়ে যাচ্ছে, তার ছায়া কেউ চায়?
যেভাবে তোমাকে চাই আমি, কথা না-বলেও
কথার আলস্য ঝেড়ে আরও চুপ– জেগে থাকে চোখ?
ছায়ারও কি থাকতে পারে পৃথিবীতে ফেরার আকাঙ্ক্ষা?
উপস্থিতি
কিছুই কি ফেলে যাই সম্পর্কের খড়কুটো যত
পিঠে নখের আঁচড়, অপাঙ্ক্তেয় রোদপোড়া দাগ
কতটুকু কথা, শ্বাস, না-কথা ও বিষের আভাস
না-রাখাও রেখে দিই, আরও বেশি নিবিড়, অক্ষত
তুমিময় সূর্য ওঠে, তুমি-লাগা রাতের গলন
এর বেশি থাকা নেই, রাখা নেই যত্নের অধিক
আজানের ভেজা সুর আরও গাঢ়, আকুল বিষাদে
বাকলে ছড়িয়ে দেয় পাতাক্রান্ত বাতাসের মন
সকলের গান আছে, একান্তের নিজস্ব আধাঁর
আছে কত ভেসে যাওয়া, দূরে গিয়ে ফিরে আসা যত
না-ফেরাও থেকে যায় জলপড়া খাতার পৃষ্ঠায়
অস্পষ্ট দাগের মতো, অনুমিত ছবির আকার
শরীর সন্ধ্যা
চেয়ে আছে থির দূরে কোন ভাঙা বাড়ি
ধুলো ধুলো আলো চেরাগ জ্বলছে নীল
ঘাড় বেয়ে নামে কুহু নিশ্বাস ভারী
সন্ধ্যা পুড়ছে তোমার গলার স্বরে
আগুন আগুন ফুল ফুটে আছে বনে
ইশারা বিছিয়ে ডাকছে খেলার রং
আজান কাঁপছে হাওয়ার সন্তরণে
পাথরে জলের সম্মুখ শিহরন
জ্বর লেগে আছে বিরহবোধের মতো!
গান ভিজে যায় তামাটে অন্ধকারে
গমখেতে জমে দুপুরপোড়ার ক্ষত
কোমলতা ঢাকা আশক্ত আবরণে
আধভেজা শাড়ি উঠোনে ছড়ানো তারে
খুলে দেয় কেউ গামছায় বাঁধা চুল
গোপনে পুড়ছি তোমার অহংকারে
নিচে ঝরে পড়ে গুঁড়ো গুঁড়ো সংসার
পরমান্ন
তোমাকে কি অন্ধকার বলে ডাকা যায়, আ-রাত্রির–গাঢ়স্বরে?
নিজেকে যেখানে দেখি অন্তর্ভেদী আদিম বিস্ময়ে
প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে সমস্তই জলের প্রহারে
নির্দয় আগুন রাখে মৃত্যুঘ্রাণ, উনুনের জিহ্বা– সতেজ আনাজে
বিরুদ্ধ ডানার দিকে যে কখনো দেয়নি উড়াল
হাড়ের মজ্জায় তার বিষ-বাঁশি নিরন্তর বাজে
শুধু কি প্রণয় ছিল, তুমুল তর্কের শেষে হয়েছে বিবাদও
ডানা মুড়ে রাখা আলো, স্বেদজল– বাহুলগ্না চাঁদ
মানুষের অশ্রু দিয়ে তুমি আজও পরমান্ন রাঁধো
আশ্রয়
সন্ধ্যাকে ঝাড়ু দিই, পর্ণমোচী বিষাদ ঝরে পড়ে। পত্রমুদ্রা থেকে ধুলোর অক্ষর কুড়িয়ে সাজাই অলীক আকৃতি, নাম রাখি– নিশ্বাস। আমাদের সকলেরই মাঝে মাঝে যেতে হয় গোপন হাওয়ার কাছে। জানালা খুলে দিতে হয় শব্দহীন। তুমি কি হাওয়া, নাকি জানালা?এই ভেবে জল তুলি, উনুনে চড়াই চাল। ফেন উথলে পড়ে…
ঘরকোপ থেকে ছেনে আনি ঠাট্টা, গায়ে মাখি। হাসির দানায় জমে তিলবিন্দু ঘাম। ছাইমাখা হাতে ঢেকে রাখছি গোপন মেহেদির রং। তোমার করতল ভরা আশ্বিনের রোদ মধ্যবয়সী রমণীদের মুখে গলে পড়ছে। গ্রীবার অহম উড়ছে ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে, বাঁকানো সাপের ভঙ্গিতে।
আমিও কি সে-ই কুণ্ডলীতে জড়িয়ে পড়ছি অবলীলায় আত্মমৃত্যুর ধ্যানে!

