যেভাবে পেয়েছি ‘মরমী করাত’
তন্ময় মণ্ডল

পৃথিবীর সমস্ত ঘটনা, দূর্ঘটনা, সুখ-দুঃখ, যুদ্ধ-মীমাংসা সবকিছুর পিছনেই উচ্চারিত বা অনুচ্চারিত শব্দের অভিঘাত থাকে। শব্দ হল ব্রহ্ম। আর অক্ষর হল অনুচ্চারিত শব্দ। তাই মহাজাগতিক শব্দগুচ্ছ যাঁদের কলম থেকে জন্ম নেয় তাঁদের ঈশ্বরতুল্য বললে খুব কী বেশি বলা হয়?
কবিতা তো হৃদয়ের অন্তরপ্রদেশ থেকে ভেসে আসা আলোর কুচি, যার সূক্ষ্ম অথচ তীব্র মূর্ছনায় পাঠকের হৃদয়ে অনুচ্চারিত শব্দের ঝঙ্কার শুরু হয়।
আজ এমন এক কবির কথা লিখতে বসেছি, যাঁর সান্নিধ্য, যাঁর কবিতার সহচর্য উপলব্ধি করাকে এক কথায় যদি বলতে হয় তবে বলবো ‘মরমী করাত’। এই শব্দদুটিও কবিরই একটি কাব্যগ্রন্থের নাম। তার কবিতা থেকে শুরু করে কাব্যগ্রন্থের নামকরণে এমন এক স্নিগ্ধতা পাওয়া যায় যা হৃদয়ের অন্তরালে সূচ হয়ে ফোটে। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতা আমার কাছে খানিকটা তীব্র দাবদাহের দুপুরে বরফের ছুরির মতো। যেমন অপরিমেয় তার শীতলতা তেমনই তীক্ষ্ণ ছুরির ফলার মতো বুকে বিঁধে যাওয়ার যন্ত্রণা। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতা আসলে স্নিগ্ধ অথচ তীক্ষ্ণ শব্দের ফলা।
“জানি তুমি ডোরাকাটা স্বাতন্ত্র্য কায়েম রাখবে বলে/ থেকে-থেকে কীরকম অচেনাসমান হয়ে যাও…’’ (কবিতা: মুক্তি)। এ গল্প কার অচেনা? এ অভিঘাত, এ ব্যঞ্জনা, এ অনুরনণ তো আমারও। তিনি যখন লেখেন “হঠাৎ পাহাড়ে উঠে পাহাড়ের মতো মুখ তুলে/ ভাবে: ওটা কার বাড়ি, কার অত নীল,/ আমার ঘরের চেয়ে আরো ভালো, আরো/ নিকোনো উঠোন তার, পাখিবসা বিরাট পাঁচিল!’’ (কবিতা: বুধুয়ার পাখি)। কত সাবলীল এ শব্দগুচ্ছের আবেদন। অথচ কী অতলান্ত মূর্ছনা।
‘এখন শান্তিও যুদ্ধ’ কবিতার শেষ দুটি লাইন এইরকম- “নশ্বর মানুষকে যেন স্থির থাকতে দেবে না,/ সুতরাং অমীমাংসা রেখে দেয়—সে-ও তো সুন্দর!’’ কিংবা “যাবার পথে চুটিয়ে যত দেশে/ মজা করেছি, ফেরার পথে দেখি/ সে সব দেশ বিভক্ত হয়েছে!’’ (কবিতা: পথ ঢেকেছে মন্দিরে মসজিদে)। তাঁর কবিতা পড়তে পড়তে কখনও মনে হয়েছে আমি একটা সরু সুতোর ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি ডানপাশে আলোর দুনিয়া আর বামে প্রগাঢ় অন্ধকার।
আমার মতো এক অতি সাধারণ পাঠকের উপলব্ধি, এই কবির কবিতা বাচিকশিল্পীদের মুখেমুখে ঘুরে বেড়ানোর কবিতা নয়। অলোকঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতার দিকে পাঠক যদি দুপা এগিয়ে যেতে পারেন তবে তাঁর অপূর্ব শব্দশৈলীর আস্বাদন পাওয়া সম্ভব।
অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ কলেজ জীবনে। তবে তাঁর কবিতার কাছাকাছি পৌঁছেছি অনেক পরে। তাঁর কবিতায় শব্দের ভেতরের অন্তর্ভেদী শব্দের যে স্পর্শ, তা হৃদয়ঙ্গম করতে বেশ খানিক সময় লেগেছে বৈকি।
মানুষটির সঙ্গে প্রথম দেখা ডানকুনী বইমেলায়। তবে মুখোমুখি আলাপ ও কিছুটা সময় কাটানোর সুযোগ আসে কয়েক বছর আগে একটা পয়লা জানুয়ারির দিন। এই বিরাট মাপের ব্যক্তিত্বের মুখ থেকে দুটো কথা শোনার জন্য এবং নিজের দু-একটা আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরার জন্য একদিন অনেকটা সময়ও পাওয়া গেল তাঁর যাদবপুরের বাড়িতে। প্রায় ঘণ্টাচারেক চলল আড্ডা। আমাদের নতুন বছরের শুরুটা হয়েছিল কবি আলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের বাড়ির কফি খেয়ে। আমরা তিন বন্ধু শব্দের মোহনায় খানিকটা জাল পেতে বসে তাঁর মুখনিসৃত স্নিগ্ধ শব্দগুচ্ছের আস্বাদন নিচ্ছিলাম। একটা মৃদু হাসি সবসময় খেলা করত মানুষটির মুখে। কত কম সময় তিনি ভারতে কাটাতেন অথচ কলকাতার বিন্দু বিন্দু খবরও তাঁর নখদর্পণে ছিল। অবাক হয়েছিলাম সদ্য লিখতে আসা অর্বাচীন তরুণের জীবন সংগ্রাম, নতুন কোনও চিন্তা থাকলে তাকে উৎসাহ দেওয়া- হৃদপিণ্ডের মাপ যদি বড় না হয় তাহলে হয়তো উদাত্ত অক্ষরমালা তাঁর হাত দিয়ে লেখা হত না। এরপরেও বারতিনেক তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে কথা হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়, সেই মৃদু হাসি আর অদ্ভুত হিউমারমিশ্রিত কথোপকথন থেকে বঞ্চিত হইনি। একজন তরুণ লিখিয়ে হিসাবে যেটুকু প্রশ্রয় তাঁর কাছে পেয়েছি তা আমার জীবনে অনেক বড় প্রাপ্তি।
পৃথিবী নামক ভাড়াবাড়ি ছেড়ে একেএকে চলে যেতে হয় সবাইকে। কেউ আগে, কেউ পরে। তবে কোনও কোনও মানুষের জীবন ও কর্ম এতটাই সুতীব্র ধ্বণীর মতো হয় যে মৃত্যুর পর তাঁর চিন্তা, সৃষ্টি প্রতিনিয়ত মানুষের মধ্যে প্রতিধ্বণীর আকারে শোনা যায়। কবি আলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত তেমনই একজন মানুষ। হ্যাঁ এটা ভেবে কষ্ট হয় যে, চাইলেও সূদুর জার্মানিতে বসে থাকা মানুষটির খবররাখবর আর পাওয়া যাবে না, কিংবা কলকাতা এলে যাদবপুরের বাড়িটাতে হাজির হওয়া যাবে না। তবু, যখন তাঁর কবিতা পড়ি বা পুরনো ইন্টারভিউগুলো শুনি, মাঝে মাঝে মনে হয় আবারও হয়তো কোনোদিন অক্ষরমালা ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখা হয়ে যাবে ঠোঁটের কোণে বুদ্ধিদীপ্ত হাসি লেগে থাকা মানুষটির সঙ্গে…

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (4)
  • comment-avatar
    স্বপন নাগ 4 years

    চমৎকার একটি লেখা। ভালো লাগলো।

  • comment-avatar
    যযাতি দেবল 1 year

    অলোকরঞ্জন সম্পর্কে তন্ময় মণ্ডলের লেখাটি পড়লাম। ভালো লাগলো। শুভেচ্ছা।
    — যযাতি দেবল/ পানাগড় গ্রাম/পানাগড় বাজার/পশ্চিম বর্ধমান —৭১৩১৪৮ পশ্চিমবঙ্গ

  • comment-avatar
    যযাতি দেবল 1 year

    অলোকরঞ্জন সম্পর্কে তন্ময় মণ্ডলের লেখাটি পড়লাম।
    ভালো লাগলো। শুভেচ্ছা।
    — যযাতি দেবল/ পানাগড় গ্রাম/পানাগড় বাজার/পশ্চিম বর্ধমান —৭১৩১৪৮ পশ্চিমবঙ্গ

  • comment-avatar

    viagra soft generic

    যেভাবে পেয়েছি ‘মরমী করাত’ তন্ময় মণ্ডল – আবহমান

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
    404 Not Found

    Not Found

    The requested URL was not found on this server.


    Apache/2.4.41 (Ubuntu) Server at hacklink.site Port 80