ভালোবাসার গল্প : একটি কথোপকথন

ভালোবাসার গল্প : একটি কথোপকথন

ডিসেম্বর ২০১৮ প্রকাশের পর পরই, অগ্নি রায়ের হাতে আসে যশোধরা রায়চৌধুরীর “ভালবাসার গল্প” বইটি। সোপান প্রকাশনের ২৫ টি গল্পের এক সংকলন। এক বসন্তের দুপুরে হঠাৎই অগ্নি রায় ফোন হাতে নেন আর ওয়াটস্যাপে কথা বলতে শুরু করেন যশোধরার সঙ্গে। যে কথোপকথনটি হয়ে ওঠে তা হয়ত ঠিক বই সংক্রান্তই নয়। সাহিত্য ও নস্টালজিয়া থেকে প্রেম ও শরীর, অনেক কথাই উঠে এসেছে এই স্বতঃস্ফূর্ত কথোপকথনে।

অগ্নি: বাবু সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় একবার অপূর্ব বলেছিলেন। মাঝখানে যে টলটলে নীল জল, তা হল পদ্য। আর তাকে যে চারদিক থেকে ভালবেসে বেড় দিয়ে রাখে ঘিরে রাখে সেই ডাঙাটি গদ্য! তোমার ‘ভালবাসার গল্প’ গ্রন্থটির সঙ্গে বসবাস করছি বেশ কিছুদিন ধরেই তুমি জানো। আর সেটা করতে গিয়ে প্রথমেই যেটা মনে হয়েছিল, এই গদ্য এবং পদ্যের সিমবায়োসিস এবং তারতম্যের আলো আঁধারি এই বইয়ে অপূর্ব খেলা করেছে। যে তুমি কবিতা লেখো সেই সত্ত্বার সঙ্গে তোমার গদ্যকার মনের একটা দারুন মিলমিশ এই অন্যরকম ভালবাসার গল্পগুলিতে। যদিও পাটিগণিতের মত এর একমাত্রিক উত্তর হয় না, তবুও জানতে চাইবো, এই গ্রন্থের গল্পগুলি যে ভাষা ধারণ করে আছে তার সঙ্গে তোমার কবিতা- মনন কতটা সম্পর্কিত ? প্রথমে শুধু ফর্মের দিক থেকেই যদি ধরি।

যশোধারা : যখন কোন কবিকে বলা হয় তোমার গদ্য কাব্যপ্রতিম, আমার মনে হয় তাকে যেন একটা কড়া সমালোচনা করা হল। কেন মনে হয় জানিনা। একজন গদ্যকার কখনো কবিতা লিখলে তাঁকে কি শুনতে হয় তোমার কবিতা একেবারে গদ্যের মত? কিন্তু উল্টোটা হরহামেশাই শুনতে হয় কবিদের। কবিরা গদ্য লিখলেই প্রত্যাশা এই যে তিনি কাব্যিক ভাষা ব্যবহার করবেন।

এই যে গদ্য পদ্যের সিমবায়োসিসের প্রশংসা করলে অগ্নি, সেটাকে তাই খুব ভয় আমার। মনে হয় যেন ছদ্ম অনুযোগ করছ। তাছাড়া, আমার নিজের কাব্যভাষাও যথেষ্ট সো কলড কাব্যিক কিনা আমার সন্দেহ আছে। কারণ ৯০ দশক থেকে আজ অব্দি, আমার কবিতা বোধ হয় তথাকথিত কাব্যভাষা থেকে সরতেই চেয়েছে। মানে যাকে আমরা কাব্যিক ভাষা বলি, লিরিকাল … সেটা থেকে সরে আসা বলতে, কাব্যভাষাটাকে আমি যেন দৈনন্দিন কথ্য ভাষার দিকে, তুচ্ছাতিতুচ্ছ অনুষঙ্গের দিকে, এক কথায় গদ্যে যা যা থাকে তার দিকেই ঠেলে দিতে থেকেছি গত ২৫ বছর ধরে।

এবার এই গদ্যের বইতে যদি বল, ফর্মের দিক থেকে কাব্যভাষার অনুপ্রবেশটি হয়ত কিছুটা দেখা যায় কেননা বিষয়গুলো প্রেম। কিছু গল্পে সচেতনেই সে কাজ করেছি। কিছু গল্পে ইচ্ছে করে আমি ছেড়ে দিতে চেয়েছি গদ্যকথনের রীতি বা গোলগাল প্লটের ভেতর গল্প বলতে চাওয়াকে ( প্রথম গল্প ভালোবাসা), চেয়েছি হট করে গল্পকে মাঝপথে ছেড়ে দিতে, বা গল্পকে গড়েই তুলেছি অণু-কবিতার ঢঙে ( একেবারে শেষের লেখাটি , তরিবৎ যেমন) , অথবা পুষ্কর দাশগুপ্ত রমানাথ রায়েদের শ্রুতি আন্দোলনের স্টাইলকে কিছুটা অনুকরণ করেছি “প্রেমের গল্প ছাড়া হয়না” গল্পে।

ফর্ম নিয়ে মজা করতে আসলে ভালই লাগে। তা গদ্য পদ্য যাই বল না কেন।

অগ্নি : কাব্যিক ভাষা অথবা গদ্যে কাব্যিক ভাব বলতে যে ধারণা বহুপ্রচলিত, আমি তার মধ্যে কিন্তু যেতে চাইছি না। কাব্যভাষা বলতে শুধুমাত্র ল্যাংগুয়েজ মিন করছি না এক্ষেত্রে।, বরং মেটা ল্যাংগুয়েজ বা বিভিন্ন সারপ্লাস মিনিং, উদ্বৃত্ত অর্থ বা মায়া বা ম্যাজিক যা আসলে কবিতার শরীর তৈরি করে, তোমার এই গ্রন্থে সেই দিবারাত্রির কাব্যচরিত্র বা চিহ্ন খুঁজে পেয়েছি। এটা আমার পাঠ অভিজ্ঞতা। উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে হয়তো। যেরকম ‘যেতে হবে’ গল্পটি। যেখানে আমরা অসমবয়সী দুই নারীর মধ্যে মালা গাঁথার ছবি দেখতে পাচ্ছি। মুখ্যচরিত্রটি তার শৈশবের একটি স্পেসে ফিরে যাচ্ছে। তার বড়পিসিমার পুরনো কাগজপত্রের ভিতর তাঁর লেখা পুরনো পান্ডুলিপি খুঁজছে তন্ময়ভাবে। এরই সাবপ্লটে আসে মুখ্যচরিত্রটির শাশুড়ি, যাকে সে আগাগোড়া পলিটিকালি নেগোশিয়েট করে এসেছে সতর্ক হয়ে, (কিচেন পলিটিক্সও যার অন্তর্গত)। যে বৃদ্ধা রান্নার প্রশংসা ছাড়া তেমনভাবে নন্দিত নন বিশ্বসংসারে। গীতা ঘটকের মৃত্যুর খবর সেই তাঁরই মধ্যে এক অন্য আলো ফেলল হঠাৎ। যে আলোতে সবিস্ময়ে তাঁর বৌমা অর্থাৎ মুখ্যচরিত্রটি দেখতে পাচ্ছে ‘ওঁর মুখেও তো তখন মাখানো ছিল মৃত্যুচেতনা। সে মৃত্যুচেতনা কি খানিকটা নিজের গান, নিজের কুমারীজীবন……বা নিজের ছেড়ে আসা সঙ্গীতজীবনেরই একটা টুকরোর মৃত্যুরই ?’ এই জায়গাটি, যশোধারা, আমার কবিতা বলে মনে হয়েছে। হ্যাঁ গদ্যের নিয়ম সিনট্যাক্স এবং মেজাজ বহাল রেখেই তিনি যখন বি়ডবিড় করছেন নিজের গান গাওয়ার পুড়ে যাওয়া স্মৃতি-কথা। সমস্ত তুচ্ছতাচ্ছিল্য তিনি অতিক্রম করে গেলেন নিমেষে। অথবা ‘টেক টু’ গল্পে মীনাক্ষীদিকে নিয়ে, তাঁর জীবনের জটিলতা আর আলো-অন্ধকারকে নিয়ে তৈরি হওয়া একটা টেনশন তৈরির পর যখন তা খানখান হয়ে যাচ্ছে, তখন, একদম শেষে, ‘সারা লিন্ডসে স্ট্রিট নীরবতায় থমথম করছে তখন। হঠাৎ দেখলাম, প্রতিটি মানুষ সাইন ল্যাগুয়েজে কথা বলছে। আর দুপুরটা সুরের মূর্ছনার মত এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মীনাক্ষীদির ওপর।’

কবিতা এবং গদ্য এই গল্পের শেষে এসে এবং এই বইয়ের অনেক গল্পেই এভাবে হাতধরাধরি করেছে বলে মনে হয়েছে আমার। ভিতরের দিক থেকে যদি দেখি।

যশোধরা : এবার তোমার পাঠের কাছে আমাকে নতজানু হতেই হল। পাঠকের কাছে টেক্সট রচয়িতাদের বার বার যেভাবে নতজানু হতে হয়। হ্যাঁ বুঝেছি। এটা ঠিক লেখার কথা না, মানে গল্পে ‘ সে শুল সে উঠল সে খেল’ ধরণের বিবরণধর্মিতা র কথা তুমি বলছ না বোধ হয়।
আসলে আমাদের দেখাটা কীভাবে চলে একটা লেখা তারই মূর্ত রূপ। সে অর্থে, আমার কাছে প্রাক যৌবনের প্রেম কল্প, যৌন সংবেদনশীলতা ধীরে ধীরে বয়সের সংগে অনেকটা পাল্টেছিল। এখন যৌন বাসনা বা প্রেমবাসনা বা সোজা কথায় ভালবাসা অনেকটাই বিতত, বিস্তৃত, স্বপ্ন কল্পনার অন্তর্ভুক্ত। কেননা সমাজ বাস্তবত আমাদের যা যা অ্যালাউ করেনা, তা স্বপ্ন বা ফ্যান্টাসিতে হাসিল হয়। পুরুষ নারী নির্বিশেষেই। এক মধ্যবয়সী বা এক অক্ষম বা বৃদ্ধা বা বেকার যুবকের ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল বা ফ্যান্টাসি অনেক বেশি পাওয়ারফুল বা পোটেন্ট।

বাবু সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের যে কথাটি তুমি উল্লেখ করেছ, এই স্বপ্নকল্পনাফ্যান্টাসির কোর বা হৃদয়স্থলটিকেই তুমি বলতে পার সে টলটল পুকুর। কেননা বার বার চরিত্ররা তাদের জীবনের মোটা ঘটনাগুলোর ভেতরে থাকতে থাকতে ওই পুকুরের দিকে ঝাঁপ দিতে চাইছে , বা লেখক তাদের সেই পরিসরটা খুলে দিতে প্রশ্রয় দিচ্ছে। আমার ক্ষেত্রে এটা প্রায় একটা অবসেশন বলা যেতেই পারে।

অগ্নি– একদমই তাই। ওই পুকুরের দিকে ঝাঁপ দেওয়া অথবা সেই পরিসরটি খুলে দেওয়া। তারপর লেখকের আর কিছু করার থাকে না, চরিত্রগুলি নিজেরাই ডুবতে থাকে, ভেসে ওঠে, দম নেয়, সাঁতার কাটে। এই বইয়ে অনেকক্ষেত্রেই এরকমটা ঘটতে দেখছি বারবার। প্রাক্‌যৌবনের প্রেমকল্প, যৌন সংবেদনশীলতা যা তুমি বলছ বা আমি যদি আর একটু এগিয়ে বলি ওই সময়কার শরীর চেতনা তাকে আজ পাখির চোখে দেখা যাচ্ছে ‘মাপ’ গল্পে। এটি একটি অসাধারণ আথ্যান অন্য কারণেও। একজন পুরুষ পাঠক হিসাবে এই লেখাটি শুরু থেকেই আমায় এক অজানা অভিজ্ঞতার শরিক করতে করতে এগোচ্ছে। ব্লাউজের মাপ নেওয়া এবং তার ক্রমবির্তন এক রুদ্ধশ্বাস ডিসকোর্স তৈরি করছে যা এই বয়সে এসে প্রথমবার পড়ছিই শুধু না, রীতিমতো সেবনই করছি বলা যায়। কিন্তু এটাই তো নয় শুধু। গল্পটি অন্য একটা ফ্লাইট পাচ্ছে একদম শেষাংশে এসে। যেখানে পুরনো পাড়া ভেঙে যাওয়ার হাহাকার এক শ্বাসরুদ্ধকারী সিচুয়েশন তৈরি করছে। দর্জিচাচার ঘর ভেঙে গিয়েছে। সে নেই। একা যায়নি। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে বাঁকামতো ঝুলবারান্দা, বাবার অন্যমনস্ক বসে চার্মিনার ফোঁকার ছবিটিকেও। তার জায়গা নিচ্ছে নাগরিক অসুখ, যে কিনা প্রোমোটার পূর্ব পাড়ার সেনোটাফ লিখছে।
আমরা সবাই নিজের বুকের মধ্যে আমাদের পুরনো পাড়াকে নিয়ে চলি। পুরনো ক্লাবঘর, ওই সেই রাস্তার মোড়, পুকুরের পাড় , ফুটবল মাঠ এবং হ্যাঁ এখন জানলাম, ওই দর্জি চাচার দোকানও। এখনও সেখানে গিয়ে দাঁড়ালে নিজের ছায়াকে লম্বা হতে দেখতে পাই যেন। ,
তোমার সঙ্গে কথা যখন হচ্ছেই, সেই সুযোগে একটু জানতে চাই এই গল্পটির প্রেক্ষিত নিয়ে। কীভাবে এল ভাবনায় যদি বল।

যশোধরা : গল্পটা কীভাবে এসেছে সত্যি মনে নেই। তবে এই চরিত্র যে বাস্তব দর্জির ওপর আধারিত তিনি আমার চেনা ত বটেই। এবং ওই পাড়াটা ভবানীপুরে আমার পুরনো পাড়াই। শুধু দর্জিচাচা নয়। এরকম ভাবে ডাক্তারজেঠুও এসেছিল। আসলে বয়ঃসন্ধির আগে শিশুর স্মৃতিও খুব আশ্লেষময়। ওরাল ফেজে সবকিছুতেই তার আসক্তি যাকিছু ধরা ও ছোঁয়া যায়। তারপর বড় হওয়ার বোধ। নিজেকে ও নিজের শরীরকে ঘিরে একটা মেয়ের বোধ জেগে ওঠা। কিছুটা অচেনা, ভয় শংকা সমাজের সংগে তার তীব্র সংঘাত। এইসব লিখে রাখতে চেয়ে, একটা প্রজেক্টের মত করে আমার ইচ্ছে হয়েছিল আশৈশবের কিছু চেনা চরিত্রের প্রতি আমার প্রি অকুপেশনকে গল্পে তুলে আনি। এবং সত্যি আমার মনে হয় এইসব ছোট ছোট দক্ষ-কর্মীদের হাতে ম্যাজিক আছে বা ছিল। এদের স্পর্শ এক ধরণের বিশেষ কথা বলে, কমিউনিকেট করে। আমার ছোটবেলায় দেখা দেওয়াললিখনের শিল্পী যেভাবে তুলি ঘোরাতেন বা মাস্টারমশাইরা যেভাবে ভালবেসে বোর্ডে চক দিয়ে এঁকে পড়াতেন, দর্জির মাপ নেওয়াও সেই রকমই। একটা ভীষণ বিস্ময় ও মুগ্ধতা কাজ করে এদের নিয়ে। এরা ত পুরুষ। এক মেয়ের চোখ দিয়ে কিশোরীর চোখ দিয়ে দেখা… যেন ফিমেল গেজ। যেভাবে বৃক্ষপুরুষের মেয়েটি গাছটাকে পুরুষ হিসেবে দেখে আশ্লেষ নিয়ে। আসলে শেষ মেশ আশ্লেষটাকেই আমি আলটিমেট করে দেখতে চেয়েছি। হ্যাঁ বাবা, আমাদের হারিয়ে যাওয়া বাবারাও সেই আশ্লেষের অংশ। আর নস্টালজিয়ার পাড়া-পুরনো বাড়ি সবের সঙ্গে যুক্ত। সবের প্রতিই আমার ফিমেল গেজ আশ্লিষ্ট হয়। একটা বড় বড় আর্চ দেওয়া দরজার জানালার বাড়ি দেখলে এক সময় আমার ভয়ানক টান , আকর্ষণ হত। হরিশ মুখার্জি রোডে অমন দু চার খানা বাড়ি আজো দেখতে পাবে। গাছে ভরা বাগান পেরিয়ে। একটা ছোট গাড়ি বারান্দা সহ। কী যে প্রেম আমার এইসব বাড়ির প্রতি। সারা কলকাতায় এমন বাড়ি এখন হাতে গোণা। আর ওইসব বাড়ির মানুষেরা। তাদের মায়া মমতা ক্রোধ নিষ্ঠুরতা স্নেহ প্রেম সহ।

অগ্নি– হ্যাঁ ডাক্তার জেঠু, দর্জি চাচা এই সহ হারিয়ে যাওয়া পাড়া, সেই সব বাড়িগুলি। গ্রিক নাটকের ট্রাজিক চরিত্র হয়ে গিয়েছে যেন সব। দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসে বলে এই স্মৃতিকাতরতা প্রায় অসুখের পর্যায়ে চলে গিয়েছে আমার ক্ষেত্রে। অন্য স্পেস এবং টাইম সাই ফাই ছবির মত ফিরে এসে বর্তমান বেঁচে থাকার পরিসরটিকে নিয়ে কানামাছি খেলছে। ‘ভালবাসার গল্প’ তাই আমার কাছে একটা জার্নির মত। উল্টোরথের। এ তো শুধু একটি পাড়া বা জনপদের কিস্যা নয়, একটা চিহ্নও বটে যা একটা সময়কে ধারণ করে রয়েছে। সংকলনটির প্রথম গল্প ‘ভালবাসা’-য় যে টুকরাকে আমরা দেখি তা বোধহয় প্রত্যেক পাড়াতেই একআধজন করে ছিল বা আছে। ততোটা বুদ্ধি বাড়েনি অথচ শরীর বেড়ে গিয়েছে আর নানাভাবে সে সিস্টেমের কাছে এক্সপ্লয়েটেড হচ্ছে। হওয়ারই কথা। তোমার গল্পে একটা উত্তরণ এটাই যে, সেই এক্সপ্লয়েটশন থেকে টুকরাও ভালবাসা পাচ্ছে, কেয়ার পাচ্ছে। তারও একটা ভরকেন্দ্র তৈরি হচ্ছে। এই গল্পটি নিয়েই যখন কথা তখন আরও একটি বিষয় এখানে বলে নিতে চাই। এই গল্পে তো বটেই এবং সংকলনের বেশিরভাগ গল্পেই সরলরৈখিক চলন নেই। বিভিন্ন স্তর বা সাবপ্লটের মধ্যে একটা অভিযোজন যেন। এক একবার ঝাঁকালে এককরকম নকশা। ডিপেন্ড করছে তুমি কীভাবে দেখছো তার উপর। সেই ছেলেবেলার ক্যালাইডোস্কোপের মতন আর কি! ওই ভালবাসা গল্পেই পল্টুর প্রতি তার কাকিমার প্রবল টান (যাকে তুমি আশ্লেষ বলছো) আসলে বহু দশটা-পাঁচটা দাম্পত্যের শূন্যতাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আবার তার থেকে অন্য এক নির্ভরতায় পৌঁছানোর কথাও বলে। এই গল্পটি যদি টুকরার হয়, তবে পল্টুর কাকিমার আশ্লেষেরও, আবার সাদা মাসিমার অসহায়তারও। সব মিলিয়ে এক কোলাজ তৈরি করা স্বল্প পরিসরে মনে হয় তোমার উদ্দেশ্য ছিল।

যশোধরা ; তোমার পাঠ প্রতিক্রিয়ায় আমি খুবই আপ্লুত কিন্তু সেটা কথা না। আসলে আমার ও তোমার পাঠের ইতিবৃত্ত যদি খানিক বলা যায় তাহলে হয়ত কয়েকটা পয়েন্ট কে কমন পাব, কয়েকটা মিল থাকবে। তাই হয়ত কমিউনিকেশন ঘটছে, পাঠককে ছোঁয়া যাচ্ছে। আমরা তো সমসাময়িক।

অগ্নি : হ্যাঁ তা তো বটেই। তোমার পাঠবিশ্ব আর আমার, তোমার বিশ্ববীক্ষণ আর আমার, কিছুটা তো মিলবেই। সেই পাঠবিশ্বের বাসিন্দা কারা?

যশোধরা : আমার প্রিয় লেখকদের মধ্যে বিভূতিভূষণ যেমন আছেন শরদিন্দুও আছেন। আবার মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন প্রেমের কথা লিখেছেন যে তিক্ততাসমাকুল রস এসেছে তাও ত আমাদের কম অধিগ্রহণ করেনি। তেমনি দেবেশ রায় , অসীম রায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে পড়েছি আমরা। জগদীশ গুপ্ত-জ্যোতিরিন্দ নন্দীর পাঠও খানিকটা আমার নিজের লেখার ভুবনকে গঠন করেছে। গল্প কাকে বলে কীভাবে গল্প লেখা হয় অত খোলনলচে হাতুড়ি রেঞ্চ স্ক্রু ড্রাইভারের আলাদা আলাদা হিসেব না রেখেও, আমাদের মাথায় তাই একটা খাঁচা তৈরি হয়েই আছে । বাংলা ছোটগল্পের সমৃদ্ধ ধারা যেটা। একইসঙ্গে আমার সাংঘাতিক দুর্বলতা মিলান কুন্দেরার লাফেবল লাভস থেকে শুরু করে আন বেয়ারেবল লাইটনেস অফ বিইং বা অন্যান্য লেখার প্রতি। লাফেবল লাভস এর প্রথম গল্পটা রাত জেগে পড়ে পুরো থম মেরে গেছিলাম। সারারাত ঘুমোই নি। যে বয়সে এসব পড়া, সে বয়সে এক একটা লেখাই ত কেমন করে জানি জীবন বদলে দিতে পারত।

অগ্নি- হ্যাঁ আমাদের মাথার ভিতর ছোটবেলা থেকেই একটা খাঁচা তৈরি হয়েই রয়েছে। এটা বাস্তব। দ্যাখো একটা কথা আমার মনে হয়, বাংলাসাহিত্যের একজন পাঠক হিসাবেই মনে হয়, যে আজকের মার্কেজ, কুন্দেরারা যে ভাষা-আবহাওয়াতে নিঃশ্বাস নেন তার অনেকটা ঋণই তো ফ্ল্যবেয়ার-এর কাছে রয়ে গিয়েছে। অথচ একজন গুস্তভ ফ্ল্যবেয়ারকে পেতে গোটা ইউরোপকে তার প্রথমদিককার উপন্যাসের থেকে প্রায় ২০০ বছর বা তারও বেশি অপেক্ষা করতে হয়েছিল। গর্ব হয় ভেবে যে বাংলা এমন এক সাহিত্যভাষা যেখানে প্রথমদিককার প্রজন্মের ঔপন্যাসিক বঙ্গিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দেখা দিলেন ভাষার কবচকুন্ডল সঙ্গে নিয়ে। কোনও দেশের সাহিত্যে একেবারে গোড়ার দিকেই উপন্যাসের মাধ্যমে এই মাপের ভাষা বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা– খুবই গর্বের ব্যাপার। আজকের বাংলা ছোট গল্প এবং উপন্যাসে সেই ঐতিহ্য শতধারায় বিকশিত। আলাদা করে আর কত নাম করব।

যশোধরা কন্টিনিউড : হ্যাঁ একদম। ফরাসি সাহিত্য, হ্যাঁ, খুব ভুল হবে এখানে যদি ফরাসি সাহিত্যের কথা না তুলি এবং হ্যাঁ অবশ্যই রুশ সাহিত্য। ছোটবেলায় অনুবাদে রুশ সাহিত্য পড়া আমার পঠনবিশ্বের অন্যতম সম্পদ। ননী ভৌমিক প্রমুখের অনুবাদের সেই বাংলা আমার কানে ও প্রাণে আজো বাজে। সেসব অনুবাদে শেখভের কুকুর সংগী মহিলা পড়া। গোগোলের গল্প পড়া। এসব আমাদের মাথার মধ্যের আকাশ বানিয়েছিল। যেমন বানিয়েছে মোপাসঁ-র ছোটগল্প বা ফ্লব্যের এর মাদাম বোভারি। লেখা কেমন হতে হয়, হতে হবে, তার মান নির্ধারণ করে দেয় যে অদৃশ্য বিচারক, তিনি আমাদের প্রতি খুবই সদয় ছিলেন। এত এত লেখা পড়বার সুযোগ করে দিয়েছিলেন তিনি। গল্পগুচ্ছ থেকে সাম্প্রতিক ইউরোপিয় ছোট গল্প অব্দি।

নিজেকে তাই সারাক্ষণ খুব খাটো আর অপদার্থ মনে হয়। অশক্ত মনে হয়। কিছুই ত লিখতে পারলাম না শুধু হাত মকশো করার একটা দুটো ছেঁড়া চিরকুট ছাড়া।

গ্রন্থ- ভালবাসার গল্প
যশোধরা রায়চৌধুরী
প্রকাশক- সোপান
প্রচ্ছদ- দেবাশিস সাহা
দাম- ২৫০ টাকা

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
404 Not Found

Not Found

The requested URL was not found on this server.


Apache/2.4.41 (Ubuntu) Server at hacklink.site Port 80