
বেবী সাউয়ের কবিতা
এই দেশে যুদ্ধ নেই
১.
ধীরে ধীরে আমরা মায়াকাননের মৃগ হইয়া উঠিতেছি। আমাদের দেহ এবং মনে হরেকরকমের চিত্র প্রদর্শিত হইতেছি। চারিপাশে বিভিন্ন আকৃতির পুষ্প এবং তাহার রেণু আমাদিগকে সর্বতোভাবে হরিণের বেশ ধরিতে সাহায্য করিতেছে। নিটোল, নিখুঁত এই মায়াকানন ক্রমশ বসন্তমণ্ডিত হইয়া উঠিল। কুহু ডাকিল। পুষ্পরেণু গন্ধে, বর্ণে চারিপাশ ব্যাপিয়া আমোদের সৃষ্টি করিল। এবং পৃথিবী ক্রমশ অপ্রকাশিত হইতে লাগিল।
এই বসন্তকাল, অদৃশ্য পৃথিবী, তাহার উপর আমরা এই দুইজন হরিণ- হরিণী,
ধীরে ধীরে মায়াকাননে প্রবেশ করিলাম…
মায়াময় এই জগৎ, কায়াময় এই জগৎ জল-বাতাসায় পরিপূর্ণ হইতে লাগিল…
২.
হরিণ চতুর অধিক, হরিণী ততটা নহে। হরিণী আবেগপ্রবণ, হরিণ নহে! হরিণ কায়াপ্রবণ, হরিণী মায়াময়। দুইজনে মিলিয়া একটি স্বপ্নালোকের রচনা আরম্ভ করিল। দেখিতে দেখিতে দৃশ্যময় হইলো এই মায়া-কায়া। রাত্রি ভেদ করিয়া কলধ্বনি উজ্জ্বল হইলো। এবং পৃথিবীতে প্রবিষ্ট হইল যেমন প্রেম ভালোবাসা, তেমনি বিরহও।
কায়াপ্রবণ এই দুনিয়া হরিণীর প্রতি মোহ হারাইয়া ফেলিল…
৩.
আনন্দ আর বিরহের ভেতর হাঁটিতে হাঁটিতে কয়েকটি বসন্ত হারাইয়া গেল! চলিয়া গেল বেশ কিছু কাল, সময়, মাহ! হরিণ হরিণীর প্রতি আরও গভীরতা অনুভব করিল। তাহারা পথ শিখিল, ভূমি শিখিল, শিখিল মনুষ্য, সমাজ এবং গান। এবং শিখিল গান! তাহারা শিখিল গান এবং কবিতা। এবং ধীরে ধীরে নিজেদিগের নিমিত্ত নিজেরাই আঁকিয়া ফেলিল দুর্ধর্ষ একটি বসুমতী।
যে বসুমতী স্নিগ্ধ, সরল এবং মায়ের মতন চিরমঙ্গলাকাঙখী…
৪.
তখনও তাহারা ভালোবাসে নাই! তখনও তাহারা প্রেম মানে যে শরীর— বোঝে নাই ততটা। তাহারা গান গাহিত, কবিতা লিখিত এবং একে অপরের হাত ধরিয়া হাঁটিয়া যাইত দীর্ঘ একটা মায়াবী পথ। মুগ্ধ হইয়া একে অপরের প্রতি চাহিয়া থাকিত এবং একদিন তাহাদের হস্ত হস্তের স্পর্শে পত্র হইয়া উঠিল। এমন সব পত্রে লেখা হইল চিরসবুজ এক বসন্তের উপাখ্যান…
হরিণ, হরিণী প্রেমে পড়িল…
৫.
মায়াময় এই সংসার, ধীরে ধীরে কায়াময় হইলো। ধীরে ধীরে রূপ, রস, গন্ধ হইলো পুষ্প, ফল, পত্র। স্পর্শ এবং মনোজগতের মেলবন্ধন আশ্চর্য এক আশ্রয়ের সৃষ্টি করিল। একেকটি ঘটনা যেন সুরলোক হইতে ভাসিয়া আসা সরগম। একেকটি দৃশ্য যেন নব অঙ্কুরিত ঘাসের উপর সকালের স্নিগ্ধ রৌদ্র। গান বাজিল, শব্দ বাজিল এবং প্রেম সাজিয়া উঠিল…
হরিণ অনভ্যস্ত ভঙ্গিতে হাঁটু মুড়িয়া বলিল— ” সমস্ত কিছুর সহিত তোমাকেই চাই…”
৬.
কাহার পানে ধাবমান হইবে প্রেম? কাহার প্রতি লিখিবে দীর্ঘ মন? সেও কী জাগিয়া থাকিবে চন্দ্রালোকের পৃথিবীতে! সেও কী হরিণীর মতো ভৈরবী রাগিনী লিখিতে উঠিয়া আসিবে ভোরের গন্ধে! কিংবা গভীর বিষাদের দিনে ডাকিয়া উঠিবে– ” তুই কই?” হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না! হরিণী শুধু চাতক হইলো! হরিণী মায়াময় জগতের অধিক মায়ার কবলে নিপতিত হইল— প্রেমে ডুবিল!
৭.
শব্দ বাজিল, ছন্দ বাজিল… রুণুঝুণু ধ্বনিতে মুগ্ধ হইলো হরিণ! প্রেমের কবিতা লেখা হইলো তিন সহস্র! তাও পরিপূর্ণ হয় নাই যেন! তাও প্রকাশিত হইতেছে নাই প্রেম! আরও শব্দ, আরও ভাষা, আরও আরও আরও গান, ছন্দ চাই তাহার! অবশেষে দিশাহারা হরিণ যখন চোখ রাখিল হরিণীর চোখে, বুঝিল… ” অতল, অতল…”


অপূর্ব! অপূর্ব!
কী অসাধারণ! সেই চিরন্তন প্রেমের উপাখ্যান। অথচ কী নবীন লেখিকার কলমে। চিরসবুজের দেশ!
বাঃ! খুব সুন্দর।